মামুনুর রশীদ
কাপুরুষেরা মৃত্যুর আগে বহুবার মরে
কিন্তু বীর একবারই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে।
আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়
মৃত্যু যেখানে অনিবার্য জেনেও
সেখানে মানুষ কেন ভয় পায়,
মৃত্যু যখন আসার তখনই আসবে।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অমর সংলাপটি উচ্চারিত হয়েছিল জুলিয়াস সিজারের কণ্ঠে। সিজার যখন সিনেট ভবনে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল হয়তো তিনি আততায়ীর হাতে পড়তে পারেন। নির্ভীক সিজার এ সংলাপটি উচ্চারণের মাধ্যমে মানবজাতিকে মৃত্যু সম্পর্কে একটি বার্তা দিয়ে গেছেন। কিন্তু তবু মৃত্যু অসহনীয় এবং মৃত্যুকে মেনে নেওয়া আপনজনের কাছে বড়ই কঠিন।
গত কয়েক দিনে তিনটি অসহনীয় মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। একেবারেই অকালে-অকস্মাৎ মৃত্যু আফসার আহমেদের। দীর্ঘদিন নাট্যক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি নাটক লিখেছেন, গবেষণা করেছেন, নাটকের নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, নাট্য প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর বাগ্মিতা অসাধারণ। বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক কম কিন্তু ছাত্রসুলভ কৌতূহল নিয়েই তাঁর বক্তৃতা শুনতাম। আমার মতো অগণিত শিক্ষার্থীও তাঁর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হতাম। কিছুদিন আগে জানতে পারি নাট্যতত্ত্ব ছাড়াও তিনি প্রাচ্যের দর্শন এবং পুরাণে খুবই আগ্রহী এবং কৌতূহলোদ্দীপক চিন্তার অনুসারী। আমি তাঁর সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়েছি এবং ভবিষ্যতেও গ্রিক দর্শন ও গ্রিক নাটকের সম্পর্ক নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনার আকাঙ্ক্ষা দুজনেই ব্যক্ত করেছিলাম। একটুখানি শীত পড়লেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সঙ্গে একটা বৈঠকের কথা ভাবছিলাম। এর মধ্যেই এই দুঃসংবাদ আমার আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। কী করে একটা মানুষ তাঁর যৌবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুধু নাটক নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য নয়, যখন আফসারকে দেখি। তিনি সেলিম আল দীনের সহযোগী হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব বিভাগ চালু করেছিলেন। একটা বিভাগ চালু করার পথ সহজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান জটিলতা, অসহযোগিতা এসব অতিক্রম করে ধাপে ধাপে একটি বিভাগকে প্রাণসঞ্চার করা অত্যন্ত কঠিন। সেই কঠিন কাজটি বহু বিনিদ্র রজনীর বিনিময়ে সক্ষমতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ক্রমান্বয়ে থিয়েটারে এবং বাংলা নাটকের এক এনসাইক্লোপিডিয়া অথবা জীবন্ত লাইব্রেরি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা নাটকের বিবিধক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, বিশেষ করে থিয়েটারের তাত্ত্বিক দিক, সেটা পূরণ হওয়ার নয়।
পরদিনই আরেকটি দুঃসংবাদ এবং তা হলো বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত দক্ষ পারফেকশনিস্ট চিত্রগ্রাহক সমীর কুশারী লোকান্তরিত হলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটা যুগে একজন চিত্রগ্রাহক হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন, কাজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন। এই আপসহীনতার জন্য মাঝে মাঝে আমি খুব বিরক্তও হতাম। কিন্তু পরে দেখেছি এটা খুব প্রয়োজন ছিল। একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। সব কাজ করতে উনি রাজিও হতেন না। কেমন করে যেন একটা উন্নত রুচিবোধ তৈরি হয়েছিল তাঁর মধ্যে। তিনি রনেন কুশারীর পুত্র। রনেন কুশারী ষাটের দশকে বেতার নাটকের প্রযোজক ছিলেন। তিনিও ছিলেন প্রযোজনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে এবং আপসহীন। সুদীর্ঘ দিন ধরে বেতার নাটকের অসাধারণ সব প্রযোজনা করেছেন। অনেক দিন সমীর কুশারীর সঙ্গে দেখা হয়নি কিন্তু এই মৃত্যুসংবাদ স্মরণ করিয়ে দিল যে তিনি আছেন এবং তিনি থাকবেন।
এই দুটি মৃত্যুর বেদনা নিয়ে যখন আমরা আক্রান্ত, তখনই সোমবার হঠাৎ করেই সাজু খাদেমের ফোন পেলাম, সাজু খাদেম এক হতভাগ্য শিল্পী। সম্প্রতি তার মাতৃবিয়োগ হয়েছে, সঙ্গে তার বোন, ভগ্নিপতি দুজনেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনটি মৃত্যুর ভার বহন করা সাজু খাদেম জানাল, আমার প্রিয় বন্ধু ড. ইনামুল হক আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন কিছুক্ষণ আগে। তাঁর কোনো মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল না, তেমন কোনো ব্যাধিতে আক্রান্তও ছিলেন না, দুপুরে খাওয়ার পর তাঁর প্রিয় ইজি চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে ঘটনাটি ঘটে গেল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে কী রকম বুকটা ভারী হয়ে গেল আমার, কত স্মৃতি মুহূর্তে আমার সমস্ত দেহ-মনকে অসাড় করে দিল। সেই কবে ১৯৬৮ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান টেলিভিশনে কাজ করতে করতে পরিচয়। সেই পরিচয় ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের কালে একটা রূপ পেল, আমরা বন্ধুত্বের নৈকট্যে চলে এলাম। ইনাম তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বয়সে আমার চেয়ে বড়, কেমন করে যেন আপনি থেকে তুমি এবং তুইয়ে চলে গেলাম।
ইনাম মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন, টেলিভিশনেও। আমি তখন কেবলই নাটক লিখি এবং মাঝে মাঝে আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম ও আসকার ইবনে সাইকের সঙ্গে মঞ্চনাটকের সহকারী হতাম। ইনাম আমার চেয়ে লড়াকু। কারণ, তিনি রাজনীতিও করেন। এভাবেই ১৯৭১ সাল এলে আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করে ঢাকায় এসেছি। ইনামকে বললাম, আমি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যাব। ইনাম অস্থির হয়ে গেলেন, কীভাবে আমাকে পাঠানো যায়। তখন আমাকে তাঁর এক আত্মীয়ের কাছে নিয়ে যান এবং তিনি আমাকে আগরতলা যাওয়ার পথ বাতলে দেন এবং সেখানকার সব যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে এলাম এবং যে মঞ্চনাটকের কথা আমরা ’৬৯-৭০ সালে স্বপ্ন দেখছিলাম, সেই কথা আবার পুনর্ব্যক্ত করলাম। ইনাম হাত বাড়িয়ে দিল। আলী যাকের আছে, সঙ্গে সুভাষ দত্তও আছেন। সেই সঙ্গে এসে পাশে দাঁড়াল মুজিব বিন হক এবং আমার সহকারী নাট্যসঙ্গী নাজমুল হোসাইন। মহড়া শুরু হলো জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কবর নাটকের সফল মঞ্চায়ন হলো। ইনাম সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেন।
ইনাম আগে থেকেই নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। কাজেই নাগরিকের কাজ শুরু হলে ইনাম চলে গেলেন তাঁর দলে। আলী যাকেরও তখন নাগরিকের সদস্য। সুভাস দত্ত চলে গেলেন অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী সিনেমা নির্মাণ করতে। আমি আরণ্যক পুনর্গঠন করে এগিয়ে যেতে থাকি। ইনাম নাগরিকে কর্মরত। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের কোনো রকম ঘাটতি দেখা যায়নি। আমরা দুজনই বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করি। ইনামের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর স্ত্রী লাকি ইনাম। ইনাম নাটক লেখেন। নাটক প্রকাশিত হলে তা আমাকে পাঠিয়ে দেন। নাটক নিয়ে যে কত কথা হয়, তারপর আসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সেখানে দুজনেই ভীষণভাবে সক্রিয়। এবার নাটক ছাড়াও পথে, মিছিলে গুরুত্বপূর্ণ সব সভায় ইনাম আছেন। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে মাঝে মাঝে তাঁকে সামলাই, আবার তিনি উত্তেজিত। একসময় পথ থেকে ফিরে আসি মঞ্চে। আবার অনেক ধরনের তর্ক-বিতর্ক, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বও এগিয়ে চলে।
ইনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিন্তু আমি শিক্ষক নই; বরং সবকিছুরই ছাত্র। ছাত্র-শিক্ষকে বন্ধুত্ব চলছে, হঠাৎ ইনামের মঞ্চ অভিনয়টা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ স্পন্ডালাইটিস, গলায় একধরনের পট্টি বাঁধতে হয়। এর কিছুদিন পরে দেখি ইনামের হাতে একটা ছোট্ট লাঠি। কিন্তু এসবই তাঁর জীবনযাপনে কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। স্ত্রী শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান। দুই কন্যাই কর্মঠ, অভিনয়-পরিচালনায় ঋদ্ধ। জামাতাদ্বয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা এবং তারকাও বটে। এর মধ্যেই তিনি সভা-সমিতিতে যান, বক্তব্য রাখেন এবং জীবনযাপনের সহজ পথে তাঁর অনায়াস চলাচল। বেশ একটা সুন্দর স্থিতাবস্থা। এর মধ্যেই সেদিন আমরা অন্ধকারে খুঁজতে থাকলাম আমাদের প্রিয় ড. ইনামুল হককে। আমি একা নই, তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী ছাত্র-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন একটা প্রকাণ্ড ভিড় শোকার্ত মানুষের। ইনাম তখন অনন্ত যাত্রায় গৃহ থেকে শিল্পকলায়, সেখান থেকে শহীদ মিনারে। কেন জানি এই তিনজনের কোনো বেদনার্ত মুখ মনে পড়ছে না, শুধু মনে পড়ছে সদাহাস্য তিনটি মুখ। যে তিনজন তিনজনকেই চিনত, জানত, ভালোবাসত। কোথায় পাঠাব ওদের জন্য একটা ছোট্ট নীল চিরকুট, ‘আমি তোমাদের ভালোবাসি’!
কাপুরুষেরা মৃত্যুর আগে বহুবার মরে
কিন্তু বীর একবারই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে।
আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়
মৃত্যু যেখানে অনিবার্য জেনেও
সেখানে মানুষ কেন ভয় পায়,
মৃত্যু যখন আসার তখনই আসবে।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অমর সংলাপটি উচ্চারিত হয়েছিল জুলিয়াস সিজারের কণ্ঠে। সিজার যখন সিনেট ভবনে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল হয়তো তিনি আততায়ীর হাতে পড়তে পারেন। নির্ভীক সিজার এ সংলাপটি উচ্চারণের মাধ্যমে মানবজাতিকে মৃত্যু সম্পর্কে একটি বার্তা দিয়ে গেছেন। কিন্তু তবু মৃত্যু অসহনীয় এবং মৃত্যুকে মেনে নেওয়া আপনজনের কাছে বড়ই কঠিন।
গত কয়েক দিনে তিনটি অসহনীয় মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। একেবারেই অকালে-অকস্মাৎ মৃত্যু আফসার আহমেদের। দীর্ঘদিন নাট্যক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি নাটক লিখেছেন, গবেষণা করেছেন, নাটকের নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, নাট্য প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর বাগ্মিতা অসাধারণ। বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক কম কিন্তু ছাত্রসুলভ কৌতূহল নিয়েই তাঁর বক্তৃতা শুনতাম। আমার মতো অগণিত শিক্ষার্থীও তাঁর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হতাম। কিছুদিন আগে জানতে পারি নাট্যতত্ত্ব ছাড়াও তিনি প্রাচ্যের দর্শন এবং পুরাণে খুবই আগ্রহী এবং কৌতূহলোদ্দীপক চিন্তার অনুসারী। আমি তাঁর সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়েছি এবং ভবিষ্যতেও গ্রিক দর্শন ও গ্রিক নাটকের সম্পর্ক নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনার আকাঙ্ক্ষা দুজনেই ব্যক্ত করেছিলাম। একটুখানি শীত পড়লেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সঙ্গে একটা বৈঠকের কথা ভাবছিলাম। এর মধ্যেই এই দুঃসংবাদ আমার আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। কী করে একটা মানুষ তাঁর যৌবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুধু নাটক নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য নয়, যখন আফসারকে দেখি। তিনি সেলিম আল দীনের সহযোগী হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব বিভাগ চালু করেছিলেন। একটা বিভাগ চালু করার পথ সহজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান জটিলতা, অসহযোগিতা এসব অতিক্রম করে ধাপে ধাপে একটি বিভাগকে প্রাণসঞ্চার করা অত্যন্ত কঠিন। সেই কঠিন কাজটি বহু বিনিদ্র রজনীর বিনিময়ে সক্ষমতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ক্রমান্বয়ে থিয়েটারে এবং বাংলা নাটকের এক এনসাইক্লোপিডিয়া অথবা জীবন্ত লাইব্রেরি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা নাটকের বিবিধক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, বিশেষ করে থিয়েটারের তাত্ত্বিক দিক, সেটা পূরণ হওয়ার নয়।
পরদিনই আরেকটি দুঃসংবাদ এবং তা হলো বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত দক্ষ পারফেকশনিস্ট চিত্রগ্রাহক সমীর কুশারী লোকান্তরিত হলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটা যুগে একজন চিত্রগ্রাহক হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন, কাজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন। এই আপসহীনতার জন্য মাঝে মাঝে আমি খুব বিরক্তও হতাম। কিন্তু পরে দেখেছি এটা খুব প্রয়োজন ছিল। একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। সব কাজ করতে উনি রাজিও হতেন না। কেমন করে যেন একটা উন্নত রুচিবোধ তৈরি হয়েছিল তাঁর মধ্যে। তিনি রনেন কুশারীর পুত্র। রনেন কুশারী ষাটের দশকে বেতার নাটকের প্রযোজক ছিলেন। তিনিও ছিলেন প্রযোজনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে এবং আপসহীন। সুদীর্ঘ দিন ধরে বেতার নাটকের অসাধারণ সব প্রযোজনা করেছেন। অনেক দিন সমীর কুশারীর সঙ্গে দেখা হয়নি কিন্তু এই মৃত্যুসংবাদ স্মরণ করিয়ে দিল যে তিনি আছেন এবং তিনি থাকবেন।
এই দুটি মৃত্যুর বেদনা নিয়ে যখন আমরা আক্রান্ত, তখনই সোমবার হঠাৎ করেই সাজু খাদেমের ফোন পেলাম, সাজু খাদেম এক হতভাগ্য শিল্পী। সম্প্রতি তার মাতৃবিয়োগ হয়েছে, সঙ্গে তার বোন, ভগ্নিপতি দুজনেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনটি মৃত্যুর ভার বহন করা সাজু খাদেম জানাল, আমার প্রিয় বন্ধু ড. ইনামুল হক আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন কিছুক্ষণ আগে। তাঁর কোনো মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল না, তেমন কোনো ব্যাধিতে আক্রান্তও ছিলেন না, দুপুরে খাওয়ার পর তাঁর প্রিয় ইজি চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে ঘটনাটি ঘটে গেল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে কী রকম বুকটা ভারী হয়ে গেল আমার, কত স্মৃতি মুহূর্তে আমার সমস্ত দেহ-মনকে অসাড় করে দিল। সেই কবে ১৯৬৮ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান টেলিভিশনে কাজ করতে করতে পরিচয়। সেই পরিচয় ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের কালে একটা রূপ পেল, আমরা বন্ধুত্বের নৈকট্যে চলে এলাম। ইনাম তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বয়সে আমার চেয়ে বড়, কেমন করে যেন আপনি থেকে তুমি এবং তুইয়ে চলে গেলাম।
ইনাম মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন, টেলিভিশনেও। আমি তখন কেবলই নাটক লিখি এবং মাঝে মাঝে আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম ও আসকার ইবনে সাইকের সঙ্গে মঞ্চনাটকের সহকারী হতাম। ইনাম আমার চেয়ে লড়াকু। কারণ, তিনি রাজনীতিও করেন। এভাবেই ১৯৭১ সাল এলে আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করে ঢাকায় এসেছি। ইনামকে বললাম, আমি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যাব। ইনাম অস্থির হয়ে গেলেন, কীভাবে আমাকে পাঠানো যায়। তখন আমাকে তাঁর এক আত্মীয়ের কাছে নিয়ে যান এবং তিনি আমাকে আগরতলা যাওয়ার পথ বাতলে দেন এবং সেখানকার সব যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে এলাম এবং যে মঞ্চনাটকের কথা আমরা ’৬৯-৭০ সালে স্বপ্ন দেখছিলাম, সেই কথা আবার পুনর্ব্যক্ত করলাম। ইনাম হাত বাড়িয়ে দিল। আলী যাকের আছে, সঙ্গে সুভাষ দত্তও আছেন। সেই সঙ্গে এসে পাশে দাঁড়াল মুজিব বিন হক এবং আমার সহকারী নাট্যসঙ্গী নাজমুল হোসাইন। মহড়া শুরু হলো জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কবর নাটকের সফল মঞ্চায়ন হলো। ইনাম সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেন।
ইনাম আগে থেকেই নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। কাজেই নাগরিকের কাজ শুরু হলে ইনাম চলে গেলেন তাঁর দলে। আলী যাকেরও তখন নাগরিকের সদস্য। সুভাস দত্ত চলে গেলেন অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী সিনেমা নির্মাণ করতে। আমি আরণ্যক পুনর্গঠন করে এগিয়ে যেতে থাকি। ইনাম নাগরিকে কর্মরত। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের কোনো রকম ঘাটতি দেখা যায়নি। আমরা দুজনই বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করি। ইনামের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর স্ত্রী লাকি ইনাম। ইনাম নাটক লেখেন। নাটক প্রকাশিত হলে তা আমাকে পাঠিয়ে দেন। নাটক নিয়ে যে কত কথা হয়, তারপর আসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সেখানে দুজনেই ভীষণভাবে সক্রিয়। এবার নাটক ছাড়াও পথে, মিছিলে গুরুত্বপূর্ণ সব সভায় ইনাম আছেন। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে মাঝে মাঝে তাঁকে সামলাই, আবার তিনি উত্তেজিত। একসময় পথ থেকে ফিরে আসি মঞ্চে। আবার অনেক ধরনের তর্ক-বিতর্ক, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বও এগিয়ে চলে।
ইনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিন্তু আমি শিক্ষক নই; বরং সবকিছুরই ছাত্র। ছাত্র-শিক্ষকে বন্ধুত্ব চলছে, হঠাৎ ইনামের মঞ্চ অভিনয়টা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ স্পন্ডালাইটিস, গলায় একধরনের পট্টি বাঁধতে হয়। এর কিছুদিন পরে দেখি ইনামের হাতে একটা ছোট্ট লাঠি। কিন্তু এসবই তাঁর জীবনযাপনে কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। স্ত্রী শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান। দুই কন্যাই কর্মঠ, অভিনয়-পরিচালনায় ঋদ্ধ। জামাতাদ্বয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা এবং তারকাও বটে। এর মধ্যেই তিনি সভা-সমিতিতে যান, বক্তব্য রাখেন এবং জীবনযাপনের সহজ পথে তাঁর অনায়াস চলাচল। বেশ একটা সুন্দর স্থিতাবস্থা। এর মধ্যেই সেদিন আমরা অন্ধকারে খুঁজতে থাকলাম আমাদের প্রিয় ড. ইনামুল হককে। আমি একা নই, তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী ছাত্র-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন একটা প্রকাণ্ড ভিড় শোকার্ত মানুষের। ইনাম তখন অনন্ত যাত্রায় গৃহ থেকে শিল্পকলায়, সেখান থেকে শহীদ মিনারে। কেন জানি এই তিনজনের কোনো বেদনার্ত মুখ মনে পড়ছে না, শুধু মনে পড়ছে সদাহাস্য তিনটি মুখ। যে তিনজন তিনজনকেই চিনত, জানত, ভালোবাসত। কোথায় পাঠাব ওদের জন্য একটা ছোট্ট নীল চিরকুট, ‘আমি তোমাদের ভালোবাসি’!
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে