পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা জীবনকালে এমন কিছু করে যান, যার জন্য তাঁরা দুনিয়ার মায়া চিরতরে ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পরও বেঁচে থাকা মানুষেরা তাঁদের মনে রাখেন, স্মরণ করেন। বাংলাদেশের সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তেমন একজন মানুষ। ৮৮ বছরের জীবন পেয়েছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এর মধ্যে প্রায় ৭২ বছরই সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। এতগুলো বছর ধরে কত রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন, সেই হিসাব সম্ভবত তাঁর নিজের কাছেও ছিল না। দুই হাতে লেখা বলে একটি কথা আছে। কথাটা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ক্ষেত্রে যেন শতভাগ সত্য। তিনি যেন দুই হাতেই লিখতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ছাত্র অবস্থায় ‘দৈনিক ইনসান’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যে জীবনের শুরু, তার সমাপ্তি ঘটেছে ২০২২ সালের ১৯ মে, নিজের দেশ থেকে বহু দূরে সুদূর লন্ডনের একটি হাসপাতালে। তিনি জীবনভর যত যা লিখেছেন তার সবগুলোর জন্য না হলেও মাত্র একটি গীতিকবিতার জন্য তাঁকে বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে, স্মরণ করবে। বলবে, গাফ্ফার চৌধুরী, আমরা কি আপনাকে ‘ভুলিতে পারি’?
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিল। শহীদ হয়েছিলেন বরকত, রফিক, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন। গাফ্ফার চৌধুরী মাথার খুলি উড়ে যাওয়া এক শহীদের রক্তাক্ত শরীর দেখেছিলেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ১৮ বছরের এক তরুণ গাফ্ফার চৌধুরীর হৃদয়ে তখন যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তাই তাঁকে রচনা করতে প্রাণিত করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ অতিসাধারণ সব শব্দ দিয়ে গাঁথা এই মালা কেন বাঙালির কণ্ঠে মণিহার হলো? কারণ এতে ধ্বনিত হয়েছে বাঙালির মনের কথা। প্রথমে আব্দুল লতিফ, পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুর দিয়ে এই শব্দগুলোকে করে তুলেছেন এমন এক গান, যা বাঙালির জন্য যেকোনো সংকটে, সংগ্রামে উত্তরণের অভয়বাণী হয়ে উঠেছে। তাই কালজয়ী সৃষ্টির জন্য গাফ্ফার চৌধুরীকে ভুলে যাওয়া বাঙালির পক্ষে অসম্ভব।
১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া চৌধুরী বাড়িতে জন্ম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। একেবারে স্কুলজীবনেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। একটি বামপন্থী দলের সঙ্গে জড়িতও হয়েছিলেন। কিন্তু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী না হয়ে হয়ে উঠেছেন রাজনীতি পরিচালনার মন্ত্রগুরু, পরামর্শক এবং সেটা রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক কলাম লিখে।
গাফ্ফার চৌধুরী সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ডানপিটে শওকত। এরপর একে একে লিখেছেন কৃষ্ণপক্ষ, সম্রাটের ছবি, চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, সুন্দর হে সুন্দর, নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ ইত্যাদি।
গাফ্ফার চৌধুরী রাজনৈতিক লেখালেখির প্রতি বেশি মনোযোগী বা আগ্রহী হওয়ায় সাহিত্যের পথে হাঁটা কমিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন না খারাপ করেছেন, সেটা অন্য বিতর্ক। কিন্তু বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার সঙ্গে তিনি নিজেকে যেভাবে জড়িয়েছেন, তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। কলমযোদ্ধা ছিলেন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বন্দুক হাতে না নিয়ে তিনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের সম্মুখযোদ্ধা। তাঁকে বলা হয় কালের সাক্ষী। তিনি শুধু ঘটনার নীরব দর্শক ছিলেন না, ঘটনার মোড় পরিবর্তনের জন্য চালিয়েছেন কলমযুদ্ধ। তিনি যেমন অনেক কিছু কাছ থেকে দেখেছেন, তেমনি সেগুলো লিখেছেনও।
গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন মনেপ্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার মানুষ। তাঁর অবস্থান ছিল সব সময় যুক্তির পক্ষে, কূপমণ্ডূকতা, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। তাঁর লেখা ছিল অত্যন্ত সুখপাঠ্য। তাই পাঠকদের টানত। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাজনৈতিক কলাম যে কয়েকজনের লেখার গুণে জনপ্রিয় হয়েছে, তার মধ্যে গাফ্ফার চৌধুরীর নাম নিঃসন্দেহে শীর্ষে থাকবে। তাঁর মতের সঙ্গে যাঁরা একমত হতে পারতেন না, তাঁরাও তাঁর লেখা পড়তেন। গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা পড়া অনেকের কাছেই ছিল নেশার মতো।
গাফ্ফার চৌধুরী বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, ইউনেসকো পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তবে অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসার চেয়ে বড় প্রাপ্তি ও পুরস্কার আর কী হতে পারে।
তিনি দেশে থাকতে অনেক পত্রিকায় কাজ করেছেন। তবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার স্নেহধন্য হয়ে দৈনিক ইত্তেফাকই ছিল হয়তো তাঁর সেরা কর্মক্ষেত্র। স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জনপদ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, তেমনি দেশের বাইরে গিয়েও গাফ্ফার চৌধুরী সংবাদপত্র থেকে দূরে থাকেননি। লন্ডন থেকেও তিনি পত্রিকা বের করেছেন।
লেখালেখির বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক একটি ডকুড্রামা ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নির্মাণ করেছেন ২০০৭ সালে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে সফল হননি।
অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তিনি লন্ডনে চলে গেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। তারপর গত শতকের আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন বাজারে এসেই ঝড় তোলে। গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বন্ধু শফিক রেহমানের যায়যায়দিনে লেখা শুরু করেন। বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে গাফ্ফার চৌধুরীকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যায়যায়দিন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমিও যায়যায়দিনে রাজনৈতিক প্রতিবেদন লিখতাম। সামরিক স্বৈরশাসকের লাল চোখের জন্য তখন আমাকে ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল–তারিখ ইব্রাহিম। যায়যায়দিনের মাধ্যমে আমাদের সেই যে সম্পর্কের ঝালাই হয়, তাতে আর ছেদ পড়েনি।
গাফ্ফার চৌধুরী আমাকে তাঁর প্রিয়জনদের তালিকায় নিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। আমি যখন যে পত্রিকায় কাজ করেছি, সেই পত্রিকাতেই গাফ্ফার ভাই সানন্দে লিখতে সম্মত হয়েছেন, লিখেছেন। আমার বর্তমান কর্মস্থল ‘আজকের পত্রিকা’তেও লিখতে শুরু করেছিলেন। মৃত্যুর দুই দিন আগেও হাসপাতাল থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। এর মাসখানেক আগে তাঁর এক মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন, ‘আমিও বুঝি আর বেশি দিন বাঁচব না, বিভু।’
আমি হেসে জবাব দিয়েছিলাম, ‘আপনি সেঞ্চুরি করবেন গাফ্ফার ভাই। আপনার কাজ এখনো শেষ হয়নি। ইতিহাস আপনার কাঁধে যেসব দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তার সবগুলো তো আপনি এখনো শেষ করেননি।’
তাঁকে দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কথা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। আমার কথার জবাবে বললেন, ‘বিভু, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগে। আমার সমবয়সী কিংবা আমার থেকে বয়সে ছোট অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে স্মৃতি হাতড়াই আর ভারাক্রান্ত হই।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মনে একধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে বলেও মনে হলো। বললেন, ‘আওয়ামী লীগ পথ হারিয়েছে। হাসিনার উচিত রেহানাকে তাঁর পাশে নিষ্ক্রিয় দাঁড় করিয়ে না রেখে কিছু দায়িত্ব তার কাঁধেও ছেড়ে দেওয়া। আমার বিশ্বাস, আমার মা খারাপ করবে না।’
গাফ্ফার ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যাকেই কন্যার মতো ভালোবাসতেন। তবে বড় বোনের চেয়ে ছোট বোনের প্রতি তাঁর নৈকট্য বেশি বলে আমার ধারণা। শেখ রেহানা লন্ডনে কয়েক বছর থাকায় তাঁর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল বেশি। শেখ রেহানাকে গাফ্ফার ভাই ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন।
আমি গাফ্ফার ভাইকে বলি, ‘আপনি “আজকের পত্রিকা”য় লিখুন আপনার ইচ্ছের কথা।’ তিনি বলেন, ‘শুক্রবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাব। শনিবার
আপনি ফোন করবেন। আমি পরের সপ্তাহ থেকেই আপনাদের পত্রিকায় লিখব। আমি শুনেছি আজকের পত্রিকা ভালো হচ্ছে।’
হায়! এ কী ঘটে গেল। সেই শুক্রবার আসার আগেই, বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ গাফ্ফার ভাই চলে গেলেন। তাঁর আরও কত কথা বলার ছিল। সেসব আর বলা হলো না।
লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা জীবনকালে এমন কিছু করে যান, যার জন্য তাঁরা দুনিয়ার মায়া চিরতরে ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পরও বেঁচে থাকা মানুষেরা তাঁদের মনে রাখেন, স্মরণ করেন। বাংলাদেশের সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তেমন একজন মানুষ। ৮৮ বছরের জীবন পেয়েছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এর মধ্যে প্রায় ৭২ বছরই সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। এতগুলো বছর ধরে কত রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন, সেই হিসাব সম্ভবত তাঁর নিজের কাছেও ছিল না। দুই হাতে লেখা বলে একটি কথা আছে। কথাটা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ক্ষেত্রে যেন শতভাগ সত্য। তিনি যেন দুই হাতেই লিখতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ছাত্র অবস্থায় ‘দৈনিক ইনসান’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যে জীবনের শুরু, তার সমাপ্তি ঘটেছে ২০২২ সালের ১৯ মে, নিজের দেশ থেকে বহু দূরে সুদূর লন্ডনের একটি হাসপাতালে। তিনি জীবনভর যত যা লিখেছেন তার সবগুলোর জন্য না হলেও মাত্র একটি গীতিকবিতার জন্য তাঁকে বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে, স্মরণ করবে। বলবে, গাফ্ফার চৌধুরী, আমরা কি আপনাকে ‘ভুলিতে পারি’?
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিল। শহীদ হয়েছিলেন বরকত, রফিক, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন। গাফ্ফার চৌধুরী মাথার খুলি উড়ে যাওয়া এক শহীদের রক্তাক্ত শরীর দেখেছিলেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ১৮ বছরের এক তরুণ গাফ্ফার চৌধুরীর হৃদয়ে তখন যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তাই তাঁকে রচনা করতে প্রাণিত করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ অতিসাধারণ সব শব্দ দিয়ে গাঁথা এই মালা কেন বাঙালির কণ্ঠে মণিহার হলো? কারণ এতে ধ্বনিত হয়েছে বাঙালির মনের কথা। প্রথমে আব্দুল লতিফ, পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুর দিয়ে এই শব্দগুলোকে করে তুলেছেন এমন এক গান, যা বাঙালির জন্য যেকোনো সংকটে, সংগ্রামে উত্তরণের অভয়বাণী হয়ে উঠেছে। তাই কালজয়ী সৃষ্টির জন্য গাফ্ফার চৌধুরীকে ভুলে যাওয়া বাঙালির পক্ষে অসম্ভব।
১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া চৌধুরী বাড়িতে জন্ম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। একেবারে স্কুলজীবনেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। একটি বামপন্থী দলের সঙ্গে জড়িতও হয়েছিলেন। কিন্তু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী না হয়ে হয়ে উঠেছেন রাজনীতি পরিচালনার মন্ত্রগুরু, পরামর্শক এবং সেটা রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক কলাম লিখে।
গাফ্ফার চৌধুরী সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ডানপিটে শওকত। এরপর একে একে লিখেছেন কৃষ্ণপক্ষ, সম্রাটের ছবি, চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, সুন্দর হে সুন্দর, নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ ইত্যাদি।
গাফ্ফার চৌধুরী রাজনৈতিক লেখালেখির প্রতি বেশি মনোযোগী বা আগ্রহী হওয়ায় সাহিত্যের পথে হাঁটা কমিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন না খারাপ করেছেন, সেটা অন্য বিতর্ক। কিন্তু বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার সঙ্গে তিনি নিজেকে যেভাবে জড়িয়েছেন, তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। কলমযোদ্ধা ছিলেন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বন্দুক হাতে না নিয়ে তিনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের সম্মুখযোদ্ধা। তাঁকে বলা হয় কালের সাক্ষী। তিনি শুধু ঘটনার নীরব দর্শক ছিলেন না, ঘটনার মোড় পরিবর্তনের জন্য চালিয়েছেন কলমযুদ্ধ। তিনি যেমন অনেক কিছু কাছ থেকে দেখেছেন, তেমনি সেগুলো লিখেছেনও।
গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন মনেপ্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার মানুষ। তাঁর অবস্থান ছিল সব সময় যুক্তির পক্ষে, কূপমণ্ডূকতা, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। তাঁর লেখা ছিল অত্যন্ত সুখপাঠ্য। তাই পাঠকদের টানত। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাজনৈতিক কলাম যে কয়েকজনের লেখার গুণে জনপ্রিয় হয়েছে, তার মধ্যে গাফ্ফার চৌধুরীর নাম নিঃসন্দেহে শীর্ষে থাকবে। তাঁর মতের সঙ্গে যাঁরা একমত হতে পারতেন না, তাঁরাও তাঁর লেখা পড়তেন। গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা পড়া অনেকের কাছেই ছিল নেশার মতো।
গাফ্ফার চৌধুরী বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, ইউনেসকো পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তবে অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসার চেয়ে বড় প্রাপ্তি ও পুরস্কার আর কী হতে পারে।
তিনি দেশে থাকতে অনেক পত্রিকায় কাজ করেছেন। তবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার স্নেহধন্য হয়ে দৈনিক ইত্তেফাকই ছিল হয়তো তাঁর সেরা কর্মক্ষেত্র। স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জনপদ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, তেমনি দেশের বাইরে গিয়েও গাফ্ফার চৌধুরী সংবাদপত্র থেকে দূরে থাকেননি। লন্ডন থেকেও তিনি পত্রিকা বের করেছেন।
লেখালেখির বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক একটি ডকুড্রামা ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নির্মাণ করেছেন ২০০৭ সালে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে সফল হননি।
অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তিনি লন্ডনে চলে গেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। তারপর গত শতকের আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন বাজারে এসেই ঝড় তোলে। গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বন্ধু শফিক রেহমানের যায়যায়দিনে লেখা শুরু করেন। বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে গাফ্ফার চৌধুরীকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যায়যায়দিন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমিও যায়যায়দিনে রাজনৈতিক প্রতিবেদন লিখতাম। সামরিক স্বৈরশাসকের লাল চোখের জন্য তখন আমাকে ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল–তারিখ ইব্রাহিম। যায়যায়দিনের মাধ্যমে আমাদের সেই যে সম্পর্কের ঝালাই হয়, তাতে আর ছেদ পড়েনি।
গাফ্ফার চৌধুরী আমাকে তাঁর প্রিয়জনদের তালিকায় নিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। আমি যখন যে পত্রিকায় কাজ করেছি, সেই পত্রিকাতেই গাফ্ফার ভাই সানন্দে লিখতে সম্মত হয়েছেন, লিখেছেন। আমার বর্তমান কর্মস্থল ‘আজকের পত্রিকা’তেও লিখতে শুরু করেছিলেন। মৃত্যুর দুই দিন আগেও হাসপাতাল থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। এর মাসখানেক আগে তাঁর এক মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন, ‘আমিও বুঝি আর বেশি দিন বাঁচব না, বিভু।’
আমি হেসে জবাব দিয়েছিলাম, ‘আপনি সেঞ্চুরি করবেন গাফ্ফার ভাই। আপনার কাজ এখনো শেষ হয়নি। ইতিহাস আপনার কাঁধে যেসব দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তার সবগুলো তো আপনি এখনো শেষ করেননি।’
তাঁকে দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কথা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। আমার কথার জবাবে বললেন, ‘বিভু, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগে। আমার সমবয়সী কিংবা আমার থেকে বয়সে ছোট অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে স্মৃতি হাতড়াই আর ভারাক্রান্ত হই।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মনে একধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে বলেও মনে হলো। বললেন, ‘আওয়ামী লীগ পথ হারিয়েছে। হাসিনার উচিত রেহানাকে তাঁর পাশে নিষ্ক্রিয় দাঁড় করিয়ে না রেখে কিছু দায়িত্ব তার কাঁধেও ছেড়ে দেওয়া। আমার বিশ্বাস, আমার মা খারাপ করবে না।’
গাফ্ফার ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যাকেই কন্যার মতো ভালোবাসতেন। তবে বড় বোনের চেয়ে ছোট বোনের প্রতি তাঁর নৈকট্য বেশি বলে আমার ধারণা। শেখ রেহানা লন্ডনে কয়েক বছর থাকায় তাঁর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল বেশি। শেখ রেহানাকে গাফ্ফার ভাই ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন।
আমি গাফ্ফার ভাইকে বলি, ‘আপনি “আজকের পত্রিকা”য় লিখুন আপনার ইচ্ছের কথা।’ তিনি বলেন, ‘শুক্রবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাব। শনিবার
আপনি ফোন করবেন। আমি পরের সপ্তাহ থেকেই আপনাদের পত্রিকায় লিখব। আমি শুনেছি আজকের পত্রিকা ভালো হচ্ছে।’
হায়! এ কী ঘটে গেল। সেই শুক্রবার আসার আগেই, বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ গাফ্ফার ভাই চলে গেলেন। তাঁর আরও কত কথা বলার ছিল। সেসব আর বলা হলো না।
লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে