অজিত কুমার সরকার
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমি আরও এক বছর বুয়েটে পড়াশোনা করেছি। বাহাত্তর সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমরা ছাত্র ইউনিয়ন প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলাম। আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম বার্ষিকী সম্পাদক। নতুন দেশ, নতুন উদ্দীপনা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার নতুন ধারার আন্দোলন। তখন আমাদের একটা সিদ্ধান্ত হলো, আমরা একটা প্রদর্শনী করব বুয়েটে। বুয়েটে এর আগে কখনো হয়নি সে ধরনের প্রদর্শনী। বিভিন্ন বিভাগে, যেমন স্থাপত্য, মেকানিক্যাল, কেমিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং—কোন বিভাগে কী ধরনের পড়াশোনা করা হয়, ড্রয়িং, মডেল এগুলো নিয়ে আমরা একটা প্রদর্শনী করব। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রত্যেকের প্রবেশাধিকার থাকবে; বিশেষ করে আমরা চাইছিলাম যেসব ছেলেমেয়ে এসব ব্যাপারে জানতে আগ্রহী, তারা যেন বেশি বেশি করে এসে দেখতে পারে যে আমরা এখানে কী পড়াশোনা করি। আর নতুন দেশ, এ দেশকে যদি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এগুলোতে আগাতে হবে। এই চিন্তাভাবনা থেকে আমরা এই আয়োজনটা করেছিলাম। সেখানে ছাত্রলীগসহ সবাই যোগ দিয়েছিল। আমরা একসময় ঠিক করলাম, বছরের শেষ দিকে শীতকালে হবে প্রদর্শনীটা।
আমাদের মাথায় একটা চিন্তা এল যে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে প্রদর্শনীটার উদ্বোধন করালে সবচেয়ে ভালো হয়। যোগাযোগ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হলো। তিনি তখন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায় বসতেন। তাঁর অফিস ছিল ওখানে। ভিপি, জিএস আর আমি—আমরা তিনজন ঠিক করলাম দেখা করব। একদিন সময় দেওয়া হলো সন্ধ্যার পরে। গেলাম। দোতলা ভবনের ওপরতলায় তিনি বসতেন। আমরা যখন ঢুকেছি সেখানে, দেখলাম, কয়েকজন মন্ত্রী বসে আছেন ফাঁকা জায়গায়। হলঘরটা পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর রুমে নক করেছি। তোফায়েল আহমেদ দরজা খুলে দিলেন। আমরা ঢুকলাম। এই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে এত কাছে থেকে দেখলাম। একটা টেবিলে অনেকগুলো কাগজপত্র, ফাইল নিয়ে সই করছিলেন তিনি, আর পাইপ টানছিলেন।
আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের বললেন, ‘তোমরা একটু বসো। আমার হাতের কাজটা শেষ করে তোমাদের সঙ্গে কথা বলি।’ আমরা বসলাম। ততক্ষণে তিনি আবার তোফায়েল ভাইকে বললেন, ‘এদের চা-টা দেওয়ার ব্যবস্থা করো।’ মনে হলো যে একটা পরিবারের মধ্যে এসেছি। তিনি যে এত বড় নেতা, আমরা যে তাঁর কাছে কিছুই না—এ রকম কোনো কিছুই মনে হয়নি। মনে হলো, ঘরের ছেলে আমরা এসেছি, তিনি আমাদের পিতৃতুল্য কেউ একজন, সমাদর করছেন। এটা খুব ভালো লেগেছিল।
তারপর একটু পরে তিনি অবসর হয়ে বললেন, ‘বলো, তোমাদের বক্তব্য।’
আমরা বললাম, বুয়েটে একটা প্রদর্শনী করতে চাই, আপনি যাবেন।
তিনি বললেন, ‘যাব, কিন্তু সময়টা কখন?’
সময়টা জানার পর তিনি বললেন, ‘ওই সময়টা তো খুব ব্যস্ত থাকব।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসে ব্যস্ত থাকবেন?’
বললেন, ‘সামনে ইলেকশন দিচ্ছি তো, বছরের শেষ দিকে ইলেকশনের অনেক কাজ থাকে।’
আমি বললাম, ‘আমাদের অনুষ্ঠানে আপনাকে বেশিক্ষণ থাকতে হবে না, যাবেন আর আসবেন। একটু থেকে একটা ভাষণ দেবেন। বড়জোর ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে সব মিলিয়ে। এটুকু সময় আমাদের দিতেই হবে।’
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দেখি চিন্তাভাবনা করে। তোমরা তারিখটা রেখে যাও, কবে তোমরা করছ। আমি এর মধ্যে একটু বুঝে নিই যেতে পারব কি না। তোমরা
পরশু দিন এসো।’
এক দিন গ্যাপ দিয়ে আমরা আবার গেলাম দেখা করতে। সেদিন সময়টা ছিল বিকেলবেলা, দুপুরের খানিক পরে। প্রথম দিন কিন্তু সন্ধ্যায় গেছিলাম। নিচতলায় একটা বিরাট বড় দরবার হলের মতো ছিল। ওখানে বসে ছিলেন। আমরা ঢুকে দেখি তিনি সেদিনও খুব ব্যস্ত। তাঁর সামনে দাঁড়ানো পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেব। অনেকগুলো ফাইল ছিল তাঁর হাতে। বঙ্গবন্ধু সোফায় বসে পাইপ টানছেন আর মন্ত্রী সাহেবের হাত থেকে ফাইল নিয়ে সেগুলো পড়ছেন। পড়ে কিছু মন্তব্য করছেন বা সই করছেন। আমরা বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এর মধ্যে আব্দুস সামাদ আজাদ পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন আমরা তিনজন দাঁড়ানো। আমাদের আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কে? কোত্থেকে এসেছ?’
আমি বললাম, ‘আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের আসতে বলেছেন।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘দাঁড়াও, আমাদের কাজটা শেষ হলে পরে তোমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন।’ আমি তাঁকে এই ফাঁকে বললাম, ‘তিনি অবশ্য যেতে খুব একটা আগ্রহী নন। সেদিন বলেছিলেন খুব ব্যস্ত থাকবেন। আপনি যদি দয়া করে আমাদের হয়ে একটু বলেন, গেলে ভালো হয়!’
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, বলব।’
আমি দেখছিলাম, যে ফাইলগুলো দেওয়া হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে, তিনি পড়ছিলেন। একটা ফাইলের ওপর একটা লেখা ছিল—অ্যাপয়েন্টমেন্ট অব অ্যাম্বাসেডরস। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু একটা গালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওকে তো ফিরায়ে আনতে হবে।’
আমরা একটু হকচকিয়ে গেলাম, কী ব্যাপার, কার কথা বলছেন তিনি! বুঝলাম যে আমাদের কোনো অ্যাম্বাসেডর দেশের বাইরে এমন কিছু একটা করেছেন, যাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রেখেঢেকে নয়, সাধারণভাবে মানুষ যেভাবে রাগ প্রকাশ করে, সেভাবেই বঙ্গবন্ধু বিষয়টিতে তাঁর উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
ঘটনাটি দেখে আমি একটু তটস্থ হয়েছিলাম। তাঁর এই ‘মুড অফ’ অবস্থায় আমরা তাঁর সামনে গিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বললে তিনি যদি বলেন, ‘যাও যাও, আমার মেজাজ ভালো না।’ তখন তো আর তাঁকে সম্মত করা সহজ হবে না। এ জন্য আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তারপর আরও কিছু ফাইল তিনি দেখলেন। দেখার পর হঠাৎই আমাদের দিকে নজর পড়ায় বললেন, ‘আরে তোমরা এসেছ নাকি! এই বসো বসো।’
সামাদ সাহেবকেও বসতে বললেন। বাকি ফাইলগুলোও দেখা শেষ করলেন। তারপর বললেন, ‘বলো, কী বলবে।’
আমি বললাম, ‘আপনি আমাদের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কি না, সেটা জানতে এসেছি। আমরা চাই, যেভাবেই হোক কিছুটা সময় বের করে হলেও যাবেন আপনি।’
তিনি বললেন, ‘যাওয়ার তো আমারও ইচ্ছা। কিন্তু কী যে করি! খুব ঝামেলায় আছি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কি যাবেন না?’
তিনি বললেন, ‘আমি তো যেতেই চাই, তবে সময়টা ম্যানেজ করা হলো কথা।’
আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে যেন বলেছিলে সময়টা?’
তিনি একজনকে দূর থেকে ডাক দিলেন, ‘এই বাদশা, এদিকে এসো।’ পরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি হলেন আমিনুল হক বাদশা, বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব। তিনি কাছে এলে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখো তো, ওরা বুয়েট থেকে এসেছে। এই তারিখটায় আমি ফ্রি আছি কি না? যদি হয় তাহলে আমি যেতে পারব। আর তোমরা যাও, বাদশার সঙ্গে, চা-টা খাও।’
এই যে দুদিন তাঁর আপ্যায়নের ব্যাপারটা দেখলাম, খুব ভালো লেগেছিল, নেতৃত্বে থাকার বা উঁচুতে থাকার কোনো ব্যাপারই ছিল না। একেবারে মাটির মানুষ। আমরা বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে বসলাম। চা-টা খেলাম। একটু পরে তিনি তারিখটা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই দিন আপনি ফ্রি আছেন, যেতে পারেন।’
তিনি একপর্যায়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখো, আমার তো একটু ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে এ জন্য যে আমার পার্টির লোকদের যে ইলেকশন হবে, সেখানে আমার নিজেকেও অনেক জায়গায় যেতে হবে। ওদের পক্ষে ক্যাম্পেইন করতে হবে। সে জন্য আমি এত ব্যস্ত থাকব যে যেতে পারব কি না, এই দোটানায় আছি।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাকে কেন যেতে হবে?’ তখন তিনি একটু খেপে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে জানো না তো, এদের মধ্যে কেউ কেউ আছে এমপি হওয়ার যোগ্য না।’ আমি বললাম, ‘যোগ্য না, আপনি তাদের জন্য ভোট চাইতে যাবেন?’
বললেন, ‘কী করব বলো? আমার জন্য, দলের জন্য ওরা তো কষ্ট করেছে। আমি যখন জেলে থাকতাম, তখন পার্টিটা তো ওরাই ধরে রেখেছে, চালিয়ে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধেও তো ওদের অবদান আছে। এখন ওদের খুব খায়েশ—এমপি-টেমপি হবে! আমি তো ওদের বিমুখ করতে পারি না। ওদের জন্য কিছুটা সময় দিতেই হবে।’
দেখলাম, তাঁর যে প্র্যাকটিক্যাল সেন্স, একই সঙ্গে তাঁর যে ন্যায়বোধ, আবার কিছুটা কম্প্রোমাইজ না করলেও রাজনীতি এগিয়ে নেওয়া যায় না, সেটাও অকপটে তিনি বলেছেন। তাঁর এই সরলতা আমার বড় ভালো লেগেছিল।
সেদিন একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা তো মুক্তিযুদ্ধে ছিলে, তো রাজাকারদের তোমরা কেন তখনই মেরে ফেললে না? এই যে আমাকে এত বিচার নিয়ে সময় দিতে হচ্ছে, এত কোর্ট-কাচারি করতে হচ্ছে, এগুলো কিছুই করতে হতো না।’
আমি আবার একটু কায়দা করেই জবাব দিয়েছিলাম, ‘দেখেন, আমরা তখন নিজেরা বিচার হাতে নিইনি এ জন্য, আমরা তখন সবাই অপেক্ষা করছিলাম আপনার মুক্তির জন্য। আমরা যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটাতাম আর সেটার যদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতো আপনার মুক্তির ব্যাপারে, আন্তর্জাতিকভাবে দেখা যেত যে এই ঘটনাকে অবলম্বন করে সুযোগ পেত তারা আপনাকে আটকে রাখার। সহজে ছাড়ত না। সেটা আমাদের বিরাট ক্ষতি হতো। সে জন্য আমরা নিজেরা এ রকম কিছু করিনি। ভেবেছিলাম আপনি এসেই সেটা করবেন।’
তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমি আসার পরে তোমরা আমাকে বানিয়েছ জাতির পিতা, আমি কী করে এই সন্তানদের মারি?’
মনে হচ্ছিল আমি যেন আমার বাবার সঙ্গেই কথা বলছি। এ রকম সহজভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। আমিও একটু খোঁচা দিয়েই বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, আপনি জাতির পিতা। কিন্তু এরা তো জাতির মধ্যে পড়ে না। এরা তো জাতির বিরোধিতা করেছিল। এরা তো বজ্জাত। আপনি তো বজ্জাতের পিতা না।’
তিনি ‘হো হো’ করে হেসেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বুয়েটে, উদ্বোধন করেছিলেন আমাদের প্রদর্শনী। ওই যে দুটো দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, খুব ভালো লেগেছিল এই কারণে যে কত অমায়িক ছিল তাঁর ব্যবহার, একেবারে ঘরের মানুষের মতো। বড়রা আসলে এ রকমই হন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সত্যিকার অর্থেই অনেক বড় মাপের, অনেক বড় মনের মানুষ।
লেখক: স্থপতি, চলচ্চিত্র নির্মাতা
শ্রুতিলেখন: সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমি আরও এক বছর বুয়েটে পড়াশোনা করেছি। বাহাত্তর সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমরা ছাত্র ইউনিয়ন প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলাম। আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম বার্ষিকী সম্পাদক। নতুন দেশ, নতুন উদ্দীপনা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার নতুন ধারার আন্দোলন। তখন আমাদের একটা সিদ্ধান্ত হলো, আমরা একটা প্রদর্শনী করব বুয়েটে। বুয়েটে এর আগে কখনো হয়নি সে ধরনের প্রদর্শনী। বিভিন্ন বিভাগে, যেমন স্থাপত্য, মেকানিক্যাল, কেমিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং—কোন বিভাগে কী ধরনের পড়াশোনা করা হয়, ড্রয়িং, মডেল এগুলো নিয়ে আমরা একটা প্রদর্শনী করব। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রত্যেকের প্রবেশাধিকার থাকবে; বিশেষ করে আমরা চাইছিলাম যেসব ছেলেমেয়ে এসব ব্যাপারে জানতে আগ্রহী, তারা যেন বেশি বেশি করে এসে দেখতে পারে যে আমরা এখানে কী পড়াশোনা করি। আর নতুন দেশ, এ দেশকে যদি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এগুলোতে আগাতে হবে। এই চিন্তাভাবনা থেকে আমরা এই আয়োজনটা করেছিলাম। সেখানে ছাত্রলীগসহ সবাই যোগ দিয়েছিল। আমরা একসময় ঠিক করলাম, বছরের শেষ দিকে শীতকালে হবে প্রদর্শনীটা।
আমাদের মাথায় একটা চিন্তা এল যে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে প্রদর্শনীটার উদ্বোধন করালে সবচেয়ে ভালো হয়। যোগাযোগ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হলো। তিনি তখন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায় বসতেন। তাঁর অফিস ছিল ওখানে। ভিপি, জিএস আর আমি—আমরা তিনজন ঠিক করলাম দেখা করব। একদিন সময় দেওয়া হলো সন্ধ্যার পরে। গেলাম। দোতলা ভবনের ওপরতলায় তিনি বসতেন। আমরা যখন ঢুকেছি সেখানে, দেখলাম, কয়েকজন মন্ত্রী বসে আছেন ফাঁকা জায়গায়। হলঘরটা পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর রুমে নক করেছি। তোফায়েল আহমেদ দরজা খুলে দিলেন। আমরা ঢুকলাম। এই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে এত কাছে থেকে দেখলাম। একটা টেবিলে অনেকগুলো কাগজপত্র, ফাইল নিয়ে সই করছিলেন তিনি, আর পাইপ টানছিলেন।
আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের বললেন, ‘তোমরা একটু বসো। আমার হাতের কাজটা শেষ করে তোমাদের সঙ্গে কথা বলি।’ আমরা বসলাম। ততক্ষণে তিনি আবার তোফায়েল ভাইকে বললেন, ‘এদের চা-টা দেওয়ার ব্যবস্থা করো।’ মনে হলো যে একটা পরিবারের মধ্যে এসেছি। তিনি যে এত বড় নেতা, আমরা যে তাঁর কাছে কিছুই না—এ রকম কোনো কিছুই মনে হয়নি। মনে হলো, ঘরের ছেলে আমরা এসেছি, তিনি আমাদের পিতৃতুল্য কেউ একজন, সমাদর করছেন। এটা খুব ভালো লেগেছিল।
তারপর একটু পরে তিনি অবসর হয়ে বললেন, ‘বলো, তোমাদের বক্তব্য।’
আমরা বললাম, বুয়েটে একটা প্রদর্শনী করতে চাই, আপনি যাবেন।
তিনি বললেন, ‘যাব, কিন্তু সময়টা কখন?’
সময়টা জানার পর তিনি বললেন, ‘ওই সময়টা তো খুব ব্যস্ত থাকব।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসে ব্যস্ত থাকবেন?’
বললেন, ‘সামনে ইলেকশন দিচ্ছি তো, বছরের শেষ দিকে ইলেকশনের অনেক কাজ থাকে।’
আমি বললাম, ‘আমাদের অনুষ্ঠানে আপনাকে বেশিক্ষণ থাকতে হবে না, যাবেন আর আসবেন। একটু থেকে একটা ভাষণ দেবেন। বড়জোর ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে সব মিলিয়ে। এটুকু সময় আমাদের দিতেই হবে।’
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দেখি চিন্তাভাবনা করে। তোমরা তারিখটা রেখে যাও, কবে তোমরা করছ। আমি এর মধ্যে একটু বুঝে নিই যেতে পারব কি না। তোমরা
পরশু দিন এসো।’
এক দিন গ্যাপ দিয়ে আমরা আবার গেলাম দেখা করতে। সেদিন সময়টা ছিল বিকেলবেলা, দুপুরের খানিক পরে। প্রথম দিন কিন্তু সন্ধ্যায় গেছিলাম। নিচতলায় একটা বিরাট বড় দরবার হলের মতো ছিল। ওখানে বসে ছিলেন। আমরা ঢুকে দেখি তিনি সেদিনও খুব ব্যস্ত। তাঁর সামনে দাঁড়ানো পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেব। অনেকগুলো ফাইল ছিল তাঁর হাতে। বঙ্গবন্ধু সোফায় বসে পাইপ টানছেন আর মন্ত্রী সাহেবের হাত থেকে ফাইল নিয়ে সেগুলো পড়ছেন। পড়ে কিছু মন্তব্য করছেন বা সই করছেন। আমরা বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এর মধ্যে আব্দুস সামাদ আজাদ পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন আমরা তিনজন দাঁড়ানো। আমাদের আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কে? কোত্থেকে এসেছ?’
আমি বললাম, ‘আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের আসতে বলেছেন।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘দাঁড়াও, আমাদের কাজটা শেষ হলে পরে তোমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন।’ আমি তাঁকে এই ফাঁকে বললাম, ‘তিনি অবশ্য যেতে খুব একটা আগ্রহী নন। সেদিন বলেছিলেন খুব ব্যস্ত থাকবেন। আপনি যদি দয়া করে আমাদের হয়ে একটু বলেন, গেলে ভালো হয়!’
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, বলব।’
আমি দেখছিলাম, যে ফাইলগুলো দেওয়া হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে, তিনি পড়ছিলেন। একটা ফাইলের ওপর একটা লেখা ছিল—অ্যাপয়েন্টমেন্ট অব অ্যাম্বাসেডরস। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু একটা গালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওকে তো ফিরায়ে আনতে হবে।’
আমরা একটু হকচকিয়ে গেলাম, কী ব্যাপার, কার কথা বলছেন তিনি! বুঝলাম যে আমাদের কোনো অ্যাম্বাসেডর দেশের বাইরে এমন কিছু একটা করেছেন, যাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রেখেঢেকে নয়, সাধারণভাবে মানুষ যেভাবে রাগ প্রকাশ করে, সেভাবেই বঙ্গবন্ধু বিষয়টিতে তাঁর উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
ঘটনাটি দেখে আমি একটু তটস্থ হয়েছিলাম। তাঁর এই ‘মুড অফ’ অবস্থায় আমরা তাঁর সামনে গিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বললে তিনি যদি বলেন, ‘যাও যাও, আমার মেজাজ ভালো না।’ তখন তো আর তাঁকে সম্মত করা সহজ হবে না। এ জন্য আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তারপর আরও কিছু ফাইল তিনি দেখলেন। দেখার পর হঠাৎই আমাদের দিকে নজর পড়ায় বললেন, ‘আরে তোমরা এসেছ নাকি! এই বসো বসো।’
সামাদ সাহেবকেও বসতে বললেন। বাকি ফাইলগুলোও দেখা শেষ করলেন। তারপর বললেন, ‘বলো, কী বলবে।’
আমি বললাম, ‘আপনি আমাদের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কি না, সেটা জানতে এসেছি। আমরা চাই, যেভাবেই হোক কিছুটা সময় বের করে হলেও যাবেন আপনি।’
তিনি বললেন, ‘যাওয়ার তো আমারও ইচ্ছা। কিন্তু কী যে করি! খুব ঝামেলায় আছি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কি যাবেন না?’
তিনি বললেন, ‘আমি তো যেতেই চাই, তবে সময়টা ম্যানেজ করা হলো কথা।’
আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে যেন বলেছিলে সময়টা?’
তিনি একজনকে দূর থেকে ডাক দিলেন, ‘এই বাদশা, এদিকে এসো।’ পরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি হলেন আমিনুল হক বাদশা, বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব। তিনি কাছে এলে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখো তো, ওরা বুয়েট থেকে এসেছে। এই তারিখটায় আমি ফ্রি আছি কি না? যদি হয় তাহলে আমি যেতে পারব। আর তোমরা যাও, বাদশার সঙ্গে, চা-টা খাও।’
এই যে দুদিন তাঁর আপ্যায়নের ব্যাপারটা দেখলাম, খুব ভালো লেগেছিল, নেতৃত্বে থাকার বা উঁচুতে থাকার কোনো ব্যাপারই ছিল না। একেবারে মাটির মানুষ। আমরা বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে বসলাম। চা-টা খেলাম। একটু পরে তিনি তারিখটা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই দিন আপনি ফ্রি আছেন, যেতে পারেন।’
তিনি একপর্যায়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখো, আমার তো একটু ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে এ জন্য যে আমার পার্টির লোকদের যে ইলেকশন হবে, সেখানে আমার নিজেকেও অনেক জায়গায় যেতে হবে। ওদের পক্ষে ক্যাম্পেইন করতে হবে। সে জন্য আমি এত ব্যস্ত থাকব যে যেতে পারব কি না, এই দোটানায় আছি।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাকে কেন যেতে হবে?’ তখন তিনি একটু খেপে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে জানো না তো, এদের মধ্যে কেউ কেউ আছে এমপি হওয়ার যোগ্য না।’ আমি বললাম, ‘যোগ্য না, আপনি তাদের জন্য ভোট চাইতে যাবেন?’
বললেন, ‘কী করব বলো? আমার জন্য, দলের জন্য ওরা তো কষ্ট করেছে। আমি যখন জেলে থাকতাম, তখন পার্টিটা তো ওরাই ধরে রেখেছে, চালিয়ে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধেও তো ওদের অবদান আছে। এখন ওদের খুব খায়েশ—এমপি-টেমপি হবে! আমি তো ওদের বিমুখ করতে পারি না। ওদের জন্য কিছুটা সময় দিতেই হবে।’
দেখলাম, তাঁর যে প্র্যাকটিক্যাল সেন্স, একই সঙ্গে তাঁর যে ন্যায়বোধ, আবার কিছুটা কম্প্রোমাইজ না করলেও রাজনীতি এগিয়ে নেওয়া যায় না, সেটাও অকপটে তিনি বলেছেন। তাঁর এই সরলতা আমার বড় ভালো লেগেছিল।
সেদিন একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা তো মুক্তিযুদ্ধে ছিলে, তো রাজাকারদের তোমরা কেন তখনই মেরে ফেললে না? এই যে আমাকে এত বিচার নিয়ে সময় দিতে হচ্ছে, এত কোর্ট-কাচারি করতে হচ্ছে, এগুলো কিছুই করতে হতো না।’
আমি আবার একটু কায়দা করেই জবাব দিয়েছিলাম, ‘দেখেন, আমরা তখন নিজেরা বিচার হাতে নিইনি এ জন্য, আমরা তখন সবাই অপেক্ষা করছিলাম আপনার মুক্তির জন্য। আমরা যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটাতাম আর সেটার যদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতো আপনার মুক্তির ব্যাপারে, আন্তর্জাতিকভাবে দেখা যেত যে এই ঘটনাকে অবলম্বন করে সুযোগ পেত তারা আপনাকে আটকে রাখার। সহজে ছাড়ত না। সেটা আমাদের বিরাট ক্ষতি হতো। সে জন্য আমরা নিজেরা এ রকম কিছু করিনি। ভেবেছিলাম আপনি এসেই সেটা করবেন।’
তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমি আসার পরে তোমরা আমাকে বানিয়েছ জাতির পিতা, আমি কী করে এই সন্তানদের মারি?’
মনে হচ্ছিল আমি যেন আমার বাবার সঙ্গেই কথা বলছি। এ রকম সহজভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। আমিও একটু খোঁচা দিয়েই বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, আপনি জাতির পিতা। কিন্তু এরা তো জাতির মধ্যে পড়ে না। এরা তো জাতির বিরোধিতা করেছিল। এরা তো বজ্জাত। আপনি তো বজ্জাতের পিতা না।’
তিনি ‘হো হো’ করে হেসেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বুয়েটে, উদ্বোধন করেছিলেন আমাদের প্রদর্শনী। ওই যে দুটো দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, খুব ভালো লেগেছিল এই কারণে যে কত অমায়িক ছিল তাঁর ব্যবহার, একেবারে ঘরের মানুষের মতো। বড়রা আসলে এ রকমই হন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সত্যিকার অর্থেই অনেক বড় মাপের, অনেক বড় মনের মানুষ।
লেখক: স্থপতি, চলচ্চিত্র নির্মাতা
শ্রুতিলেখন: সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে