ড. মইনুল ইসলাম
দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে নিমজ্জমান তার সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখুন: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে পতনের ধারা, মারাত্মক ডলার-সংকটের কারণে আমদানির এলসি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ থেকে ২০২৪ সালের মার্চে ১১০-১৫ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশি টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ২৮ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ। আরেকটু বিস্তৃতভাবে কয়েকটি সংকটের বর্তমান ভয়াবহতা দেখুন:
১. আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের যে ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা সামাল দিতে পারছে না সরকার।
২. ২০২১ সালের আগস্টে দেশে ১ ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দুই বছরে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে ১ ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকায়। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ২৮ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে।
৩. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ, হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হওয়া।
৪. কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকেরা এলসি খুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৭-১১৮ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
৫. আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এই চারটি প্রধান অর্থ পাচার-প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাঁদের অবস্থান। তাঁরা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তাঁরা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তাঁরা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ফ্রেটারনিটি ও মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন।
৬. আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯ দশমিক ৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি।
উপরোল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধান অযোগ্য কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রীর অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে অনেকগুলো সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পরিণত হয়েছে। নতুন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে আশা করি দেশ ক্রমেই এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠবে। তবে প্রথমেই প্রয়োজন হবে সরকারি নীতির দিক পরিবর্তন। বিগত দিনে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানো, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল, সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, ব্যাংকের প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ইতিমধ্যেই সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণে পরিণত হলেও রাঘব বোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নানা রকম অযৌক্তিক ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার সুবন্দোবস্ত করে চলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, যার ফলে দেশের সুপরিচিত বড় বড় ঋণখেলাপির প্রায় সবাই এখন এই তালিকা থেকে নিজেদের নাম লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। দ্বিতীয় যে নজিরটি উল্লেখ করা যায় সেটি হলো, ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা পুঁজি দেশে ফেরত নিয়ে আসার যে ব্যবস্থা সাবেক অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন, এর মাধ্যমে পরবর্তী অর্থবছরে একটি কানাকড়িও দেশে ফেরত আসেনি।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে। এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, এর পরিবর্তে এখন একঝাঁক সমস্যা অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, যেটা সত্যিই দুঃখজনক।
বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার বেশির ভাগ ব্যাংকের ঋণ। সরকারেরই একটি প্রতিষ্ঠান সিআইডি বলছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়াতেই প্রতিবছর বিদেশে পুঁজি পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্কিং অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছরে সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য জিনি সহগ সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত পরিমাপক। কোনো অর্থনীতির জিনি সহগ যখন বেড়ে শূন্য দশমিক ৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা শূন্য দশমিক ৫ অতিক্রম করে, তখন ওই দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে নিমজ্জমান তার সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখুন: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে পতনের ধারা, মারাত্মক ডলার-সংকটের কারণে আমদানির এলসি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ থেকে ২০২৪ সালের মার্চে ১১০-১৫ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশি টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ২৮ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ। আরেকটু বিস্তৃতভাবে কয়েকটি সংকটের বর্তমান ভয়াবহতা দেখুন:
১. আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের যে ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা সামাল দিতে পারছে না সরকার।
২. ২০২১ সালের আগস্টে দেশে ১ ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দুই বছরে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে ১ ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকায়। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ২৮ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে।
৩. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ, হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হওয়া।
৪. কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকেরা এলসি খুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৭-১১৮ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
৫. আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এই চারটি প্রধান অর্থ পাচার-প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাঁদের অবস্থান। তাঁরা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তাঁরা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তাঁরা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ফ্রেটারনিটি ও মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন।
৬. আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯ দশমিক ৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি।
উপরোল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধান অযোগ্য কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রীর অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে অনেকগুলো সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পরিণত হয়েছে। নতুন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে আশা করি দেশ ক্রমেই এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠবে। তবে প্রথমেই প্রয়োজন হবে সরকারি নীতির দিক পরিবর্তন। বিগত দিনে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানো, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল, সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, ব্যাংকের প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ইতিমধ্যেই সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণে পরিণত হলেও রাঘব বোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নানা রকম অযৌক্তিক ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার সুবন্দোবস্ত করে চলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, যার ফলে দেশের সুপরিচিত বড় বড় ঋণখেলাপির প্রায় সবাই এখন এই তালিকা থেকে নিজেদের নাম লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। দ্বিতীয় যে নজিরটি উল্লেখ করা যায় সেটি হলো, ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা পুঁজি দেশে ফেরত নিয়ে আসার যে ব্যবস্থা সাবেক অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন, এর মাধ্যমে পরবর্তী অর্থবছরে একটি কানাকড়িও দেশে ফেরত আসেনি।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে। এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, এর পরিবর্তে এখন একঝাঁক সমস্যা অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, যেটা সত্যিই দুঃখজনক।
বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার বেশির ভাগ ব্যাংকের ঋণ। সরকারেরই একটি প্রতিষ্ঠান সিআইডি বলছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়াতেই প্রতিবছর বিদেশে পুঁজি পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্কিং অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছরে সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য জিনি সহগ সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত পরিমাপক। কোনো অর্থনীতির জিনি সহগ যখন বেড়ে শূন্য দশমিক ৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা শূন্য দশমিক ৫ অতিক্রম করে, তখন ওই দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে