চিররঞ্জন সরকার
দেশে ডলার-সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কখনো দাম নির্ধারণ করে দিয়ে, কখনো ‘চাপ’ সৃষ্টি করে, কখনো ব্যাংকের সুদহার বেঁধে দিয়ে ডলারের দাম বশে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। সর্বশেষ ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এই দামের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা।
নতুন এই পদ্ধতি চালুর মধ্য দিয়ে ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ; অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে। কারও কাছে থাকা ১ লাখ টাকার মান এখন ৯৩ হাজার ৬৪০ টাকায় নেমেছে। এ কারণে হঠাৎ করে বিপাকে পড়ে গেছেন আমদানিকারকেরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঘোষণায় ছোট ও মাঝারি ধরনের আমদানিকারকদের এলসি পেমেন্টে অতিরিক্ত খরচ বেড়েছে কোটি টাকার ওপরে। বড় আমদানিকারকদের খরচ আরও বেড়ে গেছে। এর আগে দেশে ডলারের দাম কখনো একসঙ্গে এতটা বাড়েনি। ফলে আরও চাপ তৈরি হতে পারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের ওপর। কারণ ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত দরে ডলার কিনলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো পণ্য আমদানিতে এত দিন ১১০ টাকা দামে ডলার দিত বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘ একটা সময় ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেঁধে রেখেছিল। অর্থনীতিবিদেরা এত দিন একটি ভাসমান বিনিময় হারের কথা বলে আসছিলেন। তবে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি তাতে মোটেও কর্ণপাত করেনি। এতে ডলারের বাজারে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে মূলত রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হন। প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হওয়ায় রপ্তানিকারকেরা এই আয় থেকে বাড়তি ৭ টাকা বেশি হাতে পাবেন। এতে প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে উৎসাহিত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। বাস্তবে এই নীতি রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে কতটুকু সুফল নিয়ে আসবে, সেটা দেখার বিষয়।
তবে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ওপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। টাকার অবমূল্যায়নের আগে সাধারণ মানুষ যে পরিমাণ উপার্জন করতেন, এখনো তা-ই করছেন। তাঁরা চাইলেই আগের মতো একই পরিমাণ পণ্য বা পরিষেবা কিনতে পারবেন না। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ভ্রমণ, বিদেশে লেখাপড়া ও চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাবে। টিউশন ফি ও ফ্লাইটের টিকিট ডলারে পরিশোধ করতে হয়। তাই এতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে। যদিও এগুলোকে অন্তর্বর্তীকালীন সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। শেষ বিচারে এর সুফল ফলবে বলেই অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন।
অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য অনেক আগে থেকেই ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করে আসছিলেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ ব্যাপারে কান দেননি। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়া নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের একধরনের স্পর্শকাতরতা লক্ষ করা গেছে। তাঁরা মনে করেছেন একবার দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে সেটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ঠিক বলা যায় না। এ ছাড়া এটা আবার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারের প্রতি একধরনের অবিশ্বাস বা অনাস্থার কারণেই এত দিন ডলারের দাম নির্ধারণে বাজারকে বিশ্বাস করা হয়নি। নানা রকম ব্যর্থ টোটকার পর এখন বাজারের হাতেই ডলারের দাম ছেড়ে দেওয়া হলো। যেটা আগে করা যেত, সেটা অনেক পরে করা হলো। মাঝখান থেকে ক্ষত আর ক্ষতি যা হয়েছে, তা কিন্তু মোটেও সামান্য নয়!
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনাবেচা করা হবে, তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কান দেয়নি। এখন শেষ পর্যন্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিরাট প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করার তাগাদা দিয়ে আসছিল।
উল্লেখ্য, ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামা করে। নতুন পদ্ধতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ডলারের দাম একটা সীমার মধ্যে বাড়বে বা কমবে। ফলে ডলারের দাম একবারে খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা নির্ধারণ না করে মধ্যবর্তী সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ডলারের লেনদেনের ক্ষেত্রে এই দরের আশপাশে থাকতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে ডলার-সংকট চলছে। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে আগেই। যদিও খোলাবাজারে লেনদেন হচ্ছিল আরও বেশি দামে। ডলার-সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও।
২০২১ সালের আগস্টে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সংকটের কারণে সেটি এখন ২০ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাজারে সংকট কাটেনি। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখনই ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তার কথা জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন উপায়ে ডলারের বাজার ব্যবস্থাপনার যে চেষ্টা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেছিল, তা সংকট নিরসনে খুব একটা ভূমিকা রাখেনি।
সমস্যা হলো, ডলারের তুলনায় টাকার বিনিময় মূল্য কমার প্রভাব সরাসরি পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রল, ডিজেল, এলএনজির দাম চড়া। পেট্রল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধি মানেই একদিকে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব, অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়া বহু পণ্য নিয়মিত আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে কিছু সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, কিছু অন্তর্বর্তী পণ্য। সেগুলোরও দাম বাড়ে। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বাড়ছে।
সরকারিভাবে মূল্যস্ফীতির হার ৭-৮ শতাংশের মধ্যে দেখানো হলেও বাস্তবে তা দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে বলেই অর্থনীতিবিদদের অনুমান। টাকার দাম কমায় মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। মূল্যস্ফীতিকে একধরনের ‘কর’ হিসেবে দেখা হয়। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাঁদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা অনেক মানুষের আবার গরিব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। টাকার ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ অবমূল্যায়নের কারণে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ এক দিনে টাকার অঙ্কে ৮০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। ঋণ পরিশোধের টাকার অঙ্কও বাড়ছে।
এই মুহূর্তে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করতে হবে। এর পাশাপাশি দরকার অপ্রয়োজনীয় আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ। ডলার খরচ করে যেসব কম গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রকল্প হচ্ছে, এতেও ধীরে চলা নীতি নিতে হবে। ডলার-সংকট নিরসনে সবাইকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের ভয়াবহ বিপদে পড়তে হতে পারে। একই সঙ্গে বাজারের ওপর কঠোর নজরদারিও থাকতে হবে।
কারণ বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টি যতটা না ডলার-সংকটের ওপর নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, বাজারের ওপর নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণের অভাব, সরবরাহ না থাকা, মধ্যস্বত্বভোগীদের লাগামহীন লাভ করার মানসিকতা, চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলোর ওপর। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা না ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াটাই বাংলাদেশে ডলার-সংকটের একমাত্র সমাধান নয়; বরং যেসব অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাংলাদেশে ডলার, বিশেষ করে রেমিট্যান্স আসছে, সেগুলো বন্ধ করা না গেলে ডলার-সংকটের সমাধান সম্ভব নয়; বিশেষ করে হুন্ডি বন্ধ করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে ‘অ্যাগ্রেসিভ অ্যাকশন’ নিতে হবে। যদি কয়েকজনকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা যায়, তাহলে এটা কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। নইলে তো এটা চলতেই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা, ‘শর্ষের ভূত’ তাড়াতে হবে। শর্ষের মধ্যে ভূত রেখে কখনো প্রেতাত্মা তাড়ানো যায় না!
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
দেশে ডলার-সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কখনো দাম নির্ধারণ করে দিয়ে, কখনো ‘চাপ’ সৃষ্টি করে, কখনো ব্যাংকের সুদহার বেঁধে দিয়ে ডলারের দাম বশে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। সর্বশেষ ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এই দামের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা।
নতুন এই পদ্ধতি চালুর মধ্য দিয়ে ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ; অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে। কারও কাছে থাকা ১ লাখ টাকার মান এখন ৯৩ হাজার ৬৪০ টাকায় নেমেছে। এ কারণে হঠাৎ করে বিপাকে পড়ে গেছেন আমদানিকারকেরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঘোষণায় ছোট ও মাঝারি ধরনের আমদানিকারকদের এলসি পেমেন্টে অতিরিক্ত খরচ বেড়েছে কোটি টাকার ওপরে। বড় আমদানিকারকদের খরচ আরও বেড়ে গেছে। এর আগে দেশে ডলারের দাম কখনো একসঙ্গে এতটা বাড়েনি। ফলে আরও চাপ তৈরি হতে পারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের ওপর। কারণ ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত দরে ডলার কিনলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো পণ্য আমদানিতে এত দিন ১১০ টাকা দামে ডলার দিত বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘ একটা সময় ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেঁধে রেখেছিল। অর্থনীতিবিদেরা এত দিন একটি ভাসমান বিনিময় হারের কথা বলে আসছিলেন। তবে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি তাতে মোটেও কর্ণপাত করেনি। এতে ডলারের বাজারে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে মূলত রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হন। প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হওয়ায় রপ্তানিকারকেরা এই আয় থেকে বাড়তি ৭ টাকা বেশি হাতে পাবেন। এতে প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে উৎসাহিত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। বাস্তবে এই নীতি রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে কতটুকু সুফল নিয়ে আসবে, সেটা দেখার বিষয়।
তবে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ওপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। টাকার অবমূল্যায়নের আগে সাধারণ মানুষ যে পরিমাণ উপার্জন করতেন, এখনো তা-ই করছেন। তাঁরা চাইলেই আগের মতো একই পরিমাণ পণ্য বা পরিষেবা কিনতে পারবেন না। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ভ্রমণ, বিদেশে লেখাপড়া ও চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাবে। টিউশন ফি ও ফ্লাইটের টিকিট ডলারে পরিশোধ করতে হয়। তাই এতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে। যদিও এগুলোকে অন্তর্বর্তীকালীন সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। শেষ বিচারে এর সুফল ফলবে বলেই অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন।
অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য অনেক আগে থেকেই ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করে আসছিলেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ ব্যাপারে কান দেননি। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়া নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের একধরনের স্পর্শকাতরতা লক্ষ করা গেছে। তাঁরা মনে করেছেন একবার দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে সেটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ঠিক বলা যায় না। এ ছাড়া এটা আবার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারের প্রতি একধরনের অবিশ্বাস বা অনাস্থার কারণেই এত দিন ডলারের দাম নির্ধারণে বাজারকে বিশ্বাস করা হয়নি। নানা রকম ব্যর্থ টোটকার পর এখন বাজারের হাতেই ডলারের দাম ছেড়ে দেওয়া হলো। যেটা আগে করা যেত, সেটা অনেক পরে করা হলো। মাঝখান থেকে ক্ষত আর ক্ষতি যা হয়েছে, তা কিন্তু মোটেও সামান্য নয়!
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনাবেচা করা হবে, তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কান দেয়নি। এখন শেষ পর্যন্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিরাট প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করার তাগাদা দিয়ে আসছিল।
উল্লেখ্য, ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামা করে। নতুন পদ্ধতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ডলারের দাম একটা সীমার মধ্যে বাড়বে বা কমবে। ফলে ডলারের দাম একবারে খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা নির্ধারণ না করে মধ্যবর্তী সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ডলারের লেনদেনের ক্ষেত্রে এই দরের আশপাশে থাকতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে ডলার-সংকট চলছে। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে আগেই। যদিও খোলাবাজারে লেনদেন হচ্ছিল আরও বেশি দামে। ডলার-সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও।
২০২১ সালের আগস্টে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সংকটের কারণে সেটি এখন ২০ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাজারে সংকট কাটেনি। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখনই ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তার কথা জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন উপায়ে ডলারের বাজার ব্যবস্থাপনার যে চেষ্টা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেছিল, তা সংকট নিরসনে খুব একটা ভূমিকা রাখেনি।
সমস্যা হলো, ডলারের তুলনায় টাকার বিনিময় মূল্য কমার প্রভাব সরাসরি পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রল, ডিজেল, এলএনজির দাম চড়া। পেট্রল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধি মানেই একদিকে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব, অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়া বহু পণ্য নিয়মিত আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে কিছু সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, কিছু অন্তর্বর্তী পণ্য। সেগুলোরও দাম বাড়ে। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বাড়ছে।
সরকারিভাবে মূল্যস্ফীতির হার ৭-৮ শতাংশের মধ্যে দেখানো হলেও বাস্তবে তা দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে বলেই অর্থনীতিবিদদের অনুমান। টাকার দাম কমায় মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। মূল্যস্ফীতিকে একধরনের ‘কর’ হিসেবে দেখা হয়। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাঁদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা অনেক মানুষের আবার গরিব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। টাকার ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ অবমূল্যায়নের কারণে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ এক দিনে টাকার অঙ্কে ৮০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। ঋণ পরিশোধের টাকার অঙ্কও বাড়ছে।
এই মুহূর্তে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করতে হবে। এর পাশাপাশি দরকার অপ্রয়োজনীয় আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ। ডলার খরচ করে যেসব কম গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রকল্প হচ্ছে, এতেও ধীরে চলা নীতি নিতে হবে। ডলার-সংকট নিরসনে সবাইকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের ভয়াবহ বিপদে পড়তে হতে পারে। একই সঙ্গে বাজারের ওপর কঠোর নজরদারিও থাকতে হবে।
কারণ বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টি যতটা না ডলার-সংকটের ওপর নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, বাজারের ওপর নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণের অভাব, সরবরাহ না থাকা, মধ্যস্বত্বভোগীদের লাগামহীন লাভ করার মানসিকতা, চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলোর ওপর। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা না ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াটাই বাংলাদেশে ডলার-সংকটের একমাত্র সমাধান নয়; বরং যেসব অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাংলাদেশে ডলার, বিশেষ করে রেমিট্যান্স আসছে, সেগুলো বন্ধ করা না গেলে ডলার-সংকটের সমাধান সম্ভব নয়; বিশেষ করে হুন্ডি বন্ধ করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে ‘অ্যাগ্রেসিভ অ্যাকশন’ নিতে হবে। যদি কয়েকজনকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা যায়, তাহলে এটা কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। নইলে তো এটা চলতেই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা, ‘শর্ষের ভূত’ তাড়াতে হবে। শর্ষের মধ্যে ভূত রেখে কখনো প্রেতাত্মা তাড়ানো যায় না!
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে