জাহীদ রেজা নূর
আজকের পত্রিকা: ১৯৭১ সালেই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। যুদ্ধের মাঠে তারা কৃতিত্বও দেখিয়েছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এ ব্যাপারে আপনি যদি একটু আলোকপাত করেন।
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: যখনকার কথা বলছি, তখনো বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। আমরা চট্টগ্রামের এমপি এম আর সিদ্দিকী এবং জেনারেল ওসমানীকে পেয়ে আলাপ করলাম। বললাম যে আমরা ছোটখাটো এমন প্লেন সংগ্রহ করতে যাচ্ছি, যেগুলো বাংলাদেশের পানিতেও নামতে পারে এবং ছোট ছোট মাঠেও নামতে পারে। এটা ভারতকে কোনো সমস্যার মুখোমুখি করবে না। এম আর সিদ্দিকী আর এম এ জি ওসমানী বললেন, আমরা তোমাদের বিএসএফের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। বিএসএফপ্রধান বললেন, এটা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। কথা বলতে হবে দিল্লির সঙ্গে। একসময় দিল্লি থেকে আমাদের ডাকা হলো। আমি, আলমগীর সাত্তার এবং আরও একজন সেখানে গেলাম। এটা ছিল জুন মাসের ১২ তারিখ। আমরা আগরতলা থেকে রওনা হয়ে ১২ তারিখ রাত ১০টায় দিল্লিতে পৌঁছালাম। পরদিন ভারত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সচিব, প্রতিরক্ষা বিভাগের লোক, এয়ারফোর্সের লোকদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হলো। তাঁরা আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের পরিকল্পনাটা কী?
আমরা বললাম, আমাদের ছোট ছোট প্লেন দরকার, যেগুলো আমরা বাংলাদেশ থেকেই অপারেট করব। কারণ, এই অপারেশনগুলো যেন ভারত সরকারের বিপরীতে কোনো প্রশ্ন না তুলতে পারে। কূটনৈতিকভাবে ভারত যেন অপদস্থ না হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে।তাঁরা আমাদের প্রস্তাব প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। কিন্তু জানালেন, প্রস্তাবটা আসতে হবে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে।
আজকের পত্রিকা: তখন আপনারা কী করলেন?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: তাঁরা আমাদের কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে আমরা দেখা করলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের সঙ্গে। তাঁদের আমরা আমাদের পরিকল্পনার কথা জানালাম। ভারত সরকার আমাদের ছোট ছোট প্লেন দেবে, তাতে ভারত সরকারের কোনো অসুবিধা হবে না এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বাঙালিরাই সেগুলো চালাবে। আমরা বাংলাদেশের ভেতর থেকেই তা চালাব। তাজউদ্দীন আহমদ ও এ কে খন্দকার রাজি হলেন এবং তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টায় আমাদের এয়ার ফোর্স গঠিত হলো পরে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমাদের সবাইকে কলকাতায় থাকতে বলা হলো। এখান থেকে আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেটা আমরা জানতাম না। আমাদের ভারতীয় একটি প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া হলো। সে প্লেনটি বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম না করেই বাংলাদেশের পাশ দিয়ে যেতে লাগল। সিলেট সীমান্তের পাশে একটা এয়ারফিল্ড ছিল, সেখানেই প্লেনটি অবতরণ করল। তখন রাত হয়ে গেছে। পরদিন সকালে আবার টেক অফ করল। ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন তাঁরা ছিলেন আগরতলায়। তাঁদের এরই মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক এয়ার ফিল্ডে। কেন ডিমাপুর? উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী যে গঠিত হয়েছে, সেই সংবাদটা পাকিস্তানিরা যেন না পায়। পরদিন সকাল ১০টার দিকে আমরা ডিমাপুর পৌঁছালাম। সেখানে অন্য পাইলটদের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো।
২৮ সেপ্টেম্বর এ কে খন্দকার কলকাতা থেকে সেখানে এলেন। ভারতের এয়ার চিফও এলেন তাঁর সঙ্গে। তাঁরা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী উদ্বোধন করলেন। এই শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আমাদের বহরে তিনটা প্লেন ছিল। কোনোটাই যুদ্ধ উড়োজাহাজ ছিল না।
আমাদের নয়জনের মধ্যে তিনজন ছিলেন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের। বাকি ছয়জনই বেসামরিক বৈমানিক। ডিসি ১০ বিমানের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুল খালেক, আবদুস সাত্তার আর আব্দুল মুকীত। অটার বিমানের জন্য আকরাম, শরফুদ্দিন এবং শামসুল আলম। হেলিকপ্টারের জন্য সুলতান মাহমুদ, বদরুল আলম ও আমি। আমাকে অবশ্য প্রথমে ডাকোটার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। কিন্তু হেলিকপ্টারে লোকস্বল্পতার জন্য আমাকে সেখানে দেওয়া হয়। এই বিমানগুলোকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতীয়রা বোমারু বিমানে পরিণত করে।
আজকের পত্রিকা: কবে থেকে আপনারা অপারেশনে গেলেন?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলল। ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। তিনি এলেন প্রথম সপ্তাহে। ভারতীয় ইন্সট্রাক্টরদের জিজ্ঞেস করলেন, তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হতে কত দিন লাগবে? ইন্সট্রাক্টররা বললেন, নিদেন পক্ষে ছয় মাস। তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, ১৫ দিনের মধ্যে তাদের সুপ্রশিক্ষিত হিসেবে দেখতে চাই; অর্থাৎ অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে যেন প্রশিক্ষণ শেষ হয়।
নাগাল্যান্ডের প্রশিক্ষণে জায়গাটির চারদিকে পাহাড়-জঙ্গল। পাহাড়ের মাথায় আমরা প্যারাস্যুট সেট করতাম। তারপর আমরা রকেট অপারেশন করতাম—কীভাবে পাকিস্তানি টার্গেটে রকেট অ্যাটাক করব, সেটা শিখে নিচ্ছিলাম।
আমরা অপারেশনে গেলাম ৩ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে। হেলিকপ্টারটি আক্রমণ করে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে তেলের ডিপো। এই অভিযানে অংশ নেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। অটার আক্রমণ করে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির তেলের ডিপো। এই অভিযানে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম আর ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ। দুটো অভিযানই সফল হয়। আমরা যে তেলের ডিপো উড়িয়ে দিলাম, তার ফলে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী এরপর ৪৮ ঘণ্টার বেশি আর ফ্লাই করতে পারেনি।
আজকের পত্রিকা: আপনার অভিযান নিয়ে বলুন।
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: স্বাধীন হলো বাংলাদেশ আকাশসীমা। তখন আমাদের পরের অপারেশন শুরু হলো। কৈলাশহরে বেস করলাম ৫ ডিসেম্বর। ৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে আমি আর সুলতান মাহমুদ হেলিকপ্টার অপারেশন শুরু করলাম। ৬ তারিখ বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে হেলিকপ্টার নিয়ে আমরা রওনা হলাম সিলেটের পথে। এবার আমার সঙ্গে ছিলেন ভারতের একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি এম সিমলার এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। তিনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন দেখার জন্য। সিলেটে যেখানে ফোকারগুলো রাখা হতো, আমরা ঠিক করলাম সেখানে ল্যান্ড করব। তখন বাঙ্কার থেকে আমাদের ওপর ফায়ারিং শুরু হয়েছিল। রাডারে যেন ধরে না পড়ে এ জন্য ২০০-২৫০ ফিটের ওপর দিয়ে আমরা উড়তাম না। সেটা ছিল পাহাড়ি অঞ্চল, ভয়ানক বিপজ্জনক জায়গা। প্রতিটি মুহূর্তে ছিল মৃত্যুর ঝুঁকি। ওদের গুলির প্রত্যুত্তরে আমরা রকেট অ্যাটাক করলাম, তাদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করে ফিরে এলাম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল কৃষ্ণরাওকে সে কথা জানালাম।
এরপর আমাদের বেস পরিবর্তিত হয়ে আগরতলায় চলে গেল। তখন এদিকে আমাদের আর প্রয়োজন ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকার পূর্বাঞ্চল আক্রমণ করলাম। ৯ ডিসেম্বর মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চল আমাদের কন্ট্রোলে চলে আসে। ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পনা হলো তারা হেলিকপ্টারে করে সৈন্যদের নামাবে নরসিংদীর দক্ষিণে রায়পুরা বলে একটা জায়গায়।
আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমরা ওদের পাকিস্তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করব। ১১ ডিসেম্বর শুনলাম, হেলিকপ্টার প্রতিহত করার জন্য নরসিংদী থেকে পাকিস্তানিদের একটি বিরাট কনভয় এদিকে আসছে। আমি আর বদরুল আলম কনভয়টিকে অ্যাটাক করি। ১৪টি রকেট দিয়ে। এরপর আর পাকিস্তানের প্রতিরোধ রইল না।
আজকের পত্রিকা: ১৬ ডিসেম্বরের সেই অসাধারণ সময়টিতে আপনি কোথায় ছিলেন?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: আমরা ঢাকায় এসে পৌঁছানোর ঠিক দুই মিনিট আগে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। আমরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছিলাম। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ করেছে বলে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি। একটু পর সেখানে জেনারেল অরোরা এলেন জেনারেল নিয়াজিকে নিয়ে। সেটা আমরা দেখলাম। তারপর চলে গেলাম কলকাতায়। ফিরলাম পরদিন।
আজকের পত্রিকা: সেই প্লেন তিনটি কোথায়?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: স্বাধীনতার পরে ফ্লাই করতে গিয়ে প্লেন দুটোই ক্রাশ করেছিল। পরে একই রকম দুটো প্লেন ভারত আমাদের উপহার দিয়েছে। বিমানবাহিনীর জাদুঘরে তা রাখা আছে।
আজকের পত্রিকা: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: বঙ্গবন্ধু ফিরলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আমার আর সুলতান মাহমুদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ধ্বংসযজ্ঞ দেখানোর। পাকিস্তানিরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, আমরা তা দেখানোর জন্য হেলিকপ্টারে করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। যেখানে যেখানে আক্রমণ হয়েছে, যেখানে যেখানে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে বসে চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। আমরা যে হেলিকপ্টারে যুদ্ধ করেছি, সেটা নিয়েই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ দেখতে বের হতাম। ছোট্ট শেখ রাসেল থাকত আমাদের সঙ্গে।
আজকের পত্রিকা: সে সময়টির কথা মনে হলে কেমন লাগে?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: আমার মনে হয়, আমরা আমাদের কাজটা করার চেষ্টা করেছি। যতটুকুই পারি নিজের দেশের জন্য কিছু করার জন্য মরিয়া ছিলাম। যারা স্বাধীন একটা দেশ পেয়েছে, তারা ঠিক করুক, তারা দেশের জন্য কী করবে।
আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ।
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: ১৯৭১ সালেই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। যুদ্ধের মাঠে তারা কৃতিত্বও দেখিয়েছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এ ব্যাপারে আপনি যদি একটু আলোকপাত করেন।
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: যখনকার কথা বলছি, তখনো বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। আমরা চট্টগ্রামের এমপি এম আর সিদ্দিকী এবং জেনারেল ওসমানীকে পেয়ে আলাপ করলাম। বললাম যে আমরা ছোটখাটো এমন প্লেন সংগ্রহ করতে যাচ্ছি, যেগুলো বাংলাদেশের পানিতেও নামতে পারে এবং ছোট ছোট মাঠেও নামতে পারে। এটা ভারতকে কোনো সমস্যার মুখোমুখি করবে না। এম আর সিদ্দিকী আর এম এ জি ওসমানী বললেন, আমরা তোমাদের বিএসএফের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। বিএসএফপ্রধান বললেন, এটা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। কথা বলতে হবে দিল্লির সঙ্গে। একসময় দিল্লি থেকে আমাদের ডাকা হলো। আমি, আলমগীর সাত্তার এবং আরও একজন সেখানে গেলাম। এটা ছিল জুন মাসের ১২ তারিখ। আমরা আগরতলা থেকে রওনা হয়ে ১২ তারিখ রাত ১০টায় দিল্লিতে পৌঁছালাম। পরদিন ভারত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সচিব, প্রতিরক্ষা বিভাগের লোক, এয়ারফোর্সের লোকদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হলো। তাঁরা আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের পরিকল্পনাটা কী?
আমরা বললাম, আমাদের ছোট ছোট প্লেন দরকার, যেগুলো আমরা বাংলাদেশ থেকেই অপারেট করব। কারণ, এই অপারেশনগুলো যেন ভারত সরকারের বিপরীতে কোনো প্রশ্ন না তুলতে পারে। কূটনৈতিকভাবে ভারত যেন অপদস্থ না হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে।তাঁরা আমাদের প্রস্তাব প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। কিন্তু জানালেন, প্রস্তাবটা আসতে হবে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে।
আজকের পত্রিকা: তখন আপনারা কী করলেন?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: তাঁরা আমাদের কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে আমরা দেখা করলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের সঙ্গে। তাঁদের আমরা আমাদের পরিকল্পনার কথা জানালাম। ভারত সরকার আমাদের ছোট ছোট প্লেন দেবে, তাতে ভারত সরকারের কোনো অসুবিধা হবে না এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বাঙালিরাই সেগুলো চালাবে। আমরা বাংলাদেশের ভেতর থেকেই তা চালাব। তাজউদ্দীন আহমদ ও এ কে খন্দকার রাজি হলেন এবং তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টায় আমাদের এয়ার ফোর্স গঠিত হলো পরে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমাদের সবাইকে কলকাতায় থাকতে বলা হলো। এখান থেকে আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেটা আমরা জানতাম না। আমাদের ভারতীয় একটি প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া হলো। সে প্লেনটি বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম না করেই বাংলাদেশের পাশ দিয়ে যেতে লাগল। সিলেট সীমান্তের পাশে একটা এয়ারফিল্ড ছিল, সেখানেই প্লেনটি অবতরণ করল। তখন রাত হয়ে গেছে। পরদিন সকালে আবার টেক অফ করল। ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন তাঁরা ছিলেন আগরতলায়। তাঁদের এরই মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক এয়ার ফিল্ডে। কেন ডিমাপুর? উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী যে গঠিত হয়েছে, সেই সংবাদটা পাকিস্তানিরা যেন না পায়। পরদিন সকাল ১০টার দিকে আমরা ডিমাপুর পৌঁছালাম। সেখানে অন্য পাইলটদের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো।
২৮ সেপ্টেম্বর এ কে খন্দকার কলকাতা থেকে সেখানে এলেন। ভারতের এয়ার চিফও এলেন তাঁর সঙ্গে। তাঁরা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী উদ্বোধন করলেন। এই শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আমাদের বহরে তিনটা প্লেন ছিল। কোনোটাই যুদ্ধ উড়োজাহাজ ছিল না।
আমাদের নয়জনের মধ্যে তিনজন ছিলেন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের। বাকি ছয়জনই বেসামরিক বৈমানিক। ডিসি ১০ বিমানের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুল খালেক, আবদুস সাত্তার আর আব্দুল মুকীত। অটার বিমানের জন্য আকরাম, শরফুদ্দিন এবং শামসুল আলম। হেলিকপ্টারের জন্য সুলতান মাহমুদ, বদরুল আলম ও আমি। আমাকে অবশ্য প্রথমে ডাকোটার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। কিন্তু হেলিকপ্টারে লোকস্বল্পতার জন্য আমাকে সেখানে দেওয়া হয়। এই বিমানগুলোকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতীয়রা বোমারু বিমানে পরিণত করে।
আজকের পত্রিকা: কবে থেকে আপনারা অপারেশনে গেলেন?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলল। ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। তিনি এলেন প্রথম সপ্তাহে। ভারতীয় ইন্সট্রাক্টরদের জিজ্ঞেস করলেন, তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হতে কত দিন লাগবে? ইন্সট্রাক্টররা বললেন, নিদেন পক্ষে ছয় মাস। তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, ১৫ দিনের মধ্যে তাদের সুপ্রশিক্ষিত হিসেবে দেখতে চাই; অর্থাৎ অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে যেন প্রশিক্ষণ শেষ হয়।
নাগাল্যান্ডের প্রশিক্ষণে জায়গাটির চারদিকে পাহাড়-জঙ্গল। পাহাড়ের মাথায় আমরা প্যারাস্যুট সেট করতাম। তারপর আমরা রকেট অপারেশন করতাম—কীভাবে পাকিস্তানি টার্গেটে রকেট অ্যাটাক করব, সেটা শিখে নিচ্ছিলাম।
আমরা অপারেশনে গেলাম ৩ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে। হেলিকপ্টারটি আক্রমণ করে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে তেলের ডিপো। এই অভিযানে অংশ নেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। অটার আক্রমণ করে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির তেলের ডিপো। এই অভিযানে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম আর ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ। দুটো অভিযানই সফল হয়। আমরা যে তেলের ডিপো উড়িয়ে দিলাম, তার ফলে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী এরপর ৪৮ ঘণ্টার বেশি আর ফ্লাই করতে পারেনি।
আজকের পত্রিকা: আপনার অভিযান নিয়ে বলুন।
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: স্বাধীন হলো বাংলাদেশ আকাশসীমা। তখন আমাদের পরের অপারেশন শুরু হলো। কৈলাশহরে বেস করলাম ৫ ডিসেম্বর। ৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে আমি আর সুলতান মাহমুদ হেলিকপ্টার অপারেশন শুরু করলাম। ৬ তারিখ বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে হেলিকপ্টার নিয়ে আমরা রওনা হলাম সিলেটের পথে। এবার আমার সঙ্গে ছিলেন ভারতের একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি এম সিমলার এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। তিনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন দেখার জন্য। সিলেটে যেখানে ফোকারগুলো রাখা হতো, আমরা ঠিক করলাম সেখানে ল্যান্ড করব। তখন বাঙ্কার থেকে আমাদের ওপর ফায়ারিং শুরু হয়েছিল। রাডারে যেন ধরে না পড়ে এ জন্য ২০০-২৫০ ফিটের ওপর দিয়ে আমরা উড়তাম না। সেটা ছিল পাহাড়ি অঞ্চল, ভয়ানক বিপজ্জনক জায়গা। প্রতিটি মুহূর্তে ছিল মৃত্যুর ঝুঁকি। ওদের গুলির প্রত্যুত্তরে আমরা রকেট অ্যাটাক করলাম, তাদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করে ফিরে এলাম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল কৃষ্ণরাওকে সে কথা জানালাম।
এরপর আমাদের বেস পরিবর্তিত হয়ে আগরতলায় চলে গেল। তখন এদিকে আমাদের আর প্রয়োজন ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকার পূর্বাঞ্চল আক্রমণ করলাম। ৯ ডিসেম্বর মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চল আমাদের কন্ট্রোলে চলে আসে। ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পনা হলো তারা হেলিকপ্টারে করে সৈন্যদের নামাবে নরসিংদীর দক্ষিণে রায়পুরা বলে একটা জায়গায়।
আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমরা ওদের পাকিস্তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করব। ১১ ডিসেম্বর শুনলাম, হেলিকপ্টার প্রতিহত করার জন্য নরসিংদী থেকে পাকিস্তানিদের একটি বিরাট কনভয় এদিকে আসছে। আমি আর বদরুল আলম কনভয়টিকে অ্যাটাক করি। ১৪টি রকেট দিয়ে। এরপর আর পাকিস্তানের প্রতিরোধ রইল না।
আজকের পত্রিকা: ১৬ ডিসেম্বরের সেই অসাধারণ সময়টিতে আপনি কোথায় ছিলেন?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: আমরা ঢাকায় এসে পৌঁছানোর ঠিক দুই মিনিট আগে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। আমরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছিলাম। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ করেছে বলে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি। একটু পর সেখানে জেনারেল অরোরা এলেন জেনারেল নিয়াজিকে নিয়ে। সেটা আমরা দেখলাম। তারপর চলে গেলাম কলকাতায়। ফিরলাম পরদিন।
আজকের পত্রিকা: সেই প্লেন তিনটি কোথায়?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: স্বাধীনতার পরে ফ্লাই করতে গিয়ে প্লেন দুটোই ক্রাশ করেছিল। পরে একই রকম দুটো প্লেন ভারত আমাদের উপহার দিয়েছে। বিমানবাহিনীর জাদুঘরে তা রাখা আছে।
আজকের পত্রিকা: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: বঙ্গবন্ধু ফিরলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আমার আর সুলতান মাহমুদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ধ্বংসযজ্ঞ দেখানোর। পাকিস্তানিরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, আমরা তা দেখানোর জন্য হেলিকপ্টারে করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। যেখানে যেখানে আক্রমণ হয়েছে, যেখানে যেখানে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে বসে চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। আমরা যে হেলিকপ্টারে যুদ্ধ করেছি, সেটা নিয়েই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ দেখতে বের হতাম। ছোট্ট শেখ রাসেল থাকত আমাদের সঙ্গে।
আজকের পত্রিকা: সে সময়টির কথা মনে হলে কেমন লাগে?
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: আমার মনে হয়, আমরা আমাদের কাজটা করার চেষ্টা করেছি। যতটুকুই পারি নিজের দেশের জন্য কিছু করার জন্য মরিয়া ছিলাম। যারা স্বাধীন একটা দেশ পেয়েছে, তারা ঠিক করুক, তারা দেশের জন্য কী করবে।
আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ।
ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দীন আহমেদ: আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে