সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আন্দোলনটির সম্মুখযাত্রার সূচনা, সেটিতে ওই জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান ছিল কেন্দ্রীয় ঘটনা। পুরোনো জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান কেবল নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরে সমষ্টিগত অগ্রযাত্রার শুরুও ওখান থেকেই। প্রবল বিরোধিতা ও নির্মম দমন-পীড়নের মুখে নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি এগিয়েছে এবং সেই আন্দোলনই পরিণতিতে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এটি অসাম্প্রদায়িক। ভাষা ধর্মীয় বিভাজন মানে না, সাম্প্রদায়িকতার অবরোধ ভেঙে ফেলে এগিয়ে যায়।
ধর্মব্যবসায়ীরা বাংলা ভাষার ওপর নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক উৎপাত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভাষা সেসব তৎপরতাকে মোটেই গ্রাহ্য করেনি, সে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। ভাষা শুধু যে অসাম্প্রদায়িক তা নয়, ধর্মনিরপেক্ষও বটে। ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িকতাকেও অতিক্রম করে; কেননা তার ভেতরে থাকে পরিপূর্ণ ইহজাগতিকতা। ভাষা আত্মপ্রকাশের, সৃষ্টিশীলতার, সামাজিক যোগাযোগসহ অনেক কিছুরই মাধ্যম। ভাষার সাহায্যেই আমরা চিন্তা করি, অন্যের চিন্তাকে গ্রহণ করি, অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হই। ভাষা সমষ্টিগত স্মৃতির সৃষ্টিশীল সংরক্ষক। ভাষা ছাড়া তো মানুষ মূক ও বধির। অপরদিকে আবার ভাষা কোনো একটি শ্রেণির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভাষার সৃষ্টি সমবেতভাবে, সমষ্টিগত উদ্যোগে। বিশেষ শ্রেণি, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোক, ভাষাকে যে আটকে রাখবে, সেটা সম্ভব নয়। অতীতে সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
এই যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও শ্রেণিবিভেদ না-মানা, এর ভেতর রয়েছে গণতান্ত্রিকতা। গণতন্ত্র তো কেবল ভোটের ব্যাপার নয়, যদিও ভোট গণতন্ত্রকে কার্যকর করার একটি পদ্ধতি। ভোটের ভেতর দিয়ে মানুষ নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, সেটা ঠিক করে দেওয়ার অবকাশ পায়। কিন্তু ভোটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটবে—এমন নিশ্চয়তা যে সর্বদা থাকে, তা নয়। বাংলাদেশে সত্তর সালের নির্বাচনে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে রায় দিয়েছিল, তখনকার ক্ষমতাধরেরা সেটা মানেনি, উল্টো পাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়—এই আতঙ্কে রায়দানকারীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অতিভয়াবহ এক গণহত্যা ঘটায়। পরিণামে তারা অবশ্য ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইতিহাসের আস্তাকুঁড় জিনিসটা অলীক কল্পনা নয়, সেটি আছে, স্বৈরশাসকদের সেটি চূড়ান্ত সমাধিভূমি।
আস্তাকুঁড়ে কে আশ্রয় পেল কিংবা পেল না, সেটা আমাদের জন্য কোনো সান্ত্বনা হতে পারে না। আমাদের জন্য সুখের বিষয় হতো যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হতো। এ চেতনাটি হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। প্রকৃত গণতন্ত্রে অপরিহার্য শর্তের মধ্যে রয়েছে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, চিন্তার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের সুযোগ এবং নাগরিকদের পারস্পরিক সহনশীলতা। তবে এর মূল উপাদান হলো সব নাগরিকের জন্য অধিকার ও সুযোগের সাম্য। মাতৃভাষার চর্চা ওই অধিকার ও সুযোগের অংশ এবং স্মারক। মাতৃভাষা হচ্ছে সবার অবদান, প্রত্যেকের জন্য। স্বাভাবিকভাবে বাঁচার জন্য যেমন আলো, বাতাস ও পানি দরকার, তেমনি দরকার মাতৃভাষার চর্চা।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার যে ঠিকমতো চলছে না, বিঘ্নিত হচ্ছে নানাভাবে ও বিবিধ মাত্রায়, সেটাই অকাট্য প্রমাণ এই সত্যের যে ওই দুই চেতনার কোনোটাই বাস্তব রূপ পায়নি—না একুশের, না মুক্তিযুদ্ধের। শ্রেণিবিভাজন শিক্ষাকে তিন ধারায় ভাগ করে ফেলেছে, মূল ধারায় মাতৃভাষা চালু আছে বটে, কিন্তু ঠিকমতো নেই, অন্য দুই ধারায় তার প্রবেশাধিকার প্রায় নিষিদ্ধ। বিত্তবানেরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে না, কারণ তাদের দৃষ্টিতে বাংলা গরিব মানুষের ভাষা। বিত্তহীনেরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারে না সুযোগের অভাবে। রাষ্ট্র চলে বিত্তবানদের হুকুমে, তাদের হুকুম বাংলা ভাষার পক্ষে নয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আমরা তখনই মুক্ত হব এবং মুক্ত হয়েছি বলে জানতে পারব, মাতৃভাষা যখন শিক্ষার ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের সর্বজনীন মাধ্যম হবে, তার আগে নয়।
সার কথাটা এই দাঁড়ায় যে একুশের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উভয়েরই লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার দায়িত্ব যাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা যে নতুন রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই ঘটনাটি এমনি এমনি ঘটেনি। এর পেছনে কারও করুণা বা কোনো দুর্ঘটনা কাজ করেনি। সেটি ঘটেছে যুদ্ধের ভেতরে বিকশিত ও প্রকাশিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকেই। সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তি সম্ভব—যুদ্ধসময়ে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগই ছিল না।
কিন্তু রাষ্ট্র তার অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সরে এসেছে। রাষ্ট্র বাইরে যতই বদলাক, ভেতরে মোটেই বদলায়নি। স্বভাবে ও চরিত্রে সে আগের মতোই পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রয়ে গেছে। পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের স্বপ্ন আর জনগণের মুক্তির স্বপ্ন মোটেই এক ছিল না, ছিল বিপরীতমুখী, আসলে পরস্পরবিরোধী। পেটি বুর্জোয়ারা চাইছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়া হয়ে যেতে, জনগণ চাইছিল শোষণমূলক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক চূর্ণবিচূর্ণ করে মুক্ত হতে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পেটি বুর্জোয়াদের জন্য উন্নতির পথ খুলে দিয়েছে, জনগণ মুক্তি পায়নি। এক পক্ষের উন্নতি, অপর পক্ষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাসকশ্রেণি অর্থনৈতিক উন্নতিকে তাদের শাসনক্ষমতায় থাকার যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তাদের ভাবখানা এই রকমের, ‘দেখছ না কেমন সুস্বাদু পোলাও-কোরমা রান্না হচ্ছে’! কিন্তু জনগণের দিক থেকে প্রশ্ন থেকে যায়—পোলাও-কোরমা তো রান্না হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু খাবেটা কে? জনগণ বলবে, ‘আমরা যা পাচ্ছি, সেটা তো ওই বিলাসী খাদ্য নয়, পাচ্ছি উচ্ছিষ্ট।’ পুঁজিবাদী উন্নতিতে সাধারণ মানুষের ক্ষুধা মিটবে না, উল্টো দুর্দশাই বাড়বে। বাড়ছেও। মানুষের মধ্যে যে বিক্ষোভ তা আপাতত হয়তো দৃশ্যমান নয়, কারণ বিক্ষোভ প্রকাশের সুযোগকে ক্রমাগত সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে। দমন-নিপীড়ন, গুম, হত্যা ইত্যাদি সমানে চলছে। পুলিশ বাহিনী সব সময়ই জনবিরোধী ছিল, কিন্তু এখন তাদের যে দৌরাত্ম্য তেমনটা আগে কখনোই দেখা যায়নি। মানুষ ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট। চাপা দেওয়া অসন্তোষ হয়তো শেষ পর্যন্ত অরাজকতায় রূপ নেবে, হয়তো-বা একটা বিস্ফোরণই ঘটবে। কিন্তু সেটা মুক্তির পথ নয়।
মুক্তির পথ হচ্ছে পুঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার দিকে রাষ্ট্র ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটি করতে না পারলে পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। ক্ষমতাবানের দম্ভ ও নিপীড়ন, মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ, শিশুর প্রতি দানবীর অসহিষ্ণুতা, সর্বত্র বিস্তৃত দুর্নীতি সবকিছুই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর দিকে বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশ নীরব, বড় একটি অংশ বিদ্যমান ব্যবস্থার সমর্থন ও চাটুকারিতায় ব্যস্ত, বিবেকবান মানুষেরা অসহায় ও দিশেহারা।
সন্দেহ নেই যে একুশের এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছেই আমাদের যেতে হবে। সেই চেতনা পুঁজিবাদবিরোধী এবং অনিবার্যভাবেই সমাজবিপ্লবী। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অগ্রাভিযান ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে আমরা এগোচ্ছি; মুক্তিযুদ্ধ বলছিল যে আমরা পারব, আশা জেগে উঠেছিল যে পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক শাসকদের বিতাড়িত করে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করব, সমাজে আর অত্যাচারী থাকবে না। চেতনা দুটি যে হারিয়ে গেছে, তা নয় এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করার ভেতরেই রয়েছে আমাদের জন্য আগামীকালের প্রতিশ্রুতি। অন্য সবকিছুই হয় আড়ম্বর, নয় প্রতারণা। আড়ম্বর আসলে প্রতারণাকে ঢেকে রাখার কৌশল। তবে এ-ও যেন না ভুলি যে সমাজবিপ্লব আপনা-আপনি ঘটে না, তার জন্য আন্দোলন প্রয়োজন হয়—সমাজবিপ্লবী আন্দোলন। যেটা গড়ে ওঠার অপেক্ষা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আন্দোলনটির সম্মুখযাত্রার সূচনা, সেটিতে ওই জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান ছিল কেন্দ্রীয় ঘটনা। পুরোনো জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান কেবল নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরে সমষ্টিগত অগ্রযাত্রার শুরুও ওখান থেকেই। প্রবল বিরোধিতা ও নির্মম দমন-পীড়নের মুখে নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি এগিয়েছে এবং সেই আন্দোলনই পরিণতিতে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এটি অসাম্প্রদায়িক। ভাষা ধর্মীয় বিভাজন মানে না, সাম্প্রদায়িকতার অবরোধ ভেঙে ফেলে এগিয়ে যায়।
ধর্মব্যবসায়ীরা বাংলা ভাষার ওপর নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক উৎপাত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভাষা সেসব তৎপরতাকে মোটেই গ্রাহ্য করেনি, সে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। ভাষা শুধু যে অসাম্প্রদায়িক তা নয়, ধর্মনিরপেক্ষও বটে। ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িকতাকেও অতিক্রম করে; কেননা তার ভেতরে থাকে পরিপূর্ণ ইহজাগতিকতা। ভাষা আত্মপ্রকাশের, সৃষ্টিশীলতার, সামাজিক যোগাযোগসহ অনেক কিছুরই মাধ্যম। ভাষার সাহায্যেই আমরা চিন্তা করি, অন্যের চিন্তাকে গ্রহণ করি, অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হই। ভাষা সমষ্টিগত স্মৃতির সৃষ্টিশীল সংরক্ষক। ভাষা ছাড়া তো মানুষ মূক ও বধির। অপরদিকে আবার ভাষা কোনো একটি শ্রেণির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভাষার সৃষ্টি সমবেতভাবে, সমষ্টিগত উদ্যোগে। বিশেষ শ্রেণি, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোক, ভাষাকে যে আটকে রাখবে, সেটা সম্ভব নয়। অতীতে সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
এই যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও শ্রেণিবিভেদ না-মানা, এর ভেতর রয়েছে গণতান্ত্রিকতা। গণতন্ত্র তো কেবল ভোটের ব্যাপার নয়, যদিও ভোট গণতন্ত্রকে কার্যকর করার একটি পদ্ধতি। ভোটের ভেতর দিয়ে মানুষ নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, সেটা ঠিক করে দেওয়ার অবকাশ পায়। কিন্তু ভোটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটবে—এমন নিশ্চয়তা যে সর্বদা থাকে, তা নয়। বাংলাদেশে সত্তর সালের নির্বাচনে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে রায় দিয়েছিল, তখনকার ক্ষমতাধরেরা সেটা মানেনি, উল্টো পাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়—এই আতঙ্কে রায়দানকারীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অতিভয়াবহ এক গণহত্যা ঘটায়। পরিণামে তারা অবশ্য ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইতিহাসের আস্তাকুঁড় জিনিসটা অলীক কল্পনা নয়, সেটি আছে, স্বৈরশাসকদের সেটি চূড়ান্ত সমাধিভূমি।
আস্তাকুঁড়ে কে আশ্রয় পেল কিংবা পেল না, সেটা আমাদের জন্য কোনো সান্ত্বনা হতে পারে না। আমাদের জন্য সুখের বিষয় হতো যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হতো। এ চেতনাটি হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। প্রকৃত গণতন্ত্রে অপরিহার্য শর্তের মধ্যে রয়েছে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, চিন্তার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের সুযোগ এবং নাগরিকদের পারস্পরিক সহনশীলতা। তবে এর মূল উপাদান হলো সব নাগরিকের জন্য অধিকার ও সুযোগের সাম্য। মাতৃভাষার চর্চা ওই অধিকার ও সুযোগের অংশ এবং স্মারক। মাতৃভাষা হচ্ছে সবার অবদান, প্রত্যেকের জন্য। স্বাভাবিকভাবে বাঁচার জন্য যেমন আলো, বাতাস ও পানি দরকার, তেমনি দরকার মাতৃভাষার চর্চা।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার যে ঠিকমতো চলছে না, বিঘ্নিত হচ্ছে নানাভাবে ও বিবিধ মাত্রায়, সেটাই অকাট্য প্রমাণ এই সত্যের যে ওই দুই চেতনার কোনোটাই বাস্তব রূপ পায়নি—না একুশের, না মুক্তিযুদ্ধের। শ্রেণিবিভাজন শিক্ষাকে তিন ধারায় ভাগ করে ফেলেছে, মূল ধারায় মাতৃভাষা চালু আছে বটে, কিন্তু ঠিকমতো নেই, অন্য দুই ধারায় তার প্রবেশাধিকার প্রায় নিষিদ্ধ। বিত্তবানেরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে না, কারণ তাদের দৃষ্টিতে বাংলা গরিব মানুষের ভাষা। বিত্তহীনেরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারে না সুযোগের অভাবে। রাষ্ট্র চলে বিত্তবানদের হুকুমে, তাদের হুকুম বাংলা ভাষার পক্ষে নয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আমরা তখনই মুক্ত হব এবং মুক্ত হয়েছি বলে জানতে পারব, মাতৃভাষা যখন শিক্ষার ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের সর্বজনীন মাধ্যম হবে, তার আগে নয়।
সার কথাটা এই দাঁড়ায় যে একুশের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উভয়েরই লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার দায়িত্ব যাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা যে নতুন রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই ঘটনাটি এমনি এমনি ঘটেনি। এর পেছনে কারও করুণা বা কোনো দুর্ঘটনা কাজ করেনি। সেটি ঘটেছে যুদ্ধের ভেতরে বিকশিত ও প্রকাশিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকেই। সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তি সম্ভব—যুদ্ধসময়ে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগই ছিল না।
কিন্তু রাষ্ট্র তার অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সরে এসেছে। রাষ্ট্র বাইরে যতই বদলাক, ভেতরে মোটেই বদলায়নি। স্বভাবে ও চরিত্রে সে আগের মতোই পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রয়ে গেছে। পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের স্বপ্ন আর জনগণের মুক্তির স্বপ্ন মোটেই এক ছিল না, ছিল বিপরীতমুখী, আসলে পরস্পরবিরোধী। পেটি বুর্জোয়ারা চাইছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়া হয়ে যেতে, জনগণ চাইছিল শোষণমূলক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক চূর্ণবিচূর্ণ করে মুক্ত হতে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পেটি বুর্জোয়াদের জন্য উন্নতির পথ খুলে দিয়েছে, জনগণ মুক্তি পায়নি। এক পক্ষের উন্নতি, অপর পক্ষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাসকশ্রেণি অর্থনৈতিক উন্নতিকে তাদের শাসনক্ষমতায় থাকার যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তাদের ভাবখানা এই রকমের, ‘দেখছ না কেমন সুস্বাদু পোলাও-কোরমা রান্না হচ্ছে’! কিন্তু জনগণের দিক থেকে প্রশ্ন থেকে যায়—পোলাও-কোরমা তো রান্না হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু খাবেটা কে? জনগণ বলবে, ‘আমরা যা পাচ্ছি, সেটা তো ওই বিলাসী খাদ্য নয়, পাচ্ছি উচ্ছিষ্ট।’ পুঁজিবাদী উন্নতিতে সাধারণ মানুষের ক্ষুধা মিটবে না, উল্টো দুর্দশাই বাড়বে। বাড়ছেও। মানুষের মধ্যে যে বিক্ষোভ তা আপাতত হয়তো দৃশ্যমান নয়, কারণ বিক্ষোভ প্রকাশের সুযোগকে ক্রমাগত সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে। দমন-নিপীড়ন, গুম, হত্যা ইত্যাদি সমানে চলছে। পুলিশ বাহিনী সব সময়ই জনবিরোধী ছিল, কিন্তু এখন তাদের যে দৌরাত্ম্য তেমনটা আগে কখনোই দেখা যায়নি। মানুষ ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট। চাপা দেওয়া অসন্তোষ হয়তো শেষ পর্যন্ত অরাজকতায় রূপ নেবে, হয়তো-বা একটা বিস্ফোরণই ঘটবে। কিন্তু সেটা মুক্তির পথ নয়।
মুক্তির পথ হচ্ছে পুঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার দিকে রাষ্ট্র ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটি করতে না পারলে পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। ক্ষমতাবানের দম্ভ ও নিপীড়ন, মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ, শিশুর প্রতি দানবীর অসহিষ্ণুতা, সর্বত্র বিস্তৃত দুর্নীতি সবকিছুই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর দিকে বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশ নীরব, বড় একটি অংশ বিদ্যমান ব্যবস্থার সমর্থন ও চাটুকারিতায় ব্যস্ত, বিবেকবান মানুষেরা অসহায় ও দিশেহারা।
সন্দেহ নেই যে একুশের এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছেই আমাদের যেতে হবে। সেই চেতনা পুঁজিবাদবিরোধী এবং অনিবার্যভাবেই সমাজবিপ্লবী। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অগ্রাভিযান ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে আমরা এগোচ্ছি; মুক্তিযুদ্ধ বলছিল যে আমরা পারব, আশা জেগে উঠেছিল যে পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক শাসকদের বিতাড়িত করে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করব, সমাজে আর অত্যাচারী থাকবে না। চেতনা দুটি যে হারিয়ে গেছে, তা নয় এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করার ভেতরেই রয়েছে আমাদের জন্য আগামীকালের প্রতিশ্রুতি। অন্য সবকিছুই হয় আড়ম্বর, নয় প্রতারণা। আড়ম্বর আসলে প্রতারণাকে ঢেকে রাখার কৌশল। তবে এ-ও যেন না ভুলি যে সমাজবিপ্লব আপনা-আপনি ঘটে না, তার জন্য আন্দোলন প্রয়োজন হয়—সমাজবিপ্লবী আন্দোলন। যেটা গড়ে ওঠার অপেক্ষা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে