বিভুরঞ্জন সরকার
আমাদের দেশে সরকার এবং বিরোধী দলের রাজনীতি বৈরিতার, সহযোগিতার নয়। স্বাধীনতার পর নতুন দেশে নতুন রাজনীতির একটি ধারা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। বঙ্গবন্ধু সরকারের ভালো কাজের সমর্থন বা প্রশংসা ও খারাপ কাজের বিরোধিতা বা সংগ্রামের নীতি নিয়েছিল দল দুটি। কিন্তু এই ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি বা কৌশল রাজনৈতিক মহলে এমনকি জনসাধারণের মধ্যেও খুব প্রশংসিত হয়নি। উল্টো সিপিবি ও ন্যাপকে আওয়ামী লীগের বি-টিম, সি-টিম হিসেবে টিটকারী সহ্য করতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগও যে সিপিবি-ন্যাপের প্রস্তাব বা বক্তব্য খুব বিবেচনায় নিয়েছে, তা-ও নয়। আওয়ামী লীগ আসলে আওয়ামী লীগের মতোই চলেছে। ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিপিবি-ন্যাপের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করে চলতেন। আবার তাদের সব বক্তব্যের সঙ্গেই একমত পোষণ করতেন, তা নয়। তবে এটা ঠিক, বঙ্গবন্ধুর সময় পর্যন্ত দেশের রাজনীতি চরম বৈরিতাপূর্ণ ছিল না। একধরনের সমঝোতার মনোভাব ও পরিবেশ বজায় ছিল। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিরোধীপক্ষের সঙ্গেও কখনো অসৌজন্যমূলক আচরণ করেননি, প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে কোনো বক্তব্যও দেননি।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে রাজনীতির ধারা বদলে দেওয়া হয়। তারপর ধারাবাহিকভাবেই রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার ধারা প্রবল হয়ে উঠেছে। এখন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আর একে অপরের সহযোগী তো নয়ই, প্রতিদ্বন্দ্বীও নয়; একেবারে শত্রুতার সম্পর্ক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করার কোনো দাওয়াই সম্ভবত জানা নেই। পরস্পরের বিরোধিতার অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি কোন ওষুধে কীভাবে সারানো যাবে, তা কেউ বলতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ যাতে উৎফুল্ল হয়, খুশি হয়, বিএনপি তাতে বেজার হয়, নাখোশ হয়। সম্প্রতি কিছুটা আকস্মিকভাবেই যেন এই দুই দল মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে দুই দলই। মাঠে শেষ পর্যন্ত কোন দলের আধিপত্য বজায় থাকবে, কোন দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে, তা দেখার জন্য উৎসুক অপেক্ষা এখন অনেকেরই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন কেন? নির্বাচনের তো এখনো বছর দেড়েক বাকি। এত আগে থেকে নেমে মাঠ গরম রাখার সাংগঠনিক শক্তি বিএনপি ও তার সহযোগীদের আছে তো?
কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঘোষণার পর বিএনপিও তাড়া অনুভব করছে সরকারকে একটু বেশি জোরে নাড়া দিতে। পদ্মা সেতু সরকারের সাফল্যের একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে সবার সামনে আসছে। দেশে-বিদেশে নানা বিরোধিতা-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সরকার এই সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করায় এ নিয়ে অহংকার বা গর্ব করার, এর সব কৃতিত্ব দাবি করার সংগত অধিকার অর্জন করেছে সরকার। বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও পদ্মা সেতু তৈরি করায় শেখ হাসিনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্য বিএনপির গায়ে স্বাভাবিকভাবেই জ্বালা ধরাচ্ছে। আওয়ামী লীগের ভালো বিএনপি সহ্য করতে পারে না। আবার বিএনপির সাফল্যও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের শিরঃপীড়ার কারণ হয়।
একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। এটা গত শতকের নব্বইয়ের দশকের কথা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসেছে। মির্জা গোলাম হাফিজ তখন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী। একদিন সচিবালয়ে মির্জা হাফিজের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যে সংসদে ইনডেমনিটি প্রত্যাহারের জন্য বিল জমা দিয়েছে, তা তিনি ড্রয়ারের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে ইনডেমনিটি বাতিল হবে না। কারণ, এটা বাতিল হলে লাভ আওয়ামী লীগের, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের যেটায় লাভ, সেটা বিএনপি করবে কেন?
পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু আওয়ামী লীগের নয়, দেশের মানুষেরও লাভ। কিন্তু তাতে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে নিঃসন্দেহে। শেখ হাসিনা প্রশংসিত হলে বিএনপি তা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। তাই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর পরই রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করছে দেশের দ্বিতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। আর বিএনপির এ চেষ্টা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আরও মাঠ উত্তপ্ত করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। উভয় দলই তাদের প্রধান নেত্রীকে হত্যার হুমকির অভিযোগ তুলে মাঠে নেমেছে। এ নিয়ে বাগ্যুদ্ধ চলছে। উভয় দলের ছাত্রসংগঠনের মধ্যে এ নিয়ে সংঘর্ষ, মামলা, পাল্টা মামলার ঘটনাও ঘটেছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম শুরুর পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে।’ খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের জবাব দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৮ মে দলীয় এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু থেকে খালেদা জিয়াকে টুস করে ফেলে দেওয়া উচিত।’
এরপর ২২ মে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বেশ কিছু কড়া বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘অনেকেই মনে করছেন আমরা তপ্ত রোদে উত্তপ্ত! আমরা উত্তপ্ত নই, শেখ হাসিনা আমাদের হৃদয়ে আঘাত করেছেন; আমাদের আদর্শিক মাকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাই আমরা উত্তপ্ত।’
ছাত্রলীগের অভিযোগ, ওই সমাবেশে ছাত্রদলের নেতারা ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ এমন স্লোগান দেন। জুয়েলের এই বক্তব্য ও স্লোগানের পর মাঠে নামে ছাত্রলীগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। এই স্লোগান ও বক্তব্যের জন্য ক্ষমা না চাইলে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদককে প্রতিহতের ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। এরপর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাবি ক্যাম্পাস।
অবশ্য ঘটনা এখন আর ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ‘সরকার হটানো’র হুংকার দিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। বসে নেই আওয়ামী লীগও। নেতা-মন্ত্রীদের কণ্ঠে অসহিষ্ণুতার সুর। প্রতিদিনই বইছে পাল্টাপাল্টি বক্তৃতার ঝড়।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে, আর আমরা বসে তামাক খাব?’
না, আওয়ামী লীগকে ‘তামাক’ খাওয়ার পরামর্শ কেউ নিশ্চয়ই দেবেন না। কারণ, সবারই এটা জানা যে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ক্ষতিকর কোনো কাজ কাউকে করতে বলা অপরাধ। কিন্তু ‘বসে তামাক না খেয়ে’ আওয়ামী লীগ তার ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে যা করার পরামর্শ দিচ্ছে, তা তামাক খাওয়া বা ধূমপানের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয় কোনো বিবেচনাতেই।
ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর সম্প্রতি ছাত্রলীগের চড়াও হওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিলে ছাত্রলীগ কি চুপ করে বসে থাকবে? নেত্রীকে অপমান করা হচ্ছে। এই অপমান কি আমরা সইতে পারি? এসব কটূক্তির প্রতিবাদ ছাত্রলীগ করেছে।’
এ তো একেবারে খুনের বদলে খুনের মতো ব্যাপার। শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। পছন্দ না হলেও এটা বিএনপির লোকজনকে মানতেই হবে। আবার শেখ হাসিনা বা সরকারের বিরোধিতা করা যাবে না–এমন কোনো আইন দেশে নেই। দেশে গণতন্ত্র আছে–এই দাবি করলে সরকারের বিরোধিতা করতে দিতেই হবে। তবে হ্যাঁ, সরকারের বিরোধিতা মানে সরকারপ্রধানের প্রতি অশালীন উক্তি করা নয়, নয় তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া। কোনো সভ্য সমাজেই কাউকে প্রাণনাশের প্রকাশ্য হুমকি দেওয়ার গণতন্ত্র আছে বলে মনে হয় না।
বিএনপি এবং ছাত্রদলসহ এই দলের সমর্থকেরা যদি ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগান দিয়ে থাকেন, তাহলে সরকারের নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগ থাকে না। পঁচাত্তরে হাতিয়ার গর্জে ওঠার পরিণতি কী হয়েছিল, তা আমরা জানি। পঁচাত্তরে রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হাতিয়ার দিয়ে হত্যা করেই রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের এই বর্বর ধারা কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষেরই সমর্থন পেতে পারে না। বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের পরিবর্তন চাইতে পারে, কিন্তু সেটা যদি ‘হাতিয়ারের’ মাধ্যমে করতে চাওয়া হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। সরকারের বিরোধিতা করতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে বিএনপিও বলতে পারে, আমাদের নেত্রীকে যে পদ্মা সেতু থেকে ‘টুস’ করে পানিতে ফেলে দিতে বললেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই, সেটা কী হত্যার হুমকি নয়? যদি এটা কথার কথাও হয়, তাহলে বিষয়টি খালেদা জিয়ার সমর্থকদের গায়ে লাগারই কথা। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক যদি অশালীন কটূক্তি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে করে থাকেন, তাহলে এভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে হবে ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী বলে দাবিদার একটি সংগঠনকে?
ছাত্রদলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলন শুরু করবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘আমরাও দেখব কত ধানে কত চাল। সবকিছুরই শেষ আছে। বাড়াবাড়ি ভালো নয়। মির্জা ফখরুলকে বলে দিচ্ছি, আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুন নিয়ে খেললে পরিণতি ভালো হবে না।’
অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের ধমকাচ্ছেন, ভয়ানক পরিণতি হবে।’ তিনি চুয়াত্তর-পঁচাত্তর সালের কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘ভয়ানক পরিণতি হয়তো আপনারা অতীতে দেখেছেন।’
নেতারা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিলেও সাধারণ মানুষ অকারণে দেশের মধ্যে অশান্তি চায় না। মানুষ শান্তি চায়। অধিকার চায়। বাঁচতে চায়।
আমাদের দেশে সরকার এবং বিরোধী দলের রাজনীতি বৈরিতার, সহযোগিতার নয়। স্বাধীনতার পর নতুন দেশে নতুন রাজনীতির একটি ধারা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। বঙ্গবন্ধু সরকারের ভালো কাজের সমর্থন বা প্রশংসা ও খারাপ কাজের বিরোধিতা বা সংগ্রামের নীতি নিয়েছিল দল দুটি। কিন্তু এই ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি বা কৌশল রাজনৈতিক মহলে এমনকি জনসাধারণের মধ্যেও খুব প্রশংসিত হয়নি। উল্টো সিপিবি ও ন্যাপকে আওয়ামী লীগের বি-টিম, সি-টিম হিসেবে টিটকারী সহ্য করতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগও যে সিপিবি-ন্যাপের প্রস্তাব বা বক্তব্য খুব বিবেচনায় নিয়েছে, তা-ও নয়। আওয়ামী লীগ আসলে আওয়ামী লীগের মতোই চলেছে। ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিপিবি-ন্যাপের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করে চলতেন। আবার তাদের সব বক্তব্যের সঙ্গেই একমত পোষণ করতেন, তা নয়। তবে এটা ঠিক, বঙ্গবন্ধুর সময় পর্যন্ত দেশের রাজনীতি চরম বৈরিতাপূর্ণ ছিল না। একধরনের সমঝোতার মনোভাব ও পরিবেশ বজায় ছিল। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিরোধীপক্ষের সঙ্গেও কখনো অসৌজন্যমূলক আচরণ করেননি, প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে কোনো বক্তব্যও দেননি।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে রাজনীতির ধারা বদলে দেওয়া হয়। তারপর ধারাবাহিকভাবেই রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার ধারা প্রবল হয়ে উঠেছে। এখন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আর একে অপরের সহযোগী তো নয়ই, প্রতিদ্বন্দ্বীও নয়; একেবারে শত্রুতার সম্পর্ক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করার কোনো দাওয়াই সম্ভবত জানা নেই। পরস্পরের বিরোধিতার অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি কোন ওষুধে কীভাবে সারানো যাবে, তা কেউ বলতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ যাতে উৎফুল্ল হয়, খুশি হয়, বিএনপি তাতে বেজার হয়, নাখোশ হয়। সম্প্রতি কিছুটা আকস্মিকভাবেই যেন এই দুই দল মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে দুই দলই। মাঠে শেষ পর্যন্ত কোন দলের আধিপত্য বজায় থাকবে, কোন দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে, তা দেখার জন্য উৎসুক অপেক্ষা এখন অনেকেরই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন কেন? নির্বাচনের তো এখনো বছর দেড়েক বাকি। এত আগে থেকে নেমে মাঠ গরম রাখার সাংগঠনিক শক্তি বিএনপি ও তার সহযোগীদের আছে তো?
কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঘোষণার পর বিএনপিও তাড়া অনুভব করছে সরকারকে একটু বেশি জোরে নাড়া দিতে। পদ্মা সেতু সরকারের সাফল্যের একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে সবার সামনে আসছে। দেশে-বিদেশে নানা বিরোধিতা-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সরকার এই সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করায় এ নিয়ে অহংকার বা গর্ব করার, এর সব কৃতিত্ব দাবি করার সংগত অধিকার অর্জন করেছে সরকার। বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও পদ্মা সেতু তৈরি করায় শেখ হাসিনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্য বিএনপির গায়ে স্বাভাবিকভাবেই জ্বালা ধরাচ্ছে। আওয়ামী লীগের ভালো বিএনপি সহ্য করতে পারে না। আবার বিএনপির সাফল্যও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের শিরঃপীড়ার কারণ হয়।
একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। এটা গত শতকের নব্বইয়ের দশকের কথা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসেছে। মির্জা গোলাম হাফিজ তখন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী। একদিন সচিবালয়ে মির্জা হাফিজের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যে সংসদে ইনডেমনিটি প্রত্যাহারের জন্য বিল জমা দিয়েছে, তা তিনি ড্রয়ারের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে ইনডেমনিটি বাতিল হবে না। কারণ, এটা বাতিল হলে লাভ আওয়ামী লীগের, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের যেটায় লাভ, সেটা বিএনপি করবে কেন?
পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু আওয়ামী লীগের নয়, দেশের মানুষেরও লাভ। কিন্তু তাতে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে নিঃসন্দেহে। শেখ হাসিনা প্রশংসিত হলে বিএনপি তা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। তাই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর পরই রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করছে দেশের দ্বিতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। আর বিএনপির এ চেষ্টা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আরও মাঠ উত্তপ্ত করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। উভয় দলই তাদের প্রধান নেত্রীকে হত্যার হুমকির অভিযোগ তুলে মাঠে নেমেছে। এ নিয়ে বাগ্যুদ্ধ চলছে। উভয় দলের ছাত্রসংগঠনের মধ্যে এ নিয়ে সংঘর্ষ, মামলা, পাল্টা মামলার ঘটনাও ঘটেছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম শুরুর পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে।’ খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের জবাব দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৮ মে দলীয় এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু থেকে খালেদা জিয়াকে টুস করে ফেলে দেওয়া উচিত।’
এরপর ২২ মে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বেশ কিছু কড়া বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘অনেকেই মনে করছেন আমরা তপ্ত রোদে উত্তপ্ত! আমরা উত্তপ্ত নই, শেখ হাসিনা আমাদের হৃদয়ে আঘাত করেছেন; আমাদের আদর্শিক মাকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাই আমরা উত্তপ্ত।’
ছাত্রলীগের অভিযোগ, ওই সমাবেশে ছাত্রদলের নেতারা ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ এমন স্লোগান দেন। জুয়েলের এই বক্তব্য ও স্লোগানের পর মাঠে নামে ছাত্রলীগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। এই স্লোগান ও বক্তব্যের জন্য ক্ষমা না চাইলে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদককে প্রতিহতের ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। এরপর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাবি ক্যাম্পাস।
অবশ্য ঘটনা এখন আর ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ‘সরকার হটানো’র হুংকার দিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। বসে নেই আওয়ামী লীগও। নেতা-মন্ত্রীদের কণ্ঠে অসহিষ্ণুতার সুর। প্রতিদিনই বইছে পাল্টাপাল্টি বক্তৃতার ঝড়।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে, আর আমরা বসে তামাক খাব?’
না, আওয়ামী লীগকে ‘তামাক’ খাওয়ার পরামর্শ কেউ নিশ্চয়ই দেবেন না। কারণ, সবারই এটা জানা যে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ক্ষতিকর কোনো কাজ কাউকে করতে বলা অপরাধ। কিন্তু ‘বসে তামাক না খেয়ে’ আওয়ামী লীগ তার ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে যা করার পরামর্শ দিচ্ছে, তা তামাক খাওয়া বা ধূমপানের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয় কোনো বিবেচনাতেই।
ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর সম্প্রতি ছাত্রলীগের চড়াও হওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিলে ছাত্রলীগ কি চুপ করে বসে থাকবে? নেত্রীকে অপমান করা হচ্ছে। এই অপমান কি আমরা সইতে পারি? এসব কটূক্তির প্রতিবাদ ছাত্রলীগ করেছে।’
এ তো একেবারে খুনের বদলে খুনের মতো ব্যাপার। শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। পছন্দ না হলেও এটা বিএনপির লোকজনকে মানতেই হবে। আবার শেখ হাসিনা বা সরকারের বিরোধিতা করা যাবে না–এমন কোনো আইন দেশে নেই। দেশে গণতন্ত্র আছে–এই দাবি করলে সরকারের বিরোধিতা করতে দিতেই হবে। তবে হ্যাঁ, সরকারের বিরোধিতা মানে সরকারপ্রধানের প্রতি অশালীন উক্তি করা নয়, নয় তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া। কোনো সভ্য সমাজেই কাউকে প্রাণনাশের প্রকাশ্য হুমকি দেওয়ার গণতন্ত্র আছে বলে মনে হয় না।
বিএনপি এবং ছাত্রদলসহ এই দলের সমর্থকেরা যদি ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগান দিয়ে থাকেন, তাহলে সরকারের নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগ থাকে না। পঁচাত্তরে হাতিয়ার গর্জে ওঠার পরিণতি কী হয়েছিল, তা আমরা জানি। পঁচাত্তরে রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হাতিয়ার দিয়ে হত্যা করেই রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের এই বর্বর ধারা কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষেরই সমর্থন পেতে পারে না। বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের পরিবর্তন চাইতে পারে, কিন্তু সেটা যদি ‘হাতিয়ারের’ মাধ্যমে করতে চাওয়া হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। সরকারের বিরোধিতা করতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে বিএনপিও বলতে পারে, আমাদের নেত্রীকে যে পদ্মা সেতু থেকে ‘টুস’ করে পানিতে ফেলে দিতে বললেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই, সেটা কী হত্যার হুমকি নয়? যদি এটা কথার কথাও হয়, তাহলে বিষয়টি খালেদা জিয়ার সমর্থকদের গায়ে লাগারই কথা। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক যদি অশালীন কটূক্তি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে করে থাকেন, তাহলে এভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে হবে ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী বলে দাবিদার একটি সংগঠনকে?
ছাত্রদলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলন শুরু করবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘আমরাও দেখব কত ধানে কত চাল। সবকিছুরই শেষ আছে। বাড়াবাড়ি ভালো নয়। মির্জা ফখরুলকে বলে দিচ্ছি, আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুন নিয়ে খেললে পরিণতি ভালো হবে না।’
অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের ধমকাচ্ছেন, ভয়ানক পরিণতি হবে।’ তিনি চুয়াত্তর-পঁচাত্তর সালের কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘ভয়ানক পরিণতি হয়তো আপনারা অতীতে দেখেছেন।’
নেতারা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিলেও সাধারণ মানুষ অকারণে দেশের মধ্যে অশান্তি চায় না। মানুষ শান্তি চায়। অধিকার চায়। বাঁচতে চায়।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে