জাহীদ রেজা নূর
বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঈদসহ ধর্মীয় উৎসবগুলো বরাবরই ঘটা করে পালন করা হতো। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে মীর্জা নাথানের বর্ণনার কাছে যেতে হয়।
তার আগে মীর্জা নাথান রচিত ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ বইটি নিয়ে দু-একটি কথা বলতে হয়। বইটির লেখক বাংলার মোগল সেনাপতি আলাউদ্দীন ইসফাহানকেই মীর্জা নাথান বলে ডাকা হতো। এই বই সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য খুবই দামি একটি উৎস। মোগল সাম্রাজ্যের অন্য সব গতানুগতিক ইতিহাস থেকে ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ ছিল ভিন্নধর্মী। মীর্জা নাথান সমগ্র সাম্রাজ্য নিয়ে লেখেননি, লিখেছেন শুধু বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ঘটনাবলি নিয়ে।
মীর্জা নাথানের বাবা মালিক আলী ছিলেন সুবাদার ইসলাম খানের নৌবহরের প্রধান। ১৬০৮ সালে ইসলাম খাঁর সঙ্গে যখন মালিক আলী ঢাকায় আসেন, মীর্জা নাথানও তখন ঢাকায় এসেছিলেন। তিনিও পিতার সঙ্গে রাজকীয় বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সুবাদার ইসলাম খানের শাসনকালে তিনি মুসা খান, খাজা উসমান ও প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। শাহজাদা শাহজাহান পিতা মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলায় এসেছিলেন। সে সময় মীর্জা নাথান শাহজাহানের দলে যোগ দেন। শাহজাহান বাংলা থেকে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার পর মীর্জা নাথান সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। সম্ভবত অবসরজীবনে তিনি তাঁর বিপুলায়তন ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ নামের মূল্যবান বইটি লিখেছিলেন।
ঈদ নিয়ে মীর্জা নাথান লিখেছেন, ‘ঈদের আনন্দ-উৎসবের সূচনা হতো নতুন চাঁদকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে। দিনের শেষে সন্ধ্যা সমাগমে নতুন চাঁদ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় নাকাড়া বেজে ওঠে এবং গোলন্দাজ সেনাদলের সকল আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ক্রমাগত তোপ দাগানো হয়। রাত্রির শেষ ভাগে কামানের অগ্ন্যুদ্গিরণ শেষ হয় এবং এরপর শোনা যায় ভারী কামানের আওয়াজ। এটা ছিল দস্তুরমতো ভূমিকম্প।’
মীর্জা নাথানের এই বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়, ঈদের আগমনে কেমন খুশির উল্লাস বয়ে যেত মুসলমানদের মনে।
ঈদের সময় স্ত্রী-পুরুষ, বালক-বালিকানির্বিশেষে প্রত্যেকেই নতুন ও ভালো কাপড় পরত। সকালেই ঈদের নামাজের স্থানে শোভাযাত্রা করে যেত। যারা অবস্থাপন্ন, তারা পথে পথে টাকা-পয়সা ও উপহারদ্রব্য ছড়িয়ে দিত। সাধারণ মুসলমান গরিবদের ভিক্ষা দিত। এই বর্ণনা পাওয়া যায় ‘নওবাহার-ই-মুর্শিদকুলী খান’ বইয়ের লেখক আজাদ হোসেন বিলগ্রামীর বর্ণনায়। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যাক, নবাব আলিবর্দী ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিশ মুহম্মদ খান প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণে ঈদুল আজহার দিন নিরানন্দভাবে সময় কাটাতেন। বৃদ্ধ নবাব চেষ্টা করতেন তাঁকে নতুন কাপড়-চোপড় পরাতে। কিন্তু তিনি তাতে ব্যর্থ হয়ে হারেমের বেগম ও নারীদের ঈদের আনন্দ-উৎসব উপযোগী কাপড় নিয়ে তাঁকে উৎফুল্ল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আবার ফিরি মীর্জা নাথানের কাছে। ঈদুল আজহা নিয়ে মীর্জা নাথান লিখেছেন, ‘নামাজান্তে খতিবের খুৎবাহ পাঠ শেষ হলে লোকেরা তাঁকে কাপড়-চোপড় ও টাকা-পয়সা উপহার দেয়। গরিব-দুঃখীদের সাহায্যের জন্য তার সম্মুখে টাকা-পয়সা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুস্থ লোকদের অনেকে এর দ্বারা তাদের অভাব দূর করে এবং সুখী হয়। পরস্পরের প্রতি সম্বোধনে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।’
এরপর লিখেছেন, ‘কোরবানি সম্পন্ন হওয়ার পর বিরাট ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। সুন্দর গায়ক, মোহনী নর্তকী এবং নম্র স্বভাবের গল্পকথকদের মধুর আপ্যায়নের সঙ্গে দিনরাত ভোজানুষ্ঠান চলতে থাকে। শিল্পকারখানার বহু শ্রমিককে উপহারসামগ্রী প্রদানে তুষ্ট করা হয়।’
সে সময় সেনাপতি শুজাত খান ঈদের দিন বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়নের জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। দু-তিন দিন ধরে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনের ব্যবস্থা থাকত তাতে। এ থেকে অনুমান করে নেওয়া কঠিন নয় যে, ঈদের সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিল পোক্ত। খাদ্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব ছিল ঈদের অন্যতম আকর্ষণ।
২.
ঢাকা শহর বাংলার রাজধানী হওয়ার সময়কার ঈদের বর্ণনা তো পাওয়া গেল। পরবর্তীকালের কথা জানা যাবে আবুল মনসুর আহমদ, আনিসুজ্জামান, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর কাছ থেকে। এবং দেখা যাবে, ঈদের আনন্দ আসলে কালের বিবর্তনে ম্লান হয়নি মোটেও। সংগীত যে ঈদের একটা অনুষঙ্গ ছিল, সেটাও পাওয়া যাবে পরবর্তী বর্ণনায়।
আবুল মনসুর আহমদ বলছেন, ‘বছরে দুইবার ঈদের জমাত হইত বটে, কিন্তু তাতে বড়রাই শামিল হইত। কাজেই জমাতে খুব অল্প লোক হইত। ঈদের মাঠে লোক না হইলেও বাড়ি-বাড়ি আমোদ-সামুদ হইত খুব। সাধ্যমতো লোকেরা নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়া বেদম গান-বাজনা করিত। সারা রাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায়ই বাড়ি বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত।’
ঈদুল আজহা সম্পর্কে আনিসুজ্জামান লিখছেন, ‘মুসলমানরা ত্যাগের উৎসরূপে ঈদ-উল আজহা উদ্যাপন করে। এর উৎপত্তি হয়েছে হযরত ইব্রাহিমের সময় থেকে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে হযরত ইব্রাহিম প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানীর আয়োজন করেছেন। মুসলমানরা এই মহৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। তারা প্রভাতে সুন্দর কাপড়চোপড় পরিধান করে এবং তকবীর উচ্চারণ করতে করতে ঈদগাহ ময়দানের দিকে গমন করে। সেখানে নামাজ আদায় করে এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, পরস্পরকে আলিঙ্গন করে ও সম্ভাষণ জানায়। অতঃপর তারা গৃহে প্রত্যাবর্তন করে এবং তাদের সাধ্যানুসারে তারা কোনো পশু, যেমন—গরু, ছাগল, মহিশ বা উট কোরবানী করে। তারা গরীব, দুঃখী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে মাংস বিতরণ করে ও গৃহে ভোজের অনুষ্ঠান করে। প্রত্যেক গৃহ ভোজানুষ্ঠান ও আনন্দ স্ফুর্তিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।’
কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য যাদের ছিল না, তারা কী করত? কেমন ছিল তাদের জীবন? আনিসুজ্জামানের কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর পাব আমরা। তিনি লিখছেন, ‘বকরিদে আমরা প্রতি বছর কোরবানি দিতাম না—মাঝমধ্যে তা বাদ পড়ত—ভক্তির অভাবে অতোটা নয়—যতোটা সামর্থ্যর অভাবে। বড়োরা চেষ্টা করতেন পশু জবাই থেকে আমাদের আড়াল করতে। আমরা ছোটরা ততোধিক উৎসাহে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে জবাই দেখে ফেলতাম। দেখার পর কিন্তু অনেকক্ষণ বিষাদে মন ছেয়ে যেত তবে শেষ পর্যন্ত এই বিষণ্নতা পিছনে ফেলে দেখা দিত কোরবানির গোশত খাওয়ার উৎসাহ।’
পুরোনো দিনের ঈদের আলোচনা করতে গিয়ে একুশের প্রথম কবিতার লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘কোরবানি মানে ত্যাগ। সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা। কিন্তু আজ সন্ত্রাস, খুন, রাহাজানি এবং ইসলামের নামে যে জঙ্গীবাদের উদ্ভব ঘটেছে, তার বিপরীতে যদি আমরা ক্রোধ, প্রতিহিংসা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি দুষ্ট রিপুর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারতাম, সেটাই কি হতো না সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগ, সবচেয়ে বড় কোরবানি? এই পরিস্থিতিতে যদি আমরা ঈদকে আনন্দোৎসবে পরিণত করতে চাই, তাহলে আমাদের শ্রেয়বোধকে জাগ্রত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে অপরাধমূলক আচার-আচরণ এবং নিজের ভেতরের পশুটিকে বধ করে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে হবে।’
৩.
আরেকটি তথ্য এখানে যোগ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু একটি ঈদই হয়েছিল। সেটি ছিল ঈদুল ফিতর। ২০ নভেম্বর হয়েছিল সেই ঈদ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদটিই ছিল ঈদুল আজহা। ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বিধ্বস্ত বাংলার বুকে নেমে এসেছিল ঈদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আগে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঈদের নামাজ আদায় করেছিলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে তাঁর বাড়ির কাছাকাছি অবস্থিত ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে।
বাংলাদেশের প্রথম ঈদের অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই ছিল করুণ। পাকিস্তানি বর্বর ও এদেশীয় আলবদরদের বীভৎস নৃশংসতায় বহু মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। লাখ লাখ শহীদ পরিবারের কাছে এই ঈদ কোনো তাৎপর্য নিয়ে আসেনি। স্বজন হারানোর ধাক্কা সামলানো কঠিন ছিল।
বাংলাদেশের প্রথম ঈদে দেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ঈদের প্রধান জামাতে অংশ নেন। এই জামাতে ইমামতি করেছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, ঈদের দিন সর্বত্রই ঈদের জামাতের পর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. ডক্টর এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রকাশক: বাংলা একাডেমি, জুন, ১৯৮২
২. এ এস এম বোরহান উদ্দীন, স্মৃতিকথায় বাংলার মুসলিম সমাজ, প্রকাশক: বাংলা একাডেমি, ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. বাশার খান, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ, প্রথম আলো, ৩১ মে, ২০১৯
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঈদসহ ধর্মীয় উৎসবগুলো বরাবরই ঘটা করে পালন করা হতো। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে মীর্জা নাথানের বর্ণনার কাছে যেতে হয়।
তার আগে মীর্জা নাথান রচিত ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ বইটি নিয়ে দু-একটি কথা বলতে হয়। বইটির লেখক বাংলার মোগল সেনাপতি আলাউদ্দীন ইসফাহানকেই মীর্জা নাথান বলে ডাকা হতো। এই বই সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য খুবই দামি একটি উৎস। মোগল সাম্রাজ্যের অন্য সব গতানুগতিক ইতিহাস থেকে ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ ছিল ভিন্নধর্মী। মীর্জা নাথান সমগ্র সাম্রাজ্য নিয়ে লেখেননি, লিখেছেন শুধু বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ঘটনাবলি নিয়ে।
মীর্জা নাথানের বাবা মালিক আলী ছিলেন সুবাদার ইসলাম খানের নৌবহরের প্রধান। ১৬০৮ সালে ইসলাম খাঁর সঙ্গে যখন মালিক আলী ঢাকায় আসেন, মীর্জা নাথানও তখন ঢাকায় এসেছিলেন। তিনিও পিতার সঙ্গে রাজকীয় বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সুবাদার ইসলাম খানের শাসনকালে তিনি মুসা খান, খাজা উসমান ও প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। শাহজাদা শাহজাহান পিতা মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলায় এসেছিলেন। সে সময় মীর্জা নাথান শাহজাহানের দলে যোগ দেন। শাহজাহান বাংলা থেকে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার পর মীর্জা নাথান সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। সম্ভবত অবসরজীবনে তিনি তাঁর বিপুলায়তন ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ নামের মূল্যবান বইটি লিখেছিলেন।
ঈদ নিয়ে মীর্জা নাথান লিখেছেন, ‘ঈদের আনন্দ-উৎসবের সূচনা হতো নতুন চাঁদকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে। দিনের শেষে সন্ধ্যা সমাগমে নতুন চাঁদ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় নাকাড়া বেজে ওঠে এবং গোলন্দাজ সেনাদলের সকল আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ক্রমাগত তোপ দাগানো হয়। রাত্রির শেষ ভাগে কামানের অগ্ন্যুদ্গিরণ শেষ হয় এবং এরপর শোনা যায় ভারী কামানের আওয়াজ। এটা ছিল দস্তুরমতো ভূমিকম্প।’
মীর্জা নাথানের এই বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়, ঈদের আগমনে কেমন খুশির উল্লাস বয়ে যেত মুসলমানদের মনে।
ঈদের সময় স্ত্রী-পুরুষ, বালক-বালিকানির্বিশেষে প্রত্যেকেই নতুন ও ভালো কাপড় পরত। সকালেই ঈদের নামাজের স্থানে শোভাযাত্রা করে যেত। যারা অবস্থাপন্ন, তারা পথে পথে টাকা-পয়সা ও উপহারদ্রব্য ছড়িয়ে দিত। সাধারণ মুসলমান গরিবদের ভিক্ষা দিত। এই বর্ণনা পাওয়া যায় ‘নওবাহার-ই-মুর্শিদকুলী খান’ বইয়ের লেখক আজাদ হোসেন বিলগ্রামীর বর্ণনায়। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যাক, নবাব আলিবর্দী ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিশ মুহম্মদ খান প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণে ঈদুল আজহার দিন নিরানন্দভাবে সময় কাটাতেন। বৃদ্ধ নবাব চেষ্টা করতেন তাঁকে নতুন কাপড়-চোপড় পরাতে। কিন্তু তিনি তাতে ব্যর্থ হয়ে হারেমের বেগম ও নারীদের ঈদের আনন্দ-উৎসব উপযোগী কাপড় নিয়ে তাঁকে উৎফুল্ল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আবার ফিরি মীর্জা নাথানের কাছে। ঈদুল আজহা নিয়ে মীর্জা নাথান লিখেছেন, ‘নামাজান্তে খতিবের খুৎবাহ পাঠ শেষ হলে লোকেরা তাঁকে কাপড়-চোপড় ও টাকা-পয়সা উপহার দেয়। গরিব-দুঃখীদের সাহায্যের জন্য তার সম্মুখে টাকা-পয়সা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুস্থ লোকদের অনেকে এর দ্বারা তাদের অভাব দূর করে এবং সুখী হয়। পরস্পরের প্রতি সম্বোধনে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।’
এরপর লিখেছেন, ‘কোরবানি সম্পন্ন হওয়ার পর বিরাট ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। সুন্দর গায়ক, মোহনী নর্তকী এবং নম্র স্বভাবের গল্পকথকদের মধুর আপ্যায়নের সঙ্গে দিনরাত ভোজানুষ্ঠান চলতে থাকে। শিল্পকারখানার বহু শ্রমিককে উপহারসামগ্রী প্রদানে তুষ্ট করা হয়।’
সে সময় সেনাপতি শুজাত খান ঈদের দিন বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়নের জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। দু-তিন দিন ধরে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনের ব্যবস্থা থাকত তাতে। এ থেকে অনুমান করে নেওয়া কঠিন নয় যে, ঈদের সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিল পোক্ত। খাদ্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব ছিল ঈদের অন্যতম আকর্ষণ।
২.
ঢাকা শহর বাংলার রাজধানী হওয়ার সময়কার ঈদের বর্ণনা তো পাওয়া গেল। পরবর্তীকালের কথা জানা যাবে আবুল মনসুর আহমদ, আনিসুজ্জামান, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর কাছ থেকে। এবং দেখা যাবে, ঈদের আনন্দ আসলে কালের বিবর্তনে ম্লান হয়নি মোটেও। সংগীত যে ঈদের একটা অনুষঙ্গ ছিল, সেটাও পাওয়া যাবে পরবর্তী বর্ণনায়।
আবুল মনসুর আহমদ বলছেন, ‘বছরে দুইবার ঈদের জমাত হইত বটে, কিন্তু তাতে বড়রাই শামিল হইত। কাজেই জমাতে খুব অল্প লোক হইত। ঈদের মাঠে লোক না হইলেও বাড়ি-বাড়ি আমোদ-সামুদ হইত খুব। সাধ্যমতো লোকেরা নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়া বেদম গান-বাজনা করিত। সারা রাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায়ই বাড়ি বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত।’
ঈদুল আজহা সম্পর্কে আনিসুজ্জামান লিখছেন, ‘মুসলমানরা ত্যাগের উৎসরূপে ঈদ-উল আজহা উদ্যাপন করে। এর উৎপত্তি হয়েছে হযরত ইব্রাহিমের সময় থেকে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে হযরত ইব্রাহিম প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানীর আয়োজন করেছেন। মুসলমানরা এই মহৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। তারা প্রভাতে সুন্দর কাপড়চোপড় পরিধান করে এবং তকবীর উচ্চারণ করতে করতে ঈদগাহ ময়দানের দিকে গমন করে। সেখানে নামাজ আদায় করে এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, পরস্পরকে আলিঙ্গন করে ও সম্ভাষণ জানায়। অতঃপর তারা গৃহে প্রত্যাবর্তন করে এবং তাদের সাধ্যানুসারে তারা কোনো পশু, যেমন—গরু, ছাগল, মহিশ বা উট কোরবানী করে। তারা গরীব, দুঃখী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে মাংস বিতরণ করে ও গৃহে ভোজের অনুষ্ঠান করে। প্রত্যেক গৃহ ভোজানুষ্ঠান ও আনন্দ স্ফুর্তিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।’
কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য যাদের ছিল না, তারা কী করত? কেমন ছিল তাদের জীবন? আনিসুজ্জামানের কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর পাব আমরা। তিনি লিখছেন, ‘বকরিদে আমরা প্রতি বছর কোরবানি দিতাম না—মাঝমধ্যে তা বাদ পড়ত—ভক্তির অভাবে অতোটা নয়—যতোটা সামর্থ্যর অভাবে। বড়োরা চেষ্টা করতেন পশু জবাই থেকে আমাদের আড়াল করতে। আমরা ছোটরা ততোধিক উৎসাহে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে জবাই দেখে ফেলতাম। দেখার পর কিন্তু অনেকক্ষণ বিষাদে মন ছেয়ে যেত তবে শেষ পর্যন্ত এই বিষণ্নতা পিছনে ফেলে দেখা দিত কোরবানির গোশত খাওয়ার উৎসাহ।’
পুরোনো দিনের ঈদের আলোচনা করতে গিয়ে একুশের প্রথম কবিতার লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘কোরবানি মানে ত্যাগ। সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা। কিন্তু আজ সন্ত্রাস, খুন, রাহাজানি এবং ইসলামের নামে যে জঙ্গীবাদের উদ্ভব ঘটেছে, তার বিপরীতে যদি আমরা ক্রোধ, প্রতিহিংসা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি দুষ্ট রিপুর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারতাম, সেটাই কি হতো না সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগ, সবচেয়ে বড় কোরবানি? এই পরিস্থিতিতে যদি আমরা ঈদকে আনন্দোৎসবে পরিণত করতে চাই, তাহলে আমাদের শ্রেয়বোধকে জাগ্রত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে অপরাধমূলক আচার-আচরণ এবং নিজের ভেতরের পশুটিকে বধ করে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে হবে।’
৩.
আরেকটি তথ্য এখানে যোগ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু একটি ঈদই হয়েছিল। সেটি ছিল ঈদুল ফিতর। ২০ নভেম্বর হয়েছিল সেই ঈদ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদটিই ছিল ঈদুল আজহা। ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বিধ্বস্ত বাংলার বুকে নেমে এসেছিল ঈদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আগে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঈদের নামাজ আদায় করেছিলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে তাঁর বাড়ির কাছাকাছি অবস্থিত ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে।
বাংলাদেশের প্রথম ঈদের অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই ছিল করুণ। পাকিস্তানি বর্বর ও এদেশীয় আলবদরদের বীভৎস নৃশংসতায় বহু মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। লাখ লাখ শহীদ পরিবারের কাছে এই ঈদ কোনো তাৎপর্য নিয়ে আসেনি। স্বজন হারানোর ধাক্কা সামলানো কঠিন ছিল।
বাংলাদেশের প্রথম ঈদে দেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ঈদের প্রধান জামাতে অংশ নেন। এই জামাতে ইমামতি করেছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, ঈদের দিন সর্বত্রই ঈদের জামাতের পর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. ডক্টর এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রকাশক: বাংলা একাডেমি, জুন, ১৯৮২
২. এ এস এম বোরহান উদ্দীন, স্মৃতিকথায় বাংলার মুসলিম সমাজ, প্রকাশক: বাংলা একাডেমি, ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. বাশার খান, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ, প্রথম আলো, ৩১ মে, ২০১৯
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে