মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন যে শিক্ষাক্রম আংশিকভাবে এ বছর শুরু করেছে, সেটি শিক্ষাবিজ্ঞানের ধারণায় যুগোপযোগী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনিতেই ১১-১২টি ধারা-উপধারায় বিভক্ত হয়ে মানের দিক থেকে যে পর্যায়ে নেমে গেছে, তাতে জাতির ভবিষ্যৎ নতুন প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষা অনেকটাই নামসর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
দেশে লাখ লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, কয়েক লাখ শিক্ষকও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় কর্মরত আছেন। ৪-৫ কোটি শিক্ষার্থী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে বলে আমরা জানি। কিন্তু তাদের কজনই কৃতী, মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে, সেই পরিসংখ্যান খুব একটা জানা না থাকলেও আশান্বিত হওয়ার মতো যে নয়, তা বলেই দেওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সাড়ে ৪ দশক ধরে অপরিকল্পিতভাবে এবং শিক্ষানীতিবিহীন অবস্থায় দেশে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেগুলোর প্রতিষ্ঠার পেছনে শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল। ফলে কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় অধিকসংখ্যক নানা ধারা-উপধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেয়ে গেছে, আবার কোথাও প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেহারাও দেখা যায় না।
শহরগুলোতেই প্রকৃত মানসম্মত শিক্ষালাভের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতেগোনা, মানসম্মত হলে তাতে ভর্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি, এরপর শ্রেণিপাঠের মান খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে পড়ে, প্রাইভেট-কোচিংয়ে শিক্ষার্থীদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পঠনপাঠনে মান খুঁজে পাওয়া যায় না। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে বাসা বেঁধে আছে। এসব নিরসনে কার্যকর উদ্যোগের দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এগুলোর অবস্থানকেই দুর্বল করে রেখেছে। ফলে শহর-গ্রামনির্বিশেষে সর্বত্র অভিভাবকেরা সন্তানদের কাঙ্ক্ষিত মানের পাঠদানে সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাতে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নিচের শ্রেণি থেকেই বাড়তে শুরু করে।
গড়পড়তা লেখাপড়া নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে ওঠা যায়, পাবলিক পরীক্ষায়ও ভালো ফল দেখানো যায়। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা লাভ কিংবা জীবনবোধ গঠনের শিক্ষা লাভ করতে পারে না। সে কারণে প্রতি ১০-১৫ বছর পরপরই শিক্ষাক্রমে নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে, অনেক স্বপ্নের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল তেমন ভালো না হওয়ায় নতুন নতুন শিক্ষাক্রমের আমদানি করতে দেখা গেছে। এতে অবশ্য বিদেশি ঋণ ও বিশেষজ্ঞদের নানা বাহারি তত্ত্বের কথা শোনা গেছে, কিন্তু ফলাফল আগের চেয়ে খুব ভালো কিছু অর্জিত হয়নি। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যার হিসাব নিলে কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকের ঘাটতি পাওয়া যাবে না। বরং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ছাত্রস্বল্পতায় রয়েছে, পাবলিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও প্রতিবছর উঠে আসছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে মানের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি।
এমন বাস্তবতায় ২০১০ সালে সৃজনশীল শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১২ বছরের অভিজ্ঞতায় সেই শিক্ষাক্রমও আয়ত্ত করতে পারেননি আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকই। শিক্ষার্থীদের শিখনফল অর্জিত না হওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, এই এক যুগের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই প্রকৃত শিক্ষালাভ থেকে পিছিয়ে পড়েছে, শিক্ষাজীবন সফল হয়নি, কর্মজীবনেও তারা তেমন কিছু করতে পারছে না। এটি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে ঘটে আসা এক করুণ অভিজ্ঞতা। তেমন অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় দক্ষতাভিত্তিক যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ সম্প্রতি নিয়েছে, সেটি শিক্ষাবিজ্ঞানের ধারণার দিক থেকে সমর্থনযোগ্য, শেখ হাসিনার সরকার সে জন্য নীতিগত সম্মতিও দিয়েছে। কিন্তু এমন একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের বাস্তবতায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় ছিল। শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য যেমন সময়ের প্রয়োজন ছিল, শিক্ষাক্রমভিত্তিক পাঠসামগ্রী, লিখন ও সম্পাদনায় অভিজ্ঞ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লেখক-সম্পাদকদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং পর্যাপ্ত সময় দিয়ে পাঠসামগ্রীর প্রস্তুতি ও যাচাই-বাছাইয়ের দিকটিও সম্পন্ন করা প্রয়োজন ছিল।
অভিজ্ঞতা থেকেই যা বলতে পারি, এনসিটিবির পেছনে ছড়ি ঘোরানো হয় আর সামনে থাকে স্বল্পতম সময়। এর ফল যা হওয়ার তা-ই হয়। ভুলে ভরা পাঠ্যবইয়ের দৃশ্য আমাদের বারবারই দেখতে হয়। পাঠ্যবইয়ের সমালোচনা পিছু ছাড়ে না। অন্যদিকে যাঁরা এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শ্রেণিপাঠ দেবেন, সেই শিক্ষকদের মানের খবর আমরা কজনই-বা রাখি? সব ধারা-উপধারারই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে নৈরাজ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থবৃদ্ধি।
শিক্ষার মতো এমন একটি জাতি গঠনের ব্যবস্থা আমরা ১৯৭৫-এর পর থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতির মতোই সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। অথচ জাতি গঠনের জন্য নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার যে নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন, সেটিকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। যারা করেছিল, তারা বুঝেশুনেই করেছিল। শিক্ষিত জাতি গঠন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল জাতির নতুন প্রজন্মকে মানহীন, প্রয়োজনহীন বহুধারায় বিভক্ত নামে শিক্ষার কাজে বেকার যুবগোষ্ঠীতে ঠেলে দেওয়া। একটি দেশ তার সূচনাতেই যদি এভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষায় পরবর্তীকালে গড়ে তোলা কোনো সরকারের পক্ষেই আর সম্ভব হয় না। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার পথ চলার ইতিহাসটি এ কারণেই এত বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে।
এমন ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশটির বেশির ভাগ মানুষই অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার ঘানি বহন করে চলেছে। খুব সামান্যসংখ্যক মানুষই তাদের সন্তানদের দেশে রেখে মানসম্মত শিক্ষা দিতে পেরেছেন। বিত্তশালীরা তাই বিদেশেই তাঁদের সন্তানদের পড়াতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এখন দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু সনদ লাভ করা অনেক শিক্ষার্থী জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবের কারণে জাতীয় চাহিদা পূরণে নির্বাচিত হতে পারছে না। তথাকথিত শিক্ষিত বেকারত্বের বাহিনী কেবলই বড় হচ্ছে। এর ফলে জাতির মেধা ও অর্থের অপচয় যেমন ঘটছে, রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা আশানুরূপ গতি পাচ্ছে না, মেধার জগতে আমাদের অবস্থান উল্লেখ করার মতো হয়নি।
নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার সূচনাতেই একের পর এক হোঁচট খাওয়ার দৃশ্য আমাদের দেখতে হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদানে যোগ্য ও সক্ষম শিক্ষকের অভাবের কারণে নতুন শিক্ষাক্রমও কতটা সফলতার আলো দেখবে, তা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। এরই মধ্যে বাজার ছেয়ে গেছে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সহায়ক গাইড বইয়ে, শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিংও শুরু হতে বাকি থাকবে না। এ দুই বাণিজ্যমুখী অনুষঙ্গ নিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গত প্রায় চার দশকজুড়ে চলে আসছে। যতই নতুন শিক্ষাক্রমে বিশেষজ্ঞরা কোচিং আর গাইড বই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে বলে দাবি করুন না কেন, তাঁদের এই দাবি যে মোটেও সঠিক হবে না, তা তো এরই মধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে।
অভিভাবকেরা এখনো বুঝতেই পারছেন না যে নতুন শিক্ষাক্রমে সামষ্টিক মূল্যায়নের নেতিবাচক কোনো প্রভাব তাদের সন্তানদের ওপর পড়বে কি না, ইতিবাচক কিছু হবে কি না। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিপাঠেই দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবে—এমন আস্থা বেশির ভাগ অভিভাবকই পোষণ করতে পারছেন না। না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা এবং অতীতের বয়ে আনা তিক্ত অভিজ্ঞতা। সে কারণে নতুন শিক্ষাক্রমটি নিয়ে এত তাড়াহুড়া করা মোটেও ঠিক হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাকের পর তবেই শুভ সূচনা করা যেতে পারত। মনে হয় এনসিটিবি পেছনের তাড়াকেই প্রাধান্য দিয়েছিল, সম্মুখের পর্বতসমান সমস্যা অতিক্রমের কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কাজগুলোকে গুরুত্ব কম দিয়েছিল। এখন তারা কী করবে?
দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন যে শিক্ষাক্রম আংশিকভাবে এ বছর শুরু করেছে, সেটি শিক্ষাবিজ্ঞানের ধারণায় যুগোপযোগী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনিতেই ১১-১২টি ধারা-উপধারায় বিভক্ত হয়ে মানের দিক থেকে যে পর্যায়ে নেমে গেছে, তাতে জাতির ভবিষ্যৎ নতুন প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষা অনেকটাই নামসর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
দেশে লাখ লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, কয়েক লাখ শিক্ষকও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় কর্মরত আছেন। ৪-৫ কোটি শিক্ষার্থী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে বলে আমরা জানি। কিন্তু তাদের কজনই কৃতী, মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে, সেই পরিসংখ্যান খুব একটা জানা না থাকলেও আশান্বিত হওয়ার মতো যে নয়, তা বলেই দেওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সাড়ে ৪ দশক ধরে অপরিকল্পিতভাবে এবং শিক্ষানীতিবিহীন অবস্থায় দেশে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেগুলোর প্রতিষ্ঠার পেছনে শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল। ফলে কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় অধিকসংখ্যক নানা ধারা-উপধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেয়ে গেছে, আবার কোথাও প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেহারাও দেখা যায় না।
শহরগুলোতেই প্রকৃত মানসম্মত শিক্ষালাভের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতেগোনা, মানসম্মত হলে তাতে ভর্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি, এরপর শ্রেণিপাঠের মান খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে পড়ে, প্রাইভেট-কোচিংয়ে শিক্ষার্থীদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পঠনপাঠনে মান খুঁজে পাওয়া যায় না। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে বাসা বেঁধে আছে। এসব নিরসনে কার্যকর উদ্যোগের দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এগুলোর অবস্থানকেই দুর্বল করে রেখেছে। ফলে শহর-গ্রামনির্বিশেষে সর্বত্র অভিভাবকেরা সন্তানদের কাঙ্ক্ষিত মানের পাঠদানে সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাতে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নিচের শ্রেণি থেকেই বাড়তে শুরু করে।
গড়পড়তা লেখাপড়া নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে ওঠা যায়, পাবলিক পরীক্ষায়ও ভালো ফল দেখানো যায়। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা লাভ কিংবা জীবনবোধ গঠনের শিক্ষা লাভ করতে পারে না। সে কারণে প্রতি ১০-১৫ বছর পরপরই শিক্ষাক্রমে নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে, অনেক স্বপ্নের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল তেমন ভালো না হওয়ায় নতুন নতুন শিক্ষাক্রমের আমদানি করতে দেখা গেছে। এতে অবশ্য বিদেশি ঋণ ও বিশেষজ্ঞদের নানা বাহারি তত্ত্বের কথা শোনা গেছে, কিন্তু ফলাফল আগের চেয়ে খুব ভালো কিছু অর্জিত হয়নি। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যার হিসাব নিলে কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকের ঘাটতি পাওয়া যাবে না। বরং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ছাত্রস্বল্পতায় রয়েছে, পাবলিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও প্রতিবছর উঠে আসছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে মানের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি।
এমন বাস্তবতায় ২০১০ সালে সৃজনশীল শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১২ বছরের অভিজ্ঞতায় সেই শিক্ষাক্রমও আয়ত্ত করতে পারেননি আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকই। শিক্ষার্থীদের শিখনফল অর্জিত না হওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, এই এক যুগের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই প্রকৃত শিক্ষালাভ থেকে পিছিয়ে পড়েছে, শিক্ষাজীবন সফল হয়নি, কর্মজীবনেও তারা তেমন কিছু করতে পারছে না। এটি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে ঘটে আসা এক করুণ অভিজ্ঞতা। তেমন অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় দক্ষতাভিত্তিক যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ সম্প্রতি নিয়েছে, সেটি শিক্ষাবিজ্ঞানের ধারণার দিক থেকে সমর্থনযোগ্য, শেখ হাসিনার সরকার সে জন্য নীতিগত সম্মতিও দিয়েছে। কিন্তু এমন একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের বাস্তবতায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় ছিল। শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য যেমন সময়ের প্রয়োজন ছিল, শিক্ষাক্রমভিত্তিক পাঠসামগ্রী, লিখন ও সম্পাদনায় অভিজ্ঞ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লেখক-সম্পাদকদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং পর্যাপ্ত সময় দিয়ে পাঠসামগ্রীর প্রস্তুতি ও যাচাই-বাছাইয়ের দিকটিও সম্পন্ন করা প্রয়োজন ছিল।
অভিজ্ঞতা থেকেই যা বলতে পারি, এনসিটিবির পেছনে ছড়ি ঘোরানো হয় আর সামনে থাকে স্বল্পতম সময়। এর ফল যা হওয়ার তা-ই হয়। ভুলে ভরা পাঠ্যবইয়ের দৃশ্য আমাদের বারবারই দেখতে হয়। পাঠ্যবইয়ের সমালোচনা পিছু ছাড়ে না। অন্যদিকে যাঁরা এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শ্রেণিপাঠ দেবেন, সেই শিক্ষকদের মানের খবর আমরা কজনই-বা রাখি? সব ধারা-উপধারারই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে নৈরাজ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থবৃদ্ধি।
শিক্ষার মতো এমন একটি জাতি গঠনের ব্যবস্থা আমরা ১৯৭৫-এর পর থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতির মতোই সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। অথচ জাতি গঠনের জন্য নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার যে নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন, সেটিকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। যারা করেছিল, তারা বুঝেশুনেই করেছিল। শিক্ষিত জাতি গঠন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল জাতির নতুন প্রজন্মকে মানহীন, প্রয়োজনহীন বহুধারায় বিভক্ত নামে শিক্ষার কাজে বেকার যুবগোষ্ঠীতে ঠেলে দেওয়া। একটি দেশ তার সূচনাতেই যদি এভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষায় পরবর্তীকালে গড়ে তোলা কোনো সরকারের পক্ষেই আর সম্ভব হয় না। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার পথ চলার ইতিহাসটি এ কারণেই এত বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে।
এমন ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশটির বেশির ভাগ মানুষই অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার ঘানি বহন করে চলেছে। খুব সামান্যসংখ্যক মানুষই তাদের সন্তানদের দেশে রেখে মানসম্মত শিক্ষা দিতে পেরেছেন। বিত্তশালীরা তাই বিদেশেই তাঁদের সন্তানদের পড়াতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এখন দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু সনদ লাভ করা অনেক শিক্ষার্থী জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবের কারণে জাতীয় চাহিদা পূরণে নির্বাচিত হতে পারছে না। তথাকথিত শিক্ষিত বেকারত্বের বাহিনী কেবলই বড় হচ্ছে। এর ফলে জাতির মেধা ও অর্থের অপচয় যেমন ঘটছে, রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা আশানুরূপ গতি পাচ্ছে না, মেধার জগতে আমাদের অবস্থান উল্লেখ করার মতো হয়নি।
নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার সূচনাতেই একের পর এক হোঁচট খাওয়ার দৃশ্য আমাদের দেখতে হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদানে যোগ্য ও সক্ষম শিক্ষকের অভাবের কারণে নতুন শিক্ষাক্রমও কতটা সফলতার আলো দেখবে, তা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। এরই মধ্যে বাজার ছেয়ে গেছে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সহায়ক গাইড বইয়ে, শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিংও শুরু হতে বাকি থাকবে না। এ দুই বাণিজ্যমুখী অনুষঙ্গ নিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গত প্রায় চার দশকজুড়ে চলে আসছে। যতই নতুন শিক্ষাক্রমে বিশেষজ্ঞরা কোচিং আর গাইড বই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে বলে দাবি করুন না কেন, তাঁদের এই দাবি যে মোটেও সঠিক হবে না, তা তো এরই মধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে।
অভিভাবকেরা এখনো বুঝতেই পারছেন না যে নতুন শিক্ষাক্রমে সামষ্টিক মূল্যায়নের নেতিবাচক কোনো প্রভাব তাদের সন্তানদের ওপর পড়বে কি না, ইতিবাচক কিছু হবে কি না। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিপাঠেই দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবে—এমন আস্থা বেশির ভাগ অভিভাবকই পোষণ করতে পারছেন না। না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা এবং অতীতের বয়ে আনা তিক্ত অভিজ্ঞতা। সে কারণে নতুন শিক্ষাক্রমটি নিয়ে এত তাড়াহুড়া করা মোটেও ঠিক হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাকের পর তবেই শুভ সূচনা করা যেতে পারত। মনে হয় এনসিটিবি পেছনের তাড়াকেই প্রাধান্য দিয়েছিল, সম্মুখের পর্বতসমান সমস্যা অতিক্রমের কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কাজগুলোকে গুরুত্ব কম দিয়েছিল। এখন তারা কী করবে?
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে