এ কে এম শামসুদ্দিন
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি, বাঙালি জাতির জন্য এক বিশাল অর্জন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিকসহ নাম না-জানা অনেকেই নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা পেয়েছি। আমরা অনেকেই জানি না বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছে এবং আত্মাহুতির মাধ্যমে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তামিল ভাষা, স্বাধীনতার পর ১৯৬১ সালে আসামের শীলচরে বাংলা ভাষা, ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু ভাষা, লাটভিয়ায় রুশ ভাষা প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপের বেলজিয়ামে ফ্রেঞ্চ-জার্মান-ডাচ ভাষা, বলকান অঞ্চলে, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আরবি-ফারসি-তুর্কি কিংবা মেক্সিকোর উত্তরাংশে স্প্যানিশ-ইংরেজি; সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দীতে চীনে ম্যান্ডারিন-মাঞ্চুরিয়ান ভাষার মধ্যে বিরোধ ছিল অন্যতম।
১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় কংগ্রেস সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করার আইন পার্লামেন্টে পাস করতে চেষ্টা করে। উল্লেখ্য, ওই অঞ্চলের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ তামিল ভাষাভাষী। সরকারের এ সিদ্ধান্তে দক্ষিণ ভারতের এই অঞ্চলের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের এই ভাষা আন্দোলন ১৯৩৯ সাল অবধি চলতে থাকে। এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য স্থানীয় কংগ্রেসের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করেন। উর্দুভাষী মুসলমানরাও হিন্দি ভাষার পক্ষ অবলম্বন করে। এই আন্দোলনে অজ্ঞাতনামা দুজন নাগরিক প্রাণ হারান এবং প্রায় দুই হাজার নারী-পুরুষ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। ভারতের স্বাধীনতার পর জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় সরকার গঠন করে। এ সময় হিন্দি ভাষাভাষী কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও মওলানা আবুল কালাম আজাদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা চালু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তা আইন হিসেবে গৃহীত হয়। আইনে বলা হয়, ১৫ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি এ আইন কার্যকর হবে। এ আইনটি কার্যকর হওয়ার মুহূর্তে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, বিক্ষুব্ধ জনতা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। শীতের এক সকালে দক্ষিণ ভারতের তিরুচিরাপল্লীবাসী এলাকার চিন্নাস্বামী নামের এক তামিল নাগরিক শহরের রেলওয়ে স্টেশনের সন্নিকটে নিজ শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। চিন্নাস্বামী ‘তামিল জিন্দাবাদ, হিন্দি নিপাত যাক’ স্লোগান দিতে দিতে ভস্মীভূত হয়ে মারা যান। চিন্নাস্বামীর পর আরও ছয়জন তামিল নাগরিকও একইভাবে আত্মাহুতি দেন। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রায় হাজারের বেশি বিক্ষোভকারী প্রতিবাদ মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ১৭ বছরের এক কিশোর মারা যায়। পুলিশের পাশাপাশি সরকারি দলের ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীরাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ করে। শুরু হয় দাঙ্গা। সরকার আন্দোলন মোকাবিলায় সামরিক বাহিনী রাস্তায় নামায়। এই দাঙ্গা চলে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বিক্ষুব্ধ জনতা দুজন পুলিশ সদস্যকেও পুড়িয়ে মারে। দাঙ্গায় মোট ৬৩ জন তামিল নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট ভারতের সংসদে ‘লুকওয়ার্ম ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট’ পাস হয়। ভারতে ‘রাষ্ট্রভাষা’ বা ‘জাতীয় ভাষা’ বলতে কিছু নেই। ১০০টিরও বেশি ভাষাভাষীর দেশ ভারতে বর্তমানে ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে।
১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসামের বরাক উপত্যকায় কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ১১ তরুণ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন; সে ঘটনার কথা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সেই লড়াইয়ে পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীও সেদিন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তাঁর নাম কমলা ভট্টাচার্য। ১৬ বছর বয়সী এ তরুণীই সমগ্র বাঙালি নারীসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী পৃথিবীর একমাত্র শহীদ নারী ভাষাসৈনিক। বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই ছিল বাঙালি। এ ছাড়া আসামের অন্যান্য অঞ্চলেও বাঙালিদের ব্যাপক বসবাস ছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের ভেতর এমন আশঙ্কা ভর করে যে অগ্রসরমাণ বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এ ধরনের মানসিক ভীতি থেকে আসামের শাসকেরা স্বাধীনতার পর একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে Assam (official) Language Act (ALA-1960) নামে একটি অ্যাক্ট আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেয়।
১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা আসাম প্রাদেশিক পরিষদে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আইন পাস করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করেন। বিলটি উত্থাপিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে আসামের করিমগঞ্জ (উত্তর) থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের অন্যতম সদস্য রণেন্দ্র মোহন দাস তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, ‘দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে এক-তৃতীয়াংশ জনগণের অসমিয়া ভাষাকে এ অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আইন পাস করা চলবে না।’ তারপরও ২৪ অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক আনীত বিলটি পাস হয়ে যায়।
১৯৬১ সালের এপ্রিলে বাংলা ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলন জোরালো করার লক্ষ্যে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬১ সালের ২৪ এপ্রিল সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা’র কর্মসূচি শুরু করে। এই পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়।
পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, ১৩ মের মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ১৯ মে হরতাল শুরু হলে উত্তেজিত জনতা খুব ভোর থেকেই কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় সরকারি অফিস, আদালত ও রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে প্রাদেশিক সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা শহরগুলোতে আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশের টহল নামায়। আনুমানিক বেলা ২টা ৩০ মিনিটের দিকে উত্তেজিত বাঙালিরা পুলিশের একটি ট্রাক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রহরারত আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেদম লাঠিপেটা শুরু করে এবং পূর্বঘোষণা ছাড়াই নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমলা ভট্টাচার্যসহ ১১ বাঙালি তরুণ একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁরা হলেন কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব ও কমলা ভট্টাচার্য।
১১ শাহাদাতবরণকারীর মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামরামান ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের শিলচরে চলে যান। কমলা শিলচরের চোতিলাল সেন ইনস্টিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। ঘটনার আগের দিন তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়। ১৯ মে হরতাল শুরু হলে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে যোগ দিতে সকালে যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বড় বোন প্রতিভা ধর্মঘটে যেতে নিষেধ করেন। এরপরও এই মহীয়সী নারী বড় বোনের নিষেধ উপেক্ষা করে আন্দোলনে অংশ নেন। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী কমলার এ সংগ্রামী চেতনায় খুশি হন। কমলার সঙ্গে ছোট বোন মঙ্গলাও বেরিয়ে পড়েন। অবস্থান ধর্মঘটকালে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যখন লাঠিপেটা শুরু করেন, তখন মঙ্গলা সেই লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। ততক্ষণে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কমলা তাঁর বোনের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে গেলে একটি বুলেট এসে তাঁর ডান চক্ষু ভেদ করে বেরিয়ে যায়। এতে করে কমলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবেই সেদিন বাঙালি জাতির প্রথম নারী ভাষাসৈনিক মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মাহুতি দেন। মহান আত্মত্যাগী এই সাহসী নারী কমলা ভট্টাচার্যকে আমরা কতজনই-বা চিনি?
আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে ১৯৫২ সালের বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, রণকৌশল ও বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করা ইত্যাদি একই ধারায় যেন পরিচালিত হয়েছিল। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বায়ান্নর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঘটনা আসামের আন্দোলনকারীদের সাহস জুগিয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং তারই পথ ধরে আসামের বাঙালিরা এভাবেই বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
এ কে এম শামসুদ্দিন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি, বাঙালি জাতির জন্য এক বিশাল অর্জন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিকসহ নাম না-জানা অনেকেই নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা পেয়েছি। আমরা অনেকেই জানি না বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছে এবং আত্মাহুতির মাধ্যমে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তামিল ভাষা, স্বাধীনতার পর ১৯৬১ সালে আসামের শীলচরে বাংলা ভাষা, ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু ভাষা, লাটভিয়ায় রুশ ভাষা প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপের বেলজিয়ামে ফ্রেঞ্চ-জার্মান-ডাচ ভাষা, বলকান অঞ্চলে, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আরবি-ফারসি-তুর্কি কিংবা মেক্সিকোর উত্তরাংশে স্প্যানিশ-ইংরেজি; সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দীতে চীনে ম্যান্ডারিন-মাঞ্চুরিয়ান ভাষার মধ্যে বিরোধ ছিল অন্যতম।
১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় কংগ্রেস সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করার আইন পার্লামেন্টে পাস করতে চেষ্টা করে। উল্লেখ্য, ওই অঞ্চলের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ তামিল ভাষাভাষী। সরকারের এ সিদ্ধান্তে দক্ষিণ ভারতের এই অঞ্চলের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের এই ভাষা আন্দোলন ১৯৩৯ সাল অবধি চলতে থাকে। এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য স্থানীয় কংগ্রেসের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করেন। উর্দুভাষী মুসলমানরাও হিন্দি ভাষার পক্ষ অবলম্বন করে। এই আন্দোলনে অজ্ঞাতনামা দুজন নাগরিক প্রাণ হারান এবং প্রায় দুই হাজার নারী-পুরুষ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। ভারতের স্বাধীনতার পর জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় সরকার গঠন করে। এ সময় হিন্দি ভাষাভাষী কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও মওলানা আবুল কালাম আজাদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা চালু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তা আইন হিসেবে গৃহীত হয়। আইনে বলা হয়, ১৫ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি এ আইন কার্যকর হবে। এ আইনটি কার্যকর হওয়ার মুহূর্তে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, বিক্ষুব্ধ জনতা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। শীতের এক সকালে দক্ষিণ ভারতের তিরুচিরাপল্লীবাসী এলাকার চিন্নাস্বামী নামের এক তামিল নাগরিক শহরের রেলওয়ে স্টেশনের সন্নিকটে নিজ শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। চিন্নাস্বামী ‘তামিল জিন্দাবাদ, হিন্দি নিপাত যাক’ স্লোগান দিতে দিতে ভস্মীভূত হয়ে মারা যান। চিন্নাস্বামীর পর আরও ছয়জন তামিল নাগরিকও একইভাবে আত্মাহুতি দেন। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রায় হাজারের বেশি বিক্ষোভকারী প্রতিবাদ মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ১৭ বছরের এক কিশোর মারা যায়। পুলিশের পাশাপাশি সরকারি দলের ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীরাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ করে। শুরু হয় দাঙ্গা। সরকার আন্দোলন মোকাবিলায় সামরিক বাহিনী রাস্তায় নামায়। এই দাঙ্গা চলে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বিক্ষুব্ধ জনতা দুজন পুলিশ সদস্যকেও পুড়িয়ে মারে। দাঙ্গায় মোট ৬৩ জন তামিল নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট ভারতের সংসদে ‘লুকওয়ার্ম ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট’ পাস হয়। ভারতে ‘রাষ্ট্রভাষা’ বা ‘জাতীয় ভাষা’ বলতে কিছু নেই। ১০০টিরও বেশি ভাষাভাষীর দেশ ভারতে বর্তমানে ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে।
১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসামের বরাক উপত্যকায় কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ১১ তরুণ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন; সে ঘটনার কথা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সেই লড়াইয়ে পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীও সেদিন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তাঁর নাম কমলা ভট্টাচার্য। ১৬ বছর বয়সী এ তরুণীই সমগ্র বাঙালি নারীসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী পৃথিবীর একমাত্র শহীদ নারী ভাষাসৈনিক। বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই ছিল বাঙালি। এ ছাড়া আসামের অন্যান্য অঞ্চলেও বাঙালিদের ব্যাপক বসবাস ছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের ভেতর এমন আশঙ্কা ভর করে যে অগ্রসরমাণ বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এ ধরনের মানসিক ভীতি থেকে আসামের শাসকেরা স্বাধীনতার পর একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে Assam (official) Language Act (ALA-1960) নামে একটি অ্যাক্ট আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেয়।
১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা আসাম প্রাদেশিক পরিষদে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আইন পাস করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করেন। বিলটি উত্থাপিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে আসামের করিমগঞ্জ (উত্তর) থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের অন্যতম সদস্য রণেন্দ্র মোহন দাস তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, ‘দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে এক-তৃতীয়াংশ জনগণের অসমিয়া ভাষাকে এ অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আইন পাস করা চলবে না।’ তারপরও ২৪ অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক আনীত বিলটি পাস হয়ে যায়।
১৯৬১ সালের এপ্রিলে বাংলা ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলন জোরালো করার লক্ষ্যে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬১ সালের ২৪ এপ্রিল সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা’র কর্মসূচি শুরু করে। এই পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়।
পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, ১৩ মের মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ১৯ মে হরতাল শুরু হলে উত্তেজিত জনতা খুব ভোর থেকেই কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় সরকারি অফিস, আদালত ও রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে প্রাদেশিক সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা শহরগুলোতে আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশের টহল নামায়। আনুমানিক বেলা ২টা ৩০ মিনিটের দিকে উত্তেজিত বাঙালিরা পুলিশের একটি ট্রাক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রহরারত আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেদম লাঠিপেটা শুরু করে এবং পূর্বঘোষণা ছাড়াই নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমলা ভট্টাচার্যসহ ১১ বাঙালি তরুণ একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁরা হলেন কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব ও কমলা ভট্টাচার্য।
১১ শাহাদাতবরণকারীর মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামরামান ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের শিলচরে চলে যান। কমলা শিলচরের চোতিলাল সেন ইনস্টিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। ঘটনার আগের দিন তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়। ১৯ মে হরতাল শুরু হলে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে যোগ দিতে সকালে যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বড় বোন প্রতিভা ধর্মঘটে যেতে নিষেধ করেন। এরপরও এই মহীয়সী নারী বড় বোনের নিষেধ উপেক্ষা করে আন্দোলনে অংশ নেন। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী কমলার এ সংগ্রামী চেতনায় খুশি হন। কমলার সঙ্গে ছোট বোন মঙ্গলাও বেরিয়ে পড়েন। অবস্থান ধর্মঘটকালে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যখন লাঠিপেটা শুরু করেন, তখন মঙ্গলা সেই লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। ততক্ষণে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কমলা তাঁর বোনের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে গেলে একটি বুলেট এসে তাঁর ডান চক্ষু ভেদ করে বেরিয়ে যায়। এতে করে কমলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবেই সেদিন বাঙালি জাতির প্রথম নারী ভাষাসৈনিক মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মাহুতি দেন। মহান আত্মত্যাগী এই সাহসী নারী কমলা ভট্টাচার্যকে আমরা কতজনই-বা চিনি?
আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে ১৯৫২ সালের বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, রণকৌশল ও বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করা ইত্যাদি একই ধারায় যেন পরিচালিত হয়েছিল। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বায়ান্নর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঘটনা আসামের আন্দোলনকারীদের সাহস জুগিয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং তারই পথ ধরে আসামের বাঙালিরা এভাবেই বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
এ কে এম শামসুদ্দিন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে