শাইখ সিরাজ
আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, ঠিক তখন এই রাত পোহালেই পয়লা বৈশাখ, নতুন দিনের সূর্য উঠবে। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করবে দেশের ও প্রবাসের বাংলাদেশি মানুষ। আমাদের বৈশাখ উদ্যাপনের উপকরণগুলো হাজার বছরের কৃষক পরিবারের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। পান্তাভাত থেকে শুরু করে হাতপাখা, মাটির বাসন-কোসন, বাঁশের তৈরি ব্যবহার্য কিংবা কৃষকের সন্তানদের খেলার সরঞ্জামাদি বাঁশের বাঁশি, টেপাপুতুল। অথবা ঐতিহ্যের মণ্ডা-মিঠাই। ঐতিহ্যগতভাবেই আমরা কৃষকের সন্তান আর বাঙালিয়ানা বলতে যে গ্রামীণ কৃষকের যাপনকে বোঝায়, পয়লা বৈশাখ এলেই আমাদের উদ্যাপনে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমাদের অনেকেরই অজানা নয়, পয়লা বৈশাখের সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সারা বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয় মূলত কৃষিকাজের সুবিধার্থেই। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সন প্রবর্তন করেন তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে; অর্থাৎ ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে। বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হওয়ার আগে বাংলা সন ‘ফসলি সন’ নামেই পরিচিত ছিল। সে সময় বাংলার কৃষক চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীর খাজনা পরিশোধ করতেন। এ আচারকে বলা হতো পুণ্যাহ। ভূস্বামীরা পয়লা বৈশাখে কৃষককে মিষ্টিমুখ করাতেন। খোলা হতো নতুন বছরে খাজনার নতুন খাতা। এ থেকেই বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব হয়ে দাঁড়ায় হালখাতা। গ্রামগঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতে পুরোনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে খুলতেন নতুন হিসাবের খাতা। এ উপলক্ষে চলত উৎসব, মিষ্টিমুখ। মেলা বসত গ্রামে গ্রামে।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে ইরফান হাবিব রচিত ‘মুঘল ভারতের কৃষিব্যবস্থা’ বইটির কথা। সেখানে মোগল আমলের কৃষির যে চিত্র পাওয়া যায় তা সত্যি বিস্ময়কর। মোগল আমলে গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প। কৃষিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল নানা রকম কুটিরশিল্প। সে সময় থেকেই আখ ও তালের রস থেকে বিভিন্ন ধরনের চিনি তৈরি হতো। আবুল ফজল পাঁচ রকম চিনির কথা বলেছেন। চিনিশিল্পের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলা, আগ্রা ও লাহোরের মধ্যবর্তী এলাকা এবং গোলকুণ্ডা। এ অঞ্চল থেকে আরব, মেসোপটেমিয়া ও পারস্যে চিনি রপ্তানি হতো। ঘানিতে তেলবীজ থেকে তৈরি হতো তেল। সিন্ধু, গুজরাট, গোলকুণ্ডা, মহীশূর, ওডিশা ও বাংলায় এ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তামাকশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বুরহানপুর, বাংলা ও বিহার।
ভারতবর্ষেই তুলার চাষ হতো; বিশেষ করে বাংলা ছিল তুলা চাষের প্রধান আখড়া। কাপড় রং ও উজ্জ্বল করতে আগ্রা, ঢাকা, কাশিমবাজার, আহমেদাবাদ প্রভৃতি বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্রে নীলের চাহিদা ছিল। কৃষিজাত শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বস্ত্রবয়ন শিল্প। দেশজুড়ে বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরি হতো। বাংলার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি ছিল জগৎজুড়ে। ঢাকার মসলিন বস্ত্র ছিল খুব বিখ্যাত। পশম বা উলের জন্য বিখ্যাত ছিল কাবুল, কাশ্মীর ও পশ্চিম রাজস্থান। শণ ও পাটের তৈরি জিনিসও বহুল ব্যবহৃত হতো। ভারতের প্রায় সর্বত্র শণ উৎপাদন হতো। বাংলায় হতো পাটের চাষ। পাট দিয়ে তৈরি হতো দড়ি, বস্তা বা থলে। কাশিমবাজারের দড়ি ছিল বিখ্যাত। এই অঞ্চলের পাটের শাড়ির ছিল অন্য রকম কদর। সে সময়টা বলা চলে কৃষি ও কৃষকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি ও কৃষককে ঘিরেই সব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক শোষিত হলেও সমাজে কৃষকের সম্মান ছিল, ছিল অন্য রকম গ্রহণযোগ্যতা। কৃষকের পয়লা বৈশাখও ছিল আনন্দঘন এক ব্যাপার।
ইতিহাস বলে, কৃষক ভোক্তার কাছে সরাসরি যেতে না পারার কারণে বারবার শোষিত হয়েছেন। এ উপমহাদেশে বরাবর কৃষিবাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। আর এ কারণেই কৃষক হারাতে শুরু করেন তাঁর লাভের অঙ্ক। ইংরেজের শাসন আর জমিদারদের অব্যবস্থাপনায় বাংলার কৃষি ও কৃষক হারিয়ে ফেলেন তাঁর সুদিন। হাতের লাঙল ফেলে নিজের অধিকারের জন্য করতে হয় সংগ্রাম। কৃষকের পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক যন্ত্রণার নাম। এসব বইয়ে পড়া ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষককে দেখেছি খুব কাছ থেকে। প্রায় চার দশক ধরে কাজ করছি কৃষকদের নিয়ে। একটি দেশ যাত্রা শুরু করে কৃষিপ্রধান অর্থনীতি নিয়ে। সেখানে কৃষক মানেই হাড় জীর্ণ এক মানুষ। শত ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে। সেই কষ্ট জর্জরিত মানুষটিই ছিল মূল অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাঁর পয়লা বৈশাখ বলতে কিছুই ছিল না। পান্তা দিয়ে শুরু করা বছর শেষও হতো পান্তাতেই। সারা বছর লড়াই করতে হয়েছে একদিকে প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যদিকে মহাজনের সঙ্গে। গ্রামে চৈত্র মাস মানেই ছিল অভাবের এক সময়। সে সময়টায় গোলার ধান ফুরাত। ভাতের অভাবে বাজার থেকে কেনা আটার রুটি খেতে হতো। তখনো পয়লা বৈশাখ মানে কোনো আনন্দ নয়, বৈশাখ মানে আর কয়েক দিন পর উঠবে বোরো ফসল। থালা ভরা গরম ভাত তুলে দিতে পারবে সন্তানের পাতে। এটুকু ছিল সান্ত্বনার। আর কিছু নয়, ভাতের অভাবের অভিশাপ ছিল এক দশক আগেও। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে?
এখন সময় বদলেছে। বদলেছে কৃষি। একটা ছোট্ট প্রযুক্তি, উন্নত বীজ পাল্টে দিয়েছে সব। আগে ধান ফলাতে লাগত ১৪০ দিন। কার্তিক ও চৈত্রের শেষে ১০-১২ দিন খাদ্যাভাব দেখা দিত চরম আকারে। সে সময়টায় কর্মহীনতায় মঙ্গা হতো। এখন শর্ট ডিউরেশনের (স্বল্পমেয়াদি) ধানের জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ধান উৎপাদনে লাগছে ১১০ থেকে ১২০ দিন। কার্তিকের আগেই ধান উঠছে গোলায়। ফলে কার্তিকের মঙ্গা দূর হয়ে গেছে। বছরে এখন তিনটি ফসল চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। জাত উন্নয়ন করায় বেড়েছে ফলন। শুধু ধান আর পাটই নয়, কৃষক চাষ করছেন উচ্চফলনশীল ফল-ফসল। লাভের হিসাবটা কৃষক ঠিকই বুঝে গেছেন। বেশ সচেতন হয়ে উঠেছেন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে। কৃষকের খাবারের থালায় ভাতের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে শাক-সবজি, মাছ-মাংস আর ফল। পয়লা বৈশাখ মানে সত্যিই এখন আনন্দের।
এক মাস ধরে প্রাক্-বাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর জন্য আমাকে যেতে হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। কথা বলেছি হাজারো কৃষকের সঙ্গে। পাল্টে গেছে কৃষি ও কৃষকের সংজ্ঞা। পাল্টেছে কৃষকের ধ্যানধারণা। উৎপাদনের পাশাপাশি বাজার সম্পর্কেও কৃষক বেশ ভালো খোঁজখবর রাখেন। কখন কোন ফসল করলে লাভ বেশি পাওয়া যাবে, এ হিসাবটাও রাখছেন বুঝে-শুনেই। বাংলাদেশের কৃষকই নিজস্ব তাড়না থেকে সমৃদ্ধ করেছেন কৃষিকে।
তবে সংকটের অশনিসংকেত এখনো শুনতে পাই। সারা বিশ্বই ঝুঁকেছে প্রযুক্তির কৃষিতে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাতছানিতে পাল্টে যাচ্ছে বৈশ্বিক কৃষি। তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে ছিটকে পড়তে হবে আমাদের। নতুন দিনের কৃষিতে হিসাব কষে শিল্পকারখানার মেশিনের মতোই গাছ থেকে আসবে ফল-ফসল। মাছ চাষ থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষিই চলে আসছে বদ্ধ ঘরে। দিগন্তজোড়া কৃষি নয়, বরং কৃষির সম্প্রসারণ হচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী। নিশ্চিত লাভের উন্নত প্রযুক্তির এ কৃষিতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। তাই এতে বিনিয়োগ করবে বড় বড় শিল্পপতিরা। তৈরি পোশাক কারখানার মতোই কৃষির জমিগুলোয় গড়ে উঠবে কৃষি-শিল্প প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক তাঁদের নিজের জমিতে গড়ে ওঠা কৃষি-শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হবেন। প্রকৃত কৃষকের হাত থেকে কৃষি চলে যাবে কারখানায় যন্ত্রের কাছে। আমার আশঙ্কা হয়, এ সময়ের ভেতর কৃষকের হাত থেকে কৃষি সরে যাওয়ায় হাজার বছরের লব্ধ কৃষিজ্ঞান যেমন হারিয়ে ফেলবে, তেমনি হারিয়ে ফেলবে প্রাকৃতিক কৃষি-কৌশল। ভবিষ্যতের কৃষিতে এক গভীর বিপর্যয়ের আভাস আমি পাই। তাই এখন থেকেই এসব বিষয়ে কৃষককে সচেতন হতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এখন থেকেই হিসাব কষতে হবে আগামীর কৃষির। প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পিত কৃষি ব্যবস্থাপনা যেমন নিশ্চিত করতে পারে টেকসই উন্নয়নের, তেমনি ভাগ্য ফেরাতে পারে কৃষিসংশ্লিষ্ট সবার।
বলছিলাম কৃষকের পয়লা বৈশাখ নিয়ে। এ বিষয়ে আরও এক সংকটের কথা বলতে হচ্ছে। সারা বিশ্বকেই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, বিশেষ করে সমুদ্র-নিকটবর্তী দেশগুলো এর প্রভাব টের পাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। আমি মনে করি, কৃষকই সবচেয়ে বেশি প্রকৃতিমগ্ন। পেশাগত কারণেই প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ, যেমন রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সম্পর্কে সম্যক ধারণা তাঁকে রাখতেই হয়। যুগ যুগ ধরে পরম্পরায় পরিবেশ ও আবহাওয়া সম্পর্কে একধরনের জানা-বোঝা কৃষকের রয়েছে। আকাশ দেখলেই তিনি বলে দিতে পারেন ঠিক কতক্ষণ পরে বৃষ্টি হবে। বাতাসে কান পাতলেই তিনি বুঝতে পারেন, এবারের বর্ষায় বৃষ্টি কতটুকু হবে। পুরোপুরি না মিললেও এ হিসাব-নিকাশগুলো কৃষককে কৃষিকাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের এই সময়ে এসে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি কিংবা রোদ বদলে দিয়েছে কৃষকের এত বছরের প্রকৃতির পাঠ। শীতকাল ঠিক শীতকালের জায়গায় নেই, যেমন বর্ষা নেই বর্ষাকালে। ফলে কৃষকের বৈশাখও বদলে যাচ্ছে, বৈশাখও থাকছে না আর বৈশাখের জায়গায়। কৃষককেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের। বলতে হচ্ছে কৃষিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াসে দাঁড়াতে হবে কৃষকের পাশে।
প্রতি পয়লা বৈশাখে আমরা শহর বা নগরের মানুষেরা গ্রামীণ কৃষি ঐতিহ্যের যে চর্চা মনেপ্রাণে লালন করি, প্রদর্শন করি; বাংলাদেশের কৃষকও যেন আনন্দ নিয়ে তার বেঁচে থাকার মূল মমতার জায়গা ফসল ফলিয়ে সমস্বরে গাইতে পারে, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…’। সবাইকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
শাইখ সিরাজ, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, ঠিক তখন এই রাত পোহালেই পয়লা বৈশাখ, নতুন দিনের সূর্য উঠবে। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করবে দেশের ও প্রবাসের বাংলাদেশি মানুষ। আমাদের বৈশাখ উদ্যাপনের উপকরণগুলো হাজার বছরের কৃষক পরিবারের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। পান্তাভাত থেকে শুরু করে হাতপাখা, মাটির বাসন-কোসন, বাঁশের তৈরি ব্যবহার্য কিংবা কৃষকের সন্তানদের খেলার সরঞ্জামাদি বাঁশের বাঁশি, টেপাপুতুল। অথবা ঐতিহ্যের মণ্ডা-মিঠাই। ঐতিহ্যগতভাবেই আমরা কৃষকের সন্তান আর বাঙালিয়ানা বলতে যে গ্রামীণ কৃষকের যাপনকে বোঝায়, পয়লা বৈশাখ এলেই আমাদের উদ্যাপনে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমাদের অনেকেরই অজানা নয়, পয়লা বৈশাখের সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সারা বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয় মূলত কৃষিকাজের সুবিধার্থেই। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সন প্রবর্তন করেন তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে; অর্থাৎ ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে। বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হওয়ার আগে বাংলা সন ‘ফসলি সন’ নামেই পরিচিত ছিল। সে সময় বাংলার কৃষক চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীর খাজনা পরিশোধ করতেন। এ আচারকে বলা হতো পুণ্যাহ। ভূস্বামীরা পয়লা বৈশাখে কৃষককে মিষ্টিমুখ করাতেন। খোলা হতো নতুন বছরে খাজনার নতুন খাতা। এ থেকেই বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব হয়ে দাঁড়ায় হালখাতা। গ্রামগঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতে পুরোনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে খুলতেন নতুন হিসাবের খাতা। এ উপলক্ষে চলত উৎসব, মিষ্টিমুখ। মেলা বসত গ্রামে গ্রামে।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে ইরফান হাবিব রচিত ‘মুঘল ভারতের কৃষিব্যবস্থা’ বইটির কথা। সেখানে মোগল আমলের কৃষির যে চিত্র পাওয়া যায় তা সত্যি বিস্ময়কর। মোগল আমলে গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প। কৃষিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল নানা রকম কুটিরশিল্প। সে সময় থেকেই আখ ও তালের রস থেকে বিভিন্ন ধরনের চিনি তৈরি হতো। আবুল ফজল পাঁচ রকম চিনির কথা বলেছেন। চিনিশিল্পের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলা, আগ্রা ও লাহোরের মধ্যবর্তী এলাকা এবং গোলকুণ্ডা। এ অঞ্চল থেকে আরব, মেসোপটেমিয়া ও পারস্যে চিনি রপ্তানি হতো। ঘানিতে তেলবীজ থেকে তৈরি হতো তেল। সিন্ধু, গুজরাট, গোলকুণ্ডা, মহীশূর, ওডিশা ও বাংলায় এ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তামাকশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বুরহানপুর, বাংলা ও বিহার।
ভারতবর্ষেই তুলার চাষ হতো; বিশেষ করে বাংলা ছিল তুলা চাষের প্রধান আখড়া। কাপড় রং ও উজ্জ্বল করতে আগ্রা, ঢাকা, কাশিমবাজার, আহমেদাবাদ প্রভৃতি বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্রে নীলের চাহিদা ছিল। কৃষিজাত শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বস্ত্রবয়ন শিল্প। দেশজুড়ে বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরি হতো। বাংলার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি ছিল জগৎজুড়ে। ঢাকার মসলিন বস্ত্র ছিল খুব বিখ্যাত। পশম বা উলের জন্য বিখ্যাত ছিল কাবুল, কাশ্মীর ও পশ্চিম রাজস্থান। শণ ও পাটের তৈরি জিনিসও বহুল ব্যবহৃত হতো। ভারতের প্রায় সর্বত্র শণ উৎপাদন হতো। বাংলায় হতো পাটের চাষ। পাট দিয়ে তৈরি হতো দড়ি, বস্তা বা থলে। কাশিমবাজারের দড়ি ছিল বিখ্যাত। এই অঞ্চলের পাটের শাড়ির ছিল অন্য রকম কদর। সে সময়টা বলা চলে কৃষি ও কৃষকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি ও কৃষককে ঘিরেই সব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক শোষিত হলেও সমাজে কৃষকের সম্মান ছিল, ছিল অন্য রকম গ্রহণযোগ্যতা। কৃষকের পয়লা বৈশাখও ছিল আনন্দঘন এক ব্যাপার।
ইতিহাস বলে, কৃষক ভোক্তার কাছে সরাসরি যেতে না পারার কারণে বারবার শোষিত হয়েছেন। এ উপমহাদেশে বরাবর কৃষিবাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। আর এ কারণেই কৃষক হারাতে শুরু করেন তাঁর লাভের অঙ্ক। ইংরেজের শাসন আর জমিদারদের অব্যবস্থাপনায় বাংলার কৃষি ও কৃষক হারিয়ে ফেলেন তাঁর সুদিন। হাতের লাঙল ফেলে নিজের অধিকারের জন্য করতে হয় সংগ্রাম। কৃষকের পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক যন্ত্রণার নাম। এসব বইয়ে পড়া ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষককে দেখেছি খুব কাছ থেকে। প্রায় চার দশক ধরে কাজ করছি কৃষকদের নিয়ে। একটি দেশ যাত্রা শুরু করে কৃষিপ্রধান অর্থনীতি নিয়ে। সেখানে কৃষক মানেই হাড় জীর্ণ এক মানুষ। শত ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে। সেই কষ্ট জর্জরিত মানুষটিই ছিল মূল অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাঁর পয়লা বৈশাখ বলতে কিছুই ছিল না। পান্তা দিয়ে শুরু করা বছর শেষও হতো পান্তাতেই। সারা বছর লড়াই করতে হয়েছে একদিকে প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যদিকে মহাজনের সঙ্গে। গ্রামে চৈত্র মাস মানেই ছিল অভাবের এক সময়। সে সময়টায় গোলার ধান ফুরাত। ভাতের অভাবে বাজার থেকে কেনা আটার রুটি খেতে হতো। তখনো পয়লা বৈশাখ মানে কোনো আনন্দ নয়, বৈশাখ মানে আর কয়েক দিন পর উঠবে বোরো ফসল। থালা ভরা গরম ভাত তুলে দিতে পারবে সন্তানের পাতে। এটুকু ছিল সান্ত্বনার। আর কিছু নয়, ভাতের অভাবের অভিশাপ ছিল এক দশক আগেও। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে?
এখন সময় বদলেছে। বদলেছে কৃষি। একটা ছোট্ট প্রযুক্তি, উন্নত বীজ পাল্টে দিয়েছে সব। আগে ধান ফলাতে লাগত ১৪০ দিন। কার্তিক ও চৈত্রের শেষে ১০-১২ দিন খাদ্যাভাব দেখা দিত চরম আকারে। সে সময়টায় কর্মহীনতায় মঙ্গা হতো। এখন শর্ট ডিউরেশনের (স্বল্পমেয়াদি) ধানের জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ধান উৎপাদনে লাগছে ১১০ থেকে ১২০ দিন। কার্তিকের আগেই ধান উঠছে গোলায়। ফলে কার্তিকের মঙ্গা দূর হয়ে গেছে। বছরে এখন তিনটি ফসল চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। জাত উন্নয়ন করায় বেড়েছে ফলন। শুধু ধান আর পাটই নয়, কৃষক চাষ করছেন উচ্চফলনশীল ফল-ফসল। লাভের হিসাবটা কৃষক ঠিকই বুঝে গেছেন। বেশ সচেতন হয়ে উঠেছেন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে। কৃষকের খাবারের থালায় ভাতের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে শাক-সবজি, মাছ-মাংস আর ফল। পয়লা বৈশাখ মানে সত্যিই এখন আনন্দের।
এক মাস ধরে প্রাক্-বাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর জন্য আমাকে যেতে হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। কথা বলেছি হাজারো কৃষকের সঙ্গে। পাল্টে গেছে কৃষি ও কৃষকের সংজ্ঞা। পাল্টেছে কৃষকের ধ্যানধারণা। উৎপাদনের পাশাপাশি বাজার সম্পর্কেও কৃষক বেশ ভালো খোঁজখবর রাখেন। কখন কোন ফসল করলে লাভ বেশি পাওয়া যাবে, এ হিসাবটাও রাখছেন বুঝে-শুনেই। বাংলাদেশের কৃষকই নিজস্ব তাড়না থেকে সমৃদ্ধ করেছেন কৃষিকে।
তবে সংকটের অশনিসংকেত এখনো শুনতে পাই। সারা বিশ্বই ঝুঁকেছে প্রযুক্তির কৃষিতে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাতছানিতে পাল্টে যাচ্ছে বৈশ্বিক কৃষি। তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে ছিটকে পড়তে হবে আমাদের। নতুন দিনের কৃষিতে হিসাব কষে শিল্পকারখানার মেশিনের মতোই গাছ থেকে আসবে ফল-ফসল। মাছ চাষ থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষিই চলে আসছে বদ্ধ ঘরে। দিগন্তজোড়া কৃষি নয়, বরং কৃষির সম্প্রসারণ হচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী। নিশ্চিত লাভের উন্নত প্রযুক্তির এ কৃষিতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। তাই এতে বিনিয়োগ করবে বড় বড় শিল্পপতিরা। তৈরি পোশাক কারখানার মতোই কৃষির জমিগুলোয় গড়ে উঠবে কৃষি-শিল্প প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক তাঁদের নিজের জমিতে গড়ে ওঠা কৃষি-শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হবেন। প্রকৃত কৃষকের হাত থেকে কৃষি চলে যাবে কারখানায় যন্ত্রের কাছে। আমার আশঙ্কা হয়, এ সময়ের ভেতর কৃষকের হাত থেকে কৃষি সরে যাওয়ায় হাজার বছরের লব্ধ কৃষিজ্ঞান যেমন হারিয়ে ফেলবে, তেমনি হারিয়ে ফেলবে প্রাকৃতিক কৃষি-কৌশল। ভবিষ্যতের কৃষিতে এক গভীর বিপর্যয়ের আভাস আমি পাই। তাই এখন থেকেই এসব বিষয়ে কৃষককে সচেতন হতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এখন থেকেই হিসাব কষতে হবে আগামীর কৃষির। প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পিত কৃষি ব্যবস্থাপনা যেমন নিশ্চিত করতে পারে টেকসই উন্নয়নের, তেমনি ভাগ্য ফেরাতে পারে কৃষিসংশ্লিষ্ট সবার।
বলছিলাম কৃষকের পয়লা বৈশাখ নিয়ে। এ বিষয়ে আরও এক সংকটের কথা বলতে হচ্ছে। সারা বিশ্বকেই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, বিশেষ করে সমুদ্র-নিকটবর্তী দেশগুলো এর প্রভাব টের পাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। আমি মনে করি, কৃষকই সবচেয়ে বেশি প্রকৃতিমগ্ন। পেশাগত কারণেই প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ, যেমন রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সম্পর্কে সম্যক ধারণা তাঁকে রাখতেই হয়। যুগ যুগ ধরে পরম্পরায় পরিবেশ ও আবহাওয়া সম্পর্কে একধরনের জানা-বোঝা কৃষকের রয়েছে। আকাশ দেখলেই তিনি বলে দিতে পারেন ঠিক কতক্ষণ পরে বৃষ্টি হবে। বাতাসে কান পাতলেই তিনি বুঝতে পারেন, এবারের বর্ষায় বৃষ্টি কতটুকু হবে। পুরোপুরি না মিললেও এ হিসাব-নিকাশগুলো কৃষককে কৃষিকাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের এই সময়ে এসে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি কিংবা রোদ বদলে দিয়েছে কৃষকের এত বছরের প্রকৃতির পাঠ। শীতকাল ঠিক শীতকালের জায়গায় নেই, যেমন বর্ষা নেই বর্ষাকালে। ফলে কৃষকের বৈশাখও বদলে যাচ্ছে, বৈশাখও থাকছে না আর বৈশাখের জায়গায়। কৃষককেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের। বলতে হচ্ছে কৃষিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াসে দাঁড়াতে হবে কৃষকের পাশে।
প্রতি পয়লা বৈশাখে আমরা শহর বা নগরের মানুষেরা গ্রামীণ কৃষি ঐতিহ্যের যে চর্চা মনেপ্রাণে লালন করি, প্রদর্শন করি; বাংলাদেশের কৃষকও যেন আনন্দ নিয়ে তার বেঁচে থাকার মূল মমতার জায়গা ফসল ফলিয়ে সমস্বরে গাইতে পারে, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…’। সবাইকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
শাইখ সিরাজ, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে