আনোয়ারুল হক
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আটটি জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, তারা এ যাত্রা ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরকে রেহাই দিয়েছে!
আটটি দিবসের মধ্যে তিন-চারটি দলীয় বা পারিবারিকভাবে পালনযোগ্য দিবস জাতীয় দিবস থেকে বাদ দেওয়ার জন্যও তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। এসব দিবসসহ আরও কয়েকটি দিবস যে জাতীয় দিবস, তা এই অধমও এত দিন জানত না।
শেখ হাসিনা সরকারের এই যে জোর করে যা খুশি চাপিয়ে দেওয়ার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, তার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নানা পর্বের ঐতিহাসিক দিনগুলোসহ স্বাধীনতাসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত সবকিছুকেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে, নিজেকে তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী বানিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের এই অবিসংবাদিত নেতাকে পরিচিত করেছিলেন তাঁরই প্রতীক হিসেবে। শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত ও বৈচিত্র্যময় এক ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে এক অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তাঁর মতো করে দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রেখে চলছিলেন। সেই আশির দশকে যখন পর্যন্ত গ্রামে কৃষি ছাড়া অর্থনীতির অন্য কোনো খাত বিকশিত হয়নি, দেশে পোশাকশিল্পও প্রায় গড়ে ওঠার পর্যায়ে, সেই সময়ে গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকাণ্ডে সংগঠিত করে নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।
এই কর্মসূচি তিনি ছড়িয়ে দেন সারা দেশে, এমনকি বহির্বিশ্বে। এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা—তিন সরকারের আমলেই গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি আনুকূল্য পেয়েছে। তবে জামায়াতসহ কট্টর ইসলামি মৌলবাদীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা করত নারীকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসায় এবং পুরুষের সঙ্গে একত্রে আর্থিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করায়। ড. ইউনূসকে ইসলামপন্থীরা ‘সুদখোর’ বলে গালি দিত। দেশের বহু স্থানে ওই সময় গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মী ও গ্রাহকেরা জামায়াতিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
কিন্তু দেশে-বিদেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস প্রশংসিত হয়েছেন। ইউনূস তাঁর ক্যারিশমাটিক গুণাবলি দ্বারা বিশ্বের বহু রাষ্ট্রনায়ক, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ধনকুবেরদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রয়াসে নিবেদিত একজন সমাজকর্মী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন।
কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল! ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। বিশেষত এক-এগারোর সরকারের সময় তাঁর রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা পরিত্যাগ করার পরেও ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন। একের পর এক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে থাকেন। এবং তাঁকে জেলে আটকে ফেলার পরিকল্পনাও প্রায় সমাপ্তির পথে ছিল। ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়।
ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ঢাকা বিমানবন্দরে প্রথম এ কথাই বলেছিলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিলে আমার কথা শুনতে হবে।’ সেই বক্তব্য অনুযায়ী এবং প্রধান উপদেষ্টার যে নির্বাহী ক্ষমতা, সে অনুযায়ী এখন যা যা ঘটছে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তার প্রধান দায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। সরকারি কিছু সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে তিনিও কি প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গেলেন?
তবে তফাত হচ্ছে হাসিনা অকথা, কুকথা (যেমন সুদখোর, পদ্মা সেতু থেকে টুক করে ফেলে দেওয়া, চুবিয়ে উঠিয়ে আনা) সরাসরি নিজে বলতেন, ইউনূস নিজে বলছেন না। অন্যকে বলার অনুমতি দিচ্ছেন। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, শোকের ১৫ আগস্ট ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যা বলছেন, তা কিন্তু অনেকটা অকথা, কুকথার পর্যায়েই পড়ে। তাঁদের নেতা মাহফুজ আলমের ‘দায় ও দরদের সমাজ ও রাজনীতির’ সঙ্গে সেসব কথা যায় না।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব জানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা কে। মানুষ মাত্রই নিখুঁত নয়। শেখ মুজিবও নন। তবু তিনিই স্বাধীনতার নেতা। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, শেখ মুজিব একা নন, স্বাধীনতাসংগ্রামে আরও অনেকের অবদান আছে। অবশ্যই আছে। নজরুল, তাজউদ্দীন, ভাসানী, মোজাফফর, মণি সিংহ, ফরহাদ, ওসমানী, জিয়া, খালেদ মোশাররফ, আওয়ামী লীগের ভেতরের নিউক্লিয়াস সেল এবং আরও অনেকে আছেন। আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক চরিত্র আছে।
যেমন—ইন্দিরা গান্ধী, পোদগর্নি, যাঁদের সহায়তা ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন আরও কঠিন হতো। কিন্তু এ সবই পার্শ্বচরিত্র। প্রধান ও কেন্দ্রীয় চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর গগনচুম্বী ও সর্বপ্লাবী ভূমিকাই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার মরণপণ লড়াইয়ে। ৭ মার্চ তর্জনী উত্তোলন করে তাঁর সেই ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পথনির্দেশ। শেখ মুজিবই আমাদের স্বাধীনতার প্রধান নেতা।
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য দেখে, ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে আনন্দনৃত্য দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, সেই রাতের সেই ঘৃণিত ঘাতকেরাই কি জিতে যাবে শেষে!
ড. ইউনূস তো বলেছিলেন, এখন থেকে সবাই মুক্তভাবে কথা বলতে পারবে। বলেছিলেন, ‘সমালোচনা করেন, না হলে জানব কীভাবে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না’। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, মুক্তভাবে কথা বলতে গেলেই মনে হয় হত্যা মামলার আসামি না হয়ে যাই!
শেখ হাসিনা দেশে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি তাঁর নিজ দলের মধ্যে যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করতেন, তাঁরাও ভয়ে তা প্রকাশ্যে বলতেন না।
আর বুদ্ধিজীবী সমাজের বড় অংশ তো তোষামোদি করে গোটা জাতিকে হতাশ করেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনা নৃশংসতায়, ঔদ্ধত্যে, অগণন মৃত্যুতে জাতির মুখে রক্তচিহ্ন এঁকে দেওয়ার পরেও আমাদের রবীন্দ্রভক্তদের কেউ একজনও স্বৈরাচারের দেওয়া পদক ছুড়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারেননি। সেটা করতে পারলে আজ রাজনৈতিক ভারসাম্য কিছুটা ভিন্ন চেহারা নিত।
এখন শুধু আফসোস ও আক্ষেপমূলক ও মৌলবাদের বিপদের কথা বলে কিছু হবে না। পতিত শাসকগোষ্ঠী জেদ, দম্ভ ও স্বৈরাচারের যে বিপজ্জনক ককটেল বানিয়ে দেশ শাসন করে আসছিল, তার থেকে মোহমুক্তি না হলে শুধু ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ খুঁজে উগ্র মৌলবাদী উত্থানকে মোকাবিলা করা যাবে না।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের কর্মকাণ্ডে পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখলে মানুষ কিন্তু ভিন্ন কথা বলা শুরু করবে। শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্র মনের পরিচয় দিয়েছেন; সেই সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার ছায়া অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তা ও শারীরিক ভাবভঙ্গিতে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই হলো, বিজয় হলো। বিজয়ীদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং কথাবার্তা, আচরণেও যদি ফ্যাসিবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়, এরপর মানুষ যাবে কোথায়?
ড. ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি। ধারণা করি, রাজনৈতিক বিশ্বাসে মধ্য ডানপন্থী হলেও উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি প্রবাসে বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। মাত্র এক মাসে হাজারের বেশি মৃত্যু আর ৩০ হাজারের মতো আহত হওয়ার বিশাল ছাত্র-গণ-আন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন।
দ্রুততার সঙ্গে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। আর এ কাজে সফল হতে হলে তাঁর প্রয়োজন দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন। সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতা কিন্তু জনসমর্থনকে সংকুচিত করে ফেলবে। ক্ষুদ্রতা আর সংকীর্ণতায় পূর্ণতা আসে না। তাই যে গুরুদায়িত্ব এই সরকারের ওপর বর্তেছে, তা পূর্ণ করতে হলে ক্ষুদ্রতার মন্দিরে নিজেদের বসানো যাবে না। পতিত সরকার ছোট মনের পরিচয় দিয়ে থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানের সরকার ছোট হবে কেন?
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আটটি জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, তারা এ যাত্রা ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরকে রেহাই দিয়েছে!
আটটি দিবসের মধ্যে তিন-চারটি দলীয় বা পারিবারিকভাবে পালনযোগ্য দিবস জাতীয় দিবস থেকে বাদ দেওয়ার জন্যও তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। এসব দিবসসহ আরও কয়েকটি দিবস যে জাতীয় দিবস, তা এই অধমও এত দিন জানত না।
শেখ হাসিনা সরকারের এই যে জোর করে যা খুশি চাপিয়ে দেওয়ার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, তার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নানা পর্বের ঐতিহাসিক দিনগুলোসহ স্বাধীনতাসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত সবকিছুকেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে, নিজেকে তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী বানিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের এই অবিসংবাদিত নেতাকে পরিচিত করেছিলেন তাঁরই প্রতীক হিসেবে। শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত ও বৈচিত্র্যময় এক ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে এক অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তাঁর মতো করে দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রেখে চলছিলেন। সেই আশির দশকে যখন পর্যন্ত গ্রামে কৃষি ছাড়া অর্থনীতির অন্য কোনো খাত বিকশিত হয়নি, দেশে পোশাকশিল্পও প্রায় গড়ে ওঠার পর্যায়ে, সেই সময়ে গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকাণ্ডে সংগঠিত করে নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।
এই কর্মসূচি তিনি ছড়িয়ে দেন সারা দেশে, এমনকি বহির্বিশ্বে। এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা—তিন সরকারের আমলেই গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি আনুকূল্য পেয়েছে। তবে জামায়াতসহ কট্টর ইসলামি মৌলবাদীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা করত নারীকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসায় এবং পুরুষের সঙ্গে একত্রে আর্থিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করায়। ড. ইউনূসকে ইসলামপন্থীরা ‘সুদখোর’ বলে গালি দিত। দেশের বহু স্থানে ওই সময় গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মী ও গ্রাহকেরা জামায়াতিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
কিন্তু দেশে-বিদেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস প্রশংসিত হয়েছেন। ইউনূস তাঁর ক্যারিশমাটিক গুণাবলি দ্বারা বিশ্বের বহু রাষ্ট্রনায়ক, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ধনকুবেরদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রয়াসে নিবেদিত একজন সমাজকর্মী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন।
কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল! ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। বিশেষত এক-এগারোর সরকারের সময় তাঁর রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা পরিত্যাগ করার পরেও ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন। একের পর এক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে থাকেন। এবং তাঁকে জেলে আটকে ফেলার পরিকল্পনাও প্রায় সমাপ্তির পথে ছিল। ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়।
ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ঢাকা বিমানবন্দরে প্রথম এ কথাই বলেছিলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিলে আমার কথা শুনতে হবে।’ সেই বক্তব্য অনুযায়ী এবং প্রধান উপদেষ্টার যে নির্বাহী ক্ষমতা, সে অনুযায়ী এখন যা যা ঘটছে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তার প্রধান দায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। সরকারি কিছু সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে তিনিও কি প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গেলেন?
তবে তফাত হচ্ছে হাসিনা অকথা, কুকথা (যেমন সুদখোর, পদ্মা সেতু থেকে টুক করে ফেলে দেওয়া, চুবিয়ে উঠিয়ে আনা) সরাসরি নিজে বলতেন, ইউনূস নিজে বলছেন না। অন্যকে বলার অনুমতি দিচ্ছেন। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, শোকের ১৫ আগস্ট ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যা বলছেন, তা কিন্তু অনেকটা অকথা, কুকথার পর্যায়েই পড়ে। তাঁদের নেতা মাহফুজ আলমের ‘দায় ও দরদের সমাজ ও রাজনীতির’ সঙ্গে সেসব কথা যায় না।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব জানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা কে। মানুষ মাত্রই নিখুঁত নয়। শেখ মুজিবও নন। তবু তিনিই স্বাধীনতার নেতা। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, শেখ মুজিব একা নন, স্বাধীনতাসংগ্রামে আরও অনেকের অবদান আছে। অবশ্যই আছে। নজরুল, তাজউদ্দীন, ভাসানী, মোজাফফর, মণি সিংহ, ফরহাদ, ওসমানী, জিয়া, খালেদ মোশাররফ, আওয়ামী লীগের ভেতরের নিউক্লিয়াস সেল এবং আরও অনেকে আছেন। আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক চরিত্র আছে।
যেমন—ইন্দিরা গান্ধী, পোদগর্নি, যাঁদের সহায়তা ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন আরও কঠিন হতো। কিন্তু এ সবই পার্শ্বচরিত্র। প্রধান ও কেন্দ্রীয় চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর গগনচুম্বী ও সর্বপ্লাবী ভূমিকাই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার মরণপণ লড়াইয়ে। ৭ মার্চ তর্জনী উত্তোলন করে তাঁর সেই ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পথনির্দেশ। শেখ মুজিবই আমাদের স্বাধীনতার প্রধান নেতা।
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য দেখে, ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে আনন্দনৃত্য দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, সেই রাতের সেই ঘৃণিত ঘাতকেরাই কি জিতে যাবে শেষে!
ড. ইউনূস তো বলেছিলেন, এখন থেকে সবাই মুক্তভাবে কথা বলতে পারবে। বলেছিলেন, ‘সমালোচনা করেন, না হলে জানব কীভাবে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না’। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, মুক্তভাবে কথা বলতে গেলেই মনে হয় হত্যা মামলার আসামি না হয়ে যাই!
শেখ হাসিনা দেশে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি তাঁর নিজ দলের মধ্যে যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করতেন, তাঁরাও ভয়ে তা প্রকাশ্যে বলতেন না।
আর বুদ্ধিজীবী সমাজের বড় অংশ তো তোষামোদি করে গোটা জাতিকে হতাশ করেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনা নৃশংসতায়, ঔদ্ধত্যে, অগণন মৃত্যুতে জাতির মুখে রক্তচিহ্ন এঁকে দেওয়ার পরেও আমাদের রবীন্দ্রভক্তদের কেউ একজনও স্বৈরাচারের দেওয়া পদক ছুড়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারেননি। সেটা করতে পারলে আজ রাজনৈতিক ভারসাম্য কিছুটা ভিন্ন চেহারা নিত।
এখন শুধু আফসোস ও আক্ষেপমূলক ও মৌলবাদের বিপদের কথা বলে কিছু হবে না। পতিত শাসকগোষ্ঠী জেদ, দম্ভ ও স্বৈরাচারের যে বিপজ্জনক ককটেল বানিয়ে দেশ শাসন করে আসছিল, তার থেকে মোহমুক্তি না হলে শুধু ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ খুঁজে উগ্র মৌলবাদী উত্থানকে মোকাবিলা করা যাবে না।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের কর্মকাণ্ডে পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখলে মানুষ কিন্তু ভিন্ন কথা বলা শুরু করবে। শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্র মনের পরিচয় দিয়েছেন; সেই সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার ছায়া অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তা ও শারীরিক ভাবভঙ্গিতে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই হলো, বিজয় হলো। বিজয়ীদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং কথাবার্তা, আচরণেও যদি ফ্যাসিবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়, এরপর মানুষ যাবে কোথায়?
ড. ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি। ধারণা করি, রাজনৈতিক বিশ্বাসে মধ্য ডানপন্থী হলেও উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি প্রবাসে বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। মাত্র এক মাসে হাজারের বেশি মৃত্যু আর ৩০ হাজারের মতো আহত হওয়ার বিশাল ছাত্র-গণ-আন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন।
দ্রুততার সঙ্গে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। আর এ কাজে সফল হতে হলে তাঁর প্রয়োজন দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন। সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতা কিন্তু জনসমর্থনকে সংকুচিত করে ফেলবে। ক্ষুদ্রতা আর সংকীর্ণতায় পূর্ণতা আসে না। তাই যে গুরুদায়িত্ব এই সরকারের ওপর বর্তেছে, তা পূর্ণ করতে হলে ক্ষুদ্রতার মন্দিরে নিজেদের বসানো যাবে না। পতিত সরকার ছোট মনের পরিচয় দিয়ে থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানের সরকার ছোট হবে কেন?
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে