সেলিম জাহান
অমর একুশে আমার কাছে বহুমাত্রিক। একটি ছাঁচে তাকে পরিস্ফুটিত করা যাবে না আমার কাছে। একুশের তিনটি মাত্রিকতা আমার অন্তরে বড় বেশি বাঙ্ময়–একটি স্মৃতির, একটি বোধের এবং একটি অঙ্গীকারের। একুশে ফেব্রুয়ারির একটি স্মৃতি আমার হৃদয়ে তৈরি হয়েছে। প্রতিটি একুশেতেই সেই স্মৃতি আমার কাছে ফিরে আসে, আমি উদ্বেলিত হই। অমর একুশ আমার চেতনায় একটি বোধেরও জন্ম দিয়েছে, যেটা থেকে আমি অনুপ্রাণিত হই, শক্তি অর্জন করি। একুশের আমার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি একটি সুপ্রথিত অঙ্গীকারেরও জন্ম হয়েছে—আমার চিন্তায়, কর্মে সে অঙ্গীকারের প্রতিফলন সতত।
একুশের যে শৈশব স্মৃতি আমার মনে গেঁথে আছে, তা হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি। বরিশালের সেই শীতের সকাল। এমন পাঁচটি শীতের সকালে বিছানা ছাড়তে বড় অনীহা। শুধু এবং একমাত্র ওই একুশের সকাল ভিন্ন। তার আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুমাতে পারি না। উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম কখন প্রভাত হবে আর কখন বন্ধুরা এসে ডাকবে।
তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হতো। বন্ধুরা এসে ডাক দিত, আর আমি বেরোতাম ঘরের বাইরে। নগ্নপদ, বন্ধুদের মুখে মৃদু হাসি, হাতে ফুলের গুচ্ছ। চারদিকে মৃদু কুয়াশা, ভোরের আলো ফুটছে—বড় পবিত্র চারপাশ। তারপর সবাই মিলে নগ্নপদে যাত্রা শুরু শহীদ মিনারের দিকে। আমাদের কচিকণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ সেই কৈশোরের একুশে ফেব্রুয়ারির বহু কথাই মনে নেই, কিন্তু প্রভাতফেরি স্মৃতি আজও ভুলিনি।
কেউ বলেনি, কেউ নির্দেশ দেয়নি, কেউ সাজায়নি, কিন্তু সেই প্রথম থেকেই একুশ উদ্যাপনের সবচেয়ে পবিত্রতম দিক ছিল প্রভাতফেরি–একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরের আলো ফুটলেই স্বতঃস্ফূর্ত নগ্ন পদযাত্রা মানুষের শহীদ মিনারের উদ্দেশে। কেউ একা একা, কেউ পরিবার নিয়ে, কখনো-বা যূথবদ্ধভাবে। ভোরের আলো ফুটছে, মানুষের শান্ত মিছিল চলছে ধীর পায়ে শহীদ মিনারের প্রতি, পুরুষদের পরিধানে পায়জামা-পাঞ্জাবি, নারীদের সাদা শাড়ি, কালো পাড়। হাতে ফুলের মালা, পুষ্পস্তবক। শিশুরাও আছে মা-বাবার হাত ধরে, তাদের কচি হাতেও ফুল।
সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’? সে অমর গান ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে-বাতাসে। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে আবেগে, সে গানের অনুরণন আমাদের প্রতি রোমকূপে, সে এক অন্য অনুভূতি।
বড় মায়ায়, অনেক শ্রদ্ধায় আমরা হাতের ফুল নামিয়ে রাখছি মিনারের বেদিতে। না, ধাক্কাধাক্কি নেই, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা নেই, ছবি তোলার উদ্দামতায় একুশকে অবমাননা করার কোনো প্রচেষ্টা নেই। শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর গোরস্থান শহীদদের সমাধিস্থলে। সেখানেও সারিবদ্ধ মানুষ ধীর নগ্ন পদযাত্রায়। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ছাপ প্রত্যেক মানুষের মুখে একটি পবিত্র কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায়।
আজিমপুর থেকে গন্তব্যস্থল বাংলা একাডেমি। সেখানে বসেছে আলোচনা, গান আর কবিতাপাঠের আসর বটবৃক্ষের তলায়। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে এখানে-ওখানে। অনুষ্ঠান চলছে কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম না মেনেই। মানুষ আসছে, মানুষ যাচ্ছে, উপভোগ করছে গান, কবিতা, কথা বলা।
আমাদের কৈশোরে-যৌবনে এটাই তো দেখেছি একুশে ফেব্রুয়ারিতে। বাহুল্য নেই, বাণিজ্যিকতা নেই, রাজনীতি নেই; আছে শুধু ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর মমতা, বাংলা ভাষার প্রতি অপার মায়া আর নিজের ভাষার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরিতে যাওয়া আমাদের কাছে ছিল প্রার্থনার মতো। বড় পবিত্র সে নগ্ন পদযাত্রা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি সে প্রভাতফেরিতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর ছাত্রজীবনে দেখেছি সে প্রভাতফেরিতে। একুশ শুরুই হতো প্রভাতফেরি দিয়ে। সেই প্রভাতফেরির আমেজ পেতে চাইলে বর্তমান প্রজন্ম শহীদ জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি দেখতে পারেন।
আমি বহুকাল প্রভাতফেরিতে যাই না। আসলে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে একুশ শুরু হলে তার আর কোনো প্রভাতফেরি থাকে না। আমরা ভুলে যাই, মধ্যরাতে দিনের শুরু পাশ্চাত্য কায়দায়, প্রাচ্যে দিনের শুরু সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। বাঙালির দিনের শুরু উষালগ্নে।
বোধের আঙ্গিকে যদি দেখি, একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য আমার কাছে তিনটি—একটি স্মৃতির, একটি অবদানের এবং অন্যটি শক্তির।
প্রথমত, যেমনটা বলেছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমার জন্য একটি স্মৃতির জায়গা। ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি এক বছরের শিশু। সুতরাং বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আমার কোনো প্রত্যক্ষ স্মৃতি নেই। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির একটি স্মৃতি আমি আমার জন্য আমার মনে তৈরি করেছি।
সে স্মৃতি তৈরি হয়েছে ইতিহাস আর স্মৃতিচারণা পড়ে, ওই সময়কার নানা ছবি দেখে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে। সেই সঙ্গে আমার নিজের মায়াময় স্মৃতি আছে নানান বছরে বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে খুব ভোরের নগ্নপদে প্রভাতফেরি, সবাই মিলে সেই কালজয়ী সংগীত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ গাইবার, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক নামিয়ে রাখার। সেই গান এখনো আমার ধমনিতে এক অনুরণন তোলে, আমি শিহরিত হই। আমি দেখিনি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি আমার আছে।
দ্বিতীয়ত, একুশে ফেব্রুয়ারির একটি অবদানের দিক আমাকে সদাই আন্দোলিত করে। একুশ শুধু আমাদের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রাম ছিল আমাদের সব আন্দোলনের, সব লড়াইয়ের, সব দাবির অনুপ্রেরণা-উৎস।
একুশের হাত ধরেই হয়েছে চুয়ান্নর সংগ্রাম, বাষট্টির আন্দোলন, তার অনুপ্রেরণায় জন্মলাভ করেছে ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরে আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। বায়ান্নর একুশে যে পথযাত্রার শুরু, তার সমাপ্তি ঘটেছে ১৯৭১-এ। এই পথযাত্রার প্রতিটি ফলকে আমরা একুশ থেকে শিক্ষা নিয়েছি, একুশ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি, আমাদের সব সংকটকালে বারবার ফিরে গিয়েছি একুশের কাছে, একুশ আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনে।
তৃতীয়ত, একুশ আমাকে এক অনন্য শক্তি দেয়। যখনই ভাবি যে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একদল মানুষ তাঁদের জীবন দিয়েছেন, তখন এক-ধরনের শক্তি আমি অনুভব করি। পৃথিবীতে নানান দেশে মানুষ স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ বিসর্জন করেছে, কিন্তু শুধু ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে বাংলাদেশ ভিন্ন এমন উদাহরণ আর শুধু ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে ঘটেছে। এ সত্যটি আমাকে উদ্বুদ্ধ করে।
আমি ভাবি আগামী দিনগুলোতে যেকোনো সংকটে, যেকোনো বিপর্যয়ে, যেকোনো সংগ্রামে একুশ আমাদের শক্তি জোগাবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামে, তারা শক্তি খুঁজে পাবে একুশের কাছে। আমরা বারবার ফিরে যাব একুশের কাছে।
উপর্যুক্ত দুটো কারণে ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি আমি অঙ্গীকারবদ্ধ হই। কৈশোর থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিটি ভাষার একটা নিজস্ব প্রাণ, সত্তা ও শক্তি আছে। বাংলা ভাষাও তার ব্যত্যয় নয়। বাংলা শুধু আবেগের ভাষা নয়, বেগের ভাষাও বটে। শৈশব ও কৈশোরে বাংলা বই ও পত্রপত্রিকা পড়ে বাংলা ভাষার প্রাণ, সত্তা ও শক্তির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। পড়তাম প্রচুর এবং পড়ার সে স্বাধীনতার ক্ষেত্রটি পারিবারিক পরিবেশই তৈরি করে দিয়েছিল।
এই সবকিছুই আমার জন্য বাংলা ভাষার একটি শক্ত ভিত্তিভূমি তৈরি করার প্রয়াসে সাহায্য করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাংলা পঠন ও ব্যবহারের দিগন্ত প্রসারিত হয়েছিল। একদিকে এপার বাংলা-ওপার বাংলার বিভিন্ন লেখকের বই-গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ-গোগ্রাসে গিলেছি। ‘দেশ’ পত্রিকা পড়তে শুরু করি সে সময়ে। নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানগুলো– মল্লিক ব্রাদার্স, ওয়ার্সী বুক সেন্টার, নলেজ হোম, মহিউদ্দীন অ্যান্ড সন্স; স্টেডিয়ামের ম্যারিয়টা, বাংলা বাজারের বইয়ের দোকানগুলোতে আমার ছিল নিত্য আনাগোনা। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিতর্কের শুরু তো আমাদের দিয়েই। বিজয়ী হয়েছি আন্তহল ও আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। শাণিত করেছি বাংলায় বলার অভ্যাস।
আশির দশকে তিনটি জিনিস আমার বাংলা চর্চাকে বেগবান করেছে। প্রথমত, রেডিও ও টেলিভিশনে নিজস্ব অনুষ্ঠান ও উপস্থাপনা বাংলায় সাবলীল বলাকে সামনে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকতা বহু শক্ত ও প্রায়োগিক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ উদ্ভাবন করতে সাহায্য করেছে। তৃতীয়ত, পত্রপত্রিকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখার ফলে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে সাবলীলতা এসেছে।
মোদ্দাকথা, বাংলা ভাষার প্রতি অঙ্গীকার, চর্চা ও মমতাই বাংলায় বলা ও লেখার ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে আমাকে প্রতিনিয়ত সাহায্য করেছে। একটি সচেতন প্রয়াস নিয়ে আমি বাংলা ব্যবহারে ব্রতী হয়েছি এবং অবিরত সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় এবং কর্মক্ষেত্রে ও দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ব্যবহারের সুযোগ আমার কম। সে জন্যই নির্ভুল বাংলায় বক্তব্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আমি আরও যত্নবান হই সতত। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি নতুন নতুন বাংলা প্রতিশব্দ বের করতে এবং সেটাকে জনপ্রিয় করতে।
সব সময় মনে রাখি যে বাংলা ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ যখনই যেখানে শুনি, শিহরিত হই। মাতৃভাষার জন্য শহীদ হওয়ার এ রকম দৃষ্টান্ত আর বেশি নেই। ‘আমি কি সে কথা ভুলিতে পারি’? সেই চেতনাই তো আমাকে প্রতি ক্ষণে, প্রতি পলে উদ্বুদ্ধ করে আমার হৃদয়ের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে, কারণ চূড়ান্ত বিচারে সেটাই আমার প্রতিজ্ঞা, আমার ভালোবাসা, আমার গর্ব।
একুশ আমাদের মুক্তি দিয়েছিল–মুক্তি দিয়েছিল চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রভাষার শৃঙ্খল থেকে। কিন্তু সেই মুক্তিদাত্রী একুশকে আজ আমরা বন্দী করেছি বাণিজ্যিকতায়, লৌকিকতায়, স্থূলতায়, আনুষ্ঠানিকতায়, আত্মপ্রচারে। আমরা নষ্ট করেছি তার স্বতঃস্ফূর্ততা, তার গাম্ভীর্য আর তার পবিত্রতা। এবারের একুশের সকালে আমার একটিই আকুল আবেদন, ‘একুশকে মুক্তি দিন সব আরোপিত কৃত্রিম শৃঙ্খল থেকে’। একুশ আমার ঐতিহ্য, আমার অহংকার, আমার প্রেরণা এবং একুশ থাকুক আমাদের নিরন্তর শক্তির উৎস হয়ে।
অমর একুশে আমার কাছে বহুমাত্রিক। একটি ছাঁচে তাকে পরিস্ফুটিত করা যাবে না আমার কাছে। একুশের তিনটি মাত্রিকতা আমার অন্তরে বড় বেশি বাঙ্ময়–একটি স্মৃতির, একটি বোধের এবং একটি অঙ্গীকারের। একুশে ফেব্রুয়ারির একটি স্মৃতি আমার হৃদয়ে তৈরি হয়েছে। প্রতিটি একুশেতেই সেই স্মৃতি আমার কাছে ফিরে আসে, আমি উদ্বেলিত হই। অমর একুশ আমার চেতনায় একটি বোধেরও জন্ম দিয়েছে, যেটা থেকে আমি অনুপ্রাণিত হই, শক্তি অর্জন করি। একুশের আমার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি একটি সুপ্রথিত অঙ্গীকারেরও জন্ম হয়েছে—আমার চিন্তায়, কর্মে সে অঙ্গীকারের প্রতিফলন সতত।
একুশের যে শৈশব স্মৃতি আমার মনে গেঁথে আছে, তা হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি। বরিশালের সেই শীতের সকাল। এমন পাঁচটি শীতের সকালে বিছানা ছাড়তে বড় অনীহা। শুধু এবং একমাত্র ওই একুশের সকাল ভিন্ন। তার আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুমাতে পারি না। উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম কখন প্রভাত হবে আর কখন বন্ধুরা এসে ডাকবে।
তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হতো। বন্ধুরা এসে ডাক দিত, আর আমি বেরোতাম ঘরের বাইরে। নগ্নপদ, বন্ধুদের মুখে মৃদু হাসি, হাতে ফুলের গুচ্ছ। চারদিকে মৃদু কুয়াশা, ভোরের আলো ফুটছে—বড় পবিত্র চারপাশ। তারপর সবাই মিলে নগ্নপদে যাত্রা শুরু শহীদ মিনারের দিকে। আমাদের কচিকণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ সেই কৈশোরের একুশে ফেব্রুয়ারির বহু কথাই মনে নেই, কিন্তু প্রভাতফেরি স্মৃতি আজও ভুলিনি।
কেউ বলেনি, কেউ নির্দেশ দেয়নি, কেউ সাজায়নি, কিন্তু সেই প্রথম থেকেই একুশ উদ্যাপনের সবচেয়ে পবিত্রতম দিক ছিল প্রভাতফেরি–একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরের আলো ফুটলেই স্বতঃস্ফূর্ত নগ্ন পদযাত্রা মানুষের শহীদ মিনারের উদ্দেশে। কেউ একা একা, কেউ পরিবার নিয়ে, কখনো-বা যূথবদ্ধভাবে। ভোরের আলো ফুটছে, মানুষের শান্ত মিছিল চলছে ধীর পায়ে শহীদ মিনারের প্রতি, পুরুষদের পরিধানে পায়জামা-পাঞ্জাবি, নারীদের সাদা শাড়ি, কালো পাড়। হাতে ফুলের মালা, পুষ্পস্তবক। শিশুরাও আছে মা-বাবার হাত ধরে, তাদের কচি হাতেও ফুল।
সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’? সে অমর গান ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে-বাতাসে। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে আবেগে, সে গানের অনুরণন আমাদের প্রতি রোমকূপে, সে এক অন্য অনুভূতি।
বড় মায়ায়, অনেক শ্রদ্ধায় আমরা হাতের ফুল নামিয়ে রাখছি মিনারের বেদিতে। না, ধাক্কাধাক্কি নেই, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা নেই, ছবি তোলার উদ্দামতায় একুশকে অবমাননা করার কোনো প্রচেষ্টা নেই। শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর গোরস্থান শহীদদের সমাধিস্থলে। সেখানেও সারিবদ্ধ মানুষ ধীর নগ্ন পদযাত্রায়। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ছাপ প্রত্যেক মানুষের মুখে একটি পবিত্র কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায়।
আজিমপুর থেকে গন্তব্যস্থল বাংলা একাডেমি। সেখানে বসেছে আলোচনা, গান আর কবিতাপাঠের আসর বটবৃক্ষের তলায়। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে এখানে-ওখানে। অনুষ্ঠান চলছে কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম না মেনেই। মানুষ আসছে, মানুষ যাচ্ছে, উপভোগ করছে গান, কবিতা, কথা বলা।
আমাদের কৈশোরে-যৌবনে এটাই তো দেখেছি একুশে ফেব্রুয়ারিতে। বাহুল্য নেই, বাণিজ্যিকতা নেই, রাজনীতি নেই; আছে শুধু ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর মমতা, বাংলা ভাষার প্রতি অপার মায়া আর নিজের ভাষার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরিতে যাওয়া আমাদের কাছে ছিল প্রার্থনার মতো। বড় পবিত্র সে নগ্ন পদযাত্রা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি সে প্রভাতফেরিতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর ছাত্রজীবনে দেখেছি সে প্রভাতফেরিতে। একুশ শুরুই হতো প্রভাতফেরি দিয়ে। সেই প্রভাতফেরির আমেজ পেতে চাইলে বর্তমান প্রজন্ম শহীদ জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি দেখতে পারেন।
আমি বহুকাল প্রভাতফেরিতে যাই না। আসলে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে একুশ শুরু হলে তার আর কোনো প্রভাতফেরি থাকে না। আমরা ভুলে যাই, মধ্যরাতে দিনের শুরু পাশ্চাত্য কায়দায়, প্রাচ্যে দিনের শুরু সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। বাঙালির দিনের শুরু উষালগ্নে।
বোধের আঙ্গিকে যদি দেখি, একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য আমার কাছে তিনটি—একটি স্মৃতির, একটি অবদানের এবং অন্যটি শক্তির।
প্রথমত, যেমনটা বলেছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমার জন্য একটি স্মৃতির জায়গা। ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি এক বছরের শিশু। সুতরাং বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আমার কোনো প্রত্যক্ষ স্মৃতি নেই। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির একটি স্মৃতি আমি আমার জন্য আমার মনে তৈরি করেছি।
সে স্মৃতি তৈরি হয়েছে ইতিহাস আর স্মৃতিচারণা পড়ে, ওই সময়কার নানা ছবি দেখে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে। সেই সঙ্গে আমার নিজের মায়াময় স্মৃতি আছে নানান বছরে বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে খুব ভোরের নগ্নপদে প্রভাতফেরি, সবাই মিলে সেই কালজয়ী সংগীত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ গাইবার, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক নামিয়ে রাখার। সেই গান এখনো আমার ধমনিতে এক অনুরণন তোলে, আমি শিহরিত হই। আমি দেখিনি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি আমার আছে।
দ্বিতীয়ত, একুশে ফেব্রুয়ারির একটি অবদানের দিক আমাকে সদাই আন্দোলিত করে। একুশ শুধু আমাদের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রাম ছিল আমাদের সব আন্দোলনের, সব লড়াইয়ের, সব দাবির অনুপ্রেরণা-উৎস।
একুশের হাত ধরেই হয়েছে চুয়ান্নর সংগ্রাম, বাষট্টির আন্দোলন, তার অনুপ্রেরণায় জন্মলাভ করেছে ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরে আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। বায়ান্নর একুশে যে পথযাত্রার শুরু, তার সমাপ্তি ঘটেছে ১৯৭১-এ। এই পথযাত্রার প্রতিটি ফলকে আমরা একুশ থেকে শিক্ষা নিয়েছি, একুশ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি, আমাদের সব সংকটকালে বারবার ফিরে গিয়েছি একুশের কাছে, একুশ আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনে।
তৃতীয়ত, একুশ আমাকে এক অনন্য শক্তি দেয়। যখনই ভাবি যে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একদল মানুষ তাঁদের জীবন দিয়েছেন, তখন এক-ধরনের শক্তি আমি অনুভব করি। পৃথিবীতে নানান দেশে মানুষ স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ বিসর্জন করেছে, কিন্তু শুধু ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে বাংলাদেশ ভিন্ন এমন উদাহরণ আর শুধু ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে ঘটেছে। এ সত্যটি আমাকে উদ্বুদ্ধ করে।
আমি ভাবি আগামী দিনগুলোতে যেকোনো সংকটে, যেকোনো বিপর্যয়ে, যেকোনো সংগ্রামে একুশ আমাদের শক্তি জোগাবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামে, তারা শক্তি খুঁজে পাবে একুশের কাছে। আমরা বারবার ফিরে যাব একুশের কাছে।
উপর্যুক্ত দুটো কারণে ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি আমি অঙ্গীকারবদ্ধ হই। কৈশোর থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিটি ভাষার একটা নিজস্ব প্রাণ, সত্তা ও শক্তি আছে। বাংলা ভাষাও তার ব্যত্যয় নয়। বাংলা শুধু আবেগের ভাষা নয়, বেগের ভাষাও বটে। শৈশব ও কৈশোরে বাংলা বই ও পত্রপত্রিকা পড়ে বাংলা ভাষার প্রাণ, সত্তা ও শক্তির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। পড়তাম প্রচুর এবং পড়ার সে স্বাধীনতার ক্ষেত্রটি পারিবারিক পরিবেশই তৈরি করে দিয়েছিল।
এই সবকিছুই আমার জন্য বাংলা ভাষার একটি শক্ত ভিত্তিভূমি তৈরি করার প্রয়াসে সাহায্য করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাংলা পঠন ও ব্যবহারের দিগন্ত প্রসারিত হয়েছিল। একদিকে এপার বাংলা-ওপার বাংলার বিভিন্ন লেখকের বই-গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ-গোগ্রাসে গিলেছি। ‘দেশ’ পত্রিকা পড়তে শুরু করি সে সময়ে। নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানগুলো– মল্লিক ব্রাদার্স, ওয়ার্সী বুক সেন্টার, নলেজ হোম, মহিউদ্দীন অ্যান্ড সন্স; স্টেডিয়ামের ম্যারিয়টা, বাংলা বাজারের বইয়ের দোকানগুলোতে আমার ছিল নিত্য আনাগোনা। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিতর্কের শুরু তো আমাদের দিয়েই। বিজয়ী হয়েছি আন্তহল ও আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। শাণিত করেছি বাংলায় বলার অভ্যাস।
আশির দশকে তিনটি জিনিস আমার বাংলা চর্চাকে বেগবান করেছে। প্রথমত, রেডিও ও টেলিভিশনে নিজস্ব অনুষ্ঠান ও উপস্থাপনা বাংলায় সাবলীল বলাকে সামনে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকতা বহু শক্ত ও প্রায়োগিক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ উদ্ভাবন করতে সাহায্য করেছে। তৃতীয়ত, পত্রপত্রিকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখার ফলে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে সাবলীলতা এসেছে।
মোদ্দাকথা, বাংলা ভাষার প্রতি অঙ্গীকার, চর্চা ও মমতাই বাংলায় বলা ও লেখার ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে আমাকে প্রতিনিয়ত সাহায্য করেছে। একটি সচেতন প্রয়াস নিয়ে আমি বাংলা ব্যবহারে ব্রতী হয়েছি এবং অবিরত সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় এবং কর্মক্ষেত্রে ও দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ব্যবহারের সুযোগ আমার কম। সে জন্যই নির্ভুল বাংলায় বক্তব্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আমি আরও যত্নবান হই সতত। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি নতুন নতুন বাংলা প্রতিশব্দ বের করতে এবং সেটাকে জনপ্রিয় করতে।
সব সময় মনে রাখি যে বাংলা ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ যখনই যেখানে শুনি, শিহরিত হই। মাতৃভাষার জন্য শহীদ হওয়ার এ রকম দৃষ্টান্ত আর বেশি নেই। ‘আমি কি সে কথা ভুলিতে পারি’? সেই চেতনাই তো আমাকে প্রতি ক্ষণে, প্রতি পলে উদ্বুদ্ধ করে আমার হৃদয়ের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে, কারণ চূড়ান্ত বিচারে সেটাই আমার প্রতিজ্ঞা, আমার ভালোবাসা, আমার গর্ব।
একুশ আমাদের মুক্তি দিয়েছিল–মুক্তি দিয়েছিল চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রভাষার শৃঙ্খল থেকে। কিন্তু সেই মুক্তিদাত্রী একুশকে আজ আমরা বন্দী করেছি বাণিজ্যিকতায়, লৌকিকতায়, স্থূলতায়, আনুষ্ঠানিকতায়, আত্মপ্রচারে। আমরা নষ্ট করেছি তার স্বতঃস্ফূর্ততা, তার গাম্ভীর্য আর তার পবিত্রতা। এবারের একুশের সকালে আমার একটিই আকুল আবেদন, ‘একুশকে মুক্তি দিন সব আরোপিত কৃত্রিম শৃঙ্খল থেকে’। একুশ আমার ঐতিহ্য, আমার অহংকার, আমার প্রেরণা এবং একুশ থাকুক আমাদের নিরন্তর শক্তির উৎস হয়ে।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে