প্রমত্তা যমুনার ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু’। ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ সেতুর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। দেশি-বিদেশি প্রায় সাড়ে চার হাজার শ্রমিকের ঘামে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে আন্তএশিয়া রেল যোগাযোগের বৃহত্তম এই সেতু। প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই ৬২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
রেলসেতুর প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন থাকলেও ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে খুবই ধীরগতিতে সেতু অতিক্রম করে। তাই রেল যোগাযোগ নিরাপদ, গতিশীল এবং আন্তএশিয়ার যোগাযোগের করিডর তৈরির জন্য বর্তমান সেতুর উজানে পৃথক রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০২০ সালের ৮ আগস্ট কার্যাদেশ দেওয়া হয়। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের আগস্টে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুটি হবে সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকে। দুই পাশে নির্মাণ করা হবে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট। ৭ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ, সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার সংযোগ রেললাইন।
প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে জাপানের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। জাপানি ওবায়শি, জেএফই ও টোআ করপোরেশন যৌথভাবে (১ নম্বর গ্রুপ) টাঙ্গাইল অংশের ৫০ থেকে ২৪ নম্বর পিলার পর্যন্ত রেলসেতু নির্মাণ করবে। সিরাজগঞ্জ অংশের ১ নম্বর পিলার থেকে ২৩ নম্বর পিলার পর্যন্ত কাজ করবে জাপানি আইএইচআই, এসএমসিসি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে সেতুর বড় একটি অংশ দৃশ্যমান হয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ কাজ বাস্তবায়নে জাপান, ভিয়েতনাম, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের কর্মীরা নিয়োজিত আছেন। ১০৩ জন বিদেশি প্রকৌশলীসহ দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ৭০০ জনের বেশি প্রকৌশলী ব্যস্ত সময় পার করছেন।
গত সোমবার প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকেরা বালু দিয়ে জিও ব্যাগ ভর্তি করছেন। কেউ ক্রেন দিয়ে জিও ব্যাগ নদী শাসনের স্থানগুলোয় পৌঁছে দিচ্ছেন। কোথাও রেললাইনে পাথর ফেলে সমান করা হচ্ছে, চলছে নাট-বল্টু টাইট দেওয়া। শ্রমিকদের স্থলভাগ থেকে নদীর মাঝে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে স্পিড বোট দিয়ে।
ইতিমধ্যে টাঙ্গাইল অংশ থেকে অর্থাৎ ৫০ থেকে ৩৪ নম্বর পিলার পর্যন্ত স্পেন বসানো শেষ। ৩৪ থেকে ২৪ নম্বর পিলারের দিকে স্প্যান বসানোর কার্যক্রমও চলছে দ্রুতগতিতে। নেপালি প্রকৌশলী অমৃত বলেন, তিনি কাতার, ওমান, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের এই রেলসেতুতে কাজ করে ইতিহাসের অংশ হতে চলেছেন।
নাট-বল্টু টাইট দেওয়া ও রঙের কাজ করতে দেখা গেল মাসুদ আলম ও ফজর আলী নামের দুই শ্রমিককে। তাঁরা বলেন, প্রতিটি ধাপের কাজ শেষ হলে মনে হয় বাংলাদেশ যেন আরেকটু এগিয়ে গেল।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ সেতু নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের ট্রেন চলাচল ও পণ্য পরিবহন সহজ হবে। এর ওপর দিয়ে চলবে ৮৮টি ট্রেন। সাধারণ ছাড়াও দ্রুতগতির (হাইস্পিড) ট্রেন চলাচলে সক্ষম করে সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে সেতুতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যাবে। তবে শুরুতে (উদ্বোধনের পর এক বছর) ঘণ্টায় ৮০-১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করবে। এই প্রকৌশলীরা আরও জানান, সেতুর পূর্ব অংশের সংযোগ রেললাইন নির্মাণের কাজও শেষের দিকে। আর পশ্চিম অংশে আগে সংযোগ রেললাইনের কাজ হচ্ছে। সে কারণে মূল সেতুর অংশের কাজে কিছুটা ধীরগতি আছে। তবে সে কাজও ধীরে ধীরে গতি পাচ্ছে।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে সেতুর প্রকল্প পরিচালক ফাত্তাহ আল মো. মাসুদুর রহমান বলেন, শত বছর পরও এই সেতুর তেমন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এ পর্যন্ত ৬২ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাকি কাজ শেষ হবে।