শিহাব আহমেদ
কোক স্টুডিওতে আপনার গাওয়া গানটি দর্শক অনেক পছন্দ করেছেন। কেমন লাগছে?
অনেক ভালো লাগতাছে। সকলে অনেক প্রশংসা করতাছে। এর আগে আমি টেলিভিশনে অনেক গাইছি। কিন্তু এভাবে সকলের স্বীকৃতি, এটা আগে কখনো হয় নাই। জনপ্রিয় ও বিশাল একটা মাধ্যমে আমাকে ডাকবে, এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। মালিকের দয়া হইছে, তাঁর দয়ার মাধ্যমেই ইমন চৌধুরী আমাকে ডাকছে।
ইমন চৌধুরীর সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
ইমন চৌধুরীর বাবা অনেক বড় ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নরসিংদীতে। সেখানে পালাগান খুব জনপ্রিয়। ৩৫ বছর আগে যখন আমি পালাগান, বিচ্ছেদের ক্যাসেট বের করি, তখন থেকে ইমনের বাবা আমাকে পালাগান শিল্পী হিসেবে চেনেন। সেখান থেকেই ইমন আমার সম্পর্কে জানে। যখন ‘গুণিন’ সিনেমার গানটির জন্য বাউলশিল্পী খুঁজছিলেন সেলিম সাহেব ও তাঁর দল, তখন ইমন চৌধুরী তাঁদের জানায়, গানটি আলেয়া বেগমের কণ্ঠে ভালো হবে। সে সময়ে তাঁদের সঙ্গে আমার মেয়ে ছিল। সে বলল, আলেয়া বেগম আমার আম্মু। সেখান থেকেই ইমন চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়। তার মাধ্যমে গুণিন সিনেমায়ও গাওয়ার সুযোগ হইছিল। এবার কোক স্টুডিওতে গাইলাম।
‘কথা কইয়ো না’ গানটি করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
কোক স্টুডিওর জন্য এ রকম একটা গান হবে, সেটা আমাকে বলা হয়নি। একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম। নভেম্বর মাসের দিকে গানটি যখন রেকর্ড করি, তখন আমার সিজন চলছে। প্রতিদিন নানা জায়গায় স্টেজে স্টেজে সারা রাত প্রোগ্রাম করি। একদিন ইমন চৌধুরী ডাকল। আমি বললাম, বাবা, রেকর্ডিংয়ের জন্য অপ্রস্তুত। আমার কণ্ঠ তো একেবারে বসা, শরীরও ভালো না। সে বলল, সমস্যা নাই আন্টি। আপনি একটু আসেন। সে আমাকে সুরটি শুনাল। বললাম, বাবা, অনেক উঁচা সুর। এই মুহূর্তে এটা আমি পারমু না। পারবেন না ঠিক আছে, একবার একটু চেষ্টা করেন, বলল ইমন। যখন সুরটি দিলাম, তখন ইমন চৌধুরী বলল, আন্টি, আমার এই কণ্ঠটাই দরকার ছিল। বুঝলাম না কেন সে এমন কথা বলল। তাঁকে বললাম, এই কণ্ঠ দিয়া যদি গান বাইর করো, তাহলে যারা বায়না করছে, তারা সবাই ফিরায় নিয়া যাইব।
সে কয়, জানেন আন্টি, এই কণ্ঠটাই গানের জন্য পারফেক্ট। আমার কাছে কেমন জানি অবান্তর অবান্তর লাগল। কী করবে, এই কণ্ঠের গান দিয়া কী হবে! এখন কিন্তু সে রকম করে গাইতে পারব না। আমার কণ্ঠে কিন্তু ওইটা আসবে না। তখন যে ভিতর থেকে, অন্তর চেরা অনেক দুঃখের পরে একটা কান্না বা শেষ চিৎকারটা আসে, আমার মধ্য থেকে সে চিৎকারটা আসছিল। আমার মনে হয় মালিকের তরফ থেকে এই কণ্ঠটা ওই সময় বানানো হইছে।
আপনার কাছে কোক স্টুডিওর কোন দিকটা ভালো লেগেছে?
কোক স্টুডিও সুন্দর একেকটা সন্তান প্রসব করে। অনেক লালন-পালন করে এমন একটি ডেলিভারি দেয়, যেটায় সকলে মুগ্ধ হয়। তারা কোনো খুঁত রাখে না। আমার গাওয়ার মধ্যে একটা শব্দ আমার মতো করে করছিলাম। কথাটা হবে আইসে, সেটা গাওয়ার সময় হয়ে গেছে আইসা। এই একটা শব্দের জন্য ইমন চৌধুরী আমাকে বলল, আন্টি, আবার আসতে হবে। আমি বললাম, অবশ্যই। যারা একটি গানের জন্য এত কষ্ট করছে, তাদের জন্য আমি আবার গাইতে পারব। পরবর্তী সময়ে এই শব্দটার জন্য ওই পার্টটুকু আমাকে আবার গাইতে হয়েছিল। এই ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লেগেছে।
এ গানে আপনার সঙ্গে আপনার মেয়ে ইন্নিমা রোশনিও ছিল…
আমার মেয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি সংগীতজগতেই আছে। সে আগে থেকেই ইমন চৌধুরীর স্টুডিওতে বেহালা বাজায়, গিটার বাজায়। এ ছাড়া আরও অনেক ব্যানারে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সঙ্গে জড়িত। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকেও কাজ করেছে। এবারই প্রথম আমার সঙ্গে বাজাল। সে আমার সঙ্গে একই মঞ্চে বাজাবে, এটা কোনো দিন ভাবিনি। সেও অনেক খুশি।
আপনি যাঁদের সঙ্গে গান করেন, তাঁরা কী বলছে?
যারা আমাকে ৫০ বছর ধরে চিনে, তাদের কাছে অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। সবাই বলছে, আপনার জন্যই এই গানটা, গানের সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে গেছেন। তবে অনেকে বলেছে, কোক স্টুডিওর মতো জায়গায়, যেটা কি না সারা বিশ্বের কাছে আয়নার মতো, সেখানে গাওয়া কীভাবে সম্ভব হইছে! আসলে মালিকের তরফ থেকে সবই হয়ে যায়। মালিক সবার জীবনে এ রকম সুযোগ দেয়। সেটাকে কাজে লাগাতে হয় আর সম্মানের সহিত ধরে রাখতে হয়।
গুণিন সিনেমায় গেয়েছেন। আবারও কি আপনাকে সিনেমার গানে পাওয়া যাবে?
যদি ওই ধরনের গান হয়, যাতে আমার কণ্ঠ মানায়। মার্জিত হয়। যদি কোনো অশ্লীলতা না থাকে, তাহলে আবারও সিনেমায় গাইব।
দীর্ঘদিন ধরে বাউল গানের সঙ্গে জড়িত আপনি। শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
আমি সংগীত পরিবারের মানুষ। মাদারীপুরের সন্ন্যাসীচর গ্রামে আমাগো বাড়ির উঠানে গানের আসর বসত। আমার দাদা মারফতের মানুষ ছিল। তখন বাড়ির মইধ্যে পালাগান, জারিগান, সারিগান শুনতাম। আমার বাবা হইল আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। তাঁর কাছ থেকেই গানের হাতেখড়ি। আর প্রথম গান করেছি মিরপুর মাজারে। যুদ্ধের পর যখন ঢাকায় থাকা শুরু করি, তখন একদিন ছোট বোনরে নিয়া মাজারের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি এক অন্ধ মহিলা গান গাইতাছেন। আসর পাইতা সবাই তাঁর গান শুনতাছে। গান শ্যাষ হওয়ার পর কইলাম, আমি একটা গান গাব। তখন সবাই কইল, এত ছোট মানুষ কী গান গাইবা। একজন আমার বোনটাকে কোলে নিল। আমি গাইলাম। গান শুইনা অনেকেই ১০ পয়সা, চার আনা, আট আনা করে উপহার দিল। বোনরে চকলেট কিন্না দিল। সেই থেকে শুরু।
আপনাকে অনেকেই বাউলমাতা বলেন। এই বিষয়টি আপনার কাছে কেমন লাগে?
৫০ বছরের মতো সময় ধরে গান করছি। যারা আমার গান ভালোবাসে, তারা এই উপাধি দিয়েছে। তাদের ভালোবাসাই তো শক্তি। অনেক সময় নিজের কাছে লজ্জা লাগে। তবে কেউ আমাকে বাউলমাতা বলবে, এটা কখনোই চাইনি। আমার চাইতে আরও ভালো প্রবীণ শিল্পী রয়েছেন। অনেকে আবার বাউল গান নিয়ে গবেষণাও করেছেন।
দীর্ঘ এ পথচলায় কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তবে বেশি না, অল্পস্বল্প। কিছু মানুষ আছে, যারা গানটাকে ভালোবাসে না। দেখা যায় গান করতে গেলাম, সেখানে তারা বাধা দিল। তখন আলোচনা করে সমাধান করি সবাই মিলে। তবে গান একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, এ রকম হয়নি। আসলে আমরা বাউলশিল্পীরা কখনোই ঝগড়া-বিবাদ করতে পৃথিবীতে আসি নাই। আমরা আসছি প্রেম, মানবতা বিতরণ করতে। মানুষের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করতে। যারা বাউল গানের আয়োজন করে আর যারা শোনে, তারা কিন্তু সন্ত্রাসী মনমানসিকতার নয়। একদম মাটির মানুষ। বাউল গান যেমন সহজ-সরল, আত্মার কথা বলে, মানবতার কথা বলে, তারাও ঠিক তেমন।
বিচ্ছেদ, পালাগানসহ বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছেন। কোন ধরনের গান গেয়ে বেশি তৃপ্তি পান?
আধ্যাত্মিক গান করে আত্মার শান্তি লাগে। তারপর আবেদন-নিবেদন। এটার মানে হলো, আমি তোমার কাছে নিজেকে অর্পণ করে দিতে চাই, তোমার মাঝে নিঃস্ব হতে চাই। তোমার মাঝেই ছিলাম, তোমার মাঝেই যেতে চাই। এখানে দুনিয়ার মোহে কিছু দোষ আমার অন্তরে প্রবেশ করে অন্তর্যামীকে তাড়িয়ে দিয়েছি। সে তো থাকতেই চেয়েছিল কিন্তু আমি তাকে উপযুক্ত অন্তর দিতে পারি নাই। অন্তরের মধ্যে দুনিয়াদারির কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, অহংকার বসিয়ে রেখেছি। এগুলোর কারণে অন্তর্যামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমি মালিকশূন্য হয়ে গেছি। এই কথাগুলো নিয়ে ভাবরেখা রেখে যখন আমি স্টেজে আত্মনিবেদন করি, তখন নিজের মধ্যে শান্তি লাগে।
গানও লিখেছেন আপনি। আপনার লেখা গানের সংখ্যা কত হবে?
আমার লেখা গানের সংখ্যা এক হাজারের বেশি হবে। এর মধ্যে বিচ্ছেদের গানের সংখ্যা বেশি।
প্রযুক্তির উন্নতির কারণে গান প্রকাশের মাধ্যমেও পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দেশের বাউলেরা এ প্রযুক্তির সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছেন?
আসলে একের পর উন্নতি হইতাছে। সব মানুষের নাগালে চলে আইতাছে। মোবাইল টিপলেই একটা গান চলে আসে। এটারে মেনে নিতে হবে। আমরা সহজ মানুষ, তাই একটু কষ্ট হচ্ছে। তবে প্রযুক্তির কারণে অনেক কিছু সহজ হয়েছে। অনেকে ইউটিউবে আমাদের গান দেখে যোগাযোগ করছেন গান করার জন্য। আগে এ ব্যাপারটা অনেক কঠিন ছিল। অনেক সময় আমরা নিজেরা মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে গান কমিটির সঙ্গে আলাপ করতে যেতাম। এ ছাড়া আগে একটা গান লাইভ রেকর্ড হতো। ভুল হলে সেটাই রেকর্ড করে চালিয়ে দিত। এখন একটা গান ভুল হলে আবার গাওয়ার সুযোগ আছে।
বাউলশিল্পীদের কি সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে?
আমরা যখন আসরে থাকি, তখন আমাদেরকে সবাই ভালোবাসে। যখন আসর থেকে নেমে যাই, তখন সমাজের বড় একটা অংশের কাছে আমরা ভালো মানুষ না। গান গাওয়া কোনো কাজ হইল নাকি? এটাই তাদের মনোভাব। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ আমাদের ভালো চোখে দেখে না। এই মনোভাবটা পাল্টানো দরকার। সরকারিভাবেও বাউলশিল্পীদের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া দরকার। শিল্পীরা সরকারিভাবে অনেক অবহেলিত।
১৯৮৯ সাল থেকে বিটিভি ও রেডিওতে নিয়মিত গান করি। সেখানেও পারিশ্রমিক সঠিক সময়ে দেওয়া হয় না। আমি তো গান করেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা করি। আমারও তো অভাব আছে। সবাই তো শখের বসে গান করে না। পেটের জন্যও অনেকে গান করে। দেখা গেল নিজের টাকা খরচ করে দল নিয়ে গান করলাম, অথচ আমার পারিশ্রমিক সঠিক সময়ে এল না। কবে যে পারিশ্রমিক পাব, এটা কিন্তু আমার জানা নাই। অনেক সময় দেখা যায় গান গাওয়ার ছয় মাস পর আমরা চেক পাই।
নতুন প্রজন্মের যাঁরা বাউল গানের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁদের মধ্যে সাধনার ব্যাপারটি কতটা লক্ষ করেন?
এখনকার সময়ে যাঁরা বাউল গান করেন, তাঁদের মধ্যে সাধনার বিষয়টি খুব কম। নতুন যাঁরা গান করেন, তাঁদের মধ্যে বাণিজ্যিক মনমানসিকতা বেশি। কয়েকটা গান করেই শুরু করে দিলাম টাকা কামানোর ধান্ধা। এটার মধ্যে কোনো জীবন নাই। এমন চিন্তার মানুষের মধ্যে সংগীত বেঁচে থাকবে না।
তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
যাঁরা গানের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান, তাঁরা যেন নিয়মিত গানের চর্চাটা করেন। বাউল গানের ওপর অনেক বই আছে। সেগুলো পড়তে হবে। বই পড়লে জ্ঞান চর্চা হয় এবং নিজের পথচলা সহজ হয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশে নয়, পরমকে সন্তুষ্ট করার জন্য যেন গানটা করা হয়। তাহলে এমনিতেই নিজের ওপর দয়া এবং রহমত চলে আসবে।
কোক স্টুডিওতে আপনার গাওয়া গানটি দর্শক অনেক পছন্দ করেছেন। কেমন লাগছে?
অনেক ভালো লাগতাছে। সকলে অনেক প্রশংসা করতাছে। এর আগে আমি টেলিভিশনে অনেক গাইছি। কিন্তু এভাবে সকলের স্বীকৃতি, এটা আগে কখনো হয় নাই। জনপ্রিয় ও বিশাল একটা মাধ্যমে আমাকে ডাকবে, এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। মালিকের দয়া হইছে, তাঁর দয়ার মাধ্যমেই ইমন চৌধুরী আমাকে ডাকছে।
ইমন চৌধুরীর সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
ইমন চৌধুরীর বাবা অনেক বড় ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নরসিংদীতে। সেখানে পালাগান খুব জনপ্রিয়। ৩৫ বছর আগে যখন আমি পালাগান, বিচ্ছেদের ক্যাসেট বের করি, তখন থেকে ইমনের বাবা আমাকে পালাগান শিল্পী হিসেবে চেনেন। সেখান থেকেই ইমন আমার সম্পর্কে জানে। যখন ‘গুণিন’ সিনেমার গানটির জন্য বাউলশিল্পী খুঁজছিলেন সেলিম সাহেব ও তাঁর দল, তখন ইমন চৌধুরী তাঁদের জানায়, গানটি আলেয়া বেগমের কণ্ঠে ভালো হবে। সে সময়ে তাঁদের সঙ্গে আমার মেয়ে ছিল। সে বলল, আলেয়া বেগম আমার আম্মু। সেখান থেকেই ইমন চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়। তার মাধ্যমে গুণিন সিনেমায়ও গাওয়ার সুযোগ হইছিল। এবার কোক স্টুডিওতে গাইলাম।
‘কথা কইয়ো না’ গানটি করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
কোক স্টুডিওর জন্য এ রকম একটা গান হবে, সেটা আমাকে বলা হয়নি। একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম। নভেম্বর মাসের দিকে গানটি যখন রেকর্ড করি, তখন আমার সিজন চলছে। প্রতিদিন নানা জায়গায় স্টেজে স্টেজে সারা রাত প্রোগ্রাম করি। একদিন ইমন চৌধুরী ডাকল। আমি বললাম, বাবা, রেকর্ডিংয়ের জন্য অপ্রস্তুত। আমার কণ্ঠ তো একেবারে বসা, শরীরও ভালো না। সে বলল, সমস্যা নাই আন্টি। আপনি একটু আসেন। সে আমাকে সুরটি শুনাল। বললাম, বাবা, অনেক উঁচা সুর। এই মুহূর্তে এটা আমি পারমু না। পারবেন না ঠিক আছে, একবার একটু চেষ্টা করেন, বলল ইমন। যখন সুরটি দিলাম, তখন ইমন চৌধুরী বলল, আন্টি, আমার এই কণ্ঠটাই দরকার ছিল। বুঝলাম না কেন সে এমন কথা বলল। তাঁকে বললাম, এই কণ্ঠ দিয়া যদি গান বাইর করো, তাহলে যারা বায়না করছে, তারা সবাই ফিরায় নিয়া যাইব।
সে কয়, জানেন আন্টি, এই কণ্ঠটাই গানের জন্য পারফেক্ট। আমার কাছে কেমন জানি অবান্তর অবান্তর লাগল। কী করবে, এই কণ্ঠের গান দিয়া কী হবে! এখন কিন্তু সে রকম করে গাইতে পারব না। আমার কণ্ঠে কিন্তু ওইটা আসবে না। তখন যে ভিতর থেকে, অন্তর চেরা অনেক দুঃখের পরে একটা কান্না বা শেষ চিৎকারটা আসে, আমার মধ্য থেকে সে চিৎকারটা আসছিল। আমার মনে হয় মালিকের তরফ থেকে এই কণ্ঠটা ওই সময় বানানো হইছে।
আপনার কাছে কোক স্টুডিওর কোন দিকটা ভালো লেগেছে?
কোক স্টুডিও সুন্দর একেকটা সন্তান প্রসব করে। অনেক লালন-পালন করে এমন একটি ডেলিভারি দেয়, যেটায় সকলে মুগ্ধ হয়। তারা কোনো খুঁত রাখে না। আমার গাওয়ার মধ্যে একটা শব্দ আমার মতো করে করছিলাম। কথাটা হবে আইসে, সেটা গাওয়ার সময় হয়ে গেছে আইসা। এই একটা শব্দের জন্য ইমন চৌধুরী আমাকে বলল, আন্টি, আবার আসতে হবে। আমি বললাম, অবশ্যই। যারা একটি গানের জন্য এত কষ্ট করছে, তাদের জন্য আমি আবার গাইতে পারব। পরবর্তী সময়ে এই শব্দটার জন্য ওই পার্টটুকু আমাকে আবার গাইতে হয়েছিল। এই ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লেগেছে।
এ গানে আপনার সঙ্গে আপনার মেয়ে ইন্নিমা রোশনিও ছিল…
আমার মেয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি সংগীতজগতেই আছে। সে আগে থেকেই ইমন চৌধুরীর স্টুডিওতে বেহালা বাজায়, গিটার বাজায়। এ ছাড়া আরও অনেক ব্যানারে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সঙ্গে জড়িত। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকেও কাজ করেছে। এবারই প্রথম আমার সঙ্গে বাজাল। সে আমার সঙ্গে একই মঞ্চে বাজাবে, এটা কোনো দিন ভাবিনি। সেও অনেক খুশি।
আপনি যাঁদের সঙ্গে গান করেন, তাঁরা কী বলছে?
যারা আমাকে ৫০ বছর ধরে চিনে, তাদের কাছে অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। সবাই বলছে, আপনার জন্যই এই গানটা, গানের সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে গেছেন। তবে অনেকে বলেছে, কোক স্টুডিওর মতো জায়গায়, যেটা কি না সারা বিশ্বের কাছে আয়নার মতো, সেখানে গাওয়া কীভাবে সম্ভব হইছে! আসলে মালিকের তরফ থেকে সবই হয়ে যায়। মালিক সবার জীবনে এ রকম সুযোগ দেয়। সেটাকে কাজে লাগাতে হয় আর সম্মানের সহিত ধরে রাখতে হয়।
গুণিন সিনেমায় গেয়েছেন। আবারও কি আপনাকে সিনেমার গানে পাওয়া যাবে?
যদি ওই ধরনের গান হয়, যাতে আমার কণ্ঠ মানায়। মার্জিত হয়। যদি কোনো অশ্লীলতা না থাকে, তাহলে আবারও সিনেমায় গাইব।
দীর্ঘদিন ধরে বাউল গানের সঙ্গে জড়িত আপনি। শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
আমি সংগীত পরিবারের মানুষ। মাদারীপুরের সন্ন্যাসীচর গ্রামে আমাগো বাড়ির উঠানে গানের আসর বসত। আমার দাদা মারফতের মানুষ ছিল। তখন বাড়ির মইধ্যে পালাগান, জারিগান, সারিগান শুনতাম। আমার বাবা হইল আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। তাঁর কাছ থেকেই গানের হাতেখড়ি। আর প্রথম গান করেছি মিরপুর মাজারে। যুদ্ধের পর যখন ঢাকায় থাকা শুরু করি, তখন একদিন ছোট বোনরে নিয়া মাজারের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি এক অন্ধ মহিলা গান গাইতাছেন। আসর পাইতা সবাই তাঁর গান শুনতাছে। গান শ্যাষ হওয়ার পর কইলাম, আমি একটা গান গাব। তখন সবাই কইল, এত ছোট মানুষ কী গান গাইবা। একজন আমার বোনটাকে কোলে নিল। আমি গাইলাম। গান শুইনা অনেকেই ১০ পয়সা, চার আনা, আট আনা করে উপহার দিল। বোনরে চকলেট কিন্না দিল। সেই থেকে শুরু।
আপনাকে অনেকেই বাউলমাতা বলেন। এই বিষয়টি আপনার কাছে কেমন লাগে?
৫০ বছরের মতো সময় ধরে গান করছি। যারা আমার গান ভালোবাসে, তারা এই উপাধি দিয়েছে। তাদের ভালোবাসাই তো শক্তি। অনেক সময় নিজের কাছে লজ্জা লাগে। তবে কেউ আমাকে বাউলমাতা বলবে, এটা কখনোই চাইনি। আমার চাইতে আরও ভালো প্রবীণ শিল্পী রয়েছেন। অনেকে আবার বাউল গান নিয়ে গবেষণাও করেছেন।
দীর্ঘ এ পথচলায় কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তবে বেশি না, অল্পস্বল্প। কিছু মানুষ আছে, যারা গানটাকে ভালোবাসে না। দেখা যায় গান করতে গেলাম, সেখানে তারা বাধা দিল। তখন আলোচনা করে সমাধান করি সবাই মিলে। তবে গান একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, এ রকম হয়নি। আসলে আমরা বাউলশিল্পীরা কখনোই ঝগড়া-বিবাদ করতে পৃথিবীতে আসি নাই। আমরা আসছি প্রেম, মানবতা বিতরণ করতে। মানুষের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করতে। যারা বাউল গানের আয়োজন করে আর যারা শোনে, তারা কিন্তু সন্ত্রাসী মনমানসিকতার নয়। একদম মাটির মানুষ। বাউল গান যেমন সহজ-সরল, আত্মার কথা বলে, মানবতার কথা বলে, তারাও ঠিক তেমন।
বিচ্ছেদ, পালাগানসহ বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছেন। কোন ধরনের গান গেয়ে বেশি তৃপ্তি পান?
আধ্যাত্মিক গান করে আত্মার শান্তি লাগে। তারপর আবেদন-নিবেদন। এটার মানে হলো, আমি তোমার কাছে নিজেকে অর্পণ করে দিতে চাই, তোমার মাঝে নিঃস্ব হতে চাই। তোমার মাঝেই ছিলাম, তোমার মাঝেই যেতে চাই। এখানে দুনিয়ার মোহে কিছু দোষ আমার অন্তরে প্রবেশ করে অন্তর্যামীকে তাড়িয়ে দিয়েছি। সে তো থাকতেই চেয়েছিল কিন্তু আমি তাকে উপযুক্ত অন্তর দিতে পারি নাই। অন্তরের মধ্যে দুনিয়াদারির কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, অহংকার বসিয়ে রেখেছি। এগুলোর কারণে অন্তর্যামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমি মালিকশূন্য হয়ে গেছি। এই কথাগুলো নিয়ে ভাবরেখা রেখে যখন আমি স্টেজে আত্মনিবেদন করি, তখন নিজের মধ্যে শান্তি লাগে।
গানও লিখেছেন আপনি। আপনার লেখা গানের সংখ্যা কত হবে?
আমার লেখা গানের সংখ্যা এক হাজারের বেশি হবে। এর মধ্যে বিচ্ছেদের গানের সংখ্যা বেশি।
প্রযুক্তির উন্নতির কারণে গান প্রকাশের মাধ্যমেও পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দেশের বাউলেরা এ প্রযুক্তির সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছেন?
আসলে একের পর উন্নতি হইতাছে। সব মানুষের নাগালে চলে আইতাছে। মোবাইল টিপলেই একটা গান চলে আসে। এটারে মেনে নিতে হবে। আমরা সহজ মানুষ, তাই একটু কষ্ট হচ্ছে। তবে প্রযুক্তির কারণে অনেক কিছু সহজ হয়েছে। অনেকে ইউটিউবে আমাদের গান দেখে যোগাযোগ করছেন গান করার জন্য। আগে এ ব্যাপারটা অনেক কঠিন ছিল। অনেক সময় আমরা নিজেরা মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে গান কমিটির সঙ্গে আলাপ করতে যেতাম। এ ছাড়া আগে একটা গান লাইভ রেকর্ড হতো। ভুল হলে সেটাই রেকর্ড করে চালিয়ে দিত। এখন একটা গান ভুল হলে আবার গাওয়ার সুযোগ আছে।
বাউলশিল্পীদের কি সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে?
আমরা যখন আসরে থাকি, তখন আমাদেরকে সবাই ভালোবাসে। যখন আসর থেকে নেমে যাই, তখন সমাজের বড় একটা অংশের কাছে আমরা ভালো মানুষ না। গান গাওয়া কোনো কাজ হইল নাকি? এটাই তাদের মনোভাব। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ আমাদের ভালো চোখে দেখে না। এই মনোভাবটা পাল্টানো দরকার। সরকারিভাবেও বাউলশিল্পীদের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া দরকার। শিল্পীরা সরকারিভাবে অনেক অবহেলিত।
১৯৮৯ সাল থেকে বিটিভি ও রেডিওতে নিয়মিত গান করি। সেখানেও পারিশ্রমিক সঠিক সময়ে দেওয়া হয় না। আমি তো গান করেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা করি। আমারও তো অভাব আছে। সবাই তো শখের বসে গান করে না। পেটের জন্যও অনেকে গান করে। দেখা গেল নিজের টাকা খরচ করে দল নিয়ে গান করলাম, অথচ আমার পারিশ্রমিক সঠিক সময়ে এল না। কবে যে পারিশ্রমিক পাব, এটা কিন্তু আমার জানা নাই। অনেক সময় দেখা যায় গান গাওয়ার ছয় মাস পর আমরা চেক পাই।
নতুন প্রজন্মের যাঁরা বাউল গানের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁদের মধ্যে সাধনার ব্যাপারটি কতটা লক্ষ করেন?
এখনকার সময়ে যাঁরা বাউল গান করেন, তাঁদের মধ্যে সাধনার বিষয়টি খুব কম। নতুন যাঁরা গান করেন, তাঁদের মধ্যে বাণিজ্যিক মনমানসিকতা বেশি। কয়েকটা গান করেই শুরু করে দিলাম টাকা কামানোর ধান্ধা। এটার মধ্যে কোনো জীবন নাই। এমন চিন্তার মানুষের মধ্যে সংগীত বেঁচে থাকবে না।
তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
যাঁরা গানের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান, তাঁরা যেন নিয়মিত গানের চর্চাটা করেন। বাউল গানের ওপর অনেক বই আছে। সেগুলো পড়তে হবে। বই পড়লে জ্ঞান চর্চা হয় এবং নিজের পথচলা সহজ হয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশে নয়, পরমকে সন্তুষ্ট করার জন্য যেন গানটা করা হয়। তাহলে এমনিতেই নিজের ওপর দয়া এবং রহমত চলে আসবে।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে