চিররঞ্জন সরকার
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বরের একটা আলাদা ভূমিকা আছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে ছলেবলে-কৌশলে পরাজিত করার যে অপপ্রয়াস তার প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আর এর চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ৭ নভেম্বর। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন সেনাবাহিনীর কিছু মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা, যাঁদের মাত্র দুজন (ফারুক ও রশীদ) ছিলেন চাকরিরত; বাকিরা সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রধানত মেজর র্যাঙ্কের কর্মকর্তা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্রে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকেই খুনি অফিসাররা খোলামেলাভাবে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী পদক্ষেপ নিতে থাকে। পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা প্রকাশ্যে কলকাঠি নাড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক, রশীদ, ডালিমরা বঙ্গভবনে বসে তাঁদের নাটের গুরু খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে দেশে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটাতে মত্ত ছিলেন। তাঁরা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন। ২৮ আগস্ট তাঁরা জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের পদে বসান। কিন্তু জিয়া ছিলেন নামেই সেনাপ্রধান। ঘাতকেরাই সব সিদ্ধান্ত নিতেন।
এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু কর্মকর্তা চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সেনাবাহিনীর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে উড়ে এসে জুড়ে বসা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ৩ নভেম্বর একটা অভিযানও পরিচালনা করেন। এই দলে ছিলেন মেজর হাফিজউদ্দিন, কর্নেল শাফায়েত জামিলসহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার।খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াকে বন্দী করে সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড নিজ হাতে তুলে নেন।
কিন্তু এই অভ্যুত্থানকারীরা প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের কাছে টিকতে পারেননি। ১৫ আগস্টের হোতারা খালেদ ও তাঁর সহযোগীদের ভারতপন্থীদের অভ্যুত্থান হিসেবে প্রচারণা চালান। এই প্রচারণায় কাজ হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে এই প্রচারণা দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। এদিকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। ১৫ আগস্টের খুনিচক্র আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার অভিপ্রায়ে জেলের অভ্যন্তরে দলটির ঊর্ধ্বতন চার নেতাকে হত্যা করে গোপনে দেশত্যাগ করে।
এ সময় ঘটনাপরম্পরায় যুক্ত হয়ে পড়ে জাসদ এবং কর্নেল তাহেরের নাম। কর্নেল তাহের ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে এক পা হারানো মানুষটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায়ই কমিউনিজমের দীক্ষা নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যাশায় জাসদে যোগ দিয়ে এর আর্মস ব্যান্ড বিপ্লবী গণবাহিনীর কমান্ডার হয়েছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হলে বুর্জোয়া সেনাবাহিনীরও বিপ্লবীকরণ দরকার। এ লক্ষ্যে তিনি জাসদে যোগ দেওয়ার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে একটি সমান্তরাল সেনাকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন।
নভেম্বরের জটিল ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। যোগাযোগ করেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার জেসিও ও এনসিও পর্যায়ের সেনাসদস্য এবং জিয়ার বিশ্বস্ত অনুসারীদের সঙ্গে। তিনি যেহেতু সেনাবাহিনীতে কর্মরত কেউ নন, সেহেতু কর্মরত একজন সেনাকর্মকর্তাকেই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে চাইলেন। সব দিক বিবেচনা করে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু জিয়াকেই বেছে নিলেন। সে সময় জিয়াকে সামনে রেখে তাহেরের অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মেতে উঠল অফিসার নিধনে। আর এ বিদ্রোহেই নিহত হলেন খালেদ মোশাররফ, লে. কর্নেল হায়দারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তা। তবে অফিসার নিধন-প্রক্রিয়া বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। জিয়ার ওপর অসীম আস্থা রেখে তাহের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণভার সম্পূর্ণরূপে ন্যস্ত করেন তাঁর ওপর। সুচতুর জিয়া এই সুযোগে মনোযোগ দেন অপ্রতিহত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘আমার জীবন আমার যুদ্ধ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি সায়েম যখন বেতার ভাষণ দেন, তখন জিয়াউর রহমান ও কর্নেল তাহের উভয়েই বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। বেতারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কামরায় বসে জিয়ার সঙ্গে তাহেরের কথাবার্তা হয়। তাহের জিয়াকে বলেন, বিপ্লবী সৈনিকদের কিছু দাবিদাওয়া আছে। জিয়া যেন তা শোনেন এবং অবিলম্বে মেনে নেন। জিয়া স্বভাবসুলভ ধীরস্থিরভাবে বলেন, তিনি একটু পরে সৈনিকদের সঙ্গে দেখা করবেন।
উল্লেখ্য, বেতারের স্টুডিওতে আসার আগেই রাষ্ট্রপতির ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছিল, যাতে আলোচনার সময় তাহের বা জাসদের সশস্ত্র সৈনিকেরা কোনো শর্ত বা দাবিদাওয়া নিয়ে চাপ দিতে না পারে। জিয়ার এ কৌশল ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল।’ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আসলে ক্যু-পাল্টা ক্যুসহ অনেক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়।
এর পরের ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত ট্র্যাজিক। সমাজে এবং সেনাবাহিনীতে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলে জিয়া কঠোরভাবে দমন করেন তাঁর সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে। তাঁর জীবন রক্ষাকারী তাহেরকে প্রহসনের ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে ঝোলান ফাঁসিতে। ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতাকে সংহত করে সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের চরিত্রটাই বদলে দেন। পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশেও অবৈধ সেনা শাসনের ভিত রচিত হয়।
জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল, অবৈধ উপায়ে একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন, গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হ্যাঁ-না ভোট করা, সংবিধানকে স্থগিত করে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তুলে দেওয়া, রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে নিজেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু, তথাকথিত ক্যুর অভিযোগে শত শত সেনাকর্মকর্তা হত্যা ও হাজার হাজার সেনাসদস্যের চাকরিচ্যুতি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে খুনিদের নিরাপত্তা দিয়ে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা।
৭ নভেম্বর আসলে বাংলাদেশবিরোধী চক্রের বিজয়ের দিন। বিএনপি ও তার অনুচরেরা দিনটিকে ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে। এই নামকরণের মধ্যেও রয়েছে একটা গভীর দুরভিসন্ধি। কর্নেল শাফায়াত জামিল রচিত ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ শীর্ষক বইয়ে বলা হয়েছে, ‘৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত থাকার ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সুচতুরভাবে দিনটিকে “জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস”রূপে ঘোষণা করা হয়েছে।
এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার একটি মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সিপাহিরা ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো ব্যাটালিয়নে ছিল না।’ সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যড়যন্ত্র এবং জঘন্য হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্যই বিশেষ মহল ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল।
প্রশ্ন হলো, ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় কেন ৭ নভেম্বরের ঘটনাগুলো ঘটেছিল? ষড়যন্ত্রকারীরা কেন মেতে উঠেছিল রক্তের হোলি-খেলায়? এ প্রশ্নের উত্তর আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের সীমাহীন গর্ব থাকলেও বাস্তবতা হলো, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধী এই গোষ্ঠী স্বাধীনতার পর থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৭১ সালে তার পরাজয়কে পাকিস্তান ইসলামের পরাজয় হিসেবে মুসলিম বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল।
তাই হাতে গোনা দু-একটি দেশ ছাড়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে পুরো মুসলিম বিশ্ব অস্বীকার করে। সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতাজনিত ক্ষোভ ও রোষ। একেবারে শূন্য হাতে দেশ গড়ার অভিযানে নেমে বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তেলের মূল্য তিন গুণ বৃদ্ধি করায় তারা পেট্রোডলারে ভাসতে থাকে।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মধ্যবিত্ত সমাজ যারা ইতিহাস সৃষ্টি করে, তাদের সব সময়ই পছন্দ স্থিতাবস্থা আর নির্ভার জীবন-জীবিকা। তারা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করার এই ইতিবাচক সম্ভাবনাকে স্বাগত জানায়। বঙ্গবন্ধু সরকারও অর্থনৈতিক সংকট সামলাতে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি নমনীয় হয় এবং ওআইসিতে যোগ দেয়।
৭ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদার মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাতিক চিন্তা-চেতনার ধারার বিপরীতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভাবদর্শনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। অবক্ষয়ের সেই ধারা থেকে রাজনীতি এখনো মুক্ত হতে পারেনি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বরের একটা আলাদা ভূমিকা আছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে ছলেবলে-কৌশলে পরাজিত করার যে অপপ্রয়াস তার প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আর এর চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ৭ নভেম্বর। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন সেনাবাহিনীর কিছু মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা, যাঁদের মাত্র দুজন (ফারুক ও রশীদ) ছিলেন চাকরিরত; বাকিরা সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রধানত মেজর র্যাঙ্কের কর্মকর্তা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্রে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকেই খুনি অফিসাররা খোলামেলাভাবে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী পদক্ষেপ নিতে থাকে। পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা প্রকাশ্যে কলকাঠি নাড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক, রশীদ, ডালিমরা বঙ্গভবনে বসে তাঁদের নাটের গুরু খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে দেশে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটাতে মত্ত ছিলেন। তাঁরা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন। ২৮ আগস্ট তাঁরা জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের পদে বসান। কিন্তু জিয়া ছিলেন নামেই সেনাপ্রধান। ঘাতকেরাই সব সিদ্ধান্ত নিতেন।
এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু কর্মকর্তা চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সেনাবাহিনীর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে উড়ে এসে জুড়ে বসা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ৩ নভেম্বর একটা অভিযানও পরিচালনা করেন। এই দলে ছিলেন মেজর হাফিজউদ্দিন, কর্নেল শাফায়েত জামিলসহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার।খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াকে বন্দী করে সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড নিজ হাতে তুলে নেন।
কিন্তু এই অভ্যুত্থানকারীরা প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের কাছে টিকতে পারেননি। ১৫ আগস্টের হোতারা খালেদ ও তাঁর সহযোগীদের ভারতপন্থীদের অভ্যুত্থান হিসেবে প্রচারণা চালান। এই প্রচারণায় কাজ হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে এই প্রচারণা দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। এদিকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। ১৫ আগস্টের খুনিচক্র আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার অভিপ্রায়ে জেলের অভ্যন্তরে দলটির ঊর্ধ্বতন চার নেতাকে হত্যা করে গোপনে দেশত্যাগ করে।
এ সময় ঘটনাপরম্পরায় যুক্ত হয়ে পড়ে জাসদ এবং কর্নেল তাহেরের নাম। কর্নেল তাহের ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে এক পা হারানো মানুষটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায়ই কমিউনিজমের দীক্ষা নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যাশায় জাসদে যোগ দিয়ে এর আর্মস ব্যান্ড বিপ্লবী গণবাহিনীর কমান্ডার হয়েছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হলে বুর্জোয়া সেনাবাহিনীরও বিপ্লবীকরণ দরকার। এ লক্ষ্যে তিনি জাসদে যোগ দেওয়ার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে একটি সমান্তরাল সেনাকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন।
নভেম্বরের জটিল ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। যোগাযোগ করেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার জেসিও ও এনসিও পর্যায়ের সেনাসদস্য এবং জিয়ার বিশ্বস্ত অনুসারীদের সঙ্গে। তিনি যেহেতু সেনাবাহিনীতে কর্মরত কেউ নন, সেহেতু কর্মরত একজন সেনাকর্মকর্তাকেই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে চাইলেন। সব দিক বিবেচনা করে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু জিয়াকেই বেছে নিলেন। সে সময় জিয়াকে সামনে রেখে তাহেরের অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মেতে উঠল অফিসার নিধনে। আর এ বিদ্রোহেই নিহত হলেন খালেদ মোশাররফ, লে. কর্নেল হায়দারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তা। তবে অফিসার নিধন-প্রক্রিয়া বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। জিয়ার ওপর অসীম আস্থা রেখে তাহের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণভার সম্পূর্ণরূপে ন্যস্ত করেন তাঁর ওপর। সুচতুর জিয়া এই সুযোগে মনোযোগ দেন অপ্রতিহত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘আমার জীবন আমার যুদ্ধ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি সায়েম যখন বেতার ভাষণ দেন, তখন জিয়াউর রহমান ও কর্নেল তাহের উভয়েই বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। বেতারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কামরায় বসে জিয়ার সঙ্গে তাহেরের কথাবার্তা হয়। তাহের জিয়াকে বলেন, বিপ্লবী সৈনিকদের কিছু দাবিদাওয়া আছে। জিয়া যেন তা শোনেন এবং অবিলম্বে মেনে নেন। জিয়া স্বভাবসুলভ ধীরস্থিরভাবে বলেন, তিনি একটু পরে সৈনিকদের সঙ্গে দেখা করবেন।
উল্লেখ্য, বেতারের স্টুডিওতে আসার আগেই রাষ্ট্রপতির ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছিল, যাতে আলোচনার সময় তাহের বা জাসদের সশস্ত্র সৈনিকেরা কোনো শর্ত বা দাবিদাওয়া নিয়ে চাপ দিতে না পারে। জিয়ার এ কৌশল ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল।’ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আসলে ক্যু-পাল্টা ক্যুসহ অনেক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়।
এর পরের ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত ট্র্যাজিক। সমাজে এবং সেনাবাহিনীতে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলে জিয়া কঠোরভাবে দমন করেন তাঁর সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে। তাঁর জীবন রক্ষাকারী তাহেরকে প্রহসনের ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে ঝোলান ফাঁসিতে। ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতাকে সংহত করে সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের চরিত্রটাই বদলে দেন। পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশেও অবৈধ সেনা শাসনের ভিত রচিত হয়।
জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল, অবৈধ উপায়ে একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন, গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হ্যাঁ-না ভোট করা, সংবিধানকে স্থগিত করে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তুলে দেওয়া, রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে নিজেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু, তথাকথিত ক্যুর অভিযোগে শত শত সেনাকর্মকর্তা হত্যা ও হাজার হাজার সেনাসদস্যের চাকরিচ্যুতি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে খুনিদের নিরাপত্তা দিয়ে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা।
৭ নভেম্বর আসলে বাংলাদেশবিরোধী চক্রের বিজয়ের দিন। বিএনপি ও তার অনুচরেরা দিনটিকে ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে। এই নামকরণের মধ্যেও রয়েছে একটা গভীর দুরভিসন্ধি। কর্নেল শাফায়াত জামিল রচিত ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ শীর্ষক বইয়ে বলা হয়েছে, ‘৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত থাকার ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সুচতুরভাবে দিনটিকে “জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস”রূপে ঘোষণা করা হয়েছে।
এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার একটি মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সিপাহিরা ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো ব্যাটালিয়নে ছিল না।’ সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যড়যন্ত্র এবং জঘন্য হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্যই বিশেষ মহল ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল।
প্রশ্ন হলো, ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় কেন ৭ নভেম্বরের ঘটনাগুলো ঘটেছিল? ষড়যন্ত্রকারীরা কেন মেতে উঠেছিল রক্তের হোলি-খেলায়? এ প্রশ্নের উত্তর আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের সীমাহীন গর্ব থাকলেও বাস্তবতা হলো, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধী এই গোষ্ঠী স্বাধীনতার পর থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৭১ সালে তার পরাজয়কে পাকিস্তান ইসলামের পরাজয় হিসেবে মুসলিম বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল।
তাই হাতে গোনা দু-একটি দেশ ছাড়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে পুরো মুসলিম বিশ্ব অস্বীকার করে। সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতাজনিত ক্ষোভ ও রোষ। একেবারে শূন্য হাতে দেশ গড়ার অভিযানে নেমে বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তেলের মূল্য তিন গুণ বৃদ্ধি করায় তারা পেট্রোডলারে ভাসতে থাকে।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মধ্যবিত্ত সমাজ যারা ইতিহাস সৃষ্টি করে, তাদের সব সময়ই পছন্দ স্থিতাবস্থা আর নির্ভার জীবন-জীবিকা। তারা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করার এই ইতিবাচক সম্ভাবনাকে স্বাগত জানায়। বঙ্গবন্ধু সরকারও অর্থনৈতিক সংকট সামলাতে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি নমনীয় হয় এবং ওআইসিতে যোগ দেয়।
৭ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদার মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাতিক চিন্তা-চেতনার ধারার বিপরীতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভাবদর্শনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। অবক্ষয়ের সেই ধারা থেকে রাজনীতি এখনো মুক্ত হতে পারেনি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
১০ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
১০ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
১১ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
১১ ঘণ্টা আগে