বলটা মিড অফে ঠেলেই সিঙ্গেল নিতে লিটন দাস দৌড়ালেন ক্ষিপ্র চিতার মতো। অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে লাফিয়ে পড়লেন উইকেটের ওপর। এতে যেন শেষ হলো তাঁর বহু প্রতীক্ষার এক দৌড়। শেষ হলো প্রায় সাড়ে ছয় বছরের অপেক্ষা। এ অপেক্ষাটা টেস্ট সেঞ্চুরির। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাট উঁচিয়ে অভিবাদনের জবাব দিতে দিতে লিটন হারিয়ে গেলেন অবিচ্ছিন্ন পঞ্চম উইকেট-জুটিতে তাঁর সঙ্গী মুশফিকুর রহিমের বাহুডোরে।

লিটন প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পাওয়ার পর দুই ব্যাটারের এ আলিঙ্গনেই যেন লেখা আছে বাংলাদেশের গৌরবগাথার এক গল্প। গতকাল শুরুতেই ভেঙে পড়া বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপটা এভাবেই জোড়া লাগিয়েছেন দুই ব্যাটার। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে দুজনের ২০৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিনটা নিজেদের করে নিয়েছে বাংলাদেশ। আলোক স্বল্পতায় ৫ ওভার আগে খেলা শেষ হওয়ার সময় বাংলাদেশের রান ৪ উইকেট হারিয়ে ২৫৩। লিটন অপরাজিত ১১৩ রানে। অষ্টম সেঞ্চুরি থেকে ১৮ রান দূরে মুশফিক।

টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতেই অদূরের একটি ভবনে লাগা আগুনের কালো ধোঁয়া উড়ল স্টেডিয়ামের আকাশে। ধোঁয়ার মতোই বাংলাদেশের টপ অর্ডারের আরেকটি বিবর্ণ সকাল গেল গতকাল জহুর আহমেদে। স্কোরবোর্ডে ৪৯ রান উঠতেই ড্রেসিংরুমে ফিরে যান সাইফ হাসান, সাদমান ইসলাম, নাজমুল হোসেন শান্ত ও অধিনায়ক মুমিনুল হক।

টি-টোয়েন্টির ‘রুগ্‌ণ’ ব্যাটিংয়ের পরও সাইফের ওপর টেস্টেও ভরসা রেখেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। গতকাল দুর্দান্ত তিন বাউন্ডারিতে টি-টোয়েন্টির দুঃস্বপ্ন ভোলারই ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন এই ওপেনার। শাহিন শাহ আফ্রিদির দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে শেষ সাইফের সেই প্রতিরোধ। দুর্বল ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো ভবনের মতো আরও একবার ধসে পড়ল বাংলাদেশ দলের টপ অর্ডার। দলীয় ৩৩ রানে হাসান আলীর বলে সাদমান এলবিডব্লিউ হলে আবারও বিপদে পড়ে বাংলাদেশ।

এ বিপদে বাংলাদেশ তখন তাকিয়ে ছিল অধিনায়ক মুমিনুলের ব্যাটের দিকে। কিন্তু নিজের ‘পয়া’ ভেন্যুতে কাল আর সৌরভ ছড়াতে পারেননি মুমিনুল। অধিনায়কের বিদায়ের পর দলীয় ৪৯ রানে শান্তও ফিরে গেলে প্রথম দিনেই কি শেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশ—এই প্রশ্ন ঘুরল চারপাশে।

৫৮ মিনিটের সেই ‘কালবৈশাখী’ ঝড়ের পরের গল্পটা শুধুই লিটন-মুশফিকের। শিল্পী যেমন পাথর খুদে গড়েন শিল্পকর্ম; ২২ গজের দুই শিল্পী লিটন-মুশফিকও ধৈর্য-শৌর্যের সবটা দিয়ে গড়লেন জুটি। আগুনের কালো ধোঁয়া মুছে ক্রমেই আকাশ পরিষ্কার হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ব্যাটিংও রূপ বদলেছে দুজনের ব্যাটের আলোয়। মুশফিকের জার্সি নম্বর ১৫, লিটনের ১৬। সংখ্যা দুটির অবস্থান যেমন পিঠাপিঠি, ব্যাটিংয়েও দুজন একইভাবে দিনভর পাশাপাশি থেকে পাকিস্তানের বোলারদের উপহার দিয়েছেন হতাশা আর ক্লান্তি। আর দলকে দিয়েছেন স্বস্তির বার্তা। ৪১৩ বলের এই জুটিতে মাত্র একবারই ভুল করেছেন লিটন। ৬৭ রানে শাহিনের বলে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিলেন, সেটি ঠিকঠাক লুফে নিতে পারেননি সাজিদ খান। মুশফিকের ইনিংসটা একেবারেই নিখুঁত।

কদিন আগেও দুজন ছিলেন বাংলাদেশের দর্শকদের ‘চক্ষুশূল’! বিশ্বকাপে বাজে খেলার পর বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টির দল থেকেই বাদ পড়ছেন দুজন। সাদা পোশাকে ফিরেই সাগরিকায় রঙিন গল্প লেখার পর দর্শকেরাই আপন করে নিয়েছেন দুজনকে। দুপুরের কড়া রোদে জহুর আহমেদের গ্যালারির ভাঙা চেয়ারে ঠিকমতো বসতে না পারার দুঃখ ভুলে দর্শকেরা সারা দিন স্লোগান দিয়েছেন দুজনের নামে।

কাজটা এখানো শেষ হয়নি মুশফিক-লিটনের। দুজনের কৃতিত্বে প্রথম দিনটা যেভাবে নিজেদের করে নেওয়া গেছে, একইভাবে চট্টগ্রাম টেস্ট মুঠোয় পোরার চ্যালেঞ্জ তাঁদের। আর সেটি করতে আজ সকালেও দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।