মামুনুর রশীদ
বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর পড়ন্ত শীত-বিকেলে গিয়েছিলাম টাঙ্গাইলের অদূরে বড়বাসালিয়া গ্রামে। দুদিকে সরিষার খেত। মায়াবী হলুদ রং ছড়াচ্ছে, তার সঙ্গে বিকেলের আলো মিলে চমৎকার একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছে।
বন্ধু শাহজাহানের সঙ্গে তার আবাসভূমির দিকে যাচ্ছিলাম বড়বাসালিয়া গ্রামে। এই বড়বাসালিয়া গ্রামের সঙ্গে আমার আশৈশবের পরিচয়। এ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এককালের স্রোতস্বিনী লৌহজং নদী। এই নদী ঢাকা থেকে মির্জাপুর হয়ে অনেক খাল তৈরি করে শেষ পর্যন্ত মিশে গেছে যমুনায়। নদীর ওপারেই কয়েকটি গ্রাম, তার মধ্যে মনে পড়ে একটি গ্রামের নাম ‘বাঁশি’। বাঁশি গ্রামটি ছিল হিন্দুপ্রধান। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে গ্রামটি মেতে উঠত! সারি সারি লিচুগাছ এবং সুপারিবাগান, মনে করিয়ে দিত নজরুলের কবিতা-বাতায়ন পাশে গোবাক তরুর সারি। ওই গ্রামেই ছিল আমার প্রিয় প্রাণনাথ স্যারের বাড়ি। প্রাণনাথ স্যার বিনা মূল্যে ছাত্রদের প্রাইভেট পড়াতেন। বিশেষ করে অঙ্ক। আরেকটু দূরেই এলেঙ্গা, ওই স্কুলেই আমি পড়তাম। এলেঙ্গার পাশ দিয়ে আরেকটি নদী চলে গেছে।
নদীভাঙনে প্রায়ই এলেঙ্গা গ্রাম একটা নতুন চেহারা নিত, ওই গ্রামেই আছে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বাড়ি, তাঁর পিতাও প্রয়াত দেবেশ ভট্টাচার্য বিচারপতি ছিলেন। বিশাল জমিদারবাড়ির প্রাচীন দালানকোঠার সামনেই ছিল একটা বড় পুকুর। শারদীয় পূজা থেকে কালীপূজা পর্যন্ত উৎসবের ধুম লেগে থাকত। নানা ধরনের পালাগান, যাত্রাগানসহ অনেক লোক আঙ্গিকের আয়োজন করা হতো তখন। এখন এলেঙ্গা এক গুরুত্বপূর্ণ ছোট্ট শহর। উত্তরবঙ্গের সব পরিবহনের যাতায়াত ওখান দিয়েই।
অদূরেই যমুনা সেতু। একসময় একটা টং চায়ের দোকানের জায়গায় এখন অসংখ্য রেস্তোরাঁ এবং বিরাট বাজার। বড়বাসালিয়ার সেই আম-লিচু বাগানঘেরা গ্রামটিতে এখন অনেক অট্টালিকা।
তবু এই গ্রামে এখনো কিছুটা সেই আমার বাল্যস্মৃতির অবশেষ আছে। শাহজাহান আমাকে এবং আমার অনুজ শিল্পী রশীদ আমিনকে নিয়ে গেল নদীর ধারে একটা ছোট্ট চায়ের স্টলে। স্টলের পাশেই বিখ্যাত সংশিল্পী গফুরের বাড়ি। গফুর এবং বড়বাসালিয়ার সংশিল্পীদের জীবন নিয়ে আমি একটি নাটক লিখেছিলাম সঙক্রান্তি। আরেকজন শিল্পী ছিল, তার নাম আইয়ূব। দুজনেই এখন প্রয়াত। ওই শিল্পীদের মধ্যে মিয়াচান এখনো বেঁচে আছে। মিয়া চানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সংশিল্পীরা যা করে থাকে—একটি অত্যন্ত কৌতুকপূর্ণ সংবাদ পরিবেশনা। সে আমাদের একটি দীর্ঘ সংলাপ শোনায়। চারদিকে হাসির রোল শুরু হয়ে গেল। চায়ের দোকানের মালিক বাহেস, সে-ও এই শিল্পীদের সঙ্গে যুক্ত। যেখানেই সং হয়, সেখানে গিয়ে সে যোগ দেয়, গান গায়। চা খেতে খেতে সামনের চায়ের দোকানের সামনে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে গফুরের ছেলে লাল চান এসে হাজির হয়। সে এবার ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে দাঁড়িয়েছিল এবং যথারীতি পরাজিত হয়েছে। এবার শুরু হলো চায়ের কাপে ঝড়। বিষয় একটাই—রাজনীতি। সম্প্রতি সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে এলাকায় কে কীভাবে বিজয়ী হলো, কে কত টাকা খরচ করেছে—তার একটা খতিয়ান প্রথমেই জানা গেল। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী যে লোকটি পরাজিত হয়েছে, সে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা খরচ করেছে, আর যে জিতেছে সে কোনো টাকাই খরচ করতে পারেনি। সে সংগতি তাঁর ছিল না। কিন্তু তাঁর ছিল জনসমর্থন। ভোট গণনার একটা পর্যায়ে যখন ব্যালট বাক্সগুলো জেলা সদরে নিতে চাচ্ছিল, তখন গ্রামের, বিশেষ করে নারীরা রুখে দাঁড়াল। অবশেষে ওখানেই ভোট গণনা শুরু হলো এবং গণনায় সঠিক প্রার্থীই বিজয়ী হয়ে গেল। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় জনগণ তা রোধ করতে পারেনি।
নির্বাচনের সূত্র ধরে দ্বিতীয় বিষয়টি এল দুর্নীতি। খাল কাটায় অনিয়ম এবং গম চুরির ঘটনা থেকে নানা বিষয়। মুহূর্তেই বিষয়গুলো এত খোলামেলাভাবে আসতে শুরু করল, যেন আমরা ফিরে গেলাম ষাটের দশকে। যখন এমন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল যে, সব কথা বলা যেত। সেই সময়ে আশাজাগানিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মওলানা ভাসানীর বক্তৃতাও এসব সংশিল্পী অসাধারণ দক্ষতায় উচ্চারণ করত। ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হওয়ার পরও গ্রামবাংলায় একটা মুক্ত পরিবেশ আবিষ্কার করলাম। এমনই ৬৮ হাজার গ্রামের মধ্যে একধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখনো রয়ে গেছে।
প্রবল উত্তেজনা, সহিংসতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও সত্য কথাটি উচ্চারিত হয়ে এসেছে। টি স্টলের সামনে নদীটি একসময় শুকিয়ে গিয়েছিল, নদী খননের জন্য সরকারি টাকাও এসেছিল; কিন্তু চুরির এমন দুর্নীতি ঘটেছিল যে, শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। বিষয়টি গ্রাম পর্যায়ে আলোচিত হতে হতে বাধ্য হয়ে আবার নদী খনন শুরু হয়। এখন এই শীতকালেও নদীতে মোটামুটি পানি থাকে। ওখানেই পরিচয় হলো এক মৎস্যজীবী নিমাই মাঝির সঙ্গে। বেশ বয়স হয়েছে মাঝির। বংশপরম্পরায় তারা মৎস্যজীবী। তার মধ্যেও কয়েক দিন আগে সে এই নদী থেকে সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের একটি বোয়াল মাছ ধরেছে। এতেই মনে হয়, নদীতে নাব্যতা আছে। এ অঞ্চলের বোয়াল মাছ খুবই বিখ্যাত। ছোটবেলায় অবশ্য দেখতাম, এ অঞ্চলে বড় বড় রুই মাছ পাওয়া যেত। আরেকটু উজানে গেলে বড় বড় বাগাড় মাছ ধরা পড়ার পর এলাকায় একটা খবর হয়ে যেত। নদীগুলোতে নাব্যতা থাকলে আজকের দিনে যে পরিমাণে আমাদের বদ্ধ জলাশয়ের মাছ খেতে হয় এবং ডিপটিউবওয়েল দিয়ে হাইব্রিডের চাষ করতে হয়, তা হয়তো করতে হতো না।
নদীকে নিয়ে নদীপারের মানুষের যেমন আনন্দ তেমনি বেদনা ছিল এককালে। কিন্তু নদী শুকিয়ে যাওয়ার পর বেদনাটাও শুকিয়ে গেছে। নদীকে নিয়ে স্বপ্নযাত্রার অবসান হয়েছে। সেই নদীতে এখন পানি, দু-পাড় আবার কিছু কিছু ভাঙতে শুরু করেছে। নদীভাঙন শুরু হলে ওসব এলাকায় লঞ্চ দেখলেই মানুষ ঢিল ছুড়ত। এখন অবশ্য এসব নদীতে লঞ্চ চলাচল বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, প্রায় সব জায়গায়ই চালু হয়েছে ছোটখাটো বা মাঝারি ধরনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা। যদিও এই নৌকাগুলো প্রবল শব্দে চলে, তাই মাঝির কণ্ঠে আর ভাটিয়ালি গান শোনা যায় না। নৌকাগুলো মাঝিকে বা মালিককে অর্থ দিচ্ছে বটে; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে শিল্প।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। আমরা নদীর পাড় থেকে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করি। সেখানে বেশ দোকানপাট, যার মধ্যে লক্ষণীয় বেশ কিছু ওষুধের দোকান। আমার সেই বাল্যকাল এবং কৈশোরের কথা মনে পড়ে, যখন একটিও ওষুধের দোকান ছিল না সেখানে। ছিল না কোনো ডাক্তার। মানুষ অসুস্থ হলে ওই বাঁশি গ্রামের ডিসপেনসারিতে যেত। ছিলেন কালীপদ ডাক্তার, তাঁর পায়ের সমস্যা ছিল। তিনি ঘোড়ায় করে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখে বেড়াতেন। দুই ধরনের মিকশ্চার ছিল—জ্বরজারি হলে এলকালি মিকশ্চার আর পেটের সমস্যা হলে কার্মেনেটি মিকশ্চার। আর পথ্য হিসেবে কিছু পরামর্শ দিতেন কম্পাউন্ডার বাবু এবং তাতেই রোগবালাই সেরে যেত গ্রামবাংলায়। তবে কলেরা-বসন্ত হলে তা এক মহামারির রূপ পেয়ে যেত এবং স্কুল, কলেজে, গ্রামগঞ্জে কলেরার ইনজেকশন ও বসন্তের টিকা দেওয়ার ধুম পড়ে যেত।
বড়বাসালিয়া গ্রামের মতো আরও অনেক গ্রাম ও উপজেলা শহরে শত শত ওষুধের দোকান দেখা যায়। একদিকে বিত্ত বাড়ছে আর অন্যদিকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ আর সেই সঙ্গে বেড়েছে স্বাস্থ্য-বাণিজ্য। টাঙ্গাইল শহরে শতাধিক ক্লিনিক রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। ওষুধ একটা সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়েছে। ছুটির দিনে ঢাকার বিখ্যাত ডাক্তারেরা ছোট ছোট শহরে মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিয়ে ভিড় করেন এবং রাতের বেলায় ব্যাগ বোঝাই টাকা নিয়ে ঢাকায় ফেরেন। বড়বাসালিয়া গ্রামে ওষুধের দোকানের কাটতি দেখে বোঝা যায়, চিকিৎসা এখন আর সেবা নয়, একটা বড় ব্যবসা।
আনন্দ ও কিছুটা বিষণ্নতা নিয়ে শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে বসি। খুবই প্রাকৃতিক পরিবেশ। টিনের ঘরের চালের ওপর শিশির পড়ছে। টুপটুপ করে শিশিরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আর ভাবছি, এই যে একসময় নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে কিছুটা চঞ্চলতা যেমন এসেছে, তেমনি একধরনের বিক্ষোভও দানা বেঁধে উঠেছে। যার পরিণতি হতে পারে বড় ধরনের বিক্ষোভ অথবা বড় ধরনের হতাশা। কারণ, বাংলার শিক্ষার সংস্কৃতির পাশাপাশি অপসংস্কৃতির শিক্ষাও পঙ্গপালের মতো বেড়ে উঠছে।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব
বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর পড়ন্ত শীত-বিকেলে গিয়েছিলাম টাঙ্গাইলের অদূরে বড়বাসালিয়া গ্রামে। দুদিকে সরিষার খেত। মায়াবী হলুদ রং ছড়াচ্ছে, তার সঙ্গে বিকেলের আলো মিলে চমৎকার একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছে।
বন্ধু শাহজাহানের সঙ্গে তার আবাসভূমির দিকে যাচ্ছিলাম বড়বাসালিয়া গ্রামে। এই বড়বাসালিয়া গ্রামের সঙ্গে আমার আশৈশবের পরিচয়। এ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এককালের স্রোতস্বিনী লৌহজং নদী। এই নদী ঢাকা থেকে মির্জাপুর হয়ে অনেক খাল তৈরি করে শেষ পর্যন্ত মিশে গেছে যমুনায়। নদীর ওপারেই কয়েকটি গ্রাম, তার মধ্যে মনে পড়ে একটি গ্রামের নাম ‘বাঁশি’। বাঁশি গ্রামটি ছিল হিন্দুপ্রধান। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে গ্রামটি মেতে উঠত! সারি সারি লিচুগাছ এবং সুপারিবাগান, মনে করিয়ে দিত নজরুলের কবিতা-বাতায়ন পাশে গোবাক তরুর সারি। ওই গ্রামেই ছিল আমার প্রিয় প্রাণনাথ স্যারের বাড়ি। প্রাণনাথ স্যার বিনা মূল্যে ছাত্রদের প্রাইভেট পড়াতেন। বিশেষ করে অঙ্ক। আরেকটু দূরেই এলেঙ্গা, ওই স্কুলেই আমি পড়তাম। এলেঙ্গার পাশ দিয়ে আরেকটি নদী চলে গেছে।
নদীভাঙনে প্রায়ই এলেঙ্গা গ্রাম একটা নতুন চেহারা নিত, ওই গ্রামেই আছে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বাড়ি, তাঁর পিতাও প্রয়াত দেবেশ ভট্টাচার্য বিচারপতি ছিলেন। বিশাল জমিদারবাড়ির প্রাচীন দালানকোঠার সামনেই ছিল একটা বড় পুকুর। শারদীয় পূজা থেকে কালীপূজা পর্যন্ত উৎসবের ধুম লেগে থাকত। নানা ধরনের পালাগান, যাত্রাগানসহ অনেক লোক আঙ্গিকের আয়োজন করা হতো তখন। এখন এলেঙ্গা এক গুরুত্বপূর্ণ ছোট্ট শহর। উত্তরবঙ্গের সব পরিবহনের যাতায়াত ওখান দিয়েই।
অদূরেই যমুনা সেতু। একসময় একটা টং চায়ের দোকানের জায়গায় এখন অসংখ্য রেস্তোরাঁ এবং বিরাট বাজার। বড়বাসালিয়ার সেই আম-লিচু বাগানঘেরা গ্রামটিতে এখন অনেক অট্টালিকা।
তবু এই গ্রামে এখনো কিছুটা সেই আমার বাল্যস্মৃতির অবশেষ আছে। শাহজাহান আমাকে এবং আমার অনুজ শিল্পী রশীদ আমিনকে নিয়ে গেল নদীর ধারে একটা ছোট্ট চায়ের স্টলে। স্টলের পাশেই বিখ্যাত সংশিল্পী গফুরের বাড়ি। গফুর এবং বড়বাসালিয়ার সংশিল্পীদের জীবন নিয়ে আমি একটি নাটক লিখেছিলাম সঙক্রান্তি। আরেকজন শিল্পী ছিল, তার নাম আইয়ূব। দুজনেই এখন প্রয়াত। ওই শিল্পীদের মধ্যে মিয়াচান এখনো বেঁচে আছে। মিয়া চানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সংশিল্পীরা যা করে থাকে—একটি অত্যন্ত কৌতুকপূর্ণ সংবাদ পরিবেশনা। সে আমাদের একটি দীর্ঘ সংলাপ শোনায়। চারদিকে হাসির রোল শুরু হয়ে গেল। চায়ের দোকানের মালিক বাহেস, সে-ও এই শিল্পীদের সঙ্গে যুক্ত। যেখানেই সং হয়, সেখানে গিয়ে সে যোগ দেয়, গান গায়। চা খেতে খেতে সামনের চায়ের দোকানের সামনে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে গফুরের ছেলে লাল চান এসে হাজির হয়। সে এবার ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে দাঁড়িয়েছিল এবং যথারীতি পরাজিত হয়েছে। এবার শুরু হলো চায়ের কাপে ঝড়। বিষয় একটাই—রাজনীতি। সম্প্রতি সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে এলাকায় কে কীভাবে বিজয়ী হলো, কে কত টাকা খরচ করেছে—তার একটা খতিয়ান প্রথমেই জানা গেল। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী যে লোকটি পরাজিত হয়েছে, সে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা খরচ করেছে, আর যে জিতেছে সে কোনো টাকাই খরচ করতে পারেনি। সে সংগতি তাঁর ছিল না। কিন্তু তাঁর ছিল জনসমর্থন। ভোট গণনার একটা পর্যায়ে যখন ব্যালট বাক্সগুলো জেলা সদরে নিতে চাচ্ছিল, তখন গ্রামের, বিশেষ করে নারীরা রুখে দাঁড়াল। অবশেষে ওখানেই ভোট গণনা শুরু হলো এবং গণনায় সঠিক প্রার্থীই বিজয়ী হয়ে গেল। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় জনগণ তা রোধ করতে পারেনি।
নির্বাচনের সূত্র ধরে দ্বিতীয় বিষয়টি এল দুর্নীতি। খাল কাটায় অনিয়ম এবং গম চুরির ঘটনা থেকে নানা বিষয়। মুহূর্তেই বিষয়গুলো এত খোলামেলাভাবে আসতে শুরু করল, যেন আমরা ফিরে গেলাম ষাটের দশকে। যখন এমন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল যে, সব কথা বলা যেত। সেই সময়ে আশাজাগানিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মওলানা ভাসানীর বক্তৃতাও এসব সংশিল্পী অসাধারণ দক্ষতায় উচ্চারণ করত। ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হওয়ার পরও গ্রামবাংলায় একটা মুক্ত পরিবেশ আবিষ্কার করলাম। এমনই ৬৮ হাজার গ্রামের মধ্যে একধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখনো রয়ে গেছে।
প্রবল উত্তেজনা, সহিংসতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও সত্য কথাটি উচ্চারিত হয়ে এসেছে। টি স্টলের সামনে নদীটি একসময় শুকিয়ে গিয়েছিল, নদী খননের জন্য সরকারি টাকাও এসেছিল; কিন্তু চুরির এমন দুর্নীতি ঘটেছিল যে, শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। বিষয়টি গ্রাম পর্যায়ে আলোচিত হতে হতে বাধ্য হয়ে আবার নদী খনন শুরু হয়। এখন এই শীতকালেও নদীতে মোটামুটি পানি থাকে। ওখানেই পরিচয় হলো এক মৎস্যজীবী নিমাই মাঝির সঙ্গে। বেশ বয়স হয়েছে মাঝির। বংশপরম্পরায় তারা মৎস্যজীবী। তার মধ্যেও কয়েক দিন আগে সে এই নদী থেকে সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের একটি বোয়াল মাছ ধরেছে। এতেই মনে হয়, নদীতে নাব্যতা আছে। এ অঞ্চলের বোয়াল মাছ খুবই বিখ্যাত। ছোটবেলায় অবশ্য দেখতাম, এ অঞ্চলে বড় বড় রুই মাছ পাওয়া যেত। আরেকটু উজানে গেলে বড় বড় বাগাড় মাছ ধরা পড়ার পর এলাকায় একটা খবর হয়ে যেত। নদীগুলোতে নাব্যতা থাকলে আজকের দিনে যে পরিমাণে আমাদের বদ্ধ জলাশয়ের মাছ খেতে হয় এবং ডিপটিউবওয়েল দিয়ে হাইব্রিডের চাষ করতে হয়, তা হয়তো করতে হতো না।
নদীকে নিয়ে নদীপারের মানুষের যেমন আনন্দ তেমনি বেদনা ছিল এককালে। কিন্তু নদী শুকিয়ে যাওয়ার পর বেদনাটাও শুকিয়ে গেছে। নদীকে নিয়ে স্বপ্নযাত্রার অবসান হয়েছে। সেই নদীতে এখন পানি, দু-পাড় আবার কিছু কিছু ভাঙতে শুরু করেছে। নদীভাঙন শুরু হলে ওসব এলাকায় লঞ্চ দেখলেই মানুষ ঢিল ছুড়ত। এখন অবশ্য এসব নদীতে লঞ্চ চলাচল বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, প্রায় সব জায়গায়ই চালু হয়েছে ছোটখাটো বা মাঝারি ধরনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা। যদিও এই নৌকাগুলো প্রবল শব্দে চলে, তাই মাঝির কণ্ঠে আর ভাটিয়ালি গান শোনা যায় না। নৌকাগুলো মাঝিকে বা মালিককে অর্থ দিচ্ছে বটে; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে শিল্প।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। আমরা নদীর পাড় থেকে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করি। সেখানে বেশ দোকানপাট, যার মধ্যে লক্ষণীয় বেশ কিছু ওষুধের দোকান। আমার সেই বাল্যকাল এবং কৈশোরের কথা মনে পড়ে, যখন একটিও ওষুধের দোকান ছিল না সেখানে। ছিল না কোনো ডাক্তার। মানুষ অসুস্থ হলে ওই বাঁশি গ্রামের ডিসপেনসারিতে যেত। ছিলেন কালীপদ ডাক্তার, তাঁর পায়ের সমস্যা ছিল। তিনি ঘোড়ায় করে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখে বেড়াতেন। দুই ধরনের মিকশ্চার ছিল—জ্বরজারি হলে এলকালি মিকশ্চার আর পেটের সমস্যা হলে কার্মেনেটি মিকশ্চার। আর পথ্য হিসেবে কিছু পরামর্শ দিতেন কম্পাউন্ডার বাবু এবং তাতেই রোগবালাই সেরে যেত গ্রামবাংলায়। তবে কলেরা-বসন্ত হলে তা এক মহামারির রূপ পেয়ে যেত এবং স্কুল, কলেজে, গ্রামগঞ্জে কলেরার ইনজেকশন ও বসন্তের টিকা দেওয়ার ধুম পড়ে যেত।
বড়বাসালিয়া গ্রামের মতো আরও অনেক গ্রাম ও উপজেলা শহরে শত শত ওষুধের দোকান দেখা যায়। একদিকে বিত্ত বাড়ছে আর অন্যদিকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ আর সেই সঙ্গে বেড়েছে স্বাস্থ্য-বাণিজ্য। টাঙ্গাইল শহরে শতাধিক ক্লিনিক রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। ওষুধ একটা সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়েছে। ছুটির দিনে ঢাকার বিখ্যাত ডাক্তারেরা ছোট ছোট শহরে মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিয়ে ভিড় করেন এবং রাতের বেলায় ব্যাগ বোঝাই টাকা নিয়ে ঢাকায় ফেরেন। বড়বাসালিয়া গ্রামে ওষুধের দোকানের কাটতি দেখে বোঝা যায়, চিকিৎসা এখন আর সেবা নয়, একটা বড় ব্যবসা।
আনন্দ ও কিছুটা বিষণ্নতা নিয়ে শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে বসি। খুবই প্রাকৃতিক পরিবেশ। টিনের ঘরের চালের ওপর শিশির পড়ছে। টুপটুপ করে শিশিরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আর ভাবছি, এই যে একসময় নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে কিছুটা চঞ্চলতা যেমন এসেছে, তেমনি একধরনের বিক্ষোভও দানা বেঁধে উঠেছে। যার পরিণতি হতে পারে বড় ধরনের বিক্ষোভ অথবা বড় ধরনের হতাশা। কারণ, বাংলার শিক্ষার সংস্কৃতির পাশাপাশি অপসংস্কৃতির শিক্ষাও পঙ্গপালের মতো বেড়ে উঠছে।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে