সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ
দেরাজ খুলতেই সেদিকে চোখ গেল। না, তেমন কিছু নয়—তিনটি পাসপোর্ট। তার একটি সবুজ রঙের বাংলাদেশের পাসপোর্ট—আমার বর্তমান ভ্রমণ ছাড়পত্র। অন্য দুটো—লাল ও নীলটি—জাতিসংঘের সময়োত্তীর্ণ ছাড়পত্র। জাতিসংঘে আমার কর্মময় জীবনের সাক্ষী তারা।
নীলটি ছিল প্রথম দিকে, তারপর পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লাল পাসপোর্টে রূপান্তর। কোন দেশে নেয়নি তারা আমাকে? বিশ্বের ৯৫টি দেশে তারা আমাকে পৌঁছে দিয়েছে কোনো প্রশ্ন ব্যতিরেকেই। শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান ছাড়পত্র তারা, সন্দেহ নেই। তবে তার মধ্যে ওই সবুজটিই মন-নাড়ানিয়া, হৃদয়-কাড়ানিয়াও বলা চলে। যতবারই সবুজ পাসপোর্টটির দিকে চোখ যায়, ততবারই বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে ওঠে। আহ্, এক টুকরা বাংলাদেশ সর্বদা হৃদয়ে বহন করি।
ওই ছাড়পত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, বড় কম দিন তো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করিনি—তেতাল্লিশ বছর। ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পরীক্ষার ফল বের না হওয়ায় প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়নি। পঞ্চাশ বছর আগে একই পরিস্থিতিতে অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্তের নিয়োগের উদাহরণ টেনে আমাকেও প্রথম নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল মাসিক ৪০০ টাকায় টিউটর হিসেবে। ১৯৭৬ সালের মার্চ নাগাদ ফল বেরোলে আমার নিয়োগের রূপান্তর ঘটে প্রভাষকে।
প্রায় দুই দশক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে কাজ করতে এলাম আন্তর্জাতিক বলয়ে ১৯৯২ সালে—জাতিসংঘে। কর্মস্থল নিউইয়র্কে। এ কাজেও তো প্রায় কাটালাম তিন দশক। হাসি-আনন্দে, সুখে-দুঃখে, শোকে-বেদনায় এতগুলো বছর কেটে গেল! কর্মক্ষেত্রে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা, কত অনন্যসাধারণ মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, কত প্রতিভাবান উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণী কাজ করেছে আমার সঙ্গে।
বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফস্বল শহরের ছেলে আমি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা কলেজশিক্ষক ছিলেন, মায়ের পড়াশোনা প্রাইমারি অবধি। না, কোনো অভিজাত স্কুল-কলেজে যাইনি, বাংলা মাধ্যমেরই ছাত্র। উচ্চশিক্ষা ঢাকা আর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যেখান থেকে এসে যেসব কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, সে আমার ভাগ্য বলে মানি, নমিত হই বারবার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন নোবেল বিজয়ীদের সঙ্গে কাজ করেছি, রাজা-রানি, যুবরাজ-রাজকুমারী, রাষ্ট্রপ্রধান-প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসেছি, অথবা বিশ্বের বিখ্যাত নামীদামি সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি, তখন প্রায়ই সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। উৎপল দত্তের ভাষায়, ‘প্রেত্যয় হয়নি’।
মনে পড়ে যায়, একটা সময়ে দিনের বেশির ভাগই কেটেছে জাতিসংঘ ভবনে। কোনো কোনো দিন সারা রাত নানান বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কত সুনন্দ মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, কত বন্ধুত্ব হয়েছে কতজনের সঙ্গে, কত মানুষ ঋদ্ধ করেছেন আমার জীবন। কাজে কেটে গেছে কত দীর্ঘ সময়, তার মধ্যে হাসি-ঠাট্টায় উচ্চকিত হয়েছে চারপাশ, উড়ে গেছে পেয়ালার পর পেয়ালা কফি।
বহু সময় কেটেছে আমার ওপরওয়ালা জাতিসংঘ মহাসচিবদের সান্নিধ্যে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অনন্য সুযোগ হয়েছে দুজন মহাসচিবের সঙ্গে—প্রয়াত মহাসচিব কফি আনান আর বান কি মুনের সঙ্গে।
নানান উচ্চপর্যায়ের পর্ষদের সদস্য ছিলাম, নানান জরুরি সময়ে মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হয়েছে।
একবার মহাসচিবের কক্ষে এক বৈঠকের সময় কাগজের ধারালো দিকে লেগে আঙুল কেটে গিয়েছিল বান কি মুনের। হইচই পড়ে গিয়েছিল—দপ্তরকর্মীরা দৌড়ালেন ব্যান্ড-এইডের জন্য। আমি তাঁর পাশেই বসেছিলাম। আমার মানিব্যাগ খুলে একটা ব্যান্ড-এইড বের করে তাঁর আঙুলে লাগিয়ে দিলাম। অবাক মানলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে সেটা আমার মানিব্যাগে এল। আমি হেসে বললাম, আমার কন্যারা যখন ছোট, তখন তারা প্রায়ই হাত-পা কাটত। তাদের জন্য আমি মানিব্যাগে ব্যান্ড-এইড রাখতাম। অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে। হেসে ফেলেছিলেন তিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘আপনি খুবই ভালো বাবা’। তাঁর শৈশব-কৈশোরে কোরিয়া যুদ্ধের পরে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের দেওয়া পাঠ্যপুস্তকের সাহায্যে পড়াশোনার গল্প শুনিয়েছিলেন বান কি মুন এক পড়ন্ত বিকেলে।
অনেক ব্যক্তিগত গল্প হতো দুজনের সঙ্গেই। কফি আনান ঘানায় তাঁর বড় হয়ে ওঠার গল্প করতেন, শরণার্থী সংস্থায় তাঁর যৌবনের কাজের গল্প করতেন। মহাসচিব হওয়ার আগে রুজভেল্ট দ্বীপে থাকতেন তিনি। দপ্তরে যাওয়ার পথে দেখা হতো প্রায়ই। একদিন তাঁর পুত্র কোজোর কথা বলেছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী নানা আনানের আঁকা ছবি দেখার জন্য একবার আমন্ত্রিত হয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। কফি আনান এবং বান কি মুন দুজনেই চমৎকার মানুষ ছিলেন। বেনুর স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞেস করতেন, আমার কন্যাদের খোঁজখবর নিতেন। বাংলাদেশের হাল-হকিকত জানতে চাইতেন।
কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে এটা ভাবতে যে এ জীবনে পৃথিবীর কত দেশে গিয়েছি। আমার মতো মানুষের জন্য সে যে কত বড় সৌভাগ্য! কি সব আশ্চর্য সেসব ভূখণ্ড—দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ, জর্ডানের মৃত সমুদ্র, ব্রাজিলের আমাজন অরণ্য, জাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। সাহারার গরমে গা পুড়ে গেছে, আইসল্যান্ডের তুষার ঝড়ে পড়েছি, জাম্বিয়ার অরণ্যে পথ হারিয়েছি, কেপটাউনের লাঙ্গা বস্তিতে গিয়ে ভয়ে কেঁপেছি। রবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার কারাবাসে গিয়ে মাথা নুয়ে গেছে, সেনেগালের গোরি দ্বীপে গিয়ে দাসপ্রথার কথা ভেবে মন কেমন যেন হয়ে গেছে, ইয়েমেনের সন্ত্রাসের জায়গাগুলো দেখে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণায় মন ভরে গেছে।
কত রাজধানী থেকে রাজধানীতে গিয়েছি। ২০১৭ সালে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ১৫ দিনে ১২টি রাজধানীতে উপস্থিত ছিলাম। তার মধ্যে ঢাকাও ছিল। এক বিমানবন্দর থেকে আরেক বিমানবন্দরে পাড়ি দিয়েছি। কতশত হোটেলে যে থেকেছি, তার গোনা-গুনতি না করাই ভালো—রাত্রিবাস নম্বরে পরিণত হয়েছিল। সেসবের কোনো কিছুই মনে নেই। নানান রাজধানীর দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ভুলে গেছি। বিস্মৃত হয়েছি কোথায় কোন হোটেলে ছিলাম। মনে নেই কোন সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছি।
আসলে পৃথিবীর যেখানেই গেছি, সেখানেই সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত হয়েছি মানুষের প্রতি। মস্কোর শেষ বিকেলের মেয়েটিকে মনে আছে, সিরিয়ার সেই শরণার্থী শিশুটির কথা ভুলিনি, যে আলেপ্পো থেকে নিয়ে আসা তার ছেঁড়া পুতুলটি ছাড়বে না, মনের চোখে চীনের সেই ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখতে পাই, যারা মুখোমুখি দুটো সাইকেলের হাতল ধরে তাদের ভালোবাসার যতি টানছিল, মুষলধারে বর্ষার মধ্যে ইউক্রেনের যে মা নিজে ভিজে জবজবে হয়ে তিনটি বাচ্চাকে নিজের ছেঁড়া কোট দিয়ে রক্ষা করছিলেন, তাঁর ছবি এখনো আমাকে তাড়া করে। আসলে স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই সব মানুষ, যাঁদের সঙ্গে দেখা পথে-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে, অরণ্যে-লোকালয়ে। মনের মধ্যে তাঁদের ‘নিত্য আনাগোনা’।
দেশে দেশে আমার দেখা নানান মানুষের কেউ কেউ আমার লেখায় উঠে এসেছে, কিন্তু লেখা হয়নি বহু মানুষের কথা। লন্ডনের এক মেমসাহেবের কথা এখনো তো লিখে উঠতে পারিনি, লিখিনি মলদোভার সেই তরুণী বধূটির কথা, যিনি পরম মমতায় যত্ন করে রাখেন তাঁর পঙ্গু স্বামীটিকে, বাহরাইনের সেই ডাক্তারটির কথা, যিনি প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ মাইল ঘুরে ঘুরে রোগী দেখেন। লেখা হয়নি আয়ারল্যান্ডের সেই ঋষিতুল্য বৃদ্ধের কথা, যিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘গ্রন্থই আমার জীবন’, রোমানিয়ার সেই জিপসি নারীর কথা, যিনি দাবি করেছিলেন যে আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভাই, কিংবা দক্ষিণ সুদানের সেই শিশুটির কথা, যে আমার চশমাটি চেয়েছিল। এদের সবাইকে নিয়ে মনের মধ্যে একধরনের আর্তি আছে। লিখতে কি পারব সবার কথা? কে জানে?
জানি, এ দীর্ঘ ভ্রমণ-যাত্রায় যেসব জায়গায় গিয়েছি, সেখানেও আর যাওয়া হবে না। আর গেলেই বা কি? এক নদীতে যেমন দুবার পা দেওয়া যায় না, এক শহরেও দুবার যাওয়া যায় না। তারচেয়েও বড় কথা, এ পথ চলায় নানান শহরে যাঁদের দেখা পেয়েছিলাম, দেখা হবে না হয়তো তাঁদের কারও সঙ্গেই এ জীবনে।
এ জীবনে কতজনের কাছে যে কত ঋণ—দিয়েছি যা, নিয়েছি তো তারচেয়ে অনেক বেশি। ও নিয়ে বড় একটা ভাবি না।
জগতের সব ঋণ শুধবার নয়, আর তা শোধ করাও যায় না এক জীবনে।
দেরাজ খুলতেই সেদিকে চোখ গেল। না, তেমন কিছু নয়—তিনটি পাসপোর্ট। তার একটি সবুজ রঙের বাংলাদেশের পাসপোর্ট—আমার বর্তমান ভ্রমণ ছাড়পত্র। অন্য দুটো—লাল ও নীলটি—জাতিসংঘের সময়োত্তীর্ণ ছাড়পত্র। জাতিসংঘে আমার কর্মময় জীবনের সাক্ষী তারা।
নীলটি ছিল প্রথম দিকে, তারপর পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লাল পাসপোর্টে রূপান্তর। কোন দেশে নেয়নি তারা আমাকে? বিশ্বের ৯৫টি দেশে তারা আমাকে পৌঁছে দিয়েছে কোনো প্রশ্ন ব্যতিরেকেই। শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান ছাড়পত্র তারা, সন্দেহ নেই। তবে তার মধ্যে ওই সবুজটিই মন-নাড়ানিয়া, হৃদয়-কাড়ানিয়াও বলা চলে। যতবারই সবুজ পাসপোর্টটির দিকে চোখ যায়, ততবারই বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে ওঠে। আহ্, এক টুকরা বাংলাদেশ সর্বদা হৃদয়ে বহন করি।
ওই ছাড়পত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, বড় কম দিন তো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করিনি—তেতাল্লিশ বছর। ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পরীক্ষার ফল বের না হওয়ায় প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়নি। পঞ্চাশ বছর আগে একই পরিস্থিতিতে অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্তের নিয়োগের উদাহরণ টেনে আমাকেও প্রথম নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল মাসিক ৪০০ টাকায় টিউটর হিসেবে। ১৯৭৬ সালের মার্চ নাগাদ ফল বেরোলে আমার নিয়োগের রূপান্তর ঘটে প্রভাষকে।
প্রায় দুই দশক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে কাজ করতে এলাম আন্তর্জাতিক বলয়ে ১৯৯২ সালে—জাতিসংঘে। কর্মস্থল নিউইয়র্কে। এ কাজেও তো প্রায় কাটালাম তিন দশক। হাসি-আনন্দে, সুখে-দুঃখে, শোকে-বেদনায় এতগুলো বছর কেটে গেল! কর্মক্ষেত্রে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা, কত অনন্যসাধারণ মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, কত প্রতিভাবান উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণী কাজ করেছে আমার সঙ্গে।
বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফস্বল শহরের ছেলে আমি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা কলেজশিক্ষক ছিলেন, মায়ের পড়াশোনা প্রাইমারি অবধি। না, কোনো অভিজাত স্কুল-কলেজে যাইনি, বাংলা মাধ্যমেরই ছাত্র। উচ্চশিক্ষা ঢাকা আর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যেখান থেকে এসে যেসব কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, সে আমার ভাগ্য বলে মানি, নমিত হই বারবার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন নোবেল বিজয়ীদের সঙ্গে কাজ করেছি, রাজা-রানি, যুবরাজ-রাজকুমারী, রাষ্ট্রপ্রধান-প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসেছি, অথবা বিশ্বের বিখ্যাত নামীদামি সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি, তখন প্রায়ই সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। উৎপল দত্তের ভাষায়, ‘প্রেত্যয় হয়নি’।
মনে পড়ে যায়, একটা সময়ে দিনের বেশির ভাগই কেটেছে জাতিসংঘ ভবনে। কোনো কোনো দিন সারা রাত নানান বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কত সুনন্দ মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, কত বন্ধুত্ব হয়েছে কতজনের সঙ্গে, কত মানুষ ঋদ্ধ করেছেন আমার জীবন। কাজে কেটে গেছে কত দীর্ঘ সময়, তার মধ্যে হাসি-ঠাট্টায় উচ্চকিত হয়েছে চারপাশ, উড়ে গেছে পেয়ালার পর পেয়ালা কফি।
বহু সময় কেটেছে আমার ওপরওয়ালা জাতিসংঘ মহাসচিবদের সান্নিধ্যে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অনন্য সুযোগ হয়েছে দুজন মহাসচিবের সঙ্গে—প্রয়াত মহাসচিব কফি আনান আর বান কি মুনের সঙ্গে।
নানান উচ্চপর্যায়ের পর্ষদের সদস্য ছিলাম, নানান জরুরি সময়ে মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হয়েছে।
একবার মহাসচিবের কক্ষে এক বৈঠকের সময় কাগজের ধারালো দিকে লেগে আঙুল কেটে গিয়েছিল বান কি মুনের। হইচই পড়ে গিয়েছিল—দপ্তরকর্মীরা দৌড়ালেন ব্যান্ড-এইডের জন্য। আমি তাঁর পাশেই বসেছিলাম। আমার মানিব্যাগ খুলে একটা ব্যান্ড-এইড বের করে তাঁর আঙুলে লাগিয়ে দিলাম। অবাক মানলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে সেটা আমার মানিব্যাগে এল। আমি হেসে বললাম, আমার কন্যারা যখন ছোট, তখন তারা প্রায়ই হাত-পা কাটত। তাদের জন্য আমি মানিব্যাগে ব্যান্ড-এইড রাখতাম। অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে। হেসে ফেলেছিলেন তিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘আপনি খুবই ভালো বাবা’। তাঁর শৈশব-কৈশোরে কোরিয়া যুদ্ধের পরে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের দেওয়া পাঠ্যপুস্তকের সাহায্যে পড়াশোনার গল্প শুনিয়েছিলেন বান কি মুন এক পড়ন্ত বিকেলে।
অনেক ব্যক্তিগত গল্প হতো দুজনের সঙ্গেই। কফি আনান ঘানায় তাঁর বড় হয়ে ওঠার গল্প করতেন, শরণার্থী সংস্থায় তাঁর যৌবনের কাজের গল্প করতেন। মহাসচিব হওয়ার আগে রুজভেল্ট দ্বীপে থাকতেন তিনি। দপ্তরে যাওয়ার পথে দেখা হতো প্রায়ই। একদিন তাঁর পুত্র কোজোর কথা বলেছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী নানা আনানের আঁকা ছবি দেখার জন্য একবার আমন্ত্রিত হয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। কফি আনান এবং বান কি মুন দুজনেই চমৎকার মানুষ ছিলেন। বেনুর স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞেস করতেন, আমার কন্যাদের খোঁজখবর নিতেন। বাংলাদেশের হাল-হকিকত জানতে চাইতেন।
কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে এটা ভাবতে যে এ জীবনে পৃথিবীর কত দেশে গিয়েছি। আমার মতো মানুষের জন্য সে যে কত বড় সৌভাগ্য! কি সব আশ্চর্য সেসব ভূখণ্ড—দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ, জর্ডানের মৃত সমুদ্র, ব্রাজিলের আমাজন অরণ্য, জাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। সাহারার গরমে গা পুড়ে গেছে, আইসল্যান্ডের তুষার ঝড়ে পড়েছি, জাম্বিয়ার অরণ্যে পথ হারিয়েছি, কেপটাউনের লাঙ্গা বস্তিতে গিয়ে ভয়ে কেঁপেছি। রবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার কারাবাসে গিয়ে মাথা নুয়ে গেছে, সেনেগালের গোরি দ্বীপে গিয়ে দাসপ্রথার কথা ভেবে মন কেমন যেন হয়ে গেছে, ইয়েমেনের সন্ত্রাসের জায়গাগুলো দেখে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণায় মন ভরে গেছে।
কত রাজধানী থেকে রাজধানীতে গিয়েছি। ২০১৭ সালে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ১৫ দিনে ১২টি রাজধানীতে উপস্থিত ছিলাম। তার মধ্যে ঢাকাও ছিল। এক বিমানবন্দর থেকে আরেক বিমানবন্দরে পাড়ি দিয়েছি। কতশত হোটেলে যে থেকেছি, তার গোনা-গুনতি না করাই ভালো—রাত্রিবাস নম্বরে পরিণত হয়েছিল। সেসবের কোনো কিছুই মনে নেই। নানান রাজধানীর দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ভুলে গেছি। বিস্মৃত হয়েছি কোথায় কোন হোটেলে ছিলাম। মনে নেই কোন সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছি।
আসলে পৃথিবীর যেখানেই গেছি, সেখানেই সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত হয়েছি মানুষের প্রতি। মস্কোর শেষ বিকেলের মেয়েটিকে মনে আছে, সিরিয়ার সেই শরণার্থী শিশুটির কথা ভুলিনি, যে আলেপ্পো থেকে নিয়ে আসা তার ছেঁড়া পুতুলটি ছাড়বে না, মনের চোখে চীনের সেই ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখতে পাই, যারা মুখোমুখি দুটো সাইকেলের হাতল ধরে তাদের ভালোবাসার যতি টানছিল, মুষলধারে বর্ষার মধ্যে ইউক্রেনের যে মা নিজে ভিজে জবজবে হয়ে তিনটি বাচ্চাকে নিজের ছেঁড়া কোট দিয়ে রক্ষা করছিলেন, তাঁর ছবি এখনো আমাকে তাড়া করে। আসলে স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই সব মানুষ, যাঁদের সঙ্গে দেখা পথে-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে, অরণ্যে-লোকালয়ে। মনের মধ্যে তাঁদের ‘নিত্য আনাগোনা’।
দেশে দেশে আমার দেখা নানান মানুষের কেউ কেউ আমার লেখায় উঠে এসেছে, কিন্তু লেখা হয়নি বহু মানুষের কথা। লন্ডনের এক মেমসাহেবের কথা এখনো তো লিখে উঠতে পারিনি, লিখিনি মলদোভার সেই তরুণী বধূটির কথা, যিনি পরম মমতায় যত্ন করে রাখেন তাঁর পঙ্গু স্বামীটিকে, বাহরাইনের সেই ডাক্তারটির কথা, যিনি প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ মাইল ঘুরে ঘুরে রোগী দেখেন। লেখা হয়নি আয়ারল্যান্ডের সেই ঋষিতুল্য বৃদ্ধের কথা, যিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘গ্রন্থই আমার জীবন’, রোমানিয়ার সেই জিপসি নারীর কথা, যিনি দাবি করেছিলেন যে আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভাই, কিংবা দক্ষিণ সুদানের সেই শিশুটির কথা, যে আমার চশমাটি চেয়েছিল। এদের সবাইকে নিয়ে মনের মধ্যে একধরনের আর্তি আছে। লিখতে কি পারব সবার কথা? কে জানে?
জানি, এ দীর্ঘ ভ্রমণ-যাত্রায় যেসব জায়গায় গিয়েছি, সেখানেও আর যাওয়া হবে না। আর গেলেই বা কি? এক নদীতে যেমন দুবার পা দেওয়া যায় না, এক শহরেও দুবার যাওয়া যায় না। তারচেয়েও বড় কথা, এ পথ চলায় নানান শহরে যাঁদের দেখা পেয়েছিলাম, দেখা হবে না হয়তো তাঁদের কারও সঙ্গেই এ জীবনে।
এ জীবনে কতজনের কাছে যে কত ঋণ—দিয়েছি যা, নিয়েছি তো তারচেয়ে অনেক বেশি। ও নিয়ে বড় একটা ভাবি না।
জগতের সব ঋণ শুধবার নয়, আর তা শোধ করাও যায় না এক জীবনে।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে