এ কে এম শামসুদ্দিন
১৫ অক্টোবর ঢাকায় প্রকাশিত পত্রিকার একটি সংবাদ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সংবাদটি হলো, কুমিল্লার লালমাইয়ে জুমার নামাজ পড়ার আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফোরকানকে একটু সরে নামাজের কাতারে দাঁড়ানোর অনুরোধ করার জন্য মসজিদের ইমামকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে! ঘটনাটি ঘটে লালমাই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের ভাটারা কাচারি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। খুতবা পড়ানো শেষে মসজিদের ইমাম নামাজ শুরুর আগে অভ্যাসমতো সবাইকে লাইন সোজা করে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তিনি সেখানে উপস্থিত ইউএনওকেও নামাজের লাইনে দাঁড়াতে বলেন। সবার সামনে ইউএনওকে ইমাম এভাবে বলবেন, এটা সম্ভবত ইউএনও ভাবেননি। সে কারণেই হয়তো তিনি অপমান বোধ করেছেন। অতঃপর যা হওয়ার কথা নয়, তা-ই হলো।
নামাজ শেষে তিনি ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে ডেকে নিয়ে তাঁকে তাঁরা চেনেন কি না, জিজ্ঞেস করেন। তখন মসজিদের ইমাম মো. আবুল বাশার তাঁকে চিনতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তার পরও ইউএনও তাঁদের ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ডেকে এনে ইমামকে মসজিদের ইমামতি থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন। চেয়ারম্যান যথাবিহিত মসজিদ কমিটিতে বলে মো. আবুল বাশারকে আর নামাজ পড়াতে নিষেধ করে দেন। ইউএনওর এরূপ আচরণের ঘটনাটি জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ জাতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রচারিত হয়। তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিসি তাঁর অফিসে সব পক্ষকে ডেকে এনে বিষয়টি মিটমাট করে দিলে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হয়।
ইদানীং প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও চরিত্র স্খলনজনিত ঘটনা জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বিশেষ করে দেশের কয়েকটি উপজেলার ইউএনও জাতীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁদের অধৈর্য ও অসহনশীল আচরণ প্রশাসনিক ক্যাডারের সুনামের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত কয়েক বছর যাবৎ প্রশাসনের নিম্ন পর্যায়ের এসব কর্মকর্তা (সবাই নন) কেবল বদনামই কুড়িয়ে এনেছেন। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। আজকের পত্রিকায় আমার নিজের লেখা এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনেক ভালো ভালো কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে যতটা না প্রচার পায়, সেই তুলনায় তাঁদের সৃষ্ট যেকোনো অসদাচরণ খুব দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমার বিশ্বাস, এসব কর্মকর্তাকে প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণে স্থানীয় বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে বিশেষ প্রেষণামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।
চাকরির শুরুতেই প্রশাসন ক্যাডারের এসব কর্মকর্তার এমন কোনো ধারণা পোষণ করা উচিত হবে না—তাঁরা যেহেতু প্রশাসনের ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা, কাজেই তাঁরা জনগণের শাসক। এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাই জনগণের সেবক। জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের পয়সায় নিজের সংসার চলে। সন্তানের শিক্ষালাভের সুযোগ হয়। কিন্তু ইদানীং লক্ষ করা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে প্রশাসন ও পুলিশ সার্ভিসের অনেক কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করেন যে, তাঁদের আচরণ দেখে মনে হয়, জনগণই তাদের প্রজা এবং তাঁরা জনগণের শাসক। এটা মোটেও কাম্য নয়।
প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদ ও পদবির নামের বিষয়টিও কর্মকর্তাদের মন ও মানসিকতার ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক পদ, আমরা যাকে ‘জেলা প্রশাসক’ বলে থাকি, তার শাব্দিক অর্থ কী দাঁড়ায়? ‘জেলা প্রশাসক’ কথাটির কি এই অর্থ দাঁড়ায় না—যিনি এই পদে কাজ করেন, তিনি সেই জেলার প্রশাসক? অর্থাৎ তিনি সেই জেলার শাসনকর্তা? আগে এই পদটিকে বলা হতো ‘ডেপুটি কালেক্টর’ বা ‘ডেপুটি কমিশনার’। এই ডেপুটি কালেক্টর বা কমিশনারকে বাংলা করতে গিয়ে করা হয়েছে ‘জেলা প্রশাসক’।
‘প্রশাসক’ শব্দটির ভেতরে কেমন ‘শাসক’-এর গন্ধ পাওয়া যায়! জেলার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে তাঁরা এমন কিছু অগ্রহণযোগ্য আচরণ করেছেন, যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের একটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ে গেল। ২০১৯ সালে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যাকাণ্ড মামলার এক শুনানি চলাকালে বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন, যাঁরা নিজেদের জমিদার মনে করেন। এমন ভাব দেখান যে তাঁরাই সব।’ জেলা প্রশাসককে আমরা সাধারণত ডিসি বলি। এখন বুঝতে হবে ডিসি মানে কী? ডিসি মানে হলো ডেপুটি কমিশনার। এখন প্রশ্ন আসবে, উনি কার ডেপুটি? আমরা সাধারণত যাঁকে বিভাগীয় কমিশনার বলি, ডেপুটি কমিশনার হলেন তাঁরই ডেপুটি, যাকে বাংলায় করা হয়েছে ‘জেলা প্রশাসক’।
আরও একটি মজার বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমাদের দেশে একটি ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ আছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণ যেখানে রাষ্ট্রের মালিক, সেখানে ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ থাকা কতটুকু যুক্তিসংগত? আমলারা হলেন জনগণের সেবক। তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। অথচ তাঁদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে ক্ষমতার ব্যবহার করে তাঁরা যে অপকর্ম করেন, সেই অপকর্মের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
সিআরপিসি ১৯৭ ধারায় সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি দায়িত্ব পালনকালে কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারেন না। কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেয়। তার পরও বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ফলে আমলাদের একধরনের দায়মুক্তি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের দেওয়া এই আনুকূল্য আমলাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া করে তুলেছে বলে অনেকেরই ধারণা। সরকার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তাঁদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে বলে তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানও হয়েছেন। নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁদের প্রতি বিশেষ নজর থাকায় তাঁরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের তুলনায়ও বেশি গুরুত্ব লাভ করছেন বলে অভিযোগও আছে। এই সরকারের আমলেই সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধির স্বার্থ বিবেচনা করে দেশে আইন হয়েছে এবং সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে যে উপজেলার ১৭টি প্রশাসনিক বডির প্রধান হবেন উপজেলা চেয়ারম্যান। তার পরও ডিসিদের সহযোগিতায় ইউএনওরা তা ছাড়ছেন না। তাঁরা এই সবকিছুই কুক্ষিগত করে রেখেছেন। ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে বিষয়টি উত্থাপন করার পরও আমলারা এ বিষয়ে আনুকূল্য পেয়ে যাচ্ছেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগেই আমলাতন্ত্রনির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণেই বর্তমানে দেশে যে বিধিব্যবস্থা চালু আছে, তাতে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুরো নিশ্চিত করে না। দেশের শাসনব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে ডিসি-ইউএনওসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের প্রভু এবং জনগণকে প্রজা মনে করেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিন্নতা বাড়লে একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম হয়। আর একচেটিয়া ব্যবস্থা যখন চালু হয়, তখন ক্ষমতার অপপ্রয়োগও বেশি হয়। ফলে প্রশাসনের শৃঙ্খলায়ও ঘাটতি দেখা দেয়। আমলাতন্ত্রের ওপর প্রখ্যাত লেখক ম্যাক্স ওয়েবারের দৃষ্টিতে ‘আমলা হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি নির্দিষ্ট নিয়মকানুন ও নীতির অধীনে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন।’ আমলারা কখনো ব্যক্তিগতভাবে আবেগতাড়িত হন না। তাঁর নিজস্ব কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে না, তিনি নিয়মের কাছে বাধ্যগত।
এখন সিনিয়র থেকে শুরু করে সহকারী সচিব পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন ৫ হাজার ৯৭৩ জন। দেশে মোট উপজেলা ৪৯২টি। প্রতিটি উপজেলায় একজন করে ইউএনও নিয়োগ করা আছে। এই ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কিছু কিছু কর্মকর্তার এরূপ অসভ্য আচরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সরকারি আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনায় আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে, তা উল্লেখ থাকলেও নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধান নেই। অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়, নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে—এমন একটি বিধির উল্লেখ আছে। এখানে অসদাচরণ বলতে ‘অসংগত আচরণ, চাকরি শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ বা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে বোঝানো হয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছরে প্রশাসনের প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে।
বিভিন্ন অভিযোগে শত শত বিভাগীয় মামলা হলেও এর মধ্যে মাত্র ১০০-এর কিছু বেশি কর্মকর্তাকে লঘু ও গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির নেই বললেই চলে। আগেই উল্লেখ করেছি, শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে বলে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এমন ঘটনাও ঘটেছে, শাস্তি দেওয়ার পরও শাস্তি মওকুফ করে নেওয়ার উদাহরণ আছে। সরকারের অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতা এর জন্য দায়ী। আগে আরও দু-একটি লেখায় উল্লেখ করেছি, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সরকারের এই আমলানির্ভরতা বেড়েছে। এ দুটি নির্বাচনে বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে ইউএনওদের কী ভূমিকা ছিল, তা নতুন করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। আগামী নির্বাচনেও সরকার আমলাদের এরূপ সহায়তা চাইবে—এটাই স্বাভাবিক। এখানেই সবার আপত্তি। জনগণ নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সর্বজন গৃহীত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে পেতে চায়। লেখাটি শেষ করার আগে আবারও উল্লেখ করতে চাই; এ দেশের মানুষ প্রজা নয়, নাগরিক। নাগরিকের সঙ্গে আমলাদের যেকোনো অসদাচারণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে তাদের কৃতকর্মের জবাবদিহির যথাযথ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, তা না হলে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাবে—আমলারা আসলেই জনগণের সেবক, নাকি শাসক?
১৫ অক্টোবর ঢাকায় প্রকাশিত পত্রিকার একটি সংবাদ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সংবাদটি হলো, কুমিল্লার লালমাইয়ে জুমার নামাজ পড়ার আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফোরকানকে একটু সরে নামাজের কাতারে দাঁড়ানোর অনুরোধ করার জন্য মসজিদের ইমামকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে! ঘটনাটি ঘটে লালমাই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের ভাটারা কাচারি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। খুতবা পড়ানো শেষে মসজিদের ইমাম নামাজ শুরুর আগে অভ্যাসমতো সবাইকে লাইন সোজা করে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তিনি সেখানে উপস্থিত ইউএনওকেও নামাজের লাইনে দাঁড়াতে বলেন। সবার সামনে ইউএনওকে ইমাম এভাবে বলবেন, এটা সম্ভবত ইউএনও ভাবেননি। সে কারণেই হয়তো তিনি অপমান বোধ করেছেন। অতঃপর যা হওয়ার কথা নয়, তা-ই হলো।
নামাজ শেষে তিনি ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে ডেকে নিয়ে তাঁকে তাঁরা চেনেন কি না, জিজ্ঞেস করেন। তখন মসজিদের ইমাম মো. আবুল বাশার তাঁকে চিনতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তার পরও ইউএনও তাঁদের ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ডেকে এনে ইমামকে মসজিদের ইমামতি থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন। চেয়ারম্যান যথাবিহিত মসজিদ কমিটিতে বলে মো. আবুল বাশারকে আর নামাজ পড়াতে নিষেধ করে দেন। ইউএনওর এরূপ আচরণের ঘটনাটি জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ জাতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রচারিত হয়। তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিসি তাঁর অফিসে সব পক্ষকে ডেকে এনে বিষয়টি মিটমাট করে দিলে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হয়।
ইদানীং প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও চরিত্র স্খলনজনিত ঘটনা জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বিশেষ করে দেশের কয়েকটি উপজেলার ইউএনও জাতীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁদের অধৈর্য ও অসহনশীল আচরণ প্রশাসনিক ক্যাডারের সুনামের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত কয়েক বছর যাবৎ প্রশাসনের নিম্ন পর্যায়ের এসব কর্মকর্তা (সবাই নন) কেবল বদনামই কুড়িয়ে এনেছেন। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। আজকের পত্রিকায় আমার নিজের লেখা এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনেক ভালো ভালো কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে যতটা না প্রচার পায়, সেই তুলনায় তাঁদের সৃষ্ট যেকোনো অসদাচরণ খুব দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমার বিশ্বাস, এসব কর্মকর্তাকে প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণে স্থানীয় বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে বিশেষ প্রেষণামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।
চাকরির শুরুতেই প্রশাসন ক্যাডারের এসব কর্মকর্তার এমন কোনো ধারণা পোষণ করা উচিত হবে না—তাঁরা যেহেতু প্রশাসনের ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা, কাজেই তাঁরা জনগণের শাসক। এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাই জনগণের সেবক। জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের পয়সায় নিজের সংসার চলে। সন্তানের শিক্ষালাভের সুযোগ হয়। কিন্তু ইদানীং লক্ষ করা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে প্রশাসন ও পুলিশ সার্ভিসের অনেক কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করেন যে, তাঁদের আচরণ দেখে মনে হয়, জনগণই তাদের প্রজা এবং তাঁরা জনগণের শাসক। এটা মোটেও কাম্য নয়।
প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদ ও পদবির নামের বিষয়টিও কর্মকর্তাদের মন ও মানসিকতার ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক পদ, আমরা যাকে ‘জেলা প্রশাসক’ বলে থাকি, তার শাব্দিক অর্থ কী দাঁড়ায়? ‘জেলা প্রশাসক’ কথাটির কি এই অর্থ দাঁড়ায় না—যিনি এই পদে কাজ করেন, তিনি সেই জেলার প্রশাসক? অর্থাৎ তিনি সেই জেলার শাসনকর্তা? আগে এই পদটিকে বলা হতো ‘ডেপুটি কালেক্টর’ বা ‘ডেপুটি কমিশনার’। এই ডেপুটি কালেক্টর বা কমিশনারকে বাংলা করতে গিয়ে করা হয়েছে ‘জেলা প্রশাসক’।
‘প্রশাসক’ শব্দটির ভেতরে কেমন ‘শাসক’-এর গন্ধ পাওয়া যায়! জেলার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে তাঁরা এমন কিছু অগ্রহণযোগ্য আচরণ করেছেন, যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের একটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ে গেল। ২০১৯ সালে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যাকাণ্ড মামলার এক শুনানি চলাকালে বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন, যাঁরা নিজেদের জমিদার মনে করেন। এমন ভাব দেখান যে তাঁরাই সব।’ জেলা প্রশাসককে আমরা সাধারণত ডিসি বলি। এখন বুঝতে হবে ডিসি মানে কী? ডিসি মানে হলো ডেপুটি কমিশনার। এখন প্রশ্ন আসবে, উনি কার ডেপুটি? আমরা সাধারণত যাঁকে বিভাগীয় কমিশনার বলি, ডেপুটি কমিশনার হলেন তাঁরই ডেপুটি, যাকে বাংলায় করা হয়েছে ‘জেলা প্রশাসক’।
আরও একটি মজার বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমাদের দেশে একটি ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ আছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণ যেখানে রাষ্ট্রের মালিক, সেখানে ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ থাকা কতটুকু যুক্তিসংগত? আমলারা হলেন জনগণের সেবক। তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। অথচ তাঁদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে ক্ষমতার ব্যবহার করে তাঁরা যে অপকর্ম করেন, সেই অপকর্মের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
সিআরপিসি ১৯৭ ধারায় সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি দায়িত্ব পালনকালে কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারেন না। কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেয়। তার পরও বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ফলে আমলাদের একধরনের দায়মুক্তি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের দেওয়া এই আনুকূল্য আমলাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া করে তুলেছে বলে অনেকেরই ধারণা। সরকার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তাঁদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে বলে তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানও হয়েছেন। নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁদের প্রতি বিশেষ নজর থাকায় তাঁরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের তুলনায়ও বেশি গুরুত্ব লাভ করছেন বলে অভিযোগও আছে। এই সরকারের আমলেই সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধির স্বার্থ বিবেচনা করে দেশে আইন হয়েছে এবং সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে যে উপজেলার ১৭টি প্রশাসনিক বডির প্রধান হবেন উপজেলা চেয়ারম্যান। তার পরও ডিসিদের সহযোগিতায় ইউএনওরা তা ছাড়ছেন না। তাঁরা এই সবকিছুই কুক্ষিগত করে রেখেছেন। ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে বিষয়টি উত্থাপন করার পরও আমলারা এ বিষয়ে আনুকূল্য পেয়ে যাচ্ছেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগেই আমলাতন্ত্রনির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণেই বর্তমানে দেশে যে বিধিব্যবস্থা চালু আছে, তাতে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুরো নিশ্চিত করে না। দেশের শাসনব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে ডিসি-ইউএনওসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের প্রভু এবং জনগণকে প্রজা মনে করেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিন্নতা বাড়লে একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম হয়। আর একচেটিয়া ব্যবস্থা যখন চালু হয়, তখন ক্ষমতার অপপ্রয়োগও বেশি হয়। ফলে প্রশাসনের শৃঙ্খলায়ও ঘাটতি দেখা দেয়। আমলাতন্ত্রের ওপর প্রখ্যাত লেখক ম্যাক্স ওয়েবারের দৃষ্টিতে ‘আমলা হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি নির্দিষ্ট নিয়মকানুন ও নীতির অধীনে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন।’ আমলারা কখনো ব্যক্তিগতভাবে আবেগতাড়িত হন না। তাঁর নিজস্ব কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে না, তিনি নিয়মের কাছে বাধ্যগত।
এখন সিনিয়র থেকে শুরু করে সহকারী সচিব পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন ৫ হাজার ৯৭৩ জন। দেশে মোট উপজেলা ৪৯২টি। প্রতিটি উপজেলায় একজন করে ইউএনও নিয়োগ করা আছে। এই ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কিছু কিছু কর্মকর্তার এরূপ অসভ্য আচরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সরকারি আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনায় আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে, তা উল্লেখ থাকলেও নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধান নেই। অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়, নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে—এমন একটি বিধির উল্লেখ আছে। এখানে অসদাচরণ বলতে ‘অসংগত আচরণ, চাকরি শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ বা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে বোঝানো হয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছরে প্রশাসনের প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে।
বিভিন্ন অভিযোগে শত শত বিভাগীয় মামলা হলেও এর মধ্যে মাত্র ১০০-এর কিছু বেশি কর্মকর্তাকে লঘু ও গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির নেই বললেই চলে। আগেই উল্লেখ করেছি, শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে বলে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এমন ঘটনাও ঘটেছে, শাস্তি দেওয়ার পরও শাস্তি মওকুফ করে নেওয়ার উদাহরণ আছে। সরকারের অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতা এর জন্য দায়ী। আগে আরও দু-একটি লেখায় উল্লেখ করেছি, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সরকারের এই আমলানির্ভরতা বেড়েছে। এ দুটি নির্বাচনে বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে ইউএনওদের কী ভূমিকা ছিল, তা নতুন করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। আগামী নির্বাচনেও সরকার আমলাদের এরূপ সহায়তা চাইবে—এটাই স্বাভাবিক। এখানেই সবার আপত্তি। জনগণ নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সর্বজন গৃহীত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে পেতে চায়। লেখাটি শেষ করার আগে আবারও উল্লেখ করতে চাই; এ দেশের মানুষ প্রজা নয়, নাগরিক। নাগরিকের সঙ্গে আমলাদের যেকোনো অসদাচারণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে তাদের কৃতকর্মের জবাবদিহির যথাযথ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, তা না হলে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাবে—আমলারা আসলেই জনগণের সেবক, নাকি শাসক?
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে