মানবর্দ্ধন পাল
পৌরাণিক যুগ বিভাগ মতে, অনন্ত মহাকালকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন—সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। এই চার যুগে চারজন অবতার পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করেছেন এবং অমঙ্গল ও অন্যায় দমন করেছেন।
যুগাবতাবৃন্দ সব অশুভ-অকল্যাণ বিনাশ করে শুভ-সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পৌরাণিক এই চার যুগাবতার হলেন—সত্যযুগে শ্রীহরি, ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র, দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ এবং কলিযুগে শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। অনাচার, অন্যায় ও অসত্য বিলোপ করে সত্য, ন্যায় ও ধর্ম প্রতিষ্ঠাই যুগাবতারদের জীবনের লক্ষ্য। তাই শ্রীশ্রী গীতায় বলা হয়েছে, ‘পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম/ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’ এই আধুনিক যুগে একই সুরে রবীন্দ্রনাথও একই কথা বলেছেন ভিন্ন ভাষায়। যেমন তিনি বলেছন, ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/ এই দয়াহীন সংসারে/ তারা বলে গেল, দয়া কর সবে,/ বলে গেল ভালোবাসো/ অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।’
অবতার শ্রীকৃষ্ণের আছে ‘আটটি নামাবলি।’ এমনকি দশভুজা-তনয়া লক্ষ্মীদেবীরও আছে শতনাম। তা একালেও সনাতনী বাঙালির ঘরে ঘরে পঠিত ও গীত হয়। দশভুজারও আছে অচর্চিত, অজানা ও অল্পজানা অনেক নাম, যা ভক্তিবাদী বাঙালি হিন্দুরা অধিকাংশই জানেন না। দশভুজার অজানা সেই নামাবলি বাঙালি হিন্দুদের গৃহে চর্চিত বা গীতও হয় না। ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী আমাদের নিত্য আরাধ্য, কিন্তু সর্বশক্তির আধার জগজ্জননী দুর্গা শারদীয় বিশেষ তিথিলগ্ন ছাড়া স্মরিত ও পূজিত হন না! তাই জগন্মাতাকে নিত্য স্মরণের লক্ষ্যে সর্বাগ্রে তাঁর নামাবলি জানা প্রয়োজন। দশভুজার রূপ, গুণ ও কীর্তি অনুসারে, যাকে বলা হয় ‘দেবলীলা’। পুরাণ মতে, তাঁর নিম্নে বর্ণিত নামাবলি জানা যায়। যেমন দুর্গা, ভগবতী, উমা, পার্বতী, পর্বতসুতা, গিরিজা, পর্বতদুহিতা, গিরিনন্দিনী, গিরিকুমারী, গিরিসুতা, গিরিবালা, শৈলজা, শৈলেয়ী, শৈলসুতা, অগসুতা, অগাত্মজা, নগনন্দিনী, হৈমবতী, বিন্ধ্যবাসিনী, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, গৌরী, জগদ্গৌরী, দক্ষজা, দক্ষকন্যা, দক্ষায়ণী, হিমালয়নন্দিনী, দশভুজা, শিবপত্নী, মহেশী, মহেশানী, শিবপ্রিয়া, শিবানী, শিবা, শংকরী, জগজ্জননী, জগদম্বা, জগন্মাতা, জগদ্ধাত্রী, মহাদেবী মহামায়া, মহাবিদ্যা, মহাশক্তি, আদ্যাশক্তি, সনাতনী, আদিদেবী, অনাদ্যা, আদিভূতা, আদ্যা, অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা, পরমেশ্বরী, বিশ্বেশ্বরী, সুরেশ্বরী, ঈশ্বরী, ঈশানী, ঐশানী, শুভংকরী, ভদ্রাণী, সর্বমঙ্গলা, মঙ্গলচণ্ডী, শুভদাচণ্ডী, আনন্দময়ী, মঙ্গলা, সর্বার্থসাধিকা, অন্নদা, অন্নপূর্ণা, মোক্ষদা, জয়া, বিজয়া, সর্বজয়া, জয়ন্তী, প্রকৃতি, পরমাপ্রকৃতি, সারদা, শর্বাণী, কৌশিকী, সাত্ত্বিকী, দানবদলিনী, দনুজদলনী, মহিষাসুরমর্দিনী, সিংহবাহিনী, ত্রিশূলধারিণী, ত্রিশূলিনী, শূলিনী, নিস্তারিণী, ভবতারিণী, তারিণী, ত্রিনয়নী, ত্রিনয়না, রুদ্রাণী, চণ্ডী, চামুণ্ডা, জ্বালামালিনী, ত্রিগুণা, শরণা, কাত্যায়নী, কপর্দিনী, চণ্ডবতী, শাকম্ভরী, নন্দা, কাণ্ডবারিণী, আর্যা, যোগমায়া, বভ্রবী, বাব্রবী, গৌতমী, সর্বজ্ঞা, সতী, সাবিত্রী, ভদ্রকালী, বাসন্তী, ভাস্বতী, কৈলাসবাসিনী, কামাক্ষী, রাজরাজেশ্বরী ও অপর্ণা।
দেবীর এই নামাবলি হাবিবুর রহমানের ‘যথাশব্দ’ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘সংসদ সমার্থ শব্দকোষ’ থেকে সংগৃহীত। এগুলো ছাড়াও দশভুজার আরও কিছু নাম থাকা বিচিত্র নয়। উল্লিখিত ১২০টি নামের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত নাম ‘দুর্গা’। দেবীর প্রতিটি নামের যেমন নিহিতার্থ আছে, তেমনি এর নেপথ্যে আছে পৌরাণিক ইতিহাস। দেবীর জন্ম, জন্মস্থান, বিবাহ, আকৃতি-প্রকৃতি, চারিত্র্যগুণ, ঐশ্বরীয় কীর্তি, লীলারহস্য—সবকিছু মিলিয়ে দেবীর এত সব নাম। এই নামের স্বরূপ থেকেই দুর্গার মাতৃরূপ ও চণ্ডরূপ, শক্তিরূপ ও শান্তরূপ, বিধ্বংসী রূপ ও সৃষ্টি রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। কেবল ‘দুর্গা’ নামটির রহস্য অনুধাবন করলেই দেবীর স্বরূপ অনেকখানি জানা হয়ে যায়।
অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস জানিয়েছেন, যাঁকে দুঃখে জানা যায় কিংবা যিনি ‘দুর্গ’, অর্থাৎ সংকট থেকে ত্রাণ করেন তিনিই দুর্গা। এই দেবী পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী। পৌরাণিক রাজা সুরথ এই দেবীর পূজা ধরাধামে প্রচার করেন। দশরথপুত্র অযোধ্যার রামচন্দ্র সীতাকে হরণকারী রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য দুর্গাদেবীকে অকালে বোধন করেছিলেন।
অপশক্তির প্রতীক মহাশক্তিধর মহিষাসুরকে বিনাশ করার জন্য সব দেবতার তেজোরাশি একত্র হয়ে সৃষ্টি হয় এই মহামায়া দুর্গা। বঙ্গীয় শব্দকোষের সংকলক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গা’ ভুক্তি থেকে জানা যায়, ‘মহাবিঘ্নাদিনাশিনী দেবী দুর্গা। মতান্তরে, দুর্গনামক দৈত্যনাশ হেতু “দুর্গা” (কালীখণ্ড, ৭৭তম অধ্যায়)।’ তিনি ‘দুর্গা’ শব্দের বর্ণগুলোর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে: দ মানে দৈত্যনাশ, উ মানে বিঘ্ননাশ, র-এর অর্থ রোগমুক্তি, গ মানে পাপনাশ, আ-এর অর্থ ভয়শত্রু নাশ—এসবের সামগ্রিক ঐকসূত্রেই তাঁর নাম দুর্গা।
পুরাণে বর্ণিত আছে, সব দেবতার অমিত তেজের সম্মিলনে অলৌকিক সৃষ্টি মহাদেবী দুর্গা। সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত ‘পৌরাণিক অভিধান’ থেকে জানা যায়, মহিষাসুর দেবতাদের যুদ্ধে পরাজিত করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে এবং স্বর্গরাজ্য দখলে নেন। দেবতারা বিধ্বস্ত ও বিপন্ন হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। তখন ব্রহ্মা পরাজিত দেবগণ ও শিবকে নিয়ে এই দুর্দশা থেকে মুক্তিলাভের জন্য বিষ্ণুর কাছে যান।
কারণ ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষের দ্বারা বধ নন! তাই বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতাদের নিজ নিজ তেজের কাছে সম্মিলিত প্রার্থনায় সৃষ্টি হয় এক অসম শক্তিধর নারীমূর্তি। এই নারীই দেবী দুর্গা। সম্মিলিত তেজ থেকে আবির্ভূত এই মহাপরাক্রমশালী নারী মহিষাসুরকে বধ করেন। সব দেবতা এই নারীকে অস্ত্র দান করে রণসজ্জায় সজ্জিত করেন। এই রূপেই দেবী দুর্গা অনাদিকাল থেকে বাঙালি সমাজে পূজিত হয়ে আসছেন।
তবে বিভিন্ন পুরাণে দেবীর রূপ ভিন্ন ভিন্ন। এই দেবী মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন। প্রথমে অষ্টাদশ ভুজা উগ্রচণ্ডারূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার দশভুজা দুর্গারূপে। পুরাণে এ কথাও বর্ণিত আছে, অন্যায়ের রূপকাধার মহিষাসুরও দুর্গার সঙ্গে পূজিত হবেন। কারণ মহিষাসুর ভদ্রকালীর আরাধনা করে বর লাভ করেছিলেন যে উগ্রচণ্ডী, ভদ্রকালী ও দুর্গারূপে দেবী পূজিত হওয়ার সময় তাঁদের পদলগ্ন হয়ে মহিষাসুরও মানুষের পূজা পাবেন। দেবী ভাগবত, মার্কণ্ডেয় চণ্ডী ও কালিকা পুরাণে এসব কথা লেখা আছে। তবে খুব বেশি আলোচিত না হলেও মহিষাসুর সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ মতও পাওয়া যায়।
ডা. নৃপেণ ভৌমিকের ‘বাংলার শব্দকথা’ বই থেকে জানা যায়, ‘বাংলার আকাশে-বাতাসে যখন শারদীয় উৎসব আনন্দ করে পালিত হয়, তখন এই ভারতীয় মানচিত্রেরই আরেক দিকে পালিত হয় দাসাই, যা আসলে শোক-উৎসব। মহিষাসুরকে অন্যায়ভাবে খুন করা হয়েছিল, এমনটিই দৃঢ় বিশ্বাস বাংলার কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার (মূলত সাঁওতাল, মুণ্ডা, খেরোয়াল প্রভৃতি জাতি) মানুষদের মধ্যে। তাই দুর্গাপূজার দিনগুলোতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এসব মানুষের ঘরে আলোও জ্বলে না। মহিষাসুর কোনো অশুভ শক্তির প্রতীক নন। তিনি শহিদ। আর্য সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে ‘খুন’ হন হুদুড় দুর্গা নামক অনার্য বীর।’ (পৃ. ৩৭৯)
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে যদিও এমন বিশ্বাসের প্রভাব নেই। তবুও এর ঐতিহাসিকতা বিবেচনার দাবি রাখে। দুর্গাপূজার ইতিহাস পৌরাণিক কালের। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী থেকে জানা যায়, সত্যযুগে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য প্রথম দুর্গামূর্তি নির্মাণ করে অবিরত তিন বছর দেবীর পূজার্চনা করেছিলেন। ত্রেতাযুগে লঙ্কাধিপতি রাবণ চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার পূজা করতেন। তা ঋতুচক্রে বসন্তকাল বলে এই পূজাকে বাসন্তীপূজা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
রামচন্দ্র লঙ্কাবিজয়, রাবণবধ ও সীতা-উদ্ধারের লক্ষ্যে শরৎকালে দেবীর অকালবোধন করেন। সেদিন ছিল আশ্বিন মাসের রামনবমী। রামচন্দ্রের এই অকালবোধনই শারদীয় দুর্গাপূজা হিসেবে হিন্দুসমাজে সর্বমান্য ও সুপ্রচলিত। আরও জানা যায়, দ্বাপরযুগে গোপ-কুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার কামনায় হেমন্তকালের অগ্রহায়ণে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তবে বাসন্তীপূজা এখনো সনাতনী বাঙালির মধ্যে প্রচলিত থাকলেও, হেমন্তের পূজা একালে আর দেখা যায় না।
যে নামে, যে ঋতুতে বা যে লক্ষ্যেই এই দেবী পূজিত হন না কেন, সর্ববিঘ্নবিনাশী ও দুর্গতিনাশিনী দুর্গা নামেই মাতৃময়ী এই দেবী আমাদের আরাধ্য। ‘রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশং দেহি’ মন্ত্র উচ্চারণ করে আমরা দেবীর কাছে ফুল-জল-বেলপাতা নিবেদন করে প্রার্থনা করি। তাই জীব ও জগতের কল্যাণের সঙ্গে এবারের দুর্গাপূজায় প্রার্থনা, দেশের সব ধর্মের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের জয়গানে মুখরিত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক, গ্রন্থকার
পৌরাণিক যুগ বিভাগ মতে, অনন্ত মহাকালকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন—সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। এই চার যুগে চারজন অবতার পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করেছেন এবং অমঙ্গল ও অন্যায় দমন করেছেন।
যুগাবতাবৃন্দ সব অশুভ-অকল্যাণ বিনাশ করে শুভ-সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পৌরাণিক এই চার যুগাবতার হলেন—সত্যযুগে শ্রীহরি, ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র, দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ এবং কলিযুগে শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। অনাচার, অন্যায় ও অসত্য বিলোপ করে সত্য, ন্যায় ও ধর্ম প্রতিষ্ঠাই যুগাবতারদের জীবনের লক্ষ্য। তাই শ্রীশ্রী গীতায় বলা হয়েছে, ‘পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম/ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’ এই আধুনিক যুগে একই সুরে রবীন্দ্রনাথও একই কথা বলেছেন ভিন্ন ভাষায়। যেমন তিনি বলেছন, ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/ এই দয়াহীন সংসারে/ তারা বলে গেল, দয়া কর সবে,/ বলে গেল ভালোবাসো/ অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।’
অবতার শ্রীকৃষ্ণের আছে ‘আটটি নামাবলি।’ এমনকি দশভুজা-তনয়া লক্ষ্মীদেবীরও আছে শতনাম। তা একালেও সনাতনী বাঙালির ঘরে ঘরে পঠিত ও গীত হয়। দশভুজারও আছে অচর্চিত, অজানা ও অল্পজানা অনেক নাম, যা ভক্তিবাদী বাঙালি হিন্দুরা অধিকাংশই জানেন না। দশভুজার অজানা সেই নামাবলি বাঙালি হিন্দুদের গৃহে চর্চিত বা গীতও হয় না। ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী আমাদের নিত্য আরাধ্য, কিন্তু সর্বশক্তির আধার জগজ্জননী দুর্গা শারদীয় বিশেষ তিথিলগ্ন ছাড়া স্মরিত ও পূজিত হন না! তাই জগন্মাতাকে নিত্য স্মরণের লক্ষ্যে সর্বাগ্রে তাঁর নামাবলি জানা প্রয়োজন। দশভুজার রূপ, গুণ ও কীর্তি অনুসারে, যাকে বলা হয় ‘দেবলীলা’। পুরাণ মতে, তাঁর নিম্নে বর্ণিত নামাবলি জানা যায়। যেমন দুর্গা, ভগবতী, উমা, পার্বতী, পর্বতসুতা, গিরিজা, পর্বতদুহিতা, গিরিনন্দিনী, গিরিকুমারী, গিরিসুতা, গিরিবালা, শৈলজা, শৈলেয়ী, শৈলসুতা, অগসুতা, অগাত্মজা, নগনন্দিনী, হৈমবতী, বিন্ধ্যবাসিনী, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, গৌরী, জগদ্গৌরী, দক্ষজা, দক্ষকন্যা, দক্ষায়ণী, হিমালয়নন্দিনী, দশভুজা, শিবপত্নী, মহেশী, মহেশানী, শিবপ্রিয়া, শিবানী, শিবা, শংকরী, জগজ্জননী, জগদম্বা, জগন্মাতা, জগদ্ধাত্রী, মহাদেবী মহামায়া, মহাবিদ্যা, মহাশক্তি, আদ্যাশক্তি, সনাতনী, আদিদেবী, অনাদ্যা, আদিভূতা, আদ্যা, অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা, পরমেশ্বরী, বিশ্বেশ্বরী, সুরেশ্বরী, ঈশ্বরী, ঈশানী, ঐশানী, শুভংকরী, ভদ্রাণী, সর্বমঙ্গলা, মঙ্গলচণ্ডী, শুভদাচণ্ডী, আনন্দময়ী, মঙ্গলা, সর্বার্থসাধিকা, অন্নদা, অন্নপূর্ণা, মোক্ষদা, জয়া, বিজয়া, সর্বজয়া, জয়ন্তী, প্রকৃতি, পরমাপ্রকৃতি, সারদা, শর্বাণী, কৌশিকী, সাত্ত্বিকী, দানবদলিনী, দনুজদলনী, মহিষাসুরমর্দিনী, সিংহবাহিনী, ত্রিশূলধারিণী, ত্রিশূলিনী, শূলিনী, নিস্তারিণী, ভবতারিণী, তারিণী, ত্রিনয়নী, ত্রিনয়না, রুদ্রাণী, চণ্ডী, চামুণ্ডা, জ্বালামালিনী, ত্রিগুণা, শরণা, কাত্যায়নী, কপর্দিনী, চণ্ডবতী, শাকম্ভরী, নন্দা, কাণ্ডবারিণী, আর্যা, যোগমায়া, বভ্রবী, বাব্রবী, গৌতমী, সর্বজ্ঞা, সতী, সাবিত্রী, ভদ্রকালী, বাসন্তী, ভাস্বতী, কৈলাসবাসিনী, কামাক্ষী, রাজরাজেশ্বরী ও অপর্ণা।
দেবীর এই নামাবলি হাবিবুর রহমানের ‘যথাশব্দ’ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘সংসদ সমার্থ শব্দকোষ’ থেকে সংগৃহীত। এগুলো ছাড়াও দশভুজার আরও কিছু নাম থাকা বিচিত্র নয়। উল্লিখিত ১২০টি নামের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত নাম ‘দুর্গা’। দেবীর প্রতিটি নামের যেমন নিহিতার্থ আছে, তেমনি এর নেপথ্যে আছে পৌরাণিক ইতিহাস। দেবীর জন্ম, জন্মস্থান, বিবাহ, আকৃতি-প্রকৃতি, চারিত্র্যগুণ, ঐশ্বরীয় কীর্তি, লীলারহস্য—সবকিছু মিলিয়ে দেবীর এত সব নাম। এই নামের স্বরূপ থেকেই দুর্গার মাতৃরূপ ও চণ্ডরূপ, শক্তিরূপ ও শান্তরূপ, বিধ্বংসী রূপ ও সৃষ্টি রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। কেবল ‘দুর্গা’ নামটির রহস্য অনুধাবন করলেই দেবীর স্বরূপ অনেকখানি জানা হয়ে যায়।
অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস জানিয়েছেন, যাঁকে দুঃখে জানা যায় কিংবা যিনি ‘দুর্গ’, অর্থাৎ সংকট থেকে ত্রাণ করেন তিনিই দুর্গা। এই দেবী পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী। পৌরাণিক রাজা সুরথ এই দেবীর পূজা ধরাধামে প্রচার করেন। দশরথপুত্র অযোধ্যার রামচন্দ্র সীতাকে হরণকারী রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য দুর্গাদেবীকে অকালে বোধন করেছিলেন।
অপশক্তির প্রতীক মহাশক্তিধর মহিষাসুরকে বিনাশ করার জন্য সব দেবতার তেজোরাশি একত্র হয়ে সৃষ্টি হয় এই মহামায়া দুর্গা। বঙ্গীয় শব্দকোষের সংকলক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গা’ ভুক্তি থেকে জানা যায়, ‘মহাবিঘ্নাদিনাশিনী দেবী দুর্গা। মতান্তরে, দুর্গনামক দৈত্যনাশ হেতু “দুর্গা” (কালীখণ্ড, ৭৭তম অধ্যায়)।’ তিনি ‘দুর্গা’ শব্দের বর্ণগুলোর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে: দ মানে দৈত্যনাশ, উ মানে বিঘ্ননাশ, র-এর অর্থ রোগমুক্তি, গ মানে পাপনাশ, আ-এর অর্থ ভয়শত্রু নাশ—এসবের সামগ্রিক ঐকসূত্রেই তাঁর নাম দুর্গা।
পুরাণে বর্ণিত আছে, সব দেবতার অমিত তেজের সম্মিলনে অলৌকিক সৃষ্টি মহাদেবী দুর্গা। সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত ‘পৌরাণিক অভিধান’ থেকে জানা যায়, মহিষাসুর দেবতাদের যুদ্ধে পরাজিত করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে এবং স্বর্গরাজ্য দখলে নেন। দেবতারা বিধ্বস্ত ও বিপন্ন হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। তখন ব্রহ্মা পরাজিত দেবগণ ও শিবকে নিয়ে এই দুর্দশা থেকে মুক্তিলাভের জন্য বিষ্ণুর কাছে যান।
কারণ ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষের দ্বারা বধ নন! তাই বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতাদের নিজ নিজ তেজের কাছে সম্মিলিত প্রার্থনায় সৃষ্টি হয় এক অসম শক্তিধর নারীমূর্তি। এই নারীই দেবী দুর্গা। সম্মিলিত তেজ থেকে আবির্ভূত এই মহাপরাক্রমশালী নারী মহিষাসুরকে বধ করেন। সব দেবতা এই নারীকে অস্ত্র দান করে রণসজ্জায় সজ্জিত করেন। এই রূপেই দেবী দুর্গা অনাদিকাল থেকে বাঙালি সমাজে পূজিত হয়ে আসছেন।
তবে বিভিন্ন পুরাণে দেবীর রূপ ভিন্ন ভিন্ন। এই দেবী মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন। প্রথমে অষ্টাদশ ভুজা উগ্রচণ্ডারূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার দশভুজা দুর্গারূপে। পুরাণে এ কথাও বর্ণিত আছে, অন্যায়ের রূপকাধার মহিষাসুরও দুর্গার সঙ্গে পূজিত হবেন। কারণ মহিষাসুর ভদ্রকালীর আরাধনা করে বর লাভ করেছিলেন যে উগ্রচণ্ডী, ভদ্রকালী ও দুর্গারূপে দেবী পূজিত হওয়ার সময় তাঁদের পদলগ্ন হয়ে মহিষাসুরও মানুষের পূজা পাবেন। দেবী ভাগবত, মার্কণ্ডেয় চণ্ডী ও কালিকা পুরাণে এসব কথা লেখা আছে। তবে খুব বেশি আলোচিত না হলেও মহিষাসুর সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ মতও পাওয়া যায়।
ডা. নৃপেণ ভৌমিকের ‘বাংলার শব্দকথা’ বই থেকে জানা যায়, ‘বাংলার আকাশে-বাতাসে যখন শারদীয় উৎসব আনন্দ করে পালিত হয়, তখন এই ভারতীয় মানচিত্রেরই আরেক দিকে পালিত হয় দাসাই, যা আসলে শোক-উৎসব। মহিষাসুরকে অন্যায়ভাবে খুন করা হয়েছিল, এমনটিই দৃঢ় বিশ্বাস বাংলার কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার (মূলত সাঁওতাল, মুণ্ডা, খেরোয়াল প্রভৃতি জাতি) মানুষদের মধ্যে। তাই দুর্গাপূজার দিনগুলোতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এসব মানুষের ঘরে আলোও জ্বলে না। মহিষাসুর কোনো অশুভ শক্তির প্রতীক নন। তিনি শহিদ। আর্য সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে ‘খুন’ হন হুদুড় দুর্গা নামক অনার্য বীর।’ (পৃ. ৩৭৯)
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে যদিও এমন বিশ্বাসের প্রভাব নেই। তবুও এর ঐতিহাসিকতা বিবেচনার দাবি রাখে। দুর্গাপূজার ইতিহাস পৌরাণিক কালের। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী থেকে জানা যায়, সত্যযুগে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য প্রথম দুর্গামূর্তি নির্মাণ করে অবিরত তিন বছর দেবীর পূজার্চনা করেছিলেন। ত্রেতাযুগে লঙ্কাধিপতি রাবণ চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার পূজা করতেন। তা ঋতুচক্রে বসন্তকাল বলে এই পূজাকে বাসন্তীপূজা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
রামচন্দ্র লঙ্কাবিজয়, রাবণবধ ও সীতা-উদ্ধারের লক্ষ্যে শরৎকালে দেবীর অকালবোধন করেন। সেদিন ছিল আশ্বিন মাসের রামনবমী। রামচন্দ্রের এই অকালবোধনই শারদীয় দুর্গাপূজা হিসেবে হিন্দুসমাজে সর্বমান্য ও সুপ্রচলিত। আরও জানা যায়, দ্বাপরযুগে গোপ-কুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার কামনায় হেমন্তকালের অগ্রহায়ণে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তবে বাসন্তীপূজা এখনো সনাতনী বাঙালির মধ্যে প্রচলিত থাকলেও, হেমন্তের পূজা একালে আর দেখা যায় না।
যে নামে, যে ঋতুতে বা যে লক্ষ্যেই এই দেবী পূজিত হন না কেন, সর্ববিঘ্নবিনাশী ও দুর্গতিনাশিনী দুর্গা নামেই মাতৃময়ী এই দেবী আমাদের আরাধ্য। ‘রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশং দেহি’ মন্ত্র উচ্চারণ করে আমরা দেবীর কাছে ফুল-জল-বেলপাতা নিবেদন করে প্রার্থনা করি। তাই জীব ও জগতের কল্যাণের সঙ্গে এবারের দুর্গাপূজায় প্রার্থনা, দেশের সব ধর্মের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের জয়গানে মুখরিত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক, গ্রন্থকার
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে