বিভুরঞ্জন সরকার
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট কেমন হলো, তা এককথায় বলার মতো অর্থনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধি আমার না থাকলেও পেশাগত কারণে কিছু না কিছু লিখতেই হয়। সাধারণ মানুষের কাছে বাজেট মানে হলো জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি। বাজেটে কর বসানো ও কর অব্যাহতি দেওয়া একটি রুটিন বিষয়।
প্রতিবছরই বাজেট পেশের পরদিন সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় কোন কোন পণ্যের দাম কমবে আর কোন কোন পণ্যের দাম বাড়বে। যেসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা, সেগুলোর দাম ঠিকই বাড়ে, হয়তো যতটুকু বাড়ার কথা তার চেয়ে বেশিই বাড়ে। কিন্তু যেগুলোর দাম কমার কথা, সেগুলোর দাম আর কমে না। আমাদের ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াতে যতটা মুখিয়ে থাকেন, কমাতে ততটা নয়।
দেশে এখন আর কৃচ্ছ্রসাধনের রাজনীতি নেই, আছে সিন্ডিকেটের অক্টোপাস। এ অবস্থায় শহুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত রয়েছে সবচেয়ে সংকটে-শঙ্কায়। সমাজের এই অংশই মতামত প্রচারের প্রধান বাহন। এই সরকারের আমলে বিগত বছরগুলোতে মানুষ কতটা ভালো ছিল, কোভিড-দুর্যোগের সময় সরকার সংগত ও ভালো কাজ কতটুকু কী করেছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে কীভাবে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল; তা দিয়ে কিন্তু গণমানুষের মতামত ও প্রতিক্রিয়া আবর্তিত হবে না। সংকট ও শঙ্কা মানুষকে সমালোচনামুখর করে তুলছে।
এরই মধ্যে এসেছে বাজেট। তাই বাজেটের গণবান্ধব বা ভালো দিকগুলো যে আলোচনায় আসবে না এবং এলেও যে তা সংকট ও শঙ্কাগ্রস্ত মানুষ তেমনভাবে আমলে নেবে না, এমনটা বলাই বাহুল্য। দেশ রয়েছে রাজনৈতিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে। সরকারবিরোধী অংশ বাজেট প্রত্যাখ্যান করে সমালোচনা করবে, এটাই নিয়ম হয়ে আসছে।
বর্তমান সরকারবিরোধী প্রধান বিরোধী দল বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই বাজেটের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। কিন্তু তারা আয়নায় নিজেদের মুখ দেখছে না। বিশ্বব্যাপী সত্তরের মতো ‘ভয়াবহ মন্দা’ যখন ছিল না, তখন ক্ষমতায় থেকে তাঁরা কী বাজেট দিয়েছিল, তা তারা স্মরণে রাখছে না। তাদের আমলে কানসাটের গুলি কিংবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা এবং দেশ যে তখন ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’, ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রভৃতি তালিকায় উঠেছিল, তা দলটি ভুলে যেতে চাইছে।
সমাজে রয়েছে প্রভাবশালী সুশীল সমাজ, যা রাষ্ট্র ও সমাজের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যাঁদের একটা অংশ সোচ্চার থাকেন কখনো সমদূরত্বের নীতি নিয়ে, কখনো সরকারের ভালো কাজ তেমন বিবেচনার মধ্যে না নিয়ে সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা নিয়ে আলোচনামুখর হন এবং সেটাকেই একমাত্র কাজ বলে মনে করেন, এমনকি তাঁরা কিং মেকার বা কিং হতেও চান। এটা তাঁদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার দিক। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরাও কিন্তু সেনাবাহিনীর ওপর ভর করে দুই বছর দেশ চালিয়েছিলেন। তদুপরি তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিভিন্ন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। নিজেরা তখন কী করেছিলেন, তা তাঁদের আয়নায় দেখা উচিত। বাস্তবে সমাজের উচ্চস্তরে দুঃসময়ে ত্যাগ বা ধৈর্য নয়, ভোগেরই রাজত্ব চলছে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে।
সংবাদপত্রে ইতিমধ্যে বাজেটের ভালো ও খারাপ যে দিকগুলো বিভিন্নজন তুলে ধরেছেন, সংক্ষেপে সেগুলো এ রকম: সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। স্বাস্থ্য খাতে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্তটিও ইতিবাচক।
করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ নির্ধারণ কিছুটা কর ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে। বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক হ্রাস। বাজারে যেন তার প্রভাব পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এডিপির শীর্ষ পাঁচটি খাতের মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত উঠে এসেছে। এই দুই খাতের বরাদ্দ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
করপোরেট কর কমানো, বাজেটঘাটতি কম রাখা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অগ্রিম করহার অর্ধেক করা বাজেটের ভালো দিক।
ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে আবাসন খাত চাঙা হতে পারে। নির্মাণশিল্পের জন্য এটা ইতিবাচক। করপোরেট করহার কিছুটা কমানোয় স্বস্তি পাওয়া যাবে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্য উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বরাদ্দ আগের চেয়ে কমে যাওয়া শিল্পকারখানার জন্য উদ্বেগজনক।
মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে কোনো উদ্যোগ নেই বাজেটে। উল্টো কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে। মেট্রোরেলে যাতায়াত করলে দিতে হবে বাড়তি অর্থ। সরকার এগুলো এড়াতে পারত।
বাজেটঘাটতি পূরণে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীলতা। এবার ঘাটতি হবে জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ; এর মধ্যে ২ দশমিক ৫ শতাংশ আসবে ব্যাংকঋণ থেকে। এতে ব্যাংকের তারল্যে চাপ পড়বে। মধ্য মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলো বাস্তবসম্মত নয়।
অপ্রদর্শিত ও কালোটাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ। এটা নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অন্যায়; এর মধ্য দিয়ে সৎ করদাতাদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। এতে খুব বেশি করও আদায় হয় না।
শেয়ারবাজারের ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধনি মুনাফায় করারোপ করা। ফার্নেস অয়েল ও লুব্রিকেটিং অয়েলের শুল্ক মূল্য দ্বিগুণ করা। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সম্পর্কে কোনো লক্ষ্যমাত্রা ও দিকনির্দেশনা না থাকা।
নতুন করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ। বিনিয়োগের বিষয়ে কোনো লক্ষ্যমাত্রা ও দিকনির্দেশনা না থাকা। সরকারের পরিচালন ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি।
ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বাড়ছে। কিন্তু কাঁচামাল আমদানিতে করহার কমানো হয়নি। শিল্পপণ্যে উৎসে কর ও স্ক্র্যাপের নির্ধারিত আমদানি শুল্ক কমানো হয়নি।
ডলার-সংকট ও ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। বাজেটে এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কোনো পদক্ষেপ নেই। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারের আবারও ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা।
৭ জুন বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন মূল্যস্ফীতি ও কালোটাকা সাদা করা নিয়ে। তিনি সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ে। এ সময় তিনি কেবল আশ্বাসই দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব পদক্ষেপই নিয়েছি। আর পদক্ষেপ নিয়েছি বলেই তা ৯ শতাংশের ঘরে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা-ও পর্যালোচনা করছি। অপেক্ষা করুন, ছয় মাস পর মূল্যস্ফীতি কমতে থাকবে।’
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহলে সংশয় আছে। তাঁরা বরং বলছেন, সাধারণ মানুষের ওপর থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য বাজেটে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আশা করা হলেও তা হয়নি। এ ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। এসব উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। বাজেট পাসের আগে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানানো হয়েছে।
বাজেটে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। অথচ গত মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। তাই বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবভিত্তিক, সেটি যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ।
সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমে আসছে, আমরা সেভাবে কমাতে পারছি না। তাই আমরা আশা করেছিলাম বর্তমানে দেশে ১২টির মতো সম্পূরক শুল্কের যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জরুরি কিছু পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানো হলে তাতে উৎপাদন খরচ কমত। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কাস্টমসের যেসব পদক্ষেপ রয়েছে, সেগুলোর কয়েকটির বিষয়ে বাজেটে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেগুলো কীভাবে ও কবে থেকে বাস্তবায়ন করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই।
শেষ কথা এটাই যে আজ পর্যন্ত যত সরকার যত বাজেট দিয়েছে, কোনো বাজেটকেই কি গরিব বাঁচানোর বাজেট বলে কেউ অভিহিত করেছে? যাঁরা সরকারে থেকে বাজেট দেন, তাঁরা অবশ্য বাজেটকে গরিবের বাজেট না বললেও সুষম বাজেট বলে দাবি করেন। আবার যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা বাজেটকে গরিব মারার বাজেট বলে সমালোচনা করে থাকেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট ৬ জুন জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে, এটাও এর বাইরে নয়। বাজেট নিয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা-ও গতানুগতিক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, গাজায় গণহত্যা এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখন অর্থনৈতিক মন্দা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হয়েছে। এর হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানো যায়নি। এহেন বৈশ্বিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এই বাজেট দিয়েছে। এ বাজেট খুব বড় বাজেট নয়। কিন্তু দেশের উন্নয়নটা যেন অব্যাহত থাকে, সেদিকে লক্ষ রেখেই বাজেটটা প্রণয়ন করা হয়েছে। বাজেটে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, যাতে এসব ক্ষেত্রে না আসে।
কিন্তু অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বাজেটের কারণে পদে পদে খরচ বাড়বে, তাই জনজীবনে চাপ ও অস্বস্তিও কমবে না। তারপরও অবশ্যই জীবন থেমে থাকবে না। সংসদে পেশ হওয়া বাজেট নিয়ে অনেক কথা হবে। তর্ক-বিতর্ক হবে। তারপর এই বাজেট পাসও হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট কেমন হলো, তা এককথায় বলার মতো অর্থনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধি আমার না থাকলেও পেশাগত কারণে কিছু না কিছু লিখতেই হয়। সাধারণ মানুষের কাছে বাজেট মানে হলো জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি। বাজেটে কর বসানো ও কর অব্যাহতি দেওয়া একটি রুটিন বিষয়।
প্রতিবছরই বাজেট পেশের পরদিন সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় কোন কোন পণ্যের দাম কমবে আর কোন কোন পণ্যের দাম বাড়বে। যেসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা, সেগুলোর দাম ঠিকই বাড়ে, হয়তো যতটুকু বাড়ার কথা তার চেয়ে বেশিই বাড়ে। কিন্তু যেগুলোর দাম কমার কথা, সেগুলোর দাম আর কমে না। আমাদের ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াতে যতটা মুখিয়ে থাকেন, কমাতে ততটা নয়।
দেশে এখন আর কৃচ্ছ্রসাধনের রাজনীতি নেই, আছে সিন্ডিকেটের অক্টোপাস। এ অবস্থায় শহুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত রয়েছে সবচেয়ে সংকটে-শঙ্কায়। সমাজের এই অংশই মতামত প্রচারের প্রধান বাহন। এই সরকারের আমলে বিগত বছরগুলোতে মানুষ কতটা ভালো ছিল, কোভিড-দুর্যোগের সময় সরকার সংগত ও ভালো কাজ কতটুকু কী করেছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে কীভাবে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল; তা দিয়ে কিন্তু গণমানুষের মতামত ও প্রতিক্রিয়া আবর্তিত হবে না। সংকট ও শঙ্কা মানুষকে সমালোচনামুখর করে তুলছে।
এরই মধ্যে এসেছে বাজেট। তাই বাজেটের গণবান্ধব বা ভালো দিকগুলো যে আলোচনায় আসবে না এবং এলেও যে তা সংকট ও শঙ্কাগ্রস্ত মানুষ তেমনভাবে আমলে নেবে না, এমনটা বলাই বাহুল্য। দেশ রয়েছে রাজনৈতিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে। সরকারবিরোধী অংশ বাজেট প্রত্যাখ্যান করে সমালোচনা করবে, এটাই নিয়ম হয়ে আসছে।
বর্তমান সরকারবিরোধী প্রধান বিরোধী দল বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই বাজেটের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। কিন্তু তারা আয়নায় নিজেদের মুখ দেখছে না। বিশ্বব্যাপী সত্তরের মতো ‘ভয়াবহ মন্দা’ যখন ছিল না, তখন ক্ষমতায় থেকে তাঁরা কী বাজেট দিয়েছিল, তা তারা স্মরণে রাখছে না। তাদের আমলে কানসাটের গুলি কিংবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা এবং দেশ যে তখন ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’, ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রভৃতি তালিকায় উঠেছিল, তা দলটি ভুলে যেতে চাইছে।
সমাজে রয়েছে প্রভাবশালী সুশীল সমাজ, যা রাষ্ট্র ও সমাজের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যাঁদের একটা অংশ সোচ্চার থাকেন কখনো সমদূরত্বের নীতি নিয়ে, কখনো সরকারের ভালো কাজ তেমন বিবেচনার মধ্যে না নিয়ে সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা নিয়ে আলোচনামুখর হন এবং সেটাকেই একমাত্র কাজ বলে মনে করেন, এমনকি তাঁরা কিং মেকার বা কিং হতেও চান। এটা তাঁদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার দিক। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরাও কিন্তু সেনাবাহিনীর ওপর ভর করে দুই বছর দেশ চালিয়েছিলেন। তদুপরি তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিভিন্ন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। নিজেরা তখন কী করেছিলেন, তা তাঁদের আয়নায় দেখা উচিত। বাস্তবে সমাজের উচ্চস্তরে দুঃসময়ে ত্যাগ বা ধৈর্য নয়, ভোগেরই রাজত্ব চলছে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে।
সংবাদপত্রে ইতিমধ্যে বাজেটের ভালো ও খারাপ যে দিকগুলো বিভিন্নজন তুলে ধরেছেন, সংক্ষেপে সেগুলো এ রকম: সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। স্বাস্থ্য খাতে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্তটিও ইতিবাচক।
করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ নির্ধারণ কিছুটা কর ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে। বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক হ্রাস। বাজারে যেন তার প্রভাব পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এডিপির শীর্ষ পাঁচটি খাতের মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত উঠে এসেছে। এই দুই খাতের বরাদ্দ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
করপোরেট কর কমানো, বাজেটঘাটতি কম রাখা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অগ্রিম করহার অর্ধেক করা বাজেটের ভালো দিক।
ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে আবাসন খাত চাঙা হতে পারে। নির্মাণশিল্পের জন্য এটা ইতিবাচক। করপোরেট করহার কিছুটা কমানোয় স্বস্তি পাওয়া যাবে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্য উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বরাদ্দ আগের চেয়ে কমে যাওয়া শিল্পকারখানার জন্য উদ্বেগজনক।
মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে কোনো উদ্যোগ নেই বাজেটে। উল্টো কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে। মেট্রোরেলে যাতায়াত করলে দিতে হবে বাড়তি অর্থ। সরকার এগুলো এড়াতে পারত।
বাজেটঘাটতি পূরণে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীলতা। এবার ঘাটতি হবে জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ; এর মধ্যে ২ দশমিক ৫ শতাংশ আসবে ব্যাংকঋণ থেকে। এতে ব্যাংকের তারল্যে চাপ পড়বে। মধ্য মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলো বাস্তবসম্মত নয়।
অপ্রদর্শিত ও কালোটাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ। এটা নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অন্যায়; এর মধ্য দিয়ে সৎ করদাতাদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। এতে খুব বেশি করও আদায় হয় না।
শেয়ারবাজারের ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধনি মুনাফায় করারোপ করা। ফার্নেস অয়েল ও লুব্রিকেটিং অয়েলের শুল্ক মূল্য দ্বিগুণ করা। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সম্পর্কে কোনো লক্ষ্যমাত্রা ও দিকনির্দেশনা না থাকা।
নতুন করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ। বিনিয়োগের বিষয়ে কোনো লক্ষ্যমাত্রা ও দিকনির্দেশনা না থাকা। সরকারের পরিচালন ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি।
ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বাড়ছে। কিন্তু কাঁচামাল আমদানিতে করহার কমানো হয়নি। শিল্পপণ্যে উৎসে কর ও স্ক্র্যাপের নির্ধারিত আমদানি শুল্ক কমানো হয়নি।
ডলার-সংকট ও ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। বাজেটে এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কোনো পদক্ষেপ নেই। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারের আবারও ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা।
৭ জুন বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন মূল্যস্ফীতি ও কালোটাকা সাদা করা নিয়ে। তিনি সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ে। এ সময় তিনি কেবল আশ্বাসই দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব পদক্ষেপই নিয়েছি। আর পদক্ষেপ নিয়েছি বলেই তা ৯ শতাংশের ঘরে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা-ও পর্যালোচনা করছি। অপেক্ষা করুন, ছয় মাস পর মূল্যস্ফীতি কমতে থাকবে।’
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহলে সংশয় আছে। তাঁরা বরং বলছেন, সাধারণ মানুষের ওপর থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য বাজেটে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আশা করা হলেও তা হয়নি। এ ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। এসব উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। বাজেট পাসের আগে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানানো হয়েছে।
বাজেটে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। অথচ গত মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। তাই বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবভিত্তিক, সেটি যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ।
সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমে আসছে, আমরা সেভাবে কমাতে পারছি না। তাই আমরা আশা করেছিলাম বর্তমানে দেশে ১২টির মতো সম্পূরক শুল্কের যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জরুরি কিছু পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানো হলে তাতে উৎপাদন খরচ কমত। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কাস্টমসের যেসব পদক্ষেপ রয়েছে, সেগুলোর কয়েকটির বিষয়ে বাজেটে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেগুলো কীভাবে ও কবে থেকে বাস্তবায়ন করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই।
শেষ কথা এটাই যে আজ পর্যন্ত যত সরকার যত বাজেট দিয়েছে, কোনো বাজেটকেই কি গরিব বাঁচানোর বাজেট বলে কেউ অভিহিত করেছে? যাঁরা সরকারে থেকে বাজেট দেন, তাঁরা অবশ্য বাজেটকে গরিবের বাজেট না বললেও সুষম বাজেট বলে দাবি করেন। আবার যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা বাজেটকে গরিব মারার বাজেট বলে সমালোচনা করে থাকেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট ৬ জুন জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে, এটাও এর বাইরে নয়। বাজেট নিয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা-ও গতানুগতিক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, গাজায় গণহত্যা এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখন অর্থনৈতিক মন্দা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হয়েছে। এর হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানো যায়নি। এহেন বৈশ্বিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এই বাজেট দিয়েছে। এ বাজেট খুব বড় বাজেট নয়। কিন্তু দেশের উন্নয়নটা যেন অব্যাহত থাকে, সেদিকে লক্ষ রেখেই বাজেটটা প্রণয়ন করা হয়েছে। বাজেটে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, যাতে এসব ক্ষেত্রে না আসে।
কিন্তু অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বাজেটের কারণে পদে পদে খরচ বাড়বে, তাই জনজীবনে চাপ ও অস্বস্তিও কমবে না। তারপরও অবশ্যই জীবন থেমে থাকবে না। সংসদে পেশ হওয়া বাজেট নিয়ে অনেক কথা হবে। তর্ক-বিতর্ক হবে। তারপর এই বাজেট পাসও হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে