বিভুরঞ্জন সরকার
১ মে, মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক ঐতিহাসিক গৌরবময় দিন। এবার বাংলাদেশে দিনটি পালিত হচ্ছে অস্বাভাবিক গরমে, যখন জনজীবনে নেমে এসেছে চরম যন্ত্রণা। দেশে কি শুধু গরমই অস্বাভাবিক? না; সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাতসহ অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না। একসময় নির্বাচন ছিল সাধারণ মানুষের কাছে উৎসবের মতো। এখন সেটাও নেই। নির্বাচন মানেই এখন আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। ভোটের নামে চলছে শক্তির প্রতিযোগিতা। শক্তি—ক্ষমতার, অর্থের, পেশির, আত্মীয়তার।
যেহেতু মে দিবসে লেখাটি পাঠকের হাতে যাবে, সেহেতু দিবসটি নিয়েই দু-চার কথা বলি।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে প্রাণ হারান ১০ শ্রমিক। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক কনভেনশনে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে তারিখকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে মেহনতি মানুষকে সম্মান জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মে দিবস। শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন মহান মে দিবস।
আমাদের দেশেও প্রতিবছর ঘটা করে মে দিবস পালন করা হয়। পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন, কিন্তু সকাল-সন্ধ্যার অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা নিয়ে কি তাঁরা সন্তুষ্ট? তাঁরা কি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারছেন?
বাস্তবে আমাদের শ্রমিকদের জীবন নানা দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে কাটছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ শ্রমিকদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। অথচ এর অভাবে দেশের, বিশেষত গার্মেন্টস কারখানাগুলো, শ্রমিকের জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় শ্রমিকেরা হতাহত হলেও এ-সংক্রান্ত আইনের কোনো প্রয়োগ হয় না। এ প্রসঙ্গে তাজরীন গার্মেন্টস ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
আদমজী জুট মিলসহ আরও অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার পর আমাদের দেশে বর্তমানে সংগঠিত খাতের চেয়ে অসংগঠিত খাতের শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। গত কয়েক দশকে আরও একটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নানা ধরনের কাজে অংশ নিচ্ছেন। গার্মেন্টস ছাড়াও কৃষি, নির্মাণ, রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, চা-বাগান, ওষুধশিল্প, কোমল পানীয়, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, হস্তশিল্প ইত্যাদি খাতে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বেশি। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মজুরিবৈষম্যের শিকার।
দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও এখন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। নানা অসুস্থ প্রবণতা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে গ্রাস করেছে। সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলন দেশে আছে, তবে খুবই দুর্বল।
প্রবীণ শ্রমিকনেতা মনজুরুল আহসান খান একবার বলেছিলেন, ‘শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকস্বার্থ রক্ষা না করে শ্রমিকের ক্ষতি করে। নেতাগিরি একটা ব্যবসা, প্রচুর টাকাপয়সা পাওয়া যায় এতে।’ বাংলাদেশের এখনকার ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রে মনজুরুল আহসানের অভিযোগটি নির্মম সত্য। শ্রমিকস্বার্থের কথা বলে, শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে, শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তির ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব যা করছে, তার নাম স্রেফ ব্যবসা। বিনা পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসা। সে জন্য আমাদের দেশে শ্রমিকেরা ভালো না থাকলেও ভালো থাকেন অধিকাংশ শ্রমিকনেতা ও মালিক।
মনে রাখতে হবে, কোনো কালে, কোনো দেশেই শ্রমিকদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, ন্যায্য মজুরি কেউ আপনা-আপনি দিয়ে দেন না, লড়াই করেই তা আদায় করতে হয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্প প্রয়োজন। আবার শিল্প বিকাশের জন্য শিল্পবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন। অসুস্থ ও সুবিধাবাদী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শিল্পের বিকাশ ও স্থিতির জন্য ক্ষতিকর। সে জন্যই শিল্প বিকাশের স্বার্থে, জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতির স্বার্থে দেশে সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের যে অভাব এখন দেশে তৈরি হয়েছে, তা দূর করা প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশের ভেতরে আমরা রাজনৈতিকভাবে যেমন একটি অত্যন্ত জটিল সময় অতিক্রম করছি, তেমনি বিশ্বব্যাপী বর্তমান সময়টা শ্রমিকশ্রেণির জন্যও অনুকূল নয়। আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর বহুধাবিভক্তি এবং অতিমাত্রায় দলীয়করণের ফলে শ্রমিকশ্রেণি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাণিজ্য উদারীকরণ ও বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পসমূহ ধ্বংস করা হয়েছে। পাট ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকশ্রেণিও অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এরই স্বাভাবিক অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেশের শ্রমিক আন্দোলনও সংকটে নিপতিত হয়ে এক বিশেষ অবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সংগঠিত শিল্পকারখানা ধ্বংস, শ্রমিকশ্রেণির অনুপস্থিতি, কিছুসংখ্যক শ্রমিকনেতার দুর্নীতি ও সুবিধাবাদী মনোভাবের কারণে সাধারণভাবে শ্রমিকদের সরকারসমর্থক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী করে তুলেছে। আন্দোলনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলের চাপে সরকারসমর্থক শ্রমিক সংগঠনের পিছুটান, সর্বোপরি আগের তুলনায় সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো দুর্বল হওয়ায় শ্রমিকশ্রেণির দর–কষাকষির ক্ষমতা কমেছে।
শ্রমিকদের সংগঠিত ও আন্দোলনমুখী করার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় অন্তরায় হলো শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতার অভাব। আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের শ্রমিকেরা এখনো পুরোদস্তুর শিল্পশ্রমিক হয়ে উঠতে পারেননি। এখনো তাঁরা কোনো না কোনোভাবে গ্রামের জমি ও গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। আধুনিক শিল্পজীবনের খানিকটা ছোঁয়া যেমন তাঁরা পাচ্ছেন, তেমনি গ্রামের মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রভাবও তাঁদের মধ্যে আছে। এতে সহজেই তাঁরা দলাদলি, অনৈক্য ও আঞ্চলিকতার শিকারে পরিণত হন। এসব কারণে নিজেদের সংগ্রামী শক্তির ওপর আস্থার অভাব দেখা যায়। ফলে সংগ্রামের দীর্ঘমেয়াদি পথ পরিহার করে সহজেই কিছু পাওয়ার আশায় কিংবা তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার চিন্তায় তাঁরা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশে শ্রমিকশ্রেণির চাওয়া-পাওয়া অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রগতিশীলতার পথে এগিয়ে নেওয়ার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব আধুনিক শ্রমিকদের রয়েছে, সে সম্পর্কে তাঁরা পুরোপুরি সচেতন নন।
সামনে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ অনেক আছে।
আবার অতীতের অনেক বড় অর্জনের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। আগের মতো ছাত্র আন্দোলন থেকে শ্রমিক আন্দোলনে সংগঠক তেমন আসছেন না। আদর্শহীনতা, ভোগবাদী চিন্তা, আত্মস্বার্থপরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে শ্রমিকশ্রেণির
জন্য লড়াই করতে নতুন প্রজন্মের সংগঠকেরা আত্মোৎসর্গের অনুপ্রেরণা পান না।
কিন্তু আমাদের হতাশ হলে চলবে না। আমাদের দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতে হবে যে যত দিন সমাজে বৈষম্য-বঞ্চনা থাকবে, তত দিন এর বিরুদ্ধে সংগ্রামও অব্যাহত থাকবে। শোষিত ও বঞ্চিতদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। অনেক খারাপ সময় মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টির জন্য লড়াকু মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
নতুন উদ্যম, নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজে নামতে হবে। সব ধরনের সুবিধাবাদ ও হঠকারিতা থেকে মুক্ত থাকার দৃঢ়তা যেমন থাকতে হবে, তেমনি শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির রাজনৈতিক লক্ষ্যও ধ্রুবতারার মতো সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত থেকে একটি সত্যিকার বিপ্লবী ধারার শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করার প্রতিজ্ঞাও থাকতে হবে। আদর্শে দৃঢ় থেকে অবস্থাভেদে কৌশলে নমনীয় হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১ মে, মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক ঐতিহাসিক গৌরবময় দিন। এবার বাংলাদেশে দিনটি পালিত হচ্ছে অস্বাভাবিক গরমে, যখন জনজীবনে নেমে এসেছে চরম যন্ত্রণা। দেশে কি শুধু গরমই অস্বাভাবিক? না; সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাতসহ অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না। একসময় নির্বাচন ছিল সাধারণ মানুষের কাছে উৎসবের মতো। এখন সেটাও নেই। নির্বাচন মানেই এখন আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। ভোটের নামে চলছে শক্তির প্রতিযোগিতা। শক্তি—ক্ষমতার, অর্থের, পেশির, আত্মীয়তার।
যেহেতু মে দিবসে লেখাটি পাঠকের হাতে যাবে, সেহেতু দিবসটি নিয়েই দু-চার কথা বলি।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে প্রাণ হারান ১০ শ্রমিক। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক কনভেনশনে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে তারিখকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে মেহনতি মানুষকে সম্মান জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মে দিবস। শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন মহান মে দিবস।
আমাদের দেশেও প্রতিবছর ঘটা করে মে দিবস পালন করা হয়। পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন, কিন্তু সকাল-সন্ধ্যার অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা নিয়ে কি তাঁরা সন্তুষ্ট? তাঁরা কি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারছেন?
বাস্তবে আমাদের শ্রমিকদের জীবন নানা দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে কাটছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ শ্রমিকদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। অথচ এর অভাবে দেশের, বিশেষত গার্মেন্টস কারখানাগুলো, শ্রমিকের জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় শ্রমিকেরা হতাহত হলেও এ-সংক্রান্ত আইনের কোনো প্রয়োগ হয় না। এ প্রসঙ্গে তাজরীন গার্মেন্টস ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
আদমজী জুট মিলসহ আরও অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার পর আমাদের দেশে বর্তমানে সংগঠিত খাতের চেয়ে অসংগঠিত খাতের শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। গত কয়েক দশকে আরও একটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নানা ধরনের কাজে অংশ নিচ্ছেন। গার্মেন্টস ছাড়াও কৃষি, নির্মাণ, রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, চা-বাগান, ওষুধশিল্প, কোমল পানীয়, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, হস্তশিল্প ইত্যাদি খাতে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বেশি। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মজুরিবৈষম্যের শিকার।
দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও এখন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। নানা অসুস্থ প্রবণতা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে গ্রাস করেছে। সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলন দেশে আছে, তবে খুবই দুর্বল।
প্রবীণ শ্রমিকনেতা মনজুরুল আহসান খান একবার বলেছিলেন, ‘শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকস্বার্থ রক্ষা না করে শ্রমিকের ক্ষতি করে। নেতাগিরি একটা ব্যবসা, প্রচুর টাকাপয়সা পাওয়া যায় এতে।’ বাংলাদেশের এখনকার ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রে মনজুরুল আহসানের অভিযোগটি নির্মম সত্য। শ্রমিকস্বার্থের কথা বলে, শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে, শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তির ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব যা করছে, তার নাম স্রেফ ব্যবসা। বিনা পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসা। সে জন্য আমাদের দেশে শ্রমিকেরা ভালো না থাকলেও ভালো থাকেন অধিকাংশ শ্রমিকনেতা ও মালিক।
মনে রাখতে হবে, কোনো কালে, কোনো দেশেই শ্রমিকদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, ন্যায্য মজুরি কেউ আপনা-আপনি দিয়ে দেন না, লড়াই করেই তা আদায় করতে হয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্প প্রয়োজন। আবার শিল্প বিকাশের জন্য শিল্পবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন। অসুস্থ ও সুবিধাবাদী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শিল্পের বিকাশ ও স্থিতির জন্য ক্ষতিকর। সে জন্যই শিল্প বিকাশের স্বার্থে, জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতির স্বার্থে দেশে সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের যে অভাব এখন দেশে তৈরি হয়েছে, তা দূর করা প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশের ভেতরে আমরা রাজনৈতিকভাবে যেমন একটি অত্যন্ত জটিল সময় অতিক্রম করছি, তেমনি বিশ্বব্যাপী বর্তমান সময়টা শ্রমিকশ্রেণির জন্যও অনুকূল নয়। আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর বহুধাবিভক্তি এবং অতিমাত্রায় দলীয়করণের ফলে শ্রমিকশ্রেণি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাণিজ্য উদারীকরণ ও বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পসমূহ ধ্বংস করা হয়েছে। পাট ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকশ্রেণিও অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এরই স্বাভাবিক অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেশের শ্রমিক আন্দোলনও সংকটে নিপতিত হয়ে এক বিশেষ অবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সংগঠিত শিল্পকারখানা ধ্বংস, শ্রমিকশ্রেণির অনুপস্থিতি, কিছুসংখ্যক শ্রমিকনেতার দুর্নীতি ও সুবিধাবাদী মনোভাবের কারণে সাধারণভাবে শ্রমিকদের সরকারসমর্থক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী করে তুলেছে। আন্দোলনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলের চাপে সরকারসমর্থক শ্রমিক সংগঠনের পিছুটান, সর্বোপরি আগের তুলনায় সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো দুর্বল হওয়ায় শ্রমিকশ্রেণির দর–কষাকষির ক্ষমতা কমেছে।
শ্রমিকদের সংগঠিত ও আন্দোলনমুখী করার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় অন্তরায় হলো শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতার অভাব। আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের শ্রমিকেরা এখনো পুরোদস্তুর শিল্পশ্রমিক হয়ে উঠতে পারেননি। এখনো তাঁরা কোনো না কোনোভাবে গ্রামের জমি ও গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। আধুনিক শিল্পজীবনের খানিকটা ছোঁয়া যেমন তাঁরা পাচ্ছেন, তেমনি গ্রামের মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রভাবও তাঁদের মধ্যে আছে। এতে সহজেই তাঁরা দলাদলি, অনৈক্য ও আঞ্চলিকতার শিকারে পরিণত হন। এসব কারণে নিজেদের সংগ্রামী শক্তির ওপর আস্থার অভাব দেখা যায়। ফলে সংগ্রামের দীর্ঘমেয়াদি পথ পরিহার করে সহজেই কিছু পাওয়ার আশায় কিংবা তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার চিন্তায় তাঁরা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশে শ্রমিকশ্রেণির চাওয়া-পাওয়া অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রগতিশীলতার পথে এগিয়ে নেওয়ার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব আধুনিক শ্রমিকদের রয়েছে, সে সম্পর্কে তাঁরা পুরোপুরি সচেতন নন।
সামনে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ অনেক আছে।
আবার অতীতের অনেক বড় অর্জনের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। আগের মতো ছাত্র আন্দোলন থেকে শ্রমিক আন্দোলনে সংগঠক তেমন আসছেন না। আদর্শহীনতা, ভোগবাদী চিন্তা, আত্মস্বার্থপরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে শ্রমিকশ্রেণির
জন্য লড়াই করতে নতুন প্রজন্মের সংগঠকেরা আত্মোৎসর্গের অনুপ্রেরণা পান না।
কিন্তু আমাদের হতাশ হলে চলবে না। আমাদের দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতে হবে যে যত দিন সমাজে বৈষম্য-বঞ্চনা থাকবে, তত দিন এর বিরুদ্ধে সংগ্রামও অব্যাহত থাকবে। শোষিত ও বঞ্চিতদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। অনেক খারাপ সময় মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টির জন্য লড়াকু মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
নতুন উদ্যম, নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজে নামতে হবে। সব ধরনের সুবিধাবাদ ও হঠকারিতা থেকে মুক্ত থাকার দৃঢ়তা যেমন থাকতে হবে, তেমনি শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির রাজনৈতিক লক্ষ্যও ধ্রুবতারার মতো সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত থেকে একটি সত্যিকার বিপ্লবী ধারার শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করার প্রতিজ্ঞাও থাকতে হবে। আদর্শে দৃঢ় থেকে অবস্থাভেদে কৌশলে নমনীয় হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে