মফিদুল হক
সংস্কৃতি ও তার পরিবর্তনময়তা নিয়ে বাঙালি ভাবুকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন গোপাল হালদার। তাঁর ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ বইটি বহুল পঠিত ও আলোচিত। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন এবং বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেই মোড়-ফেরার কালে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে টেলিভিশনে আলাপচারিতায় মিলিত হয়েছিলেন। তাঁদের আলোচ্য ছিল ‘ভাবী বাঙালির আবির্ভাব’। এমন বিষয় নির্ধারণের মধ্য দিয়েই বুঝতে পারা যায় বিজয়ী বাংলাদেশের ভাবজগতে তখন কী বিশাল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। স্থির প্রত্যয়ী উত্তর কেউ জোগাতে পারুক কিংবা না পারুক, জিজ্ঞাসা সেখানে ছিল মুখ্য। আজ যখন আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে অর্ধশতকের অতিক্রান্ত পথের পর্যালোচনা থেকে নিজেদের সাংস্কৃতিক অবস্থান বুঝে নিতে চাইছি, তখন ১৯৭৪ সালের সেই আলোচনাকে একটা যুগচিহ্ন হিসেবে ধরে নিতে পারি। কলকাতায় ফিরে গিয়ে ‘বাংলাদেশের এক বন্ধুর উদ্দেশে’ শীর্ষক পত্রনিবন্ধ লিখেছিলেন গোপাল হালদার। সেখানে তাঁর মুখের কথা কিছুটা গুছিয়ে লিখিতভাবে দাখিলের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। শামসুর রাহমানের প্রশ্ন ছিল, পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ যখন একই ‘বাঙালি সংস্কৃতির’ ধারক, তখন বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলে পৃথক কোনো সংস্কৃতি থাকবে কি, না তা মিলিয়ে যাবে বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে।
৫০ বছর পর উত্তরটি এখন আমাদের জানা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি তার নিজস্ব রূপ-রস-রং-গন্ধ নিয়ে বিকশিত হয়ে চলছে, যেমনটি পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রেও অন্যভাবে দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতির বিবর্তনে আস্থাশীল গোপাল হালদার ভবিষ্যদ্দ্রষ্টার মতো কিছু কথা বলেছিলেন, যা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গদেশ সামান্য একটা অঞ্চল নয়, প্রাকৃতিক সম্পদেও একরঙা নয়, মানবিক সম্পর্কেও একরঙা নয়। রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ-বিধৃত এই বঙ্গভূমিও রূপে-রসে অপরূপ। শুধু রাঙামাটির রাঢ়ই বাংলা নয়, শুধু কলকাতা নিয়ে কিংবা ঢাকা নিয়েই নয় বাঙালি সম্পূর্ণ।’
এই যে বৈচিত্র্যের আবাহন, সেখানে তো নতুন আরও অনেক উপাদান যুক্ত হয়েছে, মিলনে-মিশ্রণে-সৃজনে সংস্কৃতি নানা রূপে যা প্রবাহিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সেখানে যুক্ত করবে নতুন মাত্রা—এমন প্রত্যাশা ছিল গোপাল হালদারের। বাংলাদেশের সংস্কৃতি সমগ্র বাঙালি সংস্কৃতিকেই জোগাবে নতুন পরিপুষ্টি ও প্রণোদনা। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের মানব-সম্পদ,—তার মাঝি-মাল্লা, তার সমুদ্রগামী সারেং, জাহাজি, তার প্রাণবন্ত চাষী—এসবের জীবনকথা ও আত্মার স্বপ্ন,—এসব বাংলাদেশের শিল্পসৃষ্টিতে দেবে সত্যিকারের প্রাণসম্পদ,—আর যে প্রাণসম্পদে আমাদের সমগ্র বাঙালি পাবে বিশিষ্ট এক ঐশ্বর্ষ, আরও বিচিত্র প্রকাশ।’
পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপে আমরা আটক ছিলাম প্রায় ২৩ বছর। এর বিপরীতে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ও সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির আপন সত্তানুসন্ধান এবং জাতিসত্তা ও ধর্মপরিচয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রচনা করে সম্প্রীতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বাঙালির সেই সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে আমরা বিকাশের পথ তৈরির অবকাশ বিশেষ পাইনি। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রাচার থেকে চার জাতীয় মূল নীতির অপনোদন দেশকে চালিত করল ভিন্ন পথে। ধর্মের মোড়কে আবারও সামাজিক স্থিতির বিনাশ এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক চিন্তার আধিপত্য কায়েমে চলে রাষ্ট্রীয় প্রয়াস।
বিরূপ সময়েও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে এই লড়াই নানাভাবে পরিচালনা করেছে, বাঙালি সংস্কৃতির সৃজনধারায় যার নানা প্রকাশ আমরা দেখি। যদি মোটাদাগে বাংলাদেশের সংস্কৃতির পরিবর্তনময়তা বিচার করতে চাই, তবে একে আমরা নবযাত্রাই বলতে পারি। পুরোনো ধ্যানধারণা, সাম্প্রদায়িক ভেদচিন্তা, দ্বিজাতিতত্ত্বের হাতিয়ার নিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সঞ্চার নানাভাবে জাতিকে পথভ্রষ্ট করতে চাইছে। ৫০ বছরে তার প্রকাশ এবং সংঘাত ও হিংসাত্মক আক্রমণের উদাহরণ তো অজস্র। তবে এই নিরিখে পরিবর্তনময়তাও বিশেষভাবে তলিয়ে দেখার রয়েছে। স্বাধীনতার একুশ বছর পর দেশে ফিরেছিলেন দীর্ঘকালের প্রবাসী আদ্যোপান্ত বাঙালি ও বাংলার সংস্কৃতিসাধক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁর স্বদেশ-অবলোকনের কথা তিনি বলেছিলেন আত্মজৈবনিক ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’ গ্রন্থে। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এক মাস দেশে কাটিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘সতেরো বছর বিদেশে বাস করে মনে একটা ভয় জন্মেছিল, দেশে ফিরে গিয়ে হয়তো দেখব দেশটা মোল্লা ও মাস্তানদের খপ্পরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আমার এই আশঙ্কা পুরোপুরি সত্য হয়নি।’ তবে সবচেয়ে বড়ভাবে তাঁকে নাড়া দিয়েছিল বাংলাদেশের সামাজিক রূপান্তর, যার কেন্দ্রে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন নারীর অবস্থান। এই উপলব্ধি মেলে ধরে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে একটা নীরব সামাজিক বিপ্লব খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আর এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছে গ্রামীণ সমাজ-জীবন ভেঙে পড়ায় ঘর, পর্দা, পরিবার ও সমাজ থেকে বেরিয়ে আসা হাজার হাজার গৃহবধূ ও গৃহকন্যা—এবং স্কুল ও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে বেরিয়ে আসা মেয়েদের একটা সচেতন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত ও রাগী অংশ।’
সেই অবলোকনের পর আরও দুই দশক পেরিয়ে গেলেও দেখা যায়, একই লড়াইয়ে শরিক রয়েছে বাংলাদেশ। টালমাটাল এই অভিযাত্রায় অর্জনের ক্ষেত্রগুলো অনেক সময় আশু ও চলমান সংঘাতের কারণে রয়ে যায় দৃষ্টিসীমার আড়ালে। এর বড় দিক হলো, সংস্কৃতির বিস্তার ও বৈচিত্র্য, যা বহন করে জাগরণ ও সৃষ্টিশীলতার বীজ। সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখা ডালপালা নতুন প্রসারতা পাচ্ছে, যেখানে বাঙালির সংগ্রাম ও মুক্তির চেতনা অর্জন করছে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের রচনাভান্ডার হিসেবে পৃথক এক ঘরানা গড়ে উঠেছে, যেটা স্বাধীনতাসংগ্রামকারী খুব কম দেশেই মিলবে। এই ধারা যে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও বহমান, তা আশাজাগানিয়া বৈকি। তেমনিভাবে পারফর্মিং আর্টসের সব শাখাতেই আমরা দেখি প্রসারতা। তবে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, প্রসারতার তুলনায় গভীরতা তো তেমনভাবে দৃশ্যগোচর হচ্ছে না। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্মিলিতভাবে এ প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নিতে পারে। তবে গভীরতা নির্ভর করবে ব্যক্তির সাধনা ও সৃজনের ওপর। প্রসারতা থেকে জাগ্রত হবে সেই প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ।
এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের দিক থেকে ঘাটতি রয়েছে অনেক। সংস্কৃতির অবদান জিডিপি কিংবা প্রবৃদ্ধির সূচকে পরিমাপযোগ্য নয়। অথচ সংস্কৃতি সমাজে যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাবনার বাতাবরণ তৈরি করে দেশের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির জন্য, তা অত্যাবশ্যক শর্ত। আজ পুরোনো শকুন নতুনভাবে আবার কামড়ে ধরতে চাইছে জাতির পতাকা। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা আক্রমণ করছে সংস্কৃতির বিবিধ প্রকাশ ও নিবেদন, ঘাতকের তলোয়ারের আঘাতে লুটিয়ে পড়েছে মুক্তমনা ব্যক্তি, আবহমান সংস্কৃতিচর্চার সাধক। প্রবাসী অর্থনীতিবিদ মাহফুজুর রহমান স্বদেশ-বিষয়ক তাঁর গ্রন্থের শিরোনাম করেছিলেন ‘আল্লাহ হাফেজ বনাম খোদা হাফেজ’। এই দুই ধারার লড়াই, সম্প্রীতির বিরুদ্ধে সংঘাত, ভালোবাসার বিপরীতে ঘৃণা, বৈচিত্র্যের বিপরীতে আরোপিত একরঙা সমাজ, এমন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ টালমাটাল। সব বাধা উজিয়ে অব্যাহত থাকবে সংস্কৃতির অভিযাত্রা—এমন প্রত্যয় আমরা অর্জন করি দেশের ইতিহাস থেকে, দ্বিজাতিতত্ত্বের মূর্খতা ও সহিংসতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক উদার জাতিসত্তার মিলনের আদর্শে। এমন দেশের তো পরাভব নেই।
আমরা আজ নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করছি, জীবন ও সমাজ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে; যেমন স্বদেশে তেমনি বিদেশে। বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক ধারা সংস্কৃতির ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। প্রযুক্তি সেখানে যোগ করেছে আরও ব্যাপকতা। ডিজিটালের যুগে আধুনিক সংযোগ প্রযুক্তি সংস্কৃতির উৎপাদন, পুনরুৎপাদন এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগে অভাবিত সব পরিবর্তন বয়ে এনেছে। আমরা এই পরিবর্তনে ভাসছি, অনেকটাই সুখ স্রোতে গা এলিয়ে দেওয়ার মতো। প্রযুক্তির ওপর মানুষের ও সংস্কৃতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারছি না। বিপুল শঙ্কা ও বিশাল সম্ভাবনার দোলাচলে আমরা রয়েছি। সেখানে অর্থময় পরিবর্তন ঘটাতে হলে চাই মানবসম্পদের বিকাশ ও অভ্যুদয়। এই মানবসম্পদ প্রকৃত অর্থে হতে হবে মানসসম্পদ। সে জন্য শিক্ষায়, জ্ঞানচর্চায় চাই সংস্কৃতির ছোঁয়া। সংস্কৃতির বাহন হবে প্রযুক্তি। এর উপাদান হতে হবে জাতীয়তা ও স্বকীয়তা, যা একই সঙ্গে মেলাবে স্থানীয়, আঞ্চলিক, স্বাদেশিকতার সঙ্গে বিশ্বময়তার। ‘বিশ্বমানব হবি যদি শাশ্বত বাঙালি হ’, ব্রতচারীর এই উচ্চারণ প্রায় শতবর্ষী হলেও আজ তা নতুন তাৎপর্য, নতুন বার্তা বহন করছে। এমন সমীকরণ তৈরি করতে পারাটা আগামীর চ্যালেঞ্জ, নতুন যুগের দাবি। এই দায় মেটাবার শক্তি বাংলাদেশ রাখে তার অতীতের মহৎ অর্জনের ধারাবাহিকতায়। যুগ-সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে আছি যুগনির্মাতা হওয়ার দায় নিয়ে। সেই ভবিষ্যৎমুখী জাতীয়তাবোধ ও আন্তর্জাতিকতা আলিঙ্গন করে বাংলাদেশ বিকশিত হবে, সৃজনমুখর হবে—এমন প্রত্যাশার সঙ্গে চাই নির্মাতার শক্তি ও সৃজনের সাধনা। আমরা তাকিয়ে আছি অনাগত এই বিকাশের দিকে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে একীভূত করবে, জন্ম দেবে বাঙালি নবজাগরণের।
লেখক: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
সংস্কৃতি ও তার পরিবর্তনময়তা নিয়ে বাঙালি ভাবুকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন গোপাল হালদার। তাঁর ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ বইটি বহুল পঠিত ও আলোচিত। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন এবং বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেই মোড়-ফেরার কালে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে টেলিভিশনে আলাপচারিতায় মিলিত হয়েছিলেন। তাঁদের আলোচ্য ছিল ‘ভাবী বাঙালির আবির্ভাব’। এমন বিষয় নির্ধারণের মধ্য দিয়েই বুঝতে পারা যায় বিজয়ী বাংলাদেশের ভাবজগতে তখন কী বিশাল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। স্থির প্রত্যয়ী উত্তর কেউ জোগাতে পারুক কিংবা না পারুক, জিজ্ঞাসা সেখানে ছিল মুখ্য। আজ যখন আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে অর্ধশতকের অতিক্রান্ত পথের পর্যালোচনা থেকে নিজেদের সাংস্কৃতিক অবস্থান বুঝে নিতে চাইছি, তখন ১৯৭৪ সালের সেই আলোচনাকে একটা যুগচিহ্ন হিসেবে ধরে নিতে পারি। কলকাতায় ফিরে গিয়ে ‘বাংলাদেশের এক বন্ধুর উদ্দেশে’ শীর্ষক পত্রনিবন্ধ লিখেছিলেন গোপাল হালদার। সেখানে তাঁর মুখের কথা কিছুটা গুছিয়ে লিখিতভাবে দাখিলের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। শামসুর রাহমানের প্রশ্ন ছিল, পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ যখন একই ‘বাঙালি সংস্কৃতির’ ধারক, তখন বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলে পৃথক কোনো সংস্কৃতি থাকবে কি, না তা মিলিয়ে যাবে বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে।
৫০ বছর পর উত্তরটি এখন আমাদের জানা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি তার নিজস্ব রূপ-রস-রং-গন্ধ নিয়ে বিকশিত হয়ে চলছে, যেমনটি পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রেও অন্যভাবে দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতির বিবর্তনে আস্থাশীল গোপাল হালদার ভবিষ্যদ্দ্রষ্টার মতো কিছু কথা বলেছিলেন, যা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গদেশ সামান্য একটা অঞ্চল নয়, প্রাকৃতিক সম্পদেও একরঙা নয়, মানবিক সম্পর্কেও একরঙা নয়। রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ-বিধৃত এই বঙ্গভূমিও রূপে-রসে অপরূপ। শুধু রাঙামাটির রাঢ়ই বাংলা নয়, শুধু কলকাতা নিয়ে কিংবা ঢাকা নিয়েই নয় বাঙালি সম্পূর্ণ।’
এই যে বৈচিত্র্যের আবাহন, সেখানে তো নতুন আরও অনেক উপাদান যুক্ত হয়েছে, মিলনে-মিশ্রণে-সৃজনে সংস্কৃতি নানা রূপে যা প্রবাহিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সেখানে যুক্ত করবে নতুন মাত্রা—এমন প্রত্যাশা ছিল গোপাল হালদারের। বাংলাদেশের সংস্কৃতি সমগ্র বাঙালি সংস্কৃতিকেই জোগাবে নতুন পরিপুষ্টি ও প্রণোদনা। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের মানব-সম্পদ,—তার মাঝি-মাল্লা, তার সমুদ্রগামী সারেং, জাহাজি, তার প্রাণবন্ত চাষী—এসবের জীবনকথা ও আত্মার স্বপ্ন,—এসব বাংলাদেশের শিল্পসৃষ্টিতে দেবে সত্যিকারের প্রাণসম্পদ,—আর যে প্রাণসম্পদে আমাদের সমগ্র বাঙালি পাবে বিশিষ্ট এক ঐশ্বর্ষ, আরও বিচিত্র প্রকাশ।’
পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপে আমরা আটক ছিলাম প্রায় ২৩ বছর। এর বিপরীতে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ও সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির আপন সত্তানুসন্ধান এবং জাতিসত্তা ও ধর্মপরিচয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রচনা করে সম্প্রীতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বাঙালির সেই সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে আমরা বিকাশের পথ তৈরির অবকাশ বিশেষ পাইনি। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রাচার থেকে চার জাতীয় মূল নীতির অপনোদন দেশকে চালিত করল ভিন্ন পথে। ধর্মের মোড়কে আবারও সামাজিক স্থিতির বিনাশ এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক চিন্তার আধিপত্য কায়েমে চলে রাষ্ট্রীয় প্রয়াস।
বিরূপ সময়েও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে এই লড়াই নানাভাবে পরিচালনা করেছে, বাঙালি সংস্কৃতির সৃজনধারায় যার নানা প্রকাশ আমরা দেখি। যদি মোটাদাগে বাংলাদেশের সংস্কৃতির পরিবর্তনময়তা বিচার করতে চাই, তবে একে আমরা নবযাত্রাই বলতে পারি। পুরোনো ধ্যানধারণা, সাম্প্রদায়িক ভেদচিন্তা, দ্বিজাতিতত্ত্বের হাতিয়ার নিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সঞ্চার নানাভাবে জাতিকে পথভ্রষ্ট করতে চাইছে। ৫০ বছরে তার প্রকাশ এবং সংঘাত ও হিংসাত্মক আক্রমণের উদাহরণ তো অজস্র। তবে এই নিরিখে পরিবর্তনময়তাও বিশেষভাবে তলিয়ে দেখার রয়েছে। স্বাধীনতার একুশ বছর পর দেশে ফিরেছিলেন দীর্ঘকালের প্রবাসী আদ্যোপান্ত বাঙালি ও বাংলার সংস্কৃতিসাধক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁর স্বদেশ-অবলোকনের কথা তিনি বলেছিলেন আত্মজৈবনিক ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’ গ্রন্থে। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এক মাস দেশে কাটিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘সতেরো বছর বিদেশে বাস করে মনে একটা ভয় জন্মেছিল, দেশে ফিরে গিয়ে হয়তো দেখব দেশটা মোল্লা ও মাস্তানদের খপ্পরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আমার এই আশঙ্কা পুরোপুরি সত্য হয়নি।’ তবে সবচেয়ে বড়ভাবে তাঁকে নাড়া দিয়েছিল বাংলাদেশের সামাজিক রূপান্তর, যার কেন্দ্রে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন নারীর অবস্থান। এই উপলব্ধি মেলে ধরে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে একটা নীরব সামাজিক বিপ্লব খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আর এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছে গ্রামীণ সমাজ-জীবন ভেঙে পড়ায় ঘর, পর্দা, পরিবার ও সমাজ থেকে বেরিয়ে আসা হাজার হাজার গৃহবধূ ও গৃহকন্যা—এবং স্কুল ও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে বেরিয়ে আসা মেয়েদের একটা সচেতন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত ও রাগী অংশ।’
সেই অবলোকনের পর আরও দুই দশক পেরিয়ে গেলেও দেখা যায়, একই লড়াইয়ে শরিক রয়েছে বাংলাদেশ। টালমাটাল এই অভিযাত্রায় অর্জনের ক্ষেত্রগুলো অনেক সময় আশু ও চলমান সংঘাতের কারণে রয়ে যায় দৃষ্টিসীমার আড়ালে। এর বড় দিক হলো, সংস্কৃতির বিস্তার ও বৈচিত্র্য, যা বহন করে জাগরণ ও সৃষ্টিশীলতার বীজ। সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখা ডালপালা নতুন প্রসারতা পাচ্ছে, যেখানে বাঙালির সংগ্রাম ও মুক্তির চেতনা অর্জন করছে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের রচনাভান্ডার হিসেবে পৃথক এক ঘরানা গড়ে উঠেছে, যেটা স্বাধীনতাসংগ্রামকারী খুব কম দেশেই মিলবে। এই ধারা যে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও বহমান, তা আশাজাগানিয়া বৈকি। তেমনিভাবে পারফর্মিং আর্টসের সব শাখাতেই আমরা দেখি প্রসারতা। তবে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, প্রসারতার তুলনায় গভীরতা তো তেমনভাবে দৃশ্যগোচর হচ্ছে না। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্মিলিতভাবে এ প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নিতে পারে। তবে গভীরতা নির্ভর করবে ব্যক্তির সাধনা ও সৃজনের ওপর। প্রসারতা থেকে জাগ্রত হবে সেই প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ।
এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের দিক থেকে ঘাটতি রয়েছে অনেক। সংস্কৃতির অবদান জিডিপি কিংবা প্রবৃদ্ধির সূচকে পরিমাপযোগ্য নয়। অথচ সংস্কৃতি সমাজে যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাবনার বাতাবরণ তৈরি করে দেশের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির জন্য, তা অত্যাবশ্যক শর্ত। আজ পুরোনো শকুন নতুনভাবে আবার কামড়ে ধরতে চাইছে জাতির পতাকা। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা আক্রমণ করছে সংস্কৃতির বিবিধ প্রকাশ ও নিবেদন, ঘাতকের তলোয়ারের আঘাতে লুটিয়ে পড়েছে মুক্তমনা ব্যক্তি, আবহমান সংস্কৃতিচর্চার সাধক। প্রবাসী অর্থনীতিবিদ মাহফুজুর রহমান স্বদেশ-বিষয়ক তাঁর গ্রন্থের শিরোনাম করেছিলেন ‘আল্লাহ হাফেজ বনাম খোদা হাফেজ’। এই দুই ধারার লড়াই, সম্প্রীতির বিরুদ্ধে সংঘাত, ভালোবাসার বিপরীতে ঘৃণা, বৈচিত্র্যের বিপরীতে আরোপিত একরঙা সমাজ, এমন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ টালমাটাল। সব বাধা উজিয়ে অব্যাহত থাকবে সংস্কৃতির অভিযাত্রা—এমন প্রত্যয় আমরা অর্জন করি দেশের ইতিহাস থেকে, দ্বিজাতিতত্ত্বের মূর্খতা ও সহিংসতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক উদার জাতিসত্তার মিলনের আদর্শে। এমন দেশের তো পরাভব নেই।
আমরা আজ নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করছি, জীবন ও সমাজ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে; যেমন স্বদেশে তেমনি বিদেশে। বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক ধারা সংস্কৃতির ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। প্রযুক্তি সেখানে যোগ করেছে আরও ব্যাপকতা। ডিজিটালের যুগে আধুনিক সংযোগ প্রযুক্তি সংস্কৃতির উৎপাদন, পুনরুৎপাদন এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগে অভাবিত সব পরিবর্তন বয়ে এনেছে। আমরা এই পরিবর্তনে ভাসছি, অনেকটাই সুখ স্রোতে গা এলিয়ে দেওয়ার মতো। প্রযুক্তির ওপর মানুষের ও সংস্কৃতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারছি না। বিপুল শঙ্কা ও বিশাল সম্ভাবনার দোলাচলে আমরা রয়েছি। সেখানে অর্থময় পরিবর্তন ঘটাতে হলে চাই মানবসম্পদের বিকাশ ও অভ্যুদয়। এই মানবসম্পদ প্রকৃত অর্থে হতে হবে মানসসম্পদ। সে জন্য শিক্ষায়, জ্ঞানচর্চায় চাই সংস্কৃতির ছোঁয়া। সংস্কৃতির বাহন হবে প্রযুক্তি। এর উপাদান হতে হবে জাতীয়তা ও স্বকীয়তা, যা একই সঙ্গে মেলাবে স্থানীয়, আঞ্চলিক, স্বাদেশিকতার সঙ্গে বিশ্বময়তার। ‘বিশ্বমানব হবি যদি শাশ্বত বাঙালি হ’, ব্রতচারীর এই উচ্চারণ প্রায় শতবর্ষী হলেও আজ তা নতুন তাৎপর্য, নতুন বার্তা বহন করছে। এমন সমীকরণ তৈরি করতে পারাটা আগামীর চ্যালেঞ্জ, নতুন যুগের দাবি। এই দায় মেটাবার শক্তি বাংলাদেশ রাখে তার অতীতের মহৎ অর্জনের ধারাবাহিকতায়। যুগ-সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে আছি যুগনির্মাতা হওয়ার দায় নিয়ে। সেই ভবিষ্যৎমুখী জাতীয়তাবোধ ও আন্তর্জাতিকতা আলিঙ্গন করে বাংলাদেশ বিকশিত হবে, সৃজনমুখর হবে—এমন প্রত্যাশার সঙ্গে চাই নির্মাতার শক্তি ও সৃজনের সাধনা। আমরা তাকিয়ে আছি অনাগত এই বিকাশের দিকে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে একীভূত করবে, জন্ম দেবে বাঙালি নবজাগরণের।
লেখক: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে