আবু তাহের খান
১৩ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দেশটির ২০১০-১৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড উইলিয়াম ডোনাল্ড ক্যামেরন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকা বা না থাকার প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে ব্রেক্সিটপন্থী মতামত, অর্থাৎ ইইউতে থাকার অভিমত জয়লাভ করলে ক্যামেরন ২০১৬ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলের সাম্প্রতিক সময়ের অন্য প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ক্যামেরনের সঙ্গেই ইসরায়েলের পাশাপাশি সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশের বিশেষ সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। সেই সুসম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে মনে করেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা ও পারঙ্গমতার ওপর ক্যামেরনের নিজের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে বলেই হয়তো তিনিও সেই দায়িত্ব নিতে বিন্দুমাত্র কোনো সংকোচ বোধ করেননি; বরং সানন্দ্যচিত্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই নিঃসংকোচ দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে ধারণা করা যায়, ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন দেশটির বর্তমান সরকার চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি ইস্যু মোকাবিলায় কিছুটা হলেও বাড়তি শক্তি ও আস্থা খুঁজে পাবে।
একসময় ক্যামেরনই ছিলেন ঋষি সুনাকের দলীয় নেতা। তো সেই নেতাই যখন তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন, তখন সে বিষয়টি সাধারণের মাঝে যথেষ্টই কৌতূহল জাগায় বৈকি! আর সেই কৌতূহল যতটা না তাঁর দেশের ভেতরে তৈরি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জাগে দূরদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সমাজে, যেখানে ক্ষমতার লিপ্সায় রাজনীতিকদের প্রায় উন্মাদের মতো কিংবা সার্কাসের ভাঁড়ের মতো আচরণ করতে দেখা যায়। যতটুকু ধারণা করা যায়, ক্যামেরন তাঁর এই নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের আশায়। শেষ পর্যন্ত তিনি তা কতটা পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, আমরা এর কিছুই জানি না। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বা প্রয়োজনে পদাবস্থান ভুলে গিয়ে নিবেদিতচিত্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাঁর এই যে আগ্রহ, সেটাই বস্তুত একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে তাঁকে পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে কোনোভাবেই শুধু তাঁর সাফল্য বা ব্যর্থতাকে গণ্য করা ঠিক হবে না; বরং তাঁর ইচ্ছার ধরন এবং এ কাজে তাঁর নিবেদনের গভীরতাই হওয়া উচিত মূল্যায়নের মূল মাপকাঠি।
প্রশ্ন হচ্ছে, ক্যামেরন যা করলেন এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তুলনা করলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? জবাবে বলব, ক্যামেরনের কাছে দেশের হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই যেখানে মুখ্য, সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাছে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বা হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারই হচ্ছে মূল বিবেচনা। এর একটি কারণ অবশ্যই সামাজিক সংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য। তবে এটিই একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। ৫২ বছর আগে এই সমাজের মূলধারার মানুষেরাই ক্ষমতার লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ ও সব রকমের মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি আজ যাঁরা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে কিংবা ক্ষমতায় আরোহণ করতে চান, তাঁদের পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে অভিন্ন ঐক্যের অংশীদার ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একাত্তরের ঐক্যের অংশীদারদের আজকের উত্তরসূরিদের মধ্যে সেই সব বৈশিষ্ট্যের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এটি কেন ও কীভাবে ঘটল? ঘটল প্রথমত এ কারণে যে নতুন এই উত্তরসূরিদের প্রায় কেউই তৃণমূল পর্যায় থেকে ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি রাজনীতিতে যুক্ত হননি। তাঁদের একটি বড় অংশই রাজনীতিতে এসেছেন মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহদের মতো পারিবারিক উত্তরাধিকার মেনে। ফলে তাঁদের চিন্তা ও মননে জনস্বার্থের বোধ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন গভীর কোনো চিন্তাভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে তা না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ তাঁদের এই ক্ষমতাঘনিষ্ঠ জীবন দেশের কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের পাশাপাশি অবস্থান থেকে উঠে আসেনি। তাঁদের উত্তরসূরিদের রাজনৈতিক দল যখন বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ সাংগঠনিক সমস্যায় নিপতিত হয়েছে, তখনই তাঁদের শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে সাময়িকভাবে লেপ-পোঁচ দিয়ে সমস্যা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে টেনে আনা হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে এসে একপর্যায়ে তাঁরা যখন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যান, তখন এটাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের জীবনের মূল ধ্যানজ্ঞান এবং বেঁচে থাকার একমাত্র উপলক্ষ ও অবলম্বন।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং (প্রধানমন্ত্রিত্বের কার্যকাল: ২০০৪-১৪) রাজনীতিতে আসার আগে পুরো পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন আমলা। কিন্তু তারপরও তাঁর প্রশংসনীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ এখনো মানুষের কাছে প্রবাদতুল্য হয়ে আছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে না এলেও ব্যক্তিগত চিন্তা ও মেধার গুণেও মানুষ অতি উচ্চ রাজনৈতিক গুণসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতা হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশই রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনে উঠে আসেননি, উঠে এসেছেন নিজ নিজ দলীয় সাংগঠনিক বিপর্যয়ের মুখে ভাঙনের হাত থেকে দলকে রক্ষা করার জন্য এবং পরে সেটাকেই তাঁরা ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে এখন ক্ষমতাকেই জীবনের মূল আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন, যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্র ধরে রাজনীতিতে আসার মধ্যে দোষের কিছু নেই; বরং পৃথিবীর বহু দেশের রাজনীতিতেই এরূপ নির্দোষ ও মহৎ উদ্যোগের দৃষ্টান্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি ভ্রাতাত্রয় (প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট এফ কেনেডি ও সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডি) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সন্তান জাস্টিন ট্রুডোও (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) এ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য উত্তরাধিকারী। অন্যদিকে উপরিউক্ত দুই উদাহরণের বিপরীতে ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের কাছ থেকে পারিবারিক সূত্রে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ওঠা তাঁর স্ত্রী ইমেলদা মার্কোস কিংবা উত্তর কোরিয়ার সাবেক নেতা কিম জং-ইলের পুত্র হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণকারী কিম জং-উনের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কোন দৃষ্টান্ত ও বিকল্পের পথে হাঁটবে?
ডেভিড ক্যামেরন ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও এখন আবার তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীর নেতৃত্বাধীন পরিষদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন দেখে বাংলাদেশের মতো হীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমাজে কিছুটা বিস্ময় সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল ভালো করেই জানে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে নাগরিকদের পক্ষ থেকে কোনোরূপ অভিযোগ ওঠামাত্রই নৈতিক দায় নিয়ে পদত্যাগ করে থাকেন। আর এরূপ দৃষ্টান্ত সেই দেশগুলোতে আরও বহু যুগ আগে থেকেই চালু রয়েছে, এর মধ্যে ব্রিটেন অন্যতম। তো সেই ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় প্রায় ২০০ বছর কাটানোর পরও এ মানসিকতাটি বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা
কেন অর্জন করতে পারলেন না, তা এক গুরুতর প্রশ্ন বৈকি। তবে ২০০ বছরে সেটি না পারলেও মাত্র ২৩ বছর পাকিস্তানের সঙ্গে থেকেই ক্ষমতা নিয়ে হানাহানি ও কামড়াকামড়ির পাকিস্তানি সংস্কৃতিটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ উভয় শক্তিই প্রায় সমানভাবে রপ্ত করে নিয়েছে।
আর এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের রাজনীতির কদর্য দিকগুলোর জন্য বাইরের কোনো প্রভাব নয়; বরং দেশের রাজনীতিকদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা ক্লেদ ও কালিমাই মূলত দায়ী।
হৃদয়ের অন্তর্গত ক্লেদ ও কালিমা ছাড়া আর কী কী এ অবস্থার জন্য দায়ী, তা নিয়ে হয়তো আরও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে বিরাজমান পরিস্থিতি দেখে কেবলই মনে হয়, শুধু ক্যামেরন কেন, ব্রিটেনের শ্রমিক ও রক্ষণশীল উভয় দলের বেঁচে থাকা সব সাবেক প্রধানমন্ত্রীও (শ্রমিক দলের টনি ব্লেয়ার এবং রক্ষণশীল দলের থেরেসা মে, বরিস জনসন ও লিজ ট্রাস) যদি ঋষি সুনাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাহলেও তা দেখে বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা তাঁদের ক্ষমতালিপ্সা একবিন্দু ত্যাগ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তারপরও বলব, আমরা যে শুধু ব্রিটেন বা ক্যামেরনকে দেখেই শিক্ষা নেব, তা-ই নয়, এ ক্ষেত্রে আমরা যেন আমাদের বিবেককেও নিজেদের জ্ঞান, মেধা, শিক্ষা ও দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই অনুযায়ী ব্যবহারের চেষ্টা করি।
আবু তাহের খান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত
১৩ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দেশটির ২০১০-১৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড উইলিয়াম ডোনাল্ড ক্যামেরন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকা বা না থাকার প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে ব্রেক্সিটপন্থী মতামত, অর্থাৎ ইইউতে থাকার অভিমত জয়লাভ করলে ক্যামেরন ২০১৬ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলের সাম্প্রতিক সময়ের অন্য প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ক্যামেরনের সঙ্গেই ইসরায়েলের পাশাপাশি সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশের বিশেষ সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। সেই সুসম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে মনে করেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা ও পারঙ্গমতার ওপর ক্যামেরনের নিজের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে বলেই হয়তো তিনিও সেই দায়িত্ব নিতে বিন্দুমাত্র কোনো সংকোচ বোধ করেননি; বরং সানন্দ্যচিত্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই নিঃসংকোচ দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে ধারণা করা যায়, ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন দেশটির বর্তমান সরকার চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি ইস্যু মোকাবিলায় কিছুটা হলেও বাড়তি শক্তি ও আস্থা খুঁজে পাবে।
একসময় ক্যামেরনই ছিলেন ঋষি সুনাকের দলীয় নেতা। তো সেই নেতাই যখন তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন, তখন সে বিষয়টি সাধারণের মাঝে যথেষ্টই কৌতূহল জাগায় বৈকি! আর সেই কৌতূহল যতটা না তাঁর দেশের ভেতরে তৈরি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জাগে দূরদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সমাজে, যেখানে ক্ষমতার লিপ্সায় রাজনীতিকদের প্রায় উন্মাদের মতো কিংবা সার্কাসের ভাঁড়ের মতো আচরণ করতে দেখা যায়। যতটুকু ধারণা করা যায়, ক্যামেরন তাঁর এই নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের আশায়। শেষ পর্যন্ত তিনি তা কতটা পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, আমরা এর কিছুই জানি না। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বা প্রয়োজনে পদাবস্থান ভুলে গিয়ে নিবেদিতচিত্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাঁর এই যে আগ্রহ, সেটাই বস্তুত একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে তাঁকে পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে কোনোভাবেই শুধু তাঁর সাফল্য বা ব্যর্থতাকে গণ্য করা ঠিক হবে না; বরং তাঁর ইচ্ছার ধরন এবং এ কাজে তাঁর নিবেদনের গভীরতাই হওয়া উচিত মূল্যায়নের মূল মাপকাঠি।
প্রশ্ন হচ্ছে, ক্যামেরন যা করলেন এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তুলনা করলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? জবাবে বলব, ক্যামেরনের কাছে দেশের হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই যেখানে মুখ্য, সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাছে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বা হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারই হচ্ছে মূল বিবেচনা। এর একটি কারণ অবশ্যই সামাজিক সংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য। তবে এটিই একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। ৫২ বছর আগে এই সমাজের মূলধারার মানুষেরাই ক্ষমতার লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ ও সব রকমের মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি আজ যাঁরা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে কিংবা ক্ষমতায় আরোহণ করতে চান, তাঁদের পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে অভিন্ন ঐক্যের অংশীদার ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একাত্তরের ঐক্যের অংশীদারদের আজকের উত্তরসূরিদের মধ্যে সেই সব বৈশিষ্ট্যের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এটি কেন ও কীভাবে ঘটল? ঘটল প্রথমত এ কারণে যে নতুন এই উত্তরসূরিদের প্রায় কেউই তৃণমূল পর্যায় থেকে ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি রাজনীতিতে যুক্ত হননি। তাঁদের একটি বড় অংশই রাজনীতিতে এসেছেন মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহদের মতো পারিবারিক উত্তরাধিকার মেনে। ফলে তাঁদের চিন্তা ও মননে জনস্বার্থের বোধ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন গভীর কোনো চিন্তাভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে তা না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ তাঁদের এই ক্ষমতাঘনিষ্ঠ জীবন দেশের কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের পাশাপাশি অবস্থান থেকে উঠে আসেনি। তাঁদের উত্তরসূরিদের রাজনৈতিক দল যখন বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ সাংগঠনিক সমস্যায় নিপতিত হয়েছে, তখনই তাঁদের শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে সাময়িকভাবে লেপ-পোঁচ দিয়ে সমস্যা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে টেনে আনা হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে এসে একপর্যায়ে তাঁরা যখন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যান, তখন এটাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের জীবনের মূল ধ্যানজ্ঞান এবং বেঁচে থাকার একমাত্র উপলক্ষ ও অবলম্বন।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং (প্রধানমন্ত্রিত্বের কার্যকাল: ২০০৪-১৪) রাজনীতিতে আসার আগে পুরো পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন আমলা। কিন্তু তারপরও তাঁর প্রশংসনীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ এখনো মানুষের কাছে প্রবাদতুল্য হয়ে আছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে না এলেও ব্যক্তিগত চিন্তা ও মেধার গুণেও মানুষ অতি উচ্চ রাজনৈতিক গুণসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতা হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশই রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনে উঠে আসেননি, উঠে এসেছেন নিজ নিজ দলীয় সাংগঠনিক বিপর্যয়ের মুখে ভাঙনের হাত থেকে দলকে রক্ষা করার জন্য এবং পরে সেটাকেই তাঁরা ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে এখন ক্ষমতাকেই জীবনের মূল আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন, যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্র ধরে রাজনীতিতে আসার মধ্যে দোষের কিছু নেই; বরং পৃথিবীর বহু দেশের রাজনীতিতেই এরূপ নির্দোষ ও মহৎ উদ্যোগের দৃষ্টান্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি ভ্রাতাত্রয় (প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট এফ কেনেডি ও সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডি) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সন্তান জাস্টিন ট্রুডোও (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) এ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য উত্তরাধিকারী। অন্যদিকে উপরিউক্ত দুই উদাহরণের বিপরীতে ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের কাছ থেকে পারিবারিক সূত্রে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ওঠা তাঁর স্ত্রী ইমেলদা মার্কোস কিংবা উত্তর কোরিয়ার সাবেক নেতা কিম জং-ইলের পুত্র হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণকারী কিম জং-উনের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কোন দৃষ্টান্ত ও বিকল্পের পথে হাঁটবে?
ডেভিড ক্যামেরন ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও এখন আবার তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীর নেতৃত্বাধীন পরিষদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন দেখে বাংলাদেশের মতো হীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমাজে কিছুটা বিস্ময় সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল ভালো করেই জানে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে নাগরিকদের পক্ষ থেকে কোনোরূপ অভিযোগ ওঠামাত্রই নৈতিক দায় নিয়ে পদত্যাগ করে থাকেন। আর এরূপ দৃষ্টান্ত সেই দেশগুলোতে আরও বহু যুগ আগে থেকেই চালু রয়েছে, এর মধ্যে ব্রিটেন অন্যতম। তো সেই ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় প্রায় ২০০ বছর কাটানোর পরও এ মানসিকতাটি বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা
কেন অর্জন করতে পারলেন না, তা এক গুরুতর প্রশ্ন বৈকি। তবে ২০০ বছরে সেটি না পারলেও মাত্র ২৩ বছর পাকিস্তানের সঙ্গে থেকেই ক্ষমতা নিয়ে হানাহানি ও কামড়াকামড়ির পাকিস্তানি সংস্কৃতিটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ উভয় শক্তিই প্রায় সমানভাবে রপ্ত করে নিয়েছে।
আর এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের রাজনীতির কদর্য দিকগুলোর জন্য বাইরের কোনো প্রভাব নয়; বরং দেশের রাজনীতিকদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা ক্লেদ ও কালিমাই মূলত দায়ী।
হৃদয়ের অন্তর্গত ক্লেদ ও কালিমা ছাড়া আর কী কী এ অবস্থার জন্য দায়ী, তা নিয়ে হয়তো আরও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে বিরাজমান পরিস্থিতি দেখে কেবলই মনে হয়, শুধু ক্যামেরন কেন, ব্রিটেনের শ্রমিক ও রক্ষণশীল উভয় দলের বেঁচে থাকা সব সাবেক প্রধানমন্ত্রীও (শ্রমিক দলের টনি ব্লেয়ার এবং রক্ষণশীল দলের থেরেসা মে, বরিস জনসন ও লিজ ট্রাস) যদি ঋষি সুনাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাহলেও তা দেখে বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা তাঁদের ক্ষমতালিপ্সা একবিন্দু ত্যাগ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তারপরও বলব, আমরা যে শুধু ব্রিটেন বা ক্যামেরনকে দেখেই শিক্ষা নেব, তা-ই নয়, এ ক্ষেত্রে আমরা যেন আমাদের বিবেককেও নিজেদের জ্ঞান, মেধা, শিক্ষা ও দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই অনুযায়ী ব্যবহারের চেষ্টা করি।
আবু তাহের খান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৬ ঘণ্টা আগে