ফজলুল কবির
আজ কেনা খাবার দুই দিন পরই কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বাজার এক স্থায়ী দুঃখের নাম যেন। নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা কমার নাম নেয় না সহজে। ফলে বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা পড়ছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে। এটা এখন আর শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেরই বাস্তবতা, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে বছরের প্রথমার্ধে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে বেশ হট্টগোল হলো। এখন এ নিয়ে আলোচনা একটু থিতিয়ে এলেও ভোজ্যতেল নিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের সংকট একই তিমিরে রয়ে গেছে। কয়েক দফায় সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর পর অবশেষে লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও পরিবেশক কোম্পানিগুলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে যে মাত্রায় বৃদ্ধি হয়েছিল, সেই মাত্রায় দাম কমেনি। এ নিয়ে যখন আলোচনা শুরুর সময়, তার আগে আগেই খবর এল কারও কথা না শুনেই পানির দাম বাড়ানোর গোঁ ধরেছেন ওয়াসার এমডি।
জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে হুজ্জতের কথা নিশ্চয় মানুষ এখনো ভোলেনি। সঙ্গে শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ-সংকট। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিংয়ের সম্ভাব্য সময়সূচি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এলাকাভেদে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। বিদ্যুৎ সরবরাহে এই সংকট নিশ্চিতভাবে উৎপাদন ব্যাহত করবে, যেমন হচ্ছে দেশে দেশে।
এরই মধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এ তালিকায় আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো রয়েছে। সামনে এই সংকট আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি ওয়ান আর্থ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ১৭ জুলাই।
কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দুই দশকে খাদ্যনিরাপত্তা বড় সংকট হিসেবে দেখা দেবে, যা বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে। এর কারণ হিসেবে গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক সংঘাত ইত্যাদিই এর মূল কারণ। একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, ক্ষুধাপীড়িত জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই বাস করে সেই সব অঞ্চলে, যেখানে হয় স্বৈরশাসন চলছে, সরাসরি সামরিক শাসন আছে বা সংঘাত আছে বা রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে।
গবেষকেরা বলছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে সুপেয় পানির স্বল্পতা হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় সংকট। খাওয়ার পানির এই সংকটের কারণে এমনকি দেশে দেশে সংঘাতও তৈরি হতে পারে। এর সঙ্গে যোগ হবে দাবদাহ, খরা, আয়বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো।
সুপেয় পানির এই সংকট নিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা কিন্তু বহু বছর আগে থেকেই সতর্ক করছেন। আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত এত কথা হয়েছে এবং হচ্ছে যে, এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই এখন পুনরুক্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই জলবায়ু সংকট এক নিদারুণ বাস্তবতার নাম। গোটা ইউরোপ আজ যে তীব্র দাবদাহ এবং দাবানলের অভিজ্ঞতা নিচ্ছে, তার পেছনে তো রয়েছে এই জলবায়ু পরিবর্তনই। বাংলাদেশের গত কয়েক দিনের আবহাওয়াও বলে দিচ্ছে, কোথাও বড় একটা গলদ হয়েছে নিশ্চয়। প্রতিবছরই এভাবে কোনো না কোনো সময় এই গলদের কথা জানান দিয়ে যায় প্রকৃতি। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেই ভুলে বসে থাকাটা মানুষের স্বভাব হয়ে গেছে যেন।
সে কথা থাক। খাদ্যনিরাপত্তা ইস্যুটির দিকে বরং তাকানো যাক। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, গোটা বিশ্ব খাদ্যসংকটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে মূল্যস্ফীতিকে বড় কারণ হিসেবে দেখিয়েছে সংস্থাটি। তারা বলছে, বিশ্বের প্রায় সব দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে বহু মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই সংকটের পেছনে জ্বালানি দিচ্ছে। কারণ, বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ১০ শতাংশই আসে ইউক্রেন থেকে। আর বিশ্ব খাদ্য সংস্থায় যাওয়া গম সরবরাহের ৪০ শতাংশের জোগান দেয় দেশটি। ফলে এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ভুগছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জুলাই পর্যন্ত হিসাব বলছে, গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে কৃষিক্ষেত্রে মূল্যসূচক বেড়েছে ১৯ শতাংশ। গম ও ভুট্টার দাম যথাক্রমে ২৪ ও ১৫ শতাংশ বেড়েছে। যদিও চালের দাম কম। আগের বছরের জানুয়ারির তুলনায় এ বছরের জুলাইয়ে চালের দাম ১১ শতাংশ কম। এ অবস্থায় সবচেয়ে বিপদে আছে নিম্ন, নিম্নমধ্য ও উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশগুলো।
বাংলাদেশের বাজারের দিকে তাকালে কিন্তু তেমনটি মনে হচ্ছে না। প্রধান শস্য ধান হলেও এ দেশে চালের দাম বাড়লে অন্য পণ্যের মতোই তা কমার নাম নেয় না সহজে। পাশাপাশি অন্য খাদ্যপণ্যের দামও বেশি। রয়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা। ডিজেল-সংকটের কারণে লোডশেডিংয়ের সময়সূচি ঘোষণা তো মাত্রই হলো। আর পানির মূল্যবৃদ্ধি কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের করা সতর্কবার্তার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে গোটা বিশ্বে মূল্যস্ফীতির কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের প্রায় সব দেশেই উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশের মধ্যে ৯৪ দশমিক ১, নিম্নমধ্য আয়ের ৮৮ দশমিক ৯, উচ্চ-মধ্য আয়ের ৮৭ শতাংশ দেশে ৫ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো দেশেই এ হার দুই অঙ্কে পৌঁছেছে। ধনী দেশগুলোর ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশের খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে।
এর কারণ হিসেবে সাদা চোখে যে কারণ সবার সামনে এসে দাঁড়ায় তা হচ্ছে—ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ এরই মধ্যে অনেক হিসাবনিকাশ বদলে দিয়েছে। সরবরাহব্যবস্থায় বড় ধরনের ওলট-পালট হয়েছে। এই যুদ্ধের অব্যবহিত ফল হিসেবে রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে দ্রব্যমূল্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক দেশেই ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। আমদানিনির্ভর দেশগুলো এ অবস্থায় পড়েছে সবচেয়ে বড় বিপাকে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের মতো আমদানিনির্ভর ক্ষেত্রগুলো এরই মধ্যে বড় সংকটের আভাস দিচ্ছে। কম্পিউটারসহ তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জামের বাজার অনেক দিন ধরেই অস্থির। এর শুরু অবশ্য করোনা মহামারির শুরু থেকেই। দেশের বাজারে অস্থিরতার পেছনে আন্তর্জাতিক কারণগুলোর চেয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়েই জনপরিসরে বেশি আলোচনা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতায় কম-বেশি সব দেশ ভুগলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব গুণিতক হারে পড়ে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এর পেছনে বিভিন্ন খাতওয়ারি সিন্ডিকেট এবং সরকারের নানা স্তরে প্রোথিত দুর্নীতির কথাই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।
এই দুর্নীতি ও বাজারে প্রভাব বিস্তারকারী সিন্ডিকেটের জন্যই দেশের মানুষ ভোগান্তিতে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের খাদ্যনিরাপত্তা-সম্পর্কিত সর্বশেষ সূচকে (২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত) বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪। এইসূচকে মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৪৯ দশমিক ১ পয়েন্ট। খাদ্যনিরাপত্তা, খাদ্যপ্রাপ্তির সামর্থ্য কোনোটিতেই বাংলাদেশ ৫০ পয়েন্টের মার্জিন পেরোতে পারেনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক সংকট কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের বাস্তবতা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই বাজারে অস্থিতিশীলতার সবগুলো নমুনা একসঙ্গে দেখা দেয়। ফলে বর্তমান পরিস্থিতি আরও বাজে হওয়াই স্বাভাবিক।
তাহলে উত্তরণ কোথায়? এর উত্তর সবাই জানে। তা-ও একটু গবেষক বা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে শুনতে ভালো লাগে। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন, গোটা পৃথিবীতে খাদ্যসংকটের মূলে কখনোই উৎপাদন-স্বল্পতা ছিল না; বরং সরবরাহ পদ্ধতির ভেতরে লুকিয়ে থাকা বৈষম্যের বীজই এই সংকটের জ্বালানি। আজকের বিশ্বেও এই একই জ্বালানি খাদ্যসংকটকে বড় হুমকি হিসেবে সামনে আনছে। শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালে এ বৈষম্যই সামনে আসে। বাংলাদেশে আয়বৈষম্য নিয়ে কিছুদিন পরপরই কথা বলেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যেও এর সমর্থন রয়েছে। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দেশের গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২, যা ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। গিনি সহগের মান বৃদ্ধি মানেই হলো বৈষম্য বৃদ্ধি। গত কয়েক বছরের হিসাব টানলে এর মান আরও বাড়ার আশঙ্কাই প্রবল। যদিও সরকার প্রায়ই বলে, সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়।
এই জায়গাগুলোতে এগিয়ে যাওয়াকে অস্বীকার না করেই বলা যায়, ক্রমবর্ধমান মাথাপিছু আয় বা প্রবৃদ্ধির গল্প এক বড় ভাঁওতা। এই আয় ও বৃদ্ধি আসলে গুটিকয়েক জানা-অজানা ব্যাংক হিসাবেই গিয়ে জমা হচ্ছে। চুইয়ে পড়া কিছু খুচরো পয়সা গরিব লোক পাচ্ছে বটে, তবে তা আগুনে বাজার এক লহমায় হাপিশ করে দিচ্ছে। ফলে দেশি-বিদেশি গবেষক ও বিশ্লেষকেরা নানা হিসাব কষে যে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তাকে উড়িয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। আর রাস্তায় বেড়ে যাওয়া হাত পাতা লোকের দিকে তাকালে এবং তাদের আমলে নিলে তো একে আরও গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিত। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন খাদ্যসংকটের কারণ, তেমনি খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এটা যেকোনো দেশ ও যেকোনো সময়ের জন্যই সত্য।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আজ কেনা খাবার দুই দিন পরই কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বাজার এক স্থায়ী দুঃখের নাম যেন। নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা কমার নাম নেয় না সহজে। ফলে বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা পড়ছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে। এটা এখন আর শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেরই বাস্তবতা, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে বছরের প্রথমার্ধে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে বেশ হট্টগোল হলো। এখন এ নিয়ে আলোচনা একটু থিতিয়ে এলেও ভোজ্যতেল নিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের সংকট একই তিমিরে রয়ে গেছে। কয়েক দফায় সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর পর অবশেষে লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও পরিবেশক কোম্পানিগুলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে যে মাত্রায় বৃদ্ধি হয়েছিল, সেই মাত্রায় দাম কমেনি। এ নিয়ে যখন আলোচনা শুরুর সময়, তার আগে আগেই খবর এল কারও কথা না শুনেই পানির দাম বাড়ানোর গোঁ ধরেছেন ওয়াসার এমডি।
জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে হুজ্জতের কথা নিশ্চয় মানুষ এখনো ভোলেনি। সঙ্গে শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ-সংকট। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিংয়ের সম্ভাব্য সময়সূচি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এলাকাভেদে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। বিদ্যুৎ সরবরাহে এই সংকট নিশ্চিতভাবে উৎপাদন ব্যাহত করবে, যেমন হচ্ছে দেশে দেশে।
এরই মধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এ তালিকায় আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো রয়েছে। সামনে এই সংকট আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি ওয়ান আর্থ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ১৭ জুলাই।
কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দুই দশকে খাদ্যনিরাপত্তা বড় সংকট হিসেবে দেখা দেবে, যা বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে। এর কারণ হিসেবে গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক সংঘাত ইত্যাদিই এর মূল কারণ। একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, ক্ষুধাপীড়িত জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই বাস করে সেই সব অঞ্চলে, যেখানে হয় স্বৈরশাসন চলছে, সরাসরি সামরিক শাসন আছে বা সংঘাত আছে বা রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে।
গবেষকেরা বলছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে সুপেয় পানির স্বল্পতা হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় সংকট। খাওয়ার পানির এই সংকটের কারণে এমনকি দেশে দেশে সংঘাতও তৈরি হতে পারে। এর সঙ্গে যোগ হবে দাবদাহ, খরা, আয়বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো।
সুপেয় পানির এই সংকট নিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা কিন্তু বহু বছর আগে থেকেই সতর্ক করছেন। আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত এত কথা হয়েছে এবং হচ্ছে যে, এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই এখন পুনরুক্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই জলবায়ু সংকট এক নিদারুণ বাস্তবতার নাম। গোটা ইউরোপ আজ যে তীব্র দাবদাহ এবং দাবানলের অভিজ্ঞতা নিচ্ছে, তার পেছনে তো রয়েছে এই জলবায়ু পরিবর্তনই। বাংলাদেশের গত কয়েক দিনের আবহাওয়াও বলে দিচ্ছে, কোথাও বড় একটা গলদ হয়েছে নিশ্চয়। প্রতিবছরই এভাবে কোনো না কোনো সময় এই গলদের কথা জানান দিয়ে যায় প্রকৃতি। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেই ভুলে বসে থাকাটা মানুষের স্বভাব হয়ে গেছে যেন।
সে কথা থাক। খাদ্যনিরাপত্তা ইস্যুটির দিকে বরং তাকানো যাক। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, গোটা বিশ্ব খাদ্যসংকটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে মূল্যস্ফীতিকে বড় কারণ হিসেবে দেখিয়েছে সংস্থাটি। তারা বলছে, বিশ্বের প্রায় সব দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে বহু মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই সংকটের পেছনে জ্বালানি দিচ্ছে। কারণ, বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ১০ শতাংশই আসে ইউক্রেন থেকে। আর বিশ্ব খাদ্য সংস্থায় যাওয়া গম সরবরাহের ৪০ শতাংশের জোগান দেয় দেশটি। ফলে এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ভুগছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জুলাই পর্যন্ত হিসাব বলছে, গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে কৃষিক্ষেত্রে মূল্যসূচক বেড়েছে ১৯ শতাংশ। গম ও ভুট্টার দাম যথাক্রমে ২৪ ও ১৫ শতাংশ বেড়েছে। যদিও চালের দাম কম। আগের বছরের জানুয়ারির তুলনায় এ বছরের জুলাইয়ে চালের দাম ১১ শতাংশ কম। এ অবস্থায় সবচেয়ে বিপদে আছে নিম্ন, নিম্নমধ্য ও উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশগুলো।
বাংলাদেশের বাজারের দিকে তাকালে কিন্তু তেমনটি মনে হচ্ছে না। প্রধান শস্য ধান হলেও এ দেশে চালের দাম বাড়লে অন্য পণ্যের মতোই তা কমার নাম নেয় না সহজে। পাশাপাশি অন্য খাদ্যপণ্যের দামও বেশি। রয়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা। ডিজেল-সংকটের কারণে লোডশেডিংয়ের সময়সূচি ঘোষণা তো মাত্রই হলো। আর পানির মূল্যবৃদ্ধি কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের করা সতর্কবার্তার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে গোটা বিশ্বে মূল্যস্ফীতির কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের প্রায় সব দেশেই উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশের মধ্যে ৯৪ দশমিক ১, নিম্নমধ্য আয়ের ৮৮ দশমিক ৯, উচ্চ-মধ্য আয়ের ৮৭ শতাংশ দেশে ৫ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো দেশেই এ হার দুই অঙ্কে পৌঁছেছে। ধনী দেশগুলোর ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশের খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে।
এর কারণ হিসেবে সাদা চোখে যে কারণ সবার সামনে এসে দাঁড়ায় তা হচ্ছে—ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ এরই মধ্যে অনেক হিসাবনিকাশ বদলে দিয়েছে। সরবরাহব্যবস্থায় বড় ধরনের ওলট-পালট হয়েছে। এই যুদ্ধের অব্যবহিত ফল হিসেবে রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে দ্রব্যমূল্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক দেশেই ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। আমদানিনির্ভর দেশগুলো এ অবস্থায় পড়েছে সবচেয়ে বড় বিপাকে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের মতো আমদানিনির্ভর ক্ষেত্রগুলো এরই মধ্যে বড় সংকটের আভাস দিচ্ছে। কম্পিউটারসহ তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জামের বাজার অনেক দিন ধরেই অস্থির। এর শুরু অবশ্য করোনা মহামারির শুরু থেকেই। দেশের বাজারে অস্থিরতার পেছনে আন্তর্জাতিক কারণগুলোর চেয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়েই জনপরিসরে বেশি আলোচনা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতায় কম-বেশি সব দেশ ভুগলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব গুণিতক হারে পড়ে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এর পেছনে বিভিন্ন খাতওয়ারি সিন্ডিকেট এবং সরকারের নানা স্তরে প্রোথিত দুর্নীতির কথাই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।
এই দুর্নীতি ও বাজারে প্রভাব বিস্তারকারী সিন্ডিকেটের জন্যই দেশের মানুষ ভোগান্তিতে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের খাদ্যনিরাপত্তা-সম্পর্কিত সর্বশেষ সূচকে (২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত) বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪। এইসূচকে মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৪৯ দশমিক ১ পয়েন্ট। খাদ্যনিরাপত্তা, খাদ্যপ্রাপ্তির সামর্থ্য কোনোটিতেই বাংলাদেশ ৫০ পয়েন্টের মার্জিন পেরোতে পারেনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক সংকট কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের বাস্তবতা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই বাজারে অস্থিতিশীলতার সবগুলো নমুনা একসঙ্গে দেখা দেয়। ফলে বর্তমান পরিস্থিতি আরও বাজে হওয়াই স্বাভাবিক।
তাহলে উত্তরণ কোথায়? এর উত্তর সবাই জানে। তা-ও একটু গবেষক বা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে শুনতে ভালো লাগে। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন, গোটা পৃথিবীতে খাদ্যসংকটের মূলে কখনোই উৎপাদন-স্বল্পতা ছিল না; বরং সরবরাহ পদ্ধতির ভেতরে লুকিয়ে থাকা বৈষম্যের বীজই এই সংকটের জ্বালানি। আজকের বিশ্বেও এই একই জ্বালানি খাদ্যসংকটকে বড় হুমকি হিসেবে সামনে আনছে। শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালে এ বৈষম্যই সামনে আসে। বাংলাদেশে আয়বৈষম্য নিয়ে কিছুদিন পরপরই কথা বলেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যেও এর সমর্থন রয়েছে। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দেশের গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২, যা ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। গিনি সহগের মান বৃদ্ধি মানেই হলো বৈষম্য বৃদ্ধি। গত কয়েক বছরের হিসাব টানলে এর মান আরও বাড়ার আশঙ্কাই প্রবল। যদিও সরকার প্রায়ই বলে, সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়।
এই জায়গাগুলোতে এগিয়ে যাওয়াকে অস্বীকার না করেই বলা যায়, ক্রমবর্ধমান মাথাপিছু আয় বা প্রবৃদ্ধির গল্প এক বড় ভাঁওতা। এই আয় ও বৃদ্ধি আসলে গুটিকয়েক জানা-অজানা ব্যাংক হিসাবেই গিয়ে জমা হচ্ছে। চুইয়ে পড়া কিছু খুচরো পয়সা গরিব লোক পাচ্ছে বটে, তবে তা আগুনে বাজার এক লহমায় হাপিশ করে দিচ্ছে। ফলে দেশি-বিদেশি গবেষক ও বিশ্লেষকেরা নানা হিসাব কষে যে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তাকে উড়িয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। আর রাস্তায় বেড়ে যাওয়া হাত পাতা লোকের দিকে তাকালে এবং তাদের আমলে নিলে তো একে আরও গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিত। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন খাদ্যসংকটের কারণ, তেমনি খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এটা যেকোনো দেশ ও যেকোনো সময়ের জন্যই সত্য।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে