মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
আজ ১৭ মার্চ। আজ থেকে ১০২ বছর আগে টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক লেখা, অনেক স্মৃতিচারণা দীর্ঘ সময় ধরেই প্রকাশিত হয়েছে। সে সবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে বিষয়গুলো অনুচ্চারিত থেকে গেছে, তার একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে একটি লেখা তৈরির ইচ্ছে ছিল আমার অনেক দিনের।
একটা মানুষ কত মনে রাখতে পারে? কত মানুষের ঠিকানা, কত মানুষের নাম, কত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের জটিলতা—এসব মনে রাখা কতটা সম্ভব? একটা পর্যায়ে সফোক্লিসের ইডিপাস বলে উঠেছিল, ‘মানুষ কত মনে রাখবে!’ সেটি ছিল তার ব্যক্তিগত সংকটের একটি মুহূর্তের কথা। কিন্তু এমন কী সম্ভব একজন মানুষ শত শত মানুষের নাম, বাবার নাম, গ্রামের নাম অথবা বাড়ির একজন জটিল রোগীর কথা মনে রাখতে পারে? এ অসম্ভব কাজটি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। অবলীলায় তিনি প্রশ্ন করতেন, ‘কী রে, তোর বাবার পেটের ব্যথাটা কমল? ওই যে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, তারপর কেমন আছে?’ অবাক বিস্ময়ে লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। উত্তর দেয়, ‘বাবা ভালো ছিল। এই তিন মাস আগে ইন্তেকাল করছে।’ বঙ্গবন্ধু চোখের চশমাটা খুলে একটা হাহাকার দিয়ে আবার চোখে চশমা লাগিয়ে নেন।
কত মানুষের কত সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। সেগুলো কোনো খাতায় লিখে রাখেননি। শুধু স্মৃতি থেকে অবলীলায় বলে ফেলতেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল গ্রাম থেকে। সেখান থেকে কলকাতা। কলকাতায় এসেই মূলত তাঁর রাজনীতিচর্চার সূচনা। যখন তিনি রাজনীতি শুরু করেন, তখন রাজনীতিতে অধিকার কেবল উচ্চবিত্তদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিত্তবানদের সন্তানেরা লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে রাজনীতিতে ভিড়তেন, সেখানে মধ্যবিত্তদের এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের একেবারেই প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই জায়গাটা করে নিয়েছিলেন গণচরিত্র দিয়ে। সেখানেও স্মৃতি। সারা বাংলা এবং আসাম থেকে প্রচুর ছাত্র কলকাতায় এসে ভিড় জমাতেন। কারণ ভাগ্যান্বেষণ এবং উচ্চশিক্ষা। তাঁদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, কখনো কখনো অনাহারক্লিষ্ট কোনো ছেলের আহারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওই নামটিও তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। তিনি যখন গ্রামে ফিরতেন জাহাজের খালাসি থেকে শুরু করে নৌকার মাঝি সবার নামই তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। যতবার তিনি জেলে গিয়েছেন জেলের কয়েদি, জমাদার, জেলার এমনকি জেল হাসপাতালের ডাক্তার—তাঁদের নামও তাঁর মুখস্থ। মানুষ সাধারণত প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে নাম মুখস্থ করে স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত করতে চায় না। কিন্তু তখনকার মুজিব ভাই এটা বুঝেছিলেন, মানুষের পরিচয় মনে রাখার একটা বড় প্রয়োজন আছে। তিনি যেমন প্রথম থেকেই স্বপ্ন দেখেছেন রাজনীতি করবেন বিত্তহীন মানুষদের নিয়ে, তাই তাদের নাম-পরিচয় তাঁর জীবনখাতার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা দেখেছি জমিদার, সামন্তরা প্রজাদের নাম মনে রাখতে পারে না বা তাদের ইচ্ছেও হয় না। তাই জমিদার কাউকে দেখলে বলে ওঠে, ‘এই, তুই যেন কার ছেলে রে?’ মানুষের অস্তিত্বের তাদের কাছে মূল্য নেই। মুজিব ভাই ওই সময় বুঝেছিলেন মানুষের পরিচয় জানার অর্থই হচ্ছে তাকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেওয়া। তিনি যখন ট্রেনে ভ্রমণ করতেন, অসংখ্য মানুষ তাঁকে তখন দেখতে আসত। তার মধ্যে অনেকেই ছিল, যারা তাঁর পূর্বপরিচিত। দু-একজনের বাড়িতে হয়তো তিনি কখনো এক বেলা খেয়েছেনও। ওই ভিড়ের মধ্যেই তিনি চিহ্নিত করতেন এবং ডাকতেন, ‘ওরে আয়। লাউয়ের তরকারি কি আজকেও নিয়ে এসেছিস?’ সহাস্যে এবং লজ্জার সঙ্গে পরিচিত লোকটি বলে উঠত, ‘ট্রেন ফেরার সময় নিয়ে আসি?’ মুজিব ভাই বলতেন, ‘ফেরার পথে তো এ রাস্তা দিয়ে যাব না রে। তর মায় কী রান্নাবান্না করতে পারে?’ উত্তরে সেই লোকটি বলত, ‘আর কারও জন্য না পারুক, আপনার জন্য পারবে।’
তিনি যখন রাজনৈতিক সফরে যেতেন কখনো কখনো রান্নাবান্নার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকত। কিন্তু অধিকাংশ সময় সে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে খাওয়া হতো না। দেখা গেল দুপুরের ট্রেন রাত ১১টায় পৌঁছাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যখন সাতই মার্চের ভাষণ দিচ্ছিলেন, প্রবল জনস্রোতের মধ্য দিয়ে মঞ্চে উঠছিলেন, তখন ভয় পাচ্ছিলাম এত লোকের মধ্যে তিনি উঠবেন অথবা ১০ জানুয়ারিতে যখন দেশে ফিরে এলেন লাখ লাখ মানুষের মধ্যে তিনি আবারও ওপরের বেদিতে উঠছিলেন, আমরা আবারও ভয় পাচ্ছিলাম। তিনি সামাল দিতে পারবেন তো? কিন্তু জনতাই শৃঙ্খলা এনে দিল। প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে তারা মুহূর্তেই তাদের আপন করে নিল।
সামন্তবাদী নেতারা প্রায়ই জনবিচ্ছিন্ন থাকে, তারা ভয় পায়। জনতাকে ভয় পাওয়াটা তাদের চরিত্রের একটা অংশ। তাই তারা কোনো কিছু মনে রাখতে চায় না। না মানুষ, না জায়গাটা, না কোনো ঠিকানা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ বাংলা তো দূরে থাকুক সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান—এসব জায়গারও কোনো মানুষকে চিনেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর কাছে কোনো সংবাদও পৌঁছাত না। এত বড় একটা দাঙ্গা হয়ে গেল বাংলায় ও পাঞ্জাবে অথচ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে অবলীলায় বলে ফেললেন, ‘গত সাত দিন কী হয়েছে, আমি কিছুই জানি না।’ এই সাত দিন তাহলে কোথায় ছিলেন তিনি? একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গেও কি তাঁর যোগযোগ ছিল না যে তাঁকে এ ভয়ংকর সংবাদটি জানিয়ে দিতে পারে?
ষাটের দশকে আমাদের দেশে পুলিশ, সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুসহ অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন জেল খাটেন। জেলখানায় বসে তিনি সব সংবাদ জানতেন এবং তাঁর যাঁরা কর্মী তাঁদের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিতেন। যাঁর টাকা প্রয়োজন, তাঁকে টাকা পাঠানো; যাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন, তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা—এসব দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন। জেলখানার ভেতরেও এক বেলার পরিচয়েই সারা জীবনের জন্য পরিচয় হয়ে যেত। যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নানা ব্যস্ততার মধ্যেও পাশের কয়েদিকে তিনি ভুলতেন না। একটা বিষয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর কাজ মানুষকেন্দ্রিক। মানুষকে নিয়েই আন্দোলন, মানুষকে নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। একদিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আছেন তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই, আবার অন্যদিকে ঘরে ঘরে কর্মী বাহিনীকে দিয়ে দুর্গ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
এই সময়ে বিশাল বিশাল সমাবেশ হয়েছে। কখনো শ্রমিক, কখনো কৃষক, কখনো পেশাজীবী—এসব সমাবেশেও তিনি গণচরিত্রটাকে রক্ষা করতেন। সেই সময়ে বর্ষীয়ষী নেতাদের তিনি পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করতেন। যেমন মওলানা ভাসানী। যাঁর সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোনো দিন কোনো বয়স্ক নেতার সঙ্গে ঔদ্ধত্য আচরণ করেননি। সবটা মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো, গোটা দেশটাকে তিনি একটি অভিন্ন পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাসম্পন্ন মানুষ যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, সেই সব ত্যাগী নেতাকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতেন এবং পরিবারের অংশ হিসেবেও ভাবতেন। এমন করেই তিনি সারা দেশে একটা অদৃশ্য সংযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলাফলে অনেক মানুষকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন।
যা তিনি ভাবতে পারেননি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষাও অবর্ণনীয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতায়ও আরেক নতুন লড়াই। সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়; বরং তার মধ্যে একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এর মধ্যে আছে বিশ্বাসঘাতক ১৬ ডিসেম্বরের একদল বাহিনী। দেশে প্রচুর অস্ত্রের ছড়াছড়ি। দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। আমেরিকা বাংলাদেশের বিজয় মেনে নিতে পারেনি। তার সঙ্গে পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরবও রয়েছে। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে আগের মতোই ভাবতেন। আমি নিজ চোখে দেখেছি, একদিন দুপুরবেলায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোনো দেহরক্ষী ছাড়া একাই অফিসে যাচ্ছেন। বাঙালির প্রতি ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। কোনো দুর্বৃত্তের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হতে পারে, এটা ছিল তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য। এত মানুষের স্মৃতি যাঁর কাছে, সেই মানুষকে অকস্মাৎ রাতের অন্ধকারে বিশ্বাসঘাতকের অস্ত্রে রক্তাক্ত হতে হলো। তাঁর কাছ থেকে তাঁর যাপিত জীবনের স্মৃতিটুকুও মানুষ জানতে পারল না। এটা ছিল তাঁর ভাবনার অতীত, যা তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি।
আজ ১৭ মার্চ। আজ থেকে ১০২ বছর আগে টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক লেখা, অনেক স্মৃতিচারণা দীর্ঘ সময় ধরেই প্রকাশিত হয়েছে। সে সবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে বিষয়গুলো অনুচ্চারিত থেকে গেছে, তার একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে একটি লেখা তৈরির ইচ্ছে ছিল আমার অনেক দিনের।
একটা মানুষ কত মনে রাখতে পারে? কত মানুষের ঠিকানা, কত মানুষের নাম, কত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের জটিলতা—এসব মনে রাখা কতটা সম্ভব? একটা পর্যায়ে সফোক্লিসের ইডিপাস বলে উঠেছিল, ‘মানুষ কত মনে রাখবে!’ সেটি ছিল তার ব্যক্তিগত সংকটের একটি মুহূর্তের কথা। কিন্তু এমন কী সম্ভব একজন মানুষ শত শত মানুষের নাম, বাবার নাম, গ্রামের নাম অথবা বাড়ির একজন জটিল রোগীর কথা মনে রাখতে পারে? এ অসম্ভব কাজটি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। অবলীলায় তিনি প্রশ্ন করতেন, ‘কী রে, তোর বাবার পেটের ব্যথাটা কমল? ওই যে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, তারপর কেমন আছে?’ অবাক বিস্ময়ে লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। উত্তর দেয়, ‘বাবা ভালো ছিল। এই তিন মাস আগে ইন্তেকাল করছে।’ বঙ্গবন্ধু চোখের চশমাটা খুলে একটা হাহাকার দিয়ে আবার চোখে চশমা লাগিয়ে নেন।
কত মানুষের কত সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। সেগুলো কোনো খাতায় লিখে রাখেননি। শুধু স্মৃতি থেকে অবলীলায় বলে ফেলতেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল গ্রাম থেকে। সেখান থেকে কলকাতা। কলকাতায় এসেই মূলত তাঁর রাজনীতিচর্চার সূচনা। যখন তিনি রাজনীতি শুরু করেন, তখন রাজনীতিতে অধিকার কেবল উচ্চবিত্তদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিত্তবানদের সন্তানেরা লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে রাজনীতিতে ভিড়তেন, সেখানে মধ্যবিত্তদের এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের একেবারেই প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই জায়গাটা করে নিয়েছিলেন গণচরিত্র দিয়ে। সেখানেও স্মৃতি। সারা বাংলা এবং আসাম থেকে প্রচুর ছাত্র কলকাতায় এসে ভিড় জমাতেন। কারণ ভাগ্যান্বেষণ এবং উচ্চশিক্ষা। তাঁদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, কখনো কখনো অনাহারক্লিষ্ট কোনো ছেলের আহারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওই নামটিও তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। তিনি যখন গ্রামে ফিরতেন জাহাজের খালাসি থেকে শুরু করে নৌকার মাঝি সবার নামই তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। যতবার তিনি জেলে গিয়েছেন জেলের কয়েদি, জমাদার, জেলার এমনকি জেল হাসপাতালের ডাক্তার—তাঁদের নামও তাঁর মুখস্থ। মানুষ সাধারণত প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে নাম মুখস্থ করে স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত করতে চায় না। কিন্তু তখনকার মুজিব ভাই এটা বুঝেছিলেন, মানুষের পরিচয় মনে রাখার একটা বড় প্রয়োজন আছে। তিনি যেমন প্রথম থেকেই স্বপ্ন দেখেছেন রাজনীতি করবেন বিত্তহীন মানুষদের নিয়ে, তাই তাদের নাম-পরিচয় তাঁর জীবনখাতার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা দেখেছি জমিদার, সামন্তরা প্রজাদের নাম মনে রাখতে পারে না বা তাদের ইচ্ছেও হয় না। তাই জমিদার কাউকে দেখলে বলে ওঠে, ‘এই, তুই যেন কার ছেলে রে?’ মানুষের অস্তিত্বের তাদের কাছে মূল্য নেই। মুজিব ভাই ওই সময় বুঝেছিলেন মানুষের পরিচয় জানার অর্থই হচ্ছে তাকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেওয়া। তিনি যখন ট্রেনে ভ্রমণ করতেন, অসংখ্য মানুষ তাঁকে তখন দেখতে আসত। তার মধ্যে অনেকেই ছিল, যারা তাঁর পূর্বপরিচিত। দু-একজনের বাড়িতে হয়তো তিনি কখনো এক বেলা খেয়েছেনও। ওই ভিড়ের মধ্যেই তিনি চিহ্নিত করতেন এবং ডাকতেন, ‘ওরে আয়। লাউয়ের তরকারি কি আজকেও নিয়ে এসেছিস?’ সহাস্যে এবং লজ্জার সঙ্গে পরিচিত লোকটি বলে উঠত, ‘ট্রেন ফেরার সময় নিয়ে আসি?’ মুজিব ভাই বলতেন, ‘ফেরার পথে তো এ রাস্তা দিয়ে যাব না রে। তর মায় কী রান্নাবান্না করতে পারে?’ উত্তরে সেই লোকটি বলত, ‘আর কারও জন্য না পারুক, আপনার জন্য পারবে।’
তিনি যখন রাজনৈতিক সফরে যেতেন কখনো কখনো রান্নাবান্নার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকত। কিন্তু অধিকাংশ সময় সে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে খাওয়া হতো না। দেখা গেল দুপুরের ট্রেন রাত ১১টায় পৌঁছাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যখন সাতই মার্চের ভাষণ দিচ্ছিলেন, প্রবল জনস্রোতের মধ্য দিয়ে মঞ্চে উঠছিলেন, তখন ভয় পাচ্ছিলাম এত লোকের মধ্যে তিনি উঠবেন অথবা ১০ জানুয়ারিতে যখন দেশে ফিরে এলেন লাখ লাখ মানুষের মধ্যে তিনি আবারও ওপরের বেদিতে উঠছিলেন, আমরা আবারও ভয় পাচ্ছিলাম। তিনি সামাল দিতে পারবেন তো? কিন্তু জনতাই শৃঙ্খলা এনে দিল। প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে তারা মুহূর্তেই তাদের আপন করে নিল।
সামন্তবাদী নেতারা প্রায়ই জনবিচ্ছিন্ন থাকে, তারা ভয় পায়। জনতাকে ভয় পাওয়াটা তাদের চরিত্রের একটা অংশ। তাই তারা কোনো কিছু মনে রাখতে চায় না। না মানুষ, না জায়গাটা, না কোনো ঠিকানা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ বাংলা তো দূরে থাকুক সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান—এসব জায়গারও কোনো মানুষকে চিনেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর কাছে কোনো সংবাদও পৌঁছাত না। এত বড় একটা দাঙ্গা হয়ে গেল বাংলায় ও পাঞ্জাবে অথচ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে অবলীলায় বলে ফেললেন, ‘গত সাত দিন কী হয়েছে, আমি কিছুই জানি না।’ এই সাত দিন তাহলে কোথায় ছিলেন তিনি? একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গেও কি তাঁর যোগযোগ ছিল না যে তাঁকে এ ভয়ংকর সংবাদটি জানিয়ে দিতে পারে?
ষাটের দশকে আমাদের দেশে পুলিশ, সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুসহ অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন জেল খাটেন। জেলখানায় বসে তিনি সব সংবাদ জানতেন এবং তাঁর যাঁরা কর্মী তাঁদের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিতেন। যাঁর টাকা প্রয়োজন, তাঁকে টাকা পাঠানো; যাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন, তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা—এসব দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন। জেলখানার ভেতরেও এক বেলার পরিচয়েই সারা জীবনের জন্য পরিচয় হয়ে যেত। যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নানা ব্যস্ততার মধ্যেও পাশের কয়েদিকে তিনি ভুলতেন না। একটা বিষয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর কাজ মানুষকেন্দ্রিক। মানুষকে নিয়েই আন্দোলন, মানুষকে নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। একদিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আছেন তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই, আবার অন্যদিকে ঘরে ঘরে কর্মী বাহিনীকে দিয়ে দুর্গ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
এই সময়ে বিশাল বিশাল সমাবেশ হয়েছে। কখনো শ্রমিক, কখনো কৃষক, কখনো পেশাজীবী—এসব সমাবেশেও তিনি গণচরিত্রটাকে রক্ষা করতেন। সেই সময়ে বর্ষীয়ষী নেতাদের তিনি পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করতেন। যেমন মওলানা ভাসানী। যাঁর সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোনো দিন কোনো বয়স্ক নেতার সঙ্গে ঔদ্ধত্য আচরণ করেননি। সবটা মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো, গোটা দেশটাকে তিনি একটি অভিন্ন পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাসম্পন্ন মানুষ যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, সেই সব ত্যাগী নেতাকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতেন এবং পরিবারের অংশ হিসেবেও ভাবতেন। এমন করেই তিনি সারা দেশে একটা অদৃশ্য সংযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলাফলে অনেক মানুষকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন।
যা তিনি ভাবতে পারেননি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষাও অবর্ণনীয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতায়ও আরেক নতুন লড়াই। সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়; বরং তার মধ্যে একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এর মধ্যে আছে বিশ্বাসঘাতক ১৬ ডিসেম্বরের একদল বাহিনী। দেশে প্রচুর অস্ত্রের ছড়াছড়ি। দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। আমেরিকা বাংলাদেশের বিজয় মেনে নিতে পারেনি। তার সঙ্গে পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরবও রয়েছে। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে আগের মতোই ভাবতেন। আমি নিজ চোখে দেখেছি, একদিন দুপুরবেলায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোনো দেহরক্ষী ছাড়া একাই অফিসে যাচ্ছেন। বাঙালির প্রতি ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। কোনো দুর্বৃত্তের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হতে পারে, এটা ছিল তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য। এত মানুষের স্মৃতি যাঁর কাছে, সেই মানুষকে অকস্মাৎ রাতের অন্ধকারে বিশ্বাসঘাতকের অস্ত্রে রক্তাক্ত হতে হলো। তাঁর কাছ থেকে তাঁর যাপিত জীবনের স্মৃতিটুকুও মানুষ জানতে পারল না। এটা ছিল তাঁর ভাবনার অতীত, যা তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে