মহিউদ্দিন খান মোহন
আমরা রাজনীতিমনস্ক জাতি, সন্দেহ নেই। রাজনীতির ময়দান ছাড়াও এটাকে আমরা করে তুলেছি সর্বত্রগামী। সামাজিক কিংবা ব্যক্তিজীবন, সবখানে এর অবাধ প্রবেশ। যেকোনো আড্ডায় রাজনীতি এখন মধ্যমণি হয়ে বসে থাকে। সব প্রসঙ্গ ছাপিয়ে রাজনীতি হয়ে ওঠে মুখ্য আলোচ্য। আর সেসব আড্ডায় যাঁরা রাজনীতির র-ও বোঝেন না, তাঁরাও বিশেষজ্ঞের মতো অভিমত ব্যক্ত করেন। কখনো কখনো তাঁদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, রুশো, ভলতেয়ার, কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস—তাঁরা এই বিশেষজ্ঞদের ছাত্র হওয়ারও যোগ্য হতেন না, যদি এসব পণ্ডিত ওই সময়ে এই ধরাধামে তাশরিফ আনতেন। আমার এক রসিক বন্ধু অবশ্য তাঁদের আখ্যায়িত করেন ‘বিশেষ-অজ্ঞ’ হিসেবে। ওর ব্যাখ্যা হলো তাঁরা সাধারণ অজ্ঞ নন, বিশেষভাবে অজ্ঞ!
যা-ই হোক, সেটা বড় কথা নয়। কথা হলো, সব বিষয়কে রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে হবে কেন? রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়বস্তুর কি অভাব রয়েছে? নির্মম সত্য হলো, আমাদের বর্তমান রাজনীতিকেরা বড্ড বেশি একপেশে বা একচোখা হয়ে গেছেন। সরকার ও বিরোধী দল কেউ কারও ভালো কাজ অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও বোধকরি দেখতে পায় না। বিরোধী দল সরকারের সব কাজেই খুঁত ধরতে সময় ও মেধা ব্যয় করে। আর বিরোধী দলের সমালোচনার মধ্যে সরকারদলীয় নেতারা খুঁজে পান ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। এমন অবস্থায় সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ আশা করা যে বাতুলতামাত্র, সেটা ব্যাখ্যা করে না বললেও চলে।
এই মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের নতুন উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে ইউরেনিয়াম। এই মূল্যবান এবং অতিশয় শক্তিসম্পন্ন রাসায়নিক পদার্থটি সম্প্রতি আমাদের দেশে এসেছে নানা কারণে (বালিশকাণ্ডসহ) বহুল আলোচিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য। এর প্রথম চালানটি ৬ অক্টোবর বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ‘পারমাণবিক ক্লাবের’ অন্তর্ভুক্ত হলো। জাতি হিসেবে এটা আমাদের গর্বের বিষয় অবশ্যই। সবচেয়ে বড় কথা, যে ইউরেনিয়াম পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির মতো অমানবিক কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে, আমরা তা ব্যবহার করব বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো সম্পূর্ণ ‘মানবিক’ কাজে।
কিন্তু ওই যে বললাম, আমাদের দেশের ‘ট্র্যাডিশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের ভালো কাজের মধ্যেও বিরোধীদের দোষ উদ্ঘাটনের চেষ্টা, এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আর তার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহারের আগেই ইউরেনিয়াম এখন ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের দুই প্রধান দলের পরস্পরের প্রতি নিক্ষিপ্ত ‘বাক্যাস্ত্রের’ উপাদান হিসেবে। বিএনপির নেতারা ইউরেনিয়াম আমদানির সমালোচনা করে বলেছেন, এর দ্বারা দেশকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, একটু লিক (ছিদ্র) হলেই মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি হবে বলেও তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিএনপির এই সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপির নেতাদের মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে ঠান্ডা করে দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। দুই চালান ইউরেনিয়াম এসেছে বলে তিনি বলেছেন, ‘সেটা আমরা কিছু ফখরুলের মাথায়, কিছু গয়েশ্বরের মাথায়, কিছু আব্বাসের মাথায়, কিছু মঈন খানের মাথায়, কিছু রিজভী পাগলার মাথায়...যে লাফাবে মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে ঠান্ডা করে দেব। (আজকের পত্রিকা, ১০অক্টোবর, ২০২৩)
ইউরেনিয়াম নিয়ে দুই দলের বাগ্যুদ্ধের বিষয়ে কথা বলার আগে এর আবিষ্কার এবং ব্যবহার নিয়ে কথা বলে নিতে চাই। এই রাসায়নিক ধাতুটি ১৭৮৯ সালে আবিষ্কার করেন জার্মান রসায়নবিদ মার্টিন হাইনরিখ ক্ল্যাপ্রোথ। ইউরেনাস গ্রহের নামের সঙ্গে মিল রেখে তিনি এর নামকরণ করেন ‘ইউরেনিয়াম’। ১৮৯৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানী অঁরি বেকরেল ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। ইউরেনিয়াম একটি মৌলিক পদার্থ; যার রাসায়নিক প্রতীক ইংরেজি ‘ইউ’ (U)। আর পারমাণবিক সংখ্যা ৯২। পদার্থের পারমাণবিক সংখ্যা হলো পরমাণু কেন্দ্রের প্রোটনের সংখ্যা। ইউরেনিয়াম একটি রুপালি-ধূসর বর্ণের ধাতু। এর একটি পরমাণুতে ৯২টি প্রোটন ও ৯২টি ইলেকট্রন রয়েছে।
ইউরেনিয়াম দুর্বলভাবে তেজস্ক্রিয়, কারণ এর সব আইসোটোপ পরিবর্তনশীল। আইসোটোপ হলো একই পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু, যাদের পারমাণবিক সংখ্যা এক হলেও নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন। ইউরেনিয়ামের প্রাকৃতিকভাবে ঘটা আইসোটোপের অর্ধায়ু ১ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ বছর থেকে ৪৫০ কোটি বছর। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে সাধারণ আইসোটোপগুলো হলো ইউরেনিয়াম-২৩৮; যার মধ্যে ১৪৬টি নিউট্রন রয়েছে। পৃথিবীর ইউরেনিয়ামের ৯৯ ভাগের বেশি এই আইসোটোপ। আর ইউরেনিয়াম ২৩৫-এর মধ্যে রয়েছে ১৪৩ নিউট্রন। প্রাথমিকভাবে উদ্ভূত পদার্থগুলোর মধ্যে ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক ওজন সবচেয়ে বেশি। এর ঘনত্ব সিসার তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। এটি একটি প্রাকৃতিক পদার্থ। পাওয়া যায় মাটি, শিলা ও পানিতে; প্রতি মিলিয়নে কয়েক অংশের কম ঘনত্বে।
পদার্থটি বাণিজ্যিকভাবে ইউরেনিয়ামযুক্ত খনিজ, যেমন ইউরেনাইট থেকে নিষ্কাশন করা হয়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ কাজাখস্তান। এরপরই আছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে চুল্লির জন্য এটি একটি অপরিহার্য উপাদান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেড় হাজার টন কয়লা থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, মাত্র এক কেজি ইউরেনিয়ামে সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তবে এই রাসায়নিক পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহে মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর সংস্পর্শে এলে মানুষের কিডনি, মস্তিষ্ক, লিভার, হৃৎপিণ্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এখন কথা হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য আনা এই পদার্থ নিয়ে কেন অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করতে হবে? এটা বলা বোধকরি অযৌক্তিক হবে না যে দেশের উন্নয়নের একটি মেগা প্রকল্পের জন্য অপরিহার্য এই রাসায়নিক নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করে বিএনপির নেতারা ওবায়দুল কাদেরকে উসকে দিয়েছেন। ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে বিএনপির নেতাদের অন্য কারও কোনো ধারণা না থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. আবদুল মঈন খানের তা জানা থাকার কথা। এটা ঠিক, ইউরেনিয়াম একটি মারাত্মক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত) চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। তাই বলে কি এর ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে? সড়ক দুর্ঘটনা বা বিমান ক্র্যাশ হয় বলে কি গাড়ি এবং বিমানে চড়া বন্ধ করে দিতে হবে? করতে হবে সবকিছুই, তবে সতর্কতার সঙ্গে। আমরা অনেক কিছু সতর্কতার সঙ্গে করলেও কথাবার্তা বলতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় সতর্কতা অবলম্বন করি না। আর তার ফলেই নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে বিএনপির নেতাদের সমালোচনার জবাবে ওবায়দুল কাদের সাহেব যে ভাষায় মন্তব্য করেছেন, তা মোটেই গ্রহণীয় নয়। মনে হচ্ছে তিনিও ইউরেনিয়াম সম্পর্কে সম্যক অবগত নন।
তাঁর হয়তো জানা নেই ইউরেনিয়াম কঠিন অবস্থায় (সলিড ফরম্যাট) থাকে। আর কঠিন কোনো পদার্থ কারও মাথায় ঢালা যায় না; বরং তা দিয়ে কাউকে আঘাত করা যায়। তা ছাড়া বিএনপির নেতা রিজভীকে ‘রিজভী পাগলা’ বলে কটাক্ষ করে তিনি যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন তা না বললেও চলে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, বেশির ভাগ রাজনীতিক এখন যুক্তি, শালীনতা, শিষ্টাচারের ধার ধারেন না। চিন্তা করেন না কোন কথাটি মানুষ ভালোভাবে নেবে। কিন্তু আমরা তো তাঁদের কাছ থেকে এমন অবিবেচকের মতো বক্তব্য-মন্তব্য আশা করি না।
তাঁরা কি আমাদের, মানে সাধারণ মানুষের মনের কথাটি বোঝেন?
পাদটীকা: ইউরেনিয়াম-সংক্রান্ত তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
আমরা রাজনীতিমনস্ক জাতি, সন্দেহ নেই। রাজনীতির ময়দান ছাড়াও এটাকে আমরা করে তুলেছি সর্বত্রগামী। সামাজিক কিংবা ব্যক্তিজীবন, সবখানে এর অবাধ প্রবেশ। যেকোনো আড্ডায় রাজনীতি এখন মধ্যমণি হয়ে বসে থাকে। সব প্রসঙ্গ ছাপিয়ে রাজনীতি হয়ে ওঠে মুখ্য আলোচ্য। আর সেসব আড্ডায় যাঁরা রাজনীতির র-ও বোঝেন না, তাঁরাও বিশেষজ্ঞের মতো অভিমত ব্যক্ত করেন। কখনো কখনো তাঁদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, রুশো, ভলতেয়ার, কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস—তাঁরা এই বিশেষজ্ঞদের ছাত্র হওয়ারও যোগ্য হতেন না, যদি এসব পণ্ডিত ওই সময়ে এই ধরাধামে তাশরিফ আনতেন। আমার এক রসিক বন্ধু অবশ্য তাঁদের আখ্যায়িত করেন ‘বিশেষ-অজ্ঞ’ হিসেবে। ওর ব্যাখ্যা হলো তাঁরা সাধারণ অজ্ঞ নন, বিশেষভাবে অজ্ঞ!
যা-ই হোক, সেটা বড় কথা নয়। কথা হলো, সব বিষয়কে রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে হবে কেন? রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়বস্তুর কি অভাব রয়েছে? নির্মম সত্য হলো, আমাদের বর্তমান রাজনীতিকেরা বড্ড বেশি একপেশে বা একচোখা হয়ে গেছেন। সরকার ও বিরোধী দল কেউ কারও ভালো কাজ অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও বোধকরি দেখতে পায় না। বিরোধী দল সরকারের সব কাজেই খুঁত ধরতে সময় ও মেধা ব্যয় করে। আর বিরোধী দলের সমালোচনার মধ্যে সরকারদলীয় নেতারা খুঁজে পান ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। এমন অবস্থায় সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ আশা করা যে বাতুলতামাত্র, সেটা ব্যাখ্যা করে না বললেও চলে।
এই মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের নতুন উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে ইউরেনিয়াম। এই মূল্যবান এবং অতিশয় শক্তিসম্পন্ন রাসায়নিক পদার্থটি সম্প্রতি আমাদের দেশে এসেছে নানা কারণে (বালিশকাণ্ডসহ) বহুল আলোচিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য। এর প্রথম চালানটি ৬ অক্টোবর বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ‘পারমাণবিক ক্লাবের’ অন্তর্ভুক্ত হলো। জাতি হিসেবে এটা আমাদের গর্বের বিষয় অবশ্যই। সবচেয়ে বড় কথা, যে ইউরেনিয়াম পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির মতো অমানবিক কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে, আমরা তা ব্যবহার করব বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো সম্পূর্ণ ‘মানবিক’ কাজে।
কিন্তু ওই যে বললাম, আমাদের দেশের ‘ট্র্যাডিশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের ভালো কাজের মধ্যেও বিরোধীদের দোষ উদ্ঘাটনের চেষ্টা, এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আর তার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহারের আগেই ইউরেনিয়াম এখন ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের দুই প্রধান দলের পরস্পরের প্রতি নিক্ষিপ্ত ‘বাক্যাস্ত্রের’ উপাদান হিসেবে। বিএনপির নেতারা ইউরেনিয়াম আমদানির সমালোচনা করে বলেছেন, এর দ্বারা দেশকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, একটু লিক (ছিদ্র) হলেই মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি হবে বলেও তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিএনপির এই সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপির নেতাদের মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে ঠান্ডা করে দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। দুই চালান ইউরেনিয়াম এসেছে বলে তিনি বলেছেন, ‘সেটা আমরা কিছু ফখরুলের মাথায়, কিছু গয়েশ্বরের মাথায়, কিছু আব্বাসের মাথায়, কিছু মঈন খানের মাথায়, কিছু রিজভী পাগলার মাথায়...যে লাফাবে মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে ঠান্ডা করে দেব। (আজকের পত্রিকা, ১০অক্টোবর, ২০২৩)
ইউরেনিয়াম নিয়ে দুই দলের বাগ্যুদ্ধের বিষয়ে কথা বলার আগে এর আবিষ্কার এবং ব্যবহার নিয়ে কথা বলে নিতে চাই। এই রাসায়নিক ধাতুটি ১৭৮৯ সালে আবিষ্কার করেন জার্মান রসায়নবিদ মার্টিন হাইনরিখ ক্ল্যাপ্রোথ। ইউরেনাস গ্রহের নামের সঙ্গে মিল রেখে তিনি এর নামকরণ করেন ‘ইউরেনিয়াম’। ১৮৯৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানী অঁরি বেকরেল ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। ইউরেনিয়াম একটি মৌলিক পদার্থ; যার রাসায়নিক প্রতীক ইংরেজি ‘ইউ’ (U)। আর পারমাণবিক সংখ্যা ৯২। পদার্থের পারমাণবিক সংখ্যা হলো পরমাণু কেন্দ্রের প্রোটনের সংখ্যা। ইউরেনিয়াম একটি রুপালি-ধূসর বর্ণের ধাতু। এর একটি পরমাণুতে ৯২টি প্রোটন ও ৯২টি ইলেকট্রন রয়েছে।
ইউরেনিয়াম দুর্বলভাবে তেজস্ক্রিয়, কারণ এর সব আইসোটোপ পরিবর্তনশীল। আইসোটোপ হলো একই পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু, যাদের পারমাণবিক সংখ্যা এক হলেও নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন। ইউরেনিয়ামের প্রাকৃতিকভাবে ঘটা আইসোটোপের অর্ধায়ু ১ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ বছর থেকে ৪৫০ কোটি বছর। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে সাধারণ আইসোটোপগুলো হলো ইউরেনিয়াম-২৩৮; যার মধ্যে ১৪৬টি নিউট্রন রয়েছে। পৃথিবীর ইউরেনিয়ামের ৯৯ ভাগের বেশি এই আইসোটোপ। আর ইউরেনিয়াম ২৩৫-এর মধ্যে রয়েছে ১৪৩ নিউট্রন। প্রাথমিকভাবে উদ্ভূত পদার্থগুলোর মধ্যে ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক ওজন সবচেয়ে বেশি। এর ঘনত্ব সিসার তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। এটি একটি প্রাকৃতিক পদার্থ। পাওয়া যায় মাটি, শিলা ও পানিতে; প্রতি মিলিয়নে কয়েক অংশের কম ঘনত্বে।
পদার্থটি বাণিজ্যিকভাবে ইউরেনিয়ামযুক্ত খনিজ, যেমন ইউরেনাইট থেকে নিষ্কাশন করা হয়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ কাজাখস্তান। এরপরই আছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে চুল্লির জন্য এটি একটি অপরিহার্য উপাদান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেড় হাজার টন কয়লা থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, মাত্র এক কেজি ইউরেনিয়ামে সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তবে এই রাসায়নিক পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহে মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর সংস্পর্শে এলে মানুষের কিডনি, মস্তিষ্ক, লিভার, হৃৎপিণ্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এখন কথা হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য আনা এই পদার্থ নিয়ে কেন অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করতে হবে? এটা বলা বোধকরি অযৌক্তিক হবে না যে দেশের উন্নয়নের একটি মেগা প্রকল্পের জন্য অপরিহার্য এই রাসায়নিক নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করে বিএনপির নেতারা ওবায়দুল কাদেরকে উসকে দিয়েছেন। ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে বিএনপির নেতাদের অন্য কারও কোনো ধারণা না থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. আবদুল মঈন খানের তা জানা থাকার কথা। এটা ঠিক, ইউরেনিয়াম একটি মারাত্মক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত) চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। তাই বলে কি এর ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে? সড়ক দুর্ঘটনা বা বিমান ক্র্যাশ হয় বলে কি গাড়ি এবং বিমানে চড়া বন্ধ করে দিতে হবে? করতে হবে সবকিছুই, তবে সতর্কতার সঙ্গে। আমরা অনেক কিছু সতর্কতার সঙ্গে করলেও কথাবার্তা বলতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় সতর্কতা অবলম্বন করি না। আর তার ফলেই নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে বিএনপির নেতাদের সমালোচনার জবাবে ওবায়দুল কাদের সাহেব যে ভাষায় মন্তব্য করেছেন, তা মোটেই গ্রহণীয় নয়। মনে হচ্ছে তিনিও ইউরেনিয়াম সম্পর্কে সম্যক অবগত নন।
তাঁর হয়তো জানা নেই ইউরেনিয়াম কঠিন অবস্থায় (সলিড ফরম্যাট) থাকে। আর কঠিন কোনো পদার্থ কারও মাথায় ঢালা যায় না; বরং তা দিয়ে কাউকে আঘাত করা যায়। তা ছাড়া বিএনপির নেতা রিজভীকে ‘রিজভী পাগলা’ বলে কটাক্ষ করে তিনি যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন তা না বললেও চলে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, বেশির ভাগ রাজনীতিক এখন যুক্তি, শালীনতা, শিষ্টাচারের ধার ধারেন না। চিন্তা করেন না কোন কথাটি মানুষ ভালোভাবে নেবে। কিন্তু আমরা তো তাঁদের কাছ থেকে এমন অবিবেচকের মতো বক্তব্য-মন্তব্য আশা করি না।
তাঁরা কি আমাদের, মানে সাধারণ মানুষের মনের কথাটি বোঝেন?
পাদটীকা: ইউরেনিয়াম-সংক্রান্ত তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে