জাহীদ রেজা নূর
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল আকস্মিকভাবে। যদিও তিনি আমার বাবা ও শ্বশুরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তবু তাঁর সঙ্গে ১৯৯৯ সালের আগে কোনো দিন দেখা হয়নি। প্রথম আলোয় কাজ করতাম তখন, সে সময় পত্রিকাটি লেখক ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় পুনর্মিলনীর আয়োজন করত বছরে একবার। তখনো সেই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা আমার হয়নি। কিন্তু যাঁর দায়িত্ব ছিল বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নিয়ে সেই হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার, তিনি হঠাৎ কী কারণে যেন যেতে পারলেন না। তখনই প্রথম আমাকে অনুরোধ করলেন আয়োজকদের একজন, আমি যেন মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনি থেকে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দিই।
সেদিনই গাড়িতে তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হলো, যার একটা অংশ ছিল সোভিয়েত জীবনযাত্রা নিয়ে। অদ্ভুত এক প্রশ্ন করেছিলেন বিচারপতি, ‘ওই দেশে ছেলে আর মেয়েরা নাকি হোস্টেলে একই ঘরে থাকে?’
কে তাঁকে এ রকম একটি অসমর্থিত খবর দিয়েছিল, সেটা আমার জানা হয়ে ওঠেনি। প্রথম আলোয় তিনি লিখতেন। মূলত মতিউর রহমান, সাজ্জাদ শরিফ, আনিসুল হকের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। আমার সঙ্গে সখ্য হয় রুশ কবিতা অনুবাদের পথ ধরে, অনেক পরে। অনেক কবির অনেকগুলো রুশ কবিতা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। এরপর তিনি আমার কাছে এলেন সেই কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। অনুবাদগুলো ইংরেজি থেকে করেছিলেন বলে রুশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে বললেন। সে সময় প্রায় মাস আড়াই প্রতিদিন সকালে তিনি আমার ছোট্ট কামরায় এসে বসে থেকেছেন। আলাপ করেছেন রুশ সাহিত্য নিয়ে। সেটা আমার জীবনের একটি বড় স্মৃতি।
সেই বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে আমি কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সোভিয়েত বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিল। ভাষাসংগ্রামী বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আগ্রহের জায়গা ছিল অনেক। তাঁর বৈচিত্র্যময় বইপত্রগুলো দেখলেই বোঝা যায়, গবেষক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট গভীরতার পরিচয় দিয়েছেন।
প্রথম আলোয় কাজ করতেন মিজানুর রহমান খান। এর আগে মুক্তকণ্ঠ নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো, তাতেও তিনি ছিলেন আমার সহকর্মী। বিখ্যাত ছিলেন তাঁর প্রাসাদকাঁপানো হা হা হাসি দিয়ে। নিজের পরিশ্রমে তিনি বড় সাংবাদিক হয়ে উঠেছিলেন। আইন ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে তাঁর ঈর্ষণীয় পড়াশোনা ছিল। কোনো আইনজীবী কিংবা বিচারপতির সঙ্গে যখন বাহাস করতেন, তখন বোঝা যেত তাঁর জ্ঞানের গভীরতা। লেখালেখিতে ছিলেন খানিকটা অগোছালো, কিন্তু যা লিখতেন, তা ছিল যুক্তিনির্ভর।
মিজান ভাই ছিলেন খুব সরল মানুষ। জীবনের ঘোরপ্যাঁচ খুব বুঝতেন বলে মনে হতো না। জীবনের হিসাব-নিকাশগুলোও খুব পরিষ্কার ছিল না তাঁর। টাকাপয়সার ‘চাহিদা-জোগান’ খুব ভালো বুঝতেন বলে মনে হতো না। কিন্তু বাঁচতে চাইতেন প্রাণের আনন্দে। সেটা একধরনের অর্জনই বলব।
আমি যখন পদত্যাগপত্র দিই, তখন খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘এ রকম করোনাকালে হুট করে চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।’
আমি যখন যুক্তি দিয়ে তাঁকে বোঝালাম কেন চাকরি ছাড়ছি, তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘আমি তাহলে কী করব? মানসিকভাবে তো আমিও আপনার জায়গায় আছি!’
মিজান ভাই শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়েননি, জীবন ছেড়েছেন। করোনার বীজ যখন তাঁর ফুসফুস দখল করে নিল, তখনো আমার কানে ভাসছিল তাঁর প্রাসাদকাঁপানো হাসি!
১১ জানুয়ারি তাঁদের দুজনেরই মৃত্যুদিন। এখনো মনে হয়, তাঁরা আমার পাশে এসে বসবেন। বলবেন, কেমন আছ/কেমন আছেন?
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও পড়ুন:
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল আকস্মিকভাবে। যদিও তিনি আমার বাবা ও শ্বশুরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তবু তাঁর সঙ্গে ১৯৯৯ সালের আগে কোনো দিন দেখা হয়নি। প্রথম আলোয় কাজ করতাম তখন, সে সময় পত্রিকাটি লেখক ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় পুনর্মিলনীর আয়োজন করত বছরে একবার। তখনো সেই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা আমার হয়নি। কিন্তু যাঁর দায়িত্ব ছিল বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নিয়ে সেই হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার, তিনি হঠাৎ কী কারণে যেন যেতে পারলেন না। তখনই প্রথম আমাকে অনুরোধ করলেন আয়োজকদের একজন, আমি যেন মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনি থেকে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দিই।
সেদিনই গাড়িতে তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হলো, যার একটা অংশ ছিল সোভিয়েত জীবনযাত্রা নিয়ে। অদ্ভুত এক প্রশ্ন করেছিলেন বিচারপতি, ‘ওই দেশে ছেলে আর মেয়েরা নাকি হোস্টেলে একই ঘরে থাকে?’
কে তাঁকে এ রকম একটি অসমর্থিত খবর দিয়েছিল, সেটা আমার জানা হয়ে ওঠেনি। প্রথম আলোয় তিনি লিখতেন। মূলত মতিউর রহমান, সাজ্জাদ শরিফ, আনিসুল হকের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। আমার সঙ্গে সখ্য হয় রুশ কবিতা অনুবাদের পথ ধরে, অনেক পরে। অনেক কবির অনেকগুলো রুশ কবিতা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। এরপর তিনি আমার কাছে এলেন সেই কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। অনুবাদগুলো ইংরেজি থেকে করেছিলেন বলে রুশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে বললেন। সে সময় প্রায় মাস আড়াই প্রতিদিন সকালে তিনি আমার ছোট্ট কামরায় এসে বসে থেকেছেন। আলাপ করেছেন রুশ সাহিত্য নিয়ে। সেটা আমার জীবনের একটি বড় স্মৃতি।
সেই বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে আমি কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সোভিয়েত বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিল। ভাষাসংগ্রামী বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আগ্রহের জায়গা ছিল অনেক। তাঁর বৈচিত্র্যময় বইপত্রগুলো দেখলেই বোঝা যায়, গবেষক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট গভীরতার পরিচয় দিয়েছেন।
প্রথম আলোয় কাজ করতেন মিজানুর রহমান খান। এর আগে মুক্তকণ্ঠ নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো, তাতেও তিনি ছিলেন আমার সহকর্মী। বিখ্যাত ছিলেন তাঁর প্রাসাদকাঁপানো হা হা হাসি দিয়ে। নিজের পরিশ্রমে তিনি বড় সাংবাদিক হয়ে উঠেছিলেন। আইন ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে তাঁর ঈর্ষণীয় পড়াশোনা ছিল। কোনো আইনজীবী কিংবা বিচারপতির সঙ্গে যখন বাহাস করতেন, তখন বোঝা যেত তাঁর জ্ঞানের গভীরতা। লেখালেখিতে ছিলেন খানিকটা অগোছালো, কিন্তু যা লিখতেন, তা ছিল যুক্তিনির্ভর।
মিজান ভাই ছিলেন খুব সরল মানুষ। জীবনের ঘোরপ্যাঁচ খুব বুঝতেন বলে মনে হতো না। জীবনের হিসাব-নিকাশগুলোও খুব পরিষ্কার ছিল না তাঁর। টাকাপয়সার ‘চাহিদা-জোগান’ খুব ভালো বুঝতেন বলে মনে হতো না। কিন্তু বাঁচতে চাইতেন প্রাণের আনন্দে। সেটা একধরনের অর্জনই বলব।
আমি যখন পদত্যাগপত্র দিই, তখন খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘এ রকম করোনাকালে হুট করে চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।’
আমি যখন যুক্তি দিয়ে তাঁকে বোঝালাম কেন চাকরি ছাড়ছি, তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘আমি তাহলে কী করব? মানসিকভাবে তো আমিও আপনার জায়গায় আছি!’
মিজান ভাই শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়েননি, জীবন ছেড়েছেন। করোনার বীজ যখন তাঁর ফুসফুস দখল করে নিল, তখনো আমার কানে ভাসছিল তাঁর প্রাসাদকাঁপানো হাসি!
১১ জানুয়ারি তাঁদের দুজনেরই মৃত্যুদিন। এখনো মনে হয়, তাঁরা আমার পাশে এসে বসবেন। বলবেন, কেমন আছ/কেমন আছেন?
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও পড়ুন:
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে