মামুনুর রশীদ
এত দ্রুত সবকিছু ঘটবে ভাবতে পারিনি। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও নিয়মিত দেশে কালবৈশাখী হতো। পয়লা বৈশাখের মেলায় বারবারই হানা দিতে দেখেছি কালবৈশাখীকে। এ যেন প্রকৃতির এক অমোঘ নীতি। বৈশাখের ২ তারিখ থেকে ঘরে ঘরে একটা প্রশান্তি। এই প্রশান্তি চলত বেশ কিছুদিন। তারপর আবার গরম এবং আবারও ঝড়। জ্যৈষ্ঠ মাসে গরম প্রয়োজন হতো। কারণ, আম পাকতে হবে, কাঁঠাল গ্রীষ্মের অপেক্ষা করে। কিন্তু আষাঢ় আবার বর্ষণে প্রকৃতিকে ভরিয়ে দিত। শ্রাবণ এক অনিঃশেষ বৃষ্টি। এই দুই মাস বাংলার লোকজীবনে সৃষ্টিশীলতার একটা জোয়ার বইত—শুধু আষাঢ়ে গল্প নয়, নানান ধরনের গান, কবিতা, লোককাহিনি নির্মাণ, মুখে মুখে গল্প, গান বানানো। সেই সঙ্গে নানা ফলফলাদির সমারোহ, বকুল ফুলে ছড়িয়ে থাকে বাংলার আঙিনা। তারপর শরৎ আসে, হেমন্ত আসে, শীত আসে, বসন্ত আসে।
এসব প্রাকৃতিক চক্র ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। হঠাৎ করে ফাল্গুনে টানা বৃষ্টি, বসন্ত হারিয়ে গেল অথচ বৈশাখে বৃষ্টির প্রার্থনা করলে ঝড়ও এল না। জলবায়ু দ্রুতবেগে মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠল। অথচ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেও দেখেছি শীতের আমেজ। সাতই মার্চে রমনা রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়ে একটা হাফ সোয়েটার পরেছিলাম। ষাটের দশকে মধুপুরের পাহাড়ের বনজঙ্গলের মধ্যে বাঘের গন্ধ পেয়েছি। বন্য শূকর এসে ফসলের খেতে হানা দিয়েছে। বাড়ির কাছে পাহাড়ের মধ্যে লাল পথ দেখেছি, নারীর মাথার সিঁথির মতো।
আরও অনেক কিছুই প্রাকৃতিক ছিল, বাংলাদেশের অনেক অনেক অঞ্চলে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম তো বটেই। মধুপুরের গজারি বন প্রলম্বিত হয়ে ঢাকায় এসে লালমাটিতে বিলীন হতো। আর এই বন পাহাড়ের রক্ষাকর্তা ছিল সেখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা। ক্রমে ক্রমে সত্তরের দশকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে কোনো এক ম্যাজিকের মাধ্যমে উধাও করে দেওয়া হলো। সেই ম্যাজিকটা ঘটিয়েছিল বন বিভাগের কিছু অসৎ লোক, যাদের হাত পাকা শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকেই। তারপর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা কিছু স্বাধীনতাবিরোধী দুর্বৃত্ত। তাদের সঙ্গে কিছু বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধাও ছিল। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বন আইনে নানান ধরনের মামলা দেওয়া হয়, ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং সত্যিকারের বন রক্ষকেরা এই পরিস্থিতিকে হারিয়ে দেয়।
পঁচাত্তরের পর সেনাশাসকেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধাবস্থাকে আরও বেগবান করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জায়গায় বহিরাগতদের পুনর্বাসন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল্যবান কাঠগুলো এই সময়ে পাচার হতো। সেই সঙ্গে নির্দয়ভাবে কাটা হয় গজারি বন। পাহাড়কে পাহাড় কেটে সমতল ভূমি তৈরি করা হয় এবং সেই প্রক্রিয়া আজও বহাল আছে। বড় বড় হাইওয়ে নির্মাণের সময় এবং খোদ ঢাকা শহরে শতবর্ষী গাছগুলোকে নির্দয়ভাবে কেটে ফেলা হয়। ঢাকা শহরের নিরাপত্তার কারণে বড় গাছগুলো কেটে কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলো, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
পাশাপাশি খাল, বিল, পুকুর ভরাট করা শুরু হয়। সেসব জায়গায় ঘরবাড়ি, হাট-বাজার, শপিং মল নির্মাণ করে ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। তখন নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা নিদারুণভাবে কমতে থাকে। এরপর নদীর জায়গা লুণ্ঠন শুরু হয়। নদীর দুই ধারে ক্ষমতাসীনেরা বড় বড় স্থাপনা গড়ে তোলে, নদী সংকুচিত হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নদী, খাল শুকিয়ে যেতে থাকে। আজ সবাই বাতাসের আর্দ্রতা নেই বলে আহাজারি করছে। এই আর্দ্রতার যে উৎস, সেগুলোই তো শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। শুরু হয়েছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় দাবদাহ।
একটু বৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম শহরে পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থাও অনুরূপ। জলাশয় পৃথিবীর সব দেশেই কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এগুলো রাষ্ট্রের সম্পত্তি। কিন্তু এখানে কোনো জনপ্রতিরোধের সৃষ্টি হয় না। ক্ষমতার কাছে বাধ্য হয়ে সবাই আত্মসমর্পণ করে। যেকোনো সরকার ক্ষমতায় এসেই নদীর জায়গা, রেলওয়ের জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালায়, কিন্তু কিছু দূর গিয়েই এই অভিযান মুখ থুবড়ে পড়ে। এই অভিযানগুলো শতভাগ সফল হলে দেশের বৃহৎ একটি অংশ জনগণের সম্পদ হিসেবে মুক্ত হতে পারে।
মোগল আমলে সমগ্র জলাধার রাষ্ট্রের সম্পত্তি ছিল এবং সমগ্র সেচব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রের হাতে। ফলে ফসলের জন্য পানির কোনো সংকট হতো না। ব্রিটিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নদ-নদী, জলাশয় তথা যে সেচব্যবস্থা ছিল, তা ভেঙে দেয়। ফলে পাঞ্জাব এবং অন্যান্য জায়গায় ব্যাপক ফসলহানি হয়ে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। এত কিছুর পরেও এই সুজলা-শ্যামলা বঙ্গ দেশের কৃষক বুকের তাজা রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে কৃষি উৎপাদনকে অত্যন্ত সফলভাবে চালিয়ে গেছেন। যার কারণে শায়েস্তা খাঁর আমল থেকে একেবারে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত টাকায় আট মণ থেকে তিন মণ চালে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশের লুণ্ঠন-প্রক্রিয়ায় যখন মানুষকে টাকায় ছয় সের চাল কিনতে হয়েছে, তখন ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটে এবং লাখ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে।
বর্তমানে আবার দুর্ভিক্ষের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশি প্রযুক্তির ফলে মাটির নিচের পানি ব্যবহার করে মোটামুটি মাটিকে পানিশূন্য করে তুলেছে। চীনারা বাংলাদেশকে হাইড্রোলিক মুড অব প্রডাকশন বলে অভিহিত করে, যার বাংলা দাঁড়ায় কৃষিতে পানিবাহিত উৎপাদনব্যবস্থা। বৃষ্টির পানি এই অঞ্চলের একটা বড় সম্পদ, যেখানে বছরে প্রায় নয় মাসই বৃষ্টি হয়। রাজস্থানে যেখানে বৃষ্টি হয় মাত্র নয় দিন। গ্রামাঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো অমানবিক প্রকল্প করে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে, যার কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় একদা প্রচুর খাল ছিল, যেখানে সারা বছরই পানির একটা স্বাভাবিক প্রবাহ ছিল। এখানে আইয়ুব খানের আমলে বিদেশি সাহায্য নিয়ে খালগুলো বন্ধ করে পানির প্রবাহকে রুদ্ধ করে ঢাকা শহরকে একধরনের জলাবদ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে অতি নিকটে সমুদ্র থাকা সত্ত্বেও জলাবদ্ধতা একটা গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতি বিধ্বংসী এত সব কার্যকলাপের কথা দেশের বিজ্ঞ রাজনীতিক, প্রকৌশলী, আমলা, বিশেষজ্ঞ সবাই জানেন। পানি বিশেষজ্ঞরা হরহামেশাই আমস্টারডাম শহরে যান। যে শহরটাই সমুদ্রের নিচে এবং অসংখ্য খালের আশীর্বাদপুষ্ট। সেসব দেখে এসেও এসব বিজ্ঞজন নিজের দেশের পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উদ্যোগ না নিয়ে একটা লুটপাটের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। পাকিস্তান আমলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জলহস্তী বলা হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রচুর অর্থ লগ্নি করেও পানি উন্নয়ন বোর্ড তেমন কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
সবকিছুতেই আমরা বিলম্ব করে ফেলছি। বারবার ট্রেন ফেল করে বাংলাদেশের পানির ক্ষেত্রে অগ্রগতি প্রায় শূন্যের কোঠায়। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল অংশকে ডুবিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সেখানে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কী অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সরকার ভালোভাবেই জানে। সমস্যা হচ্ছে সরকার এবং তার আমলাতন্ত্র কখনোই নাগরিকদের কথা কর্ণপাত করে না, নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধিকেই সর্বোচ্চ মেধা বলে বিবেচনা করে। কিন্তু ওই আমলা বা সরকারি বিশেষজ্ঞ একটা বয়সের পর পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে বিদায় নেন আর পেছনে রেখে যান রাষ্ট্রের সর্বনাশ। রাজনীতিবিদেরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না, সম্পূর্ণ নির্ভর করেন আমলা ও সরকারি বিশেষজ্ঞদের ওপর। নতুন জ্ঞানের কোনো গুরুত্বই তাঁরা দেন না। জ্ঞান যে প্রতিনিয়ত পুরোনো হয়ে যায়, এই সত্যকেও তাঁরা বিশ্বাস করেন না। মান্ধাতা আমলের সঞ্চিত জ্ঞানটুকু দিয়ে আমলারা চাকরিজীবন পার করে দেন। সে জন্যই পানি ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং নগর-পরিকল্পনায় কারোরই তেমন আগ্রহ থাকে না।
ঢাকা ও অন্যান্য শহরে আধুনিক নগর-পরিকল্পনার কোনোই আভাস পাওয়া যায় না। এত দিন পরে সরকার ভেবেছে এ দেশে রেললাইন দরকার। একদিকে বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ, অন্যদিকে অতিরিক্ত অটোমোবাইল ব্যবহারে প্রতিদিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। এত দিন পরে তবু এ ভাবনাটা উপস্থিত হওয়ায় কিছু মানবসন্তান হয়তো স্বস্তি পাবে। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণে বিশাল বিশাল প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল রাস্তায় নামছে, সেটাকেও যে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার—এই ক্ষুদ্র বুদ্ধিটুকু আমাদের সরকারের মাথায় ঢোকে না। গাড়ি নামালেই সরকার ট্যাক্স পায়। সেটাকেই বড় করে দেখানো হয় রাজস্ব আয় হিসেবে।
কিন্তু যানজট, শহর বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ আমলে নিতে তারা বড়ই কুণ্ঠাবোধ করে; বরং নির্বাচন, ক্ষমতায় থাকা এসবই যেন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থা থেকে আমরা যদি মুক্তি না পাই, তাহলে বড় বড় অট্টালিকা দাঁড়িয়ে থাকবে, পথঘাটগুলো হবে বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত, পরবর্তী প্রজন্ম একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কোনোমতে বেঁচে থাকবে। সেই অবস্থা কি আমরা চাই?
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
এত দ্রুত সবকিছু ঘটবে ভাবতে পারিনি। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও নিয়মিত দেশে কালবৈশাখী হতো। পয়লা বৈশাখের মেলায় বারবারই হানা দিতে দেখেছি কালবৈশাখীকে। এ যেন প্রকৃতির এক অমোঘ নীতি। বৈশাখের ২ তারিখ থেকে ঘরে ঘরে একটা প্রশান্তি। এই প্রশান্তি চলত বেশ কিছুদিন। তারপর আবার গরম এবং আবারও ঝড়। জ্যৈষ্ঠ মাসে গরম প্রয়োজন হতো। কারণ, আম পাকতে হবে, কাঁঠাল গ্রীষ্মের অপেক্ষা করে। কিন্তু আষাঢ় আবার বর্ষণে প্রকৃতিকে ভরিয়ে দিত। শ্রাবণ এক অনিঃশেষ বৃষ্টি। এই দুই মাস বাংলার লোকজীবনে সৃষ্টিশীলতার একটা জোয়ার বইত—শুধু আষাঢ়ে গল্প নয়, নানান ধরনের গান, কবিতা, লোককাহিনি নির্মাণ, মুখে মুখে গল্প, গান বানানো। সেই সঙ্গে নানা ফলফলাদির সমারোহ, বকুল ফুলে ছড়িয়ে থাকে বাংলার আঙিনা। তারপর শরৎ আসে, হেমন্ত আসে, শীত আসে, বসন্ত আসে।
এসব প্রাকৃতিক চক্র ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। হঠাৎ করে ফাল্গুনে টানা বৃষ্টি, বসন্ত হারিয়ে গেল অথচ বৈশাখে বৃষ্টির প্রার্থনা করলে ঝড়ও এল না। জলবায়ু দ্রুতবেগে মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠল। অথচ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেও দেখেছি শীতের আমেজ। সাতই মার্চে রমনা রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়ে একটা হাফ সোয়েটার পরেছিলাম। ষাটের দশকে মধুপুরের পাহাড়ের বনজঙ্গলের মধ্যে বাঘের গন্ধ পেয়েছি। বন্য শূকর এসে ফসলের খেতে হানা দিয়েছে। বাড়ির কাছে পাহাড়ের মধ্যে লাল পথ দেখেছি, নারীর মাথার সিঁথির মতো।
আরও অনেক কিছুই প্রাকৃতিক ছিল, বাংলাদেশের অনেক অনেক অঞ্চলে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম তো বটেই। মধুপুরের গজারি বন প্রলম্বিত হয়ে ঢাকায় এসে লালমাটিতে বিলীন হতো। আর এই বন পাহাড়ের রক্ষাকর্তা ছিল সেখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা। ক্রমে ক্রমে সত্তরের দশকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে কোনো এক ম্যাজিকের মাধ্যমে উধাও করে দেওয়া হলো। সেই ম্যাজিকটা ঘটিয়েছিল বন বিভাগের কিছু অসৎ লোক, যাদের হাত পাকা শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকেই। তারপর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা কিছু স্বাধীনতাবিরোধী দুর্বৃত্ত। তাদের সঙ্গে কিছু বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধাও ছিল। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বন আইনে নানান ধরনের মামলা দেওয়া হয়, ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং সত্যিকারের বন রক্ষকেরা এই পরিস্থিতিকে হারিয়ে দেয়।
পঁচাত্তরের পর সেনাশাসকেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধাবস্থাকে আরও বেগবান করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জায়গায় বহিরাগতদের পুনর্বাসন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল্যবান কাঠগুলো এই সময়ে পাচার হতো। সেই সঙ্গে নির্দয়ভাবে কাটা হয় গজারি বন। পাহাড়কে পাহাড় কেটে সমতল ভূমি তৈরি করা হয় এবং সেই প্রক্রিয়া আজও বহাল আছে। বড় বড় হাইওয়ে নির্মাণের সময় এবং খোদ ঢাকা শহরে শতবর্ষী গাছগুলোকে নির্দয়ভাবে কেটে ফেলা হয়। ঢাকা শহরের নিরাপত্তার কারণে বড় গাছগুলো কেটে কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলো, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
পাশাপাশি খাল, বিল, পুকুর ভরাট করা শুরু হয়। সেসব জায়গায় ঘরবাড়ি, হাট-বাজার, শপিং মল নির্মাণ করে ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। তখন নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা নিদারুণভাবে কমতে থাকে। এরপর নদীর জায়গা লুণ্ঠন শুরু হয়। নদীর দুই ধারে ক্ষমতাসীনেরা বড় বড় স্থাপনা গড়ে তোলে, নদী সংকুচিত হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নদী, খাল শুকিয়ে যেতে থাকে। আজ সবাই বাতাসের আর্দ্রতা নেই বলে আহাজারি করছে। এই আর্দ্রতার যে উৎস, সেগুলোই তো শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। শুরু হয়েছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় দাবদাহ।
একটু বৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম শহরে পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থাও অনুরূপ। জলাশয় পৃথিবীর সব দেশেই কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এগুলো রাষ্ট্রের সম্পত্তি। কিন্তু এখানে কোনো জনপ্রতিরোধের সৃষ্টি হয় না। ক্ষমতার কাছে বাধ্য হয়ে সবাই আত্মসমর্পণ করে। যেকোনো সরকার ক্ষমতায় এসেই নদীর জায়গা, রেলওয়ের জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালায়, কিন্তু কিছু দূর গিয়েই এই অভিযান মুখ থুবড়ে পড়ে। এই অভিযানগুলো শতভাগ সফল হলে দেশের বৃহৎ একটি অংশ জনগণের সম্পদ হিসেবে মুক্ত হতে পারে।
মোগল আমলে সমগ্র জলাধার রাষ্ট্রের সম্পত্তি ছিল এবং সমগ্র সেচব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রের হাতে। ফলে ফসলের জন্য পানির কোনো সংকট হতো না। ব্রিটিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নদ-নদী, জলাশয় তথা যে সেচব্যবস্থা ছিল, তা ভেঙে দেয়। ফলে পাঞ্জাব এবং অন্যান্য জায়গায় ব্যাপক ফসলহানি হয়ে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। এত কিছুর পরেও এই সুজলা-শ্যামলা বঙ্গ দেশের কৃষক বুকের তাজা রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে কৃষি উৎপাদনকে অত্যন্ত সফলভাবে চালিয়ে গেছেন। যার কারণে শায়েস্তা খাঁর আমল থেকে একেবারে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত টাকায় আট মণ থেকে তিন মণ চালে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশের লুণ্ঠন-প্রক্রিয়ায় যখন মানুষকে টাকায় ছয় সের চাল কিনতে হয়েছে, তখন ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটে এবং লাখ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে।
বর্তমানে আবার দুর্ভিক্ষের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশি প্রযুক্তির ফলে মাটির নিচের পানি ব্যবহার করে মোটামুটি মাটিকে পানিশূন্য করে তুলেছে। চীনারা বাংলাদেশকে হাইড্রোলিক মুড অব প্রডাকশন বলে অভিহিত করে, যার বাংলা দাঁড়ায় কৃষিতে পানিবাহিত উৎপাদনব্যবস্থা। বৃষ্টির পানি এই অঞ্চলের একটা বড় সম্পদ, যেখানে বছরে প্রায় নয় মাসই বৃষ্টি হয়। রাজস্থানে যেখানে বৃষ্টি হয় মাত্র নয় দিন। গ্রামাঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো অমানবিক প্রকল্প করে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে, যার কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় একদা প্রচুর খাল ছিল, যেখানে সারা বছরই পানির একটা স্বাভাবিক প্রবাহ ছিল। এখানে আইয়ুব খানের আমলে বিদেশি সাহায্য নিয়ে খালগুলো বন্ধ করে পানির প্রবাহকে রুদ্ধ করে ঢাকা শহরকে একধরনের জলাবদ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে অতি নিকটে সমুদ্র থাকা সত্ত্বেও জলাবদ্ধতা একটা গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতি বিধ্বংসী এত সব কার্যকলাপের কথা দেশের বিজ্ঞ রাজনীতিক, প্রকৌশলী, আমলা, বিশেষজ্ঞ সবাই জানেন। পানি বিশেষজ্ঞরা হরহামেশাই আমস্টারডাম শহরে যান। যে শহরটাই সমুদ্রের নিচে এবং অসংখ্য খালের আশীর্বাদপুষ্ট। সেসব দেখে এসেও এসব বিজ্ঞজন নিজের দেশের পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উদ্যোগ না নিয়ে একটা লুটপাটের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। পাকিস্তান আমলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জলহস্তী বলা হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রচুর অর্থ লগ্নি করেও পানি উন্নয়ন বোর্ড তেমন কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
সবকিছুতেই আমরা বিলম্ব করে ফেলছি। বারবার ট্রেন ফেল করে বাংলাদেশের পানির ক্ষেত্রে অগ্রগতি প্রায় শূন্যের কোঠায়। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল অংশকে ডুবিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সেখানে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কী অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সরকার ভালোভাবেই জানে। সমস্যা হচ্ছে সরকার এবং তার আমলাতন্ত্র কখনোই নাগরিকদের কথা কর্ণপাত করে না, নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধিকেই সর্বোচ্চ মেধা বলে বিবেচনা করে। কিন্তু ওই আমলা বা সরকারি বিশেষজ্ঞ একটা বয়সের পর পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে বিদায় নেন আর পেছনে রেখে যান রাষ্ট্রের সর্বনাশ। রাজনীতিবিদেরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না, সম্পূর্ণ নির্ভর করেন আমলা ও সরকারি বিশেষজ্ঞদের ওপর। নতুন জ্ঞানের কোনো গুরুত্বই তাঁরা দেন না। জ্ঞান যে প্রতিনিয়ত পুরোনো হয়ে যায়, এই সত্যকেও তাঁরা বিশ্বাস করেন না। মান্ধাতা আমলের সঞ্চিত জ্ঞানটুকু দিয়ে আমলারা চাকরিজীবন পার করে দেন। সে জন্যই পানি ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং নগর-পরিকল্পনায় কারোরই তেমন আগ্রহ থাকে না।
ঢাকা ও অন্যান্য শহরে আধুনিক নগর-পরিকল্পনার কোনোই আভাস পাওয়া যায় না। এত দিন পরে সরকার ভেবেছে এ দেশে রেললাইন দরকার। একদিকে বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ, অন্যদিকে অতিরিক্ত অটোমোবাইল ব্যবহারে প্রতিদিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। এত দিন পরে তবু এ ভাবনাটা উপস্থিত হওয়ায় কিছু মানবসন্তান হয়তো স্বস্তি পাবে। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণে বিশাল বিশাল প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল রাস্তায় নামছে, সেটাকেও যে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার—এই ক্ষুদ্র বুদ্ধিটুকু আমাদের সরকারের মাথায় ঢোকে না। গাড়ি নামালেই সরকার ট্যাক্স পায়। সেটাকেই বড় করে দেখানো হয় রাজস্ব আয় হিসেবে।
কিন্তু যানজট, শহর বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ আমলে নিতে তারা বড়ই কুণ্ঠাবোধ করে; বরং নির্বাচন, ক্ষমতায় থাকা এসবই যেন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থা থেকে আমরা যদি মুক্তি না পাই, তাহলে বড় বড় অট্টালিকা দাঁড়িয়ে থাকবে, পথঘাটগুলো হবে বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত, পরবর্তী প্রজন্ম একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কোনোমতে বেঁচে থাকবে। সেই অবস্থা কি আমরা চাই?
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে