অরুণ কর্মকার
আকার-আয়তন ও ব্যাপ্তিতে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা এক মহানগরীই বটে। তবে নগর ব্যবস্থাপনার আধুনিক যেসব বৈশিষ্ট্য, তার ছিটেফোঁটাও এখন পর্যন্ত এখানে নেই। এখন পর্যন্ত নেই বলছি কারণ, আশায় আছি কোনো এক সময় থাকবে। অবশ্য সে আশা যে প্রায়ই দুরাশা বলে মনে হয় না, সে কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না।
এই যে আশাকে ছাপিয়ে দুরাশার প্রকট হয়ে ওঠা, এর কারণ যে শুধু এই মহানগরীতে একের পর এক ঘটে চলা প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, তা নয়। আরও কারণ আছে। যেমন, মোট ৫৪টি সংস্থা আমাদের এই মহানগরীর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কোনো না কোনো দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছে। কিন্তু তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় আছে বলে কেউ কখনো শোনেনি, সমন্বয়ের কোনো নজির দেখা যাওয়া তো দূরের কথা।
এই সমন্বয়হীনতারও কারণ আছে। ওই ৫৪টি সংস্থার প্রতিটিরই নিজস্ব আইনকানুন আছে। সেসবের আওতায় পরিচালিত হয় তারা। কাজেই যার যার পরিকল্পনা কিংবা স্বকপোলকল্পনা অনুযায়ীও কাজ করতে বাধা নেই। একটির সঙ্গে আরেকটির, একের সঙ্গে অপরের সমন্বয় করার কোনো বাধ্যবাধকতা তাদের নেই। অথচ আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো এই সমন্বয়।
আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার অবস্থা যখন এই, তখন নগরী যে অরক্ষিত হয়ে পড়বে, সে তো আর কাউকে বলে বোঝাতে হয় না। তবে বলার বিষয় হলো, এমন একটি অরক্ষিত নগরীতে শ্রেণি-পেশা-সামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে সব নাগরিক হয়ে পড়ে অনিরাপদ। নাগরিকদের জীবন-জীবিকা হয়ে যায় অনিশ্চিত। পবিত্র শবে বরাতের দিন বিকেলে গুলিস্তানসংলগ্ন কুইন্স মার্কেটে স্যানিটারি সামগ্রী কিনতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন যে দম্পতি, কিংবা যে তরুণ এসেছিলেন মায়ের জন্য ইফতারসামগ্রী নিতে, এমনকি যাঁরা পথচারী ছিলেন, ওই ভবনের সামনে বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী ছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে হতাহতদের মতো পরিণতি এই নগরীর যেকোনো নাগরিকের হতে পারে যেকোনো দিন, যেকোনো সময়।
আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার আরেকটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো, যেখানে যখন যে কারণেই দুর্ঘটনা ঘটুক, আর যে বা যাঁরাই সে দুর্ঘটনার শিকার হন, তার দায় কারও নয়। কোনো সংস্থা কিংবা কর্তৃপক্ষ এর কোনো দায় নেয় না। কখনো তাদের ওপর দায় চাপেও না। ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’ গোছের একটা ব্যাপার আরকি! অথচ নগর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের। দায় কিছুটা চাপে সংশ্লিষ্ট ভবনের মালিকের ঘাড়ে। আর চূড়ান্তভাবে চাপে গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ প্রভৃতি ইউটিলিটির ওপর।
তা সে ইউটিলিটির দায় তো আছেই। আমাদের গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার যত বেড়েছে, এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনাও বেড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, এই ঢাকাতেই নাকি প্রতিবছর তিন হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। অর্থাৎ প্রতিদিন ৮-৯টি। এর বেশির ভাগেরই কারণ গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং সেই সূত্রে বিস্ফোরণ। কিন্তু আমাদের নগর ব্যবস্থাপনায় এর প্রতিকারের কোনো বিধান নেই। আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনায় আছে। নগরবাসী এবং নগর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে নিয়ম মেনে সে দায়িত্ব পালন করে।
যেমন, বিদ্যুৎ-সংযোগের ক্ষেত্রে সংযোগ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে বাসা-বাড়ি কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জরিপ করে নির্দিষ্ট লোডে (বিদ্যুৎ ব্যবহারের নির্ধারিত পরিমাণ) সংযোগ দেওয়া হয়। এরপর আর বিতরণ কোম্পানির কোনো খবর থাকে না বিল নেওয়া ছাড়া। এদিকে গ্রাহক বছরের পর বছর ধরে ইচ্ছেমতো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাড়িয়ে চলেন। বিদ্যুৎ ব্যবহারও নির্ধারিত লোডের চেয়ে অনেক বেশি হয়। সেই বাড়তি বিলও বিতরণ কোম্পানি নিতে থাকে। কিন্তু গ্রাহক অননুমোদিতভাবে লোড বাড়ানোর ফলে তাঁর বাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় কতটা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, উভয় পক্ষের কাছেই তা থাকে উপেক্ষিত। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের যেমন দায় আছে, তেমনি দায় আছে বিতরণ কোম্পানিরও। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় অনেক বেশি। তাই সেখানে অব্যবস্থাপনার ঝুঁকিও অনেক উঁচুমাত্রার। বিতরণ কোম্পানি বছরে কিংবা দুই বছরেও একবার গ্রাহকের দুয়ারে হাজির হলে এসব দুর্ঘটনা কমত।
নগর-মহানগরীর কোনো ভবনে গ্যাস জমতে পারে নানাভাবে। রান্নার গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকে ছড়িয়ে পড়া গ্যাস যেমন ভবনের কোনো আবদ্ধ স্থানে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে জমা হতে পারে, তেমনি পয়োনিষ্কাশন লাইনের ছিদ্র, ভূগর্ভস্থ জলাধার, সেপটিক ট্যাংক, জেনারেটর প্রভৃতি থেকেও গ্যাস জমা হতে পারে। এই ধরনের জমা হওয়া গ্যাস কোনো অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে এলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এইভাবে জমা হওয়া গ্যাসই ঢাকার সর্বশেষ দুটি বিস্ফোরণের কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
আমাদের গ্যাসলাইনগুলো অনেক পুরোনো। তাতে ছিদ্রও আছে অসংখ্য। বাসাবাড়ি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লাইনও ছিদ্রমুক্ত নয়। তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির হয়ে একটি পেশাদার প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান বছর কয়েক আগে একটি জরিপ করেছিল গ্যাসলাইনের ছিদ্র বিষয়ে। সমগ্র ঢাকায় নয়, কয়েকটি এলাকায় করা হয়েছিল সেই জরিপ। তার ভিত্তিতে হিসাব করে দেখা গেছে, লাইনে ছিদ্র থাকায় প্রতিদিন তিতাসের সিস্টেম থেকে অন্তত ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) ঘনফুট গ্যাস উবে যাচ্ছে। এই গ্যাস পুরোটাই যে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে, তা বলা যায় না। কোথাও কোথাও কোনো আবদ্ধ স্থানে (ট্র্যাপ) কিছু কিছু গ্যাস জমা হতে পারে, যা একসময় প্রাণঘাতী বিস্ফোরক হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া আমাদের পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থার অবস্থা যাচ্ছেতাই। সেখান থেকেও মিথেন গ্যাস তৈরি ও নির্গত হয়ে কোনো কোনো স্থানে জমতে পারে। সেপটিক ট্যাংক ও ভূগর্ভস্থ জলাধার পরিষ্কার করার সময় বিষাক্ত গ্যাসে শ্রমিকের মৃত্যুর খবর আমরা মাঝেমধ্যেই শুনে থাকি। এই বিষাক্ত গ্যাস আর কিছু না, মিথেন।
আমাদের ভবনগুলোর অধিকাংশ ত্রুটিপূর্ণ। আজকাল বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়ও দেখা যায় কিছু অকালকুষ্মাণ্ড একত্র হয়ে কোনো একটা জায়গা কিনে কিংবা কোনোভাবে দখলে নিয়ে ভবন তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি করে। এরা সব বর্তমান অসুস্থ রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার ফসল হিসেবে গজিয়ে ওঠা বাটপার। এদের তৈরি ভবনগুলোও হয় সে রকমই। ফলে সাধারণ মানুষের ঝুঁকি বাড়ে।
কিন্তু আমাদের নগর ব্যবস্থাপকেরা কী করেন! গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পয়োনিষ্কাশন, মানসম্পন্ন ভবন নির্মাণ প্রভৃতি যে বিষয়গুলো এখানে উল্লেখ করা হলো, তার প্রতিটির জন্য অন্তত একটি করে সংস্থা রয়েছে। জননিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে তারা কি নিয়মিত এগুলোর দেখভাল করে? করে না।
নগরে কোনো একটি ভবন তৈরি হওয়ার পর সেটি নিরাপদে বসবাসযোগ্য কি না, তা দেখার জন্যও কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তাদের দায়িত্ব ভবনটির বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করে একটি ব্যবহার সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) দেওয়া। শুধু তা-ই নয়, প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর ভবন পুনঃ পরীক্ষা করে সেই সনদ নবায়ন করারও বিধান রয়েছে। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ পেশাজীবী জানালেন, ঢাকায় অন্তত ৬ লাখ ভবনের মধ্যে এই সনদ রয়েছে ১০০টির মতো ভবনের।
এ ছাড়া রয়েছে রান্নায় ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার। এই সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর সতর্কতা বিশেষ প্রয়োজন। এখানে রয়েছে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের গুদাম। অনুমোদিত এবং অননুমোদিত। এই নগরীতে দুর্ঘটনা না ঘটার কি কোনো কারণ আছে?
নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর এক যুগের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। চুরিহাট্টায় রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের পর চার বছর চলে গেছে। রাসায়নিক সামগ্রীর গুদাম-ব্যবসার জন্য সরকার নতুন জায়গা করে দিয়েছে। তারপরও নগরীতে রাসায়নিকের গুদাম থাকে কীভাবে? রাখেন কারা? নগর ব্যবস্থাপনার এই হাল কারা করেছেন? যাঁরা করেছেন দুর্ঘটনার জন্য, প্রাণহানির জন্য, তাঁদের কোনো দায় নেই!
শুধু তো বিস্ফোরণ কিংবা অগ্নিকাণ্ড নয়, সড়ক দুর্ঘটনাও আছে! গত ফেব্রুয়ারি মাসেও এই ঢাকা মহানগরীতে ১৮ জন মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। এক দিন অন্তর একটি করে প্রাণ পৃথিবীর আর কোনো নগর-মহানগরীতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে কি? অথচ কেউ দায় নেবেন না! কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান দায়ী হবে না! বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো মানুষের জন্য দাফন-কাফনের নিমিত্তে কিছু অর্থ দিয়েই শেষ হবে দায়িত্ব।
মূলত অব্যবস্থাপনার কারণে অরক্ষিত এই মহানগরী। এই মহানগরীতে সব ধরনের দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর জন্য দায়ী কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা। অব্যবস্থাপনা এবং অব্যবস্থাপনা। এর সঙ্গে আরও থাকতে পারে অবহেলা। মানুষের প্রতি অবহেলা। কর্তব্যের প্রতি অবহেলা, যা ক্ষমার অযোগ্য।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আকার-আয়তন ও ব্যাপ্তিতে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা এক মহানগরীই বটে। তবে নগর ব্যবস্থাপনার আধুনিক যেসব বৈশিষ্ট্য, তার ছিটেফোঁটাও এখন পর্যন্ত এখানে নেই। এখন পর্যন্ত নেই বলছি কারণ, আশায় আছি কোনো এক সময় থাকবে। অবশ্য সে আশা যে প্রায়ই দুরাশা বলে মনে হয় না, সে কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না।
এই যে আশাকে ছাপিয়ে দুরাশার প্রকট হয়ে ওঠা, এর কারণ যে শুধু এই মহানগরীতে একের পর এক ঘটে চলা প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, তা নয়। আরও কারণ আছে। যেমন, মোট ৫৪টি সংস্থা আমাদের এই মহানগরীর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কোনো না কোনো দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছে। কিন্তু তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় আছে বলে কেউ কখনো শোনেনি, সমন্বয়ের কোনো নজির দেখা যাওয়া তো দূরের কথা।
এই সমন্বয়হীনতারও কারণ আছে। ওই ৫৪টি সংস্থার প্রতিটিরই নিজস্ব আইনকানুন আছে। সেসবের আওতায় পরিচালিত হয় তারা। কাজেই যার যার পরিকল্পনা কিংবা স্বকপোলকল্পনা অনুযায়ীও কাজ করতে বাধা নেই। একটির সঙ্গে আরেকটির, একের সঙ্গে অপরের সমন্বয় করার কোনো বাধ্যবাধকতা তাদের নেই। অথচ আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো এই সমন্বয়।
আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার অবস্থা যখন এই, তখন নগরী যে অরক্ষিত হয়ে পড়বে, সে তো আর কাউকে বলে বোঝাতে হয় না। তবে বলার বিষয় হলো, এমন একটি অরক্ষিত নগরীতে শ্রেণি-পেশা-সামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে সব নাগরিক হয়ে পড়ে অনিরাপদ। নাগরিকদের জীবন-জীবিকা হয়ে যায় অনিশ্চিত। পবিত্র শবে বরাতের দিন বিকেলে গুলিস্তানসংলগ্ন কুইন্স মার্কেটে স্যানিটারি সামগ্রী কিনতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন যে দম্পতি, কিংবা যে তরুণ এসেছিলেন মায়ের জন্য ইফতারসামগ্রী নিতে, এমনকি যাঁরা পথচারী ছিলেন, ওই ভবনের সামনে বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী ছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে হতাহতদের মতো পরিণতি এই নগরীর যেকোনো নাগরিকের হতে পারে যেকোনো দিন, যেকোনো সময়।
আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার আরেকটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো, যেখানে যখন যে কারণেই দুর্ঘটনা ঘটুক, আর যে বা যাঁরাই সে দুর্ঘটনার শিকার হন, তার দায় কারও নয়। কোনো সংস্থা কিংবা কর্তৃপক্ষ এর কোনো দায় নেয় না। কখনো তাদের ওপর দায় চাপেও না। ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’ গোছের একটা ব্যাপার আরকি! অথচ নগর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের। দায় কিছুটা চাপে সংশ্লিষ্ট ভবনের মালিকের ঘাড়ে। আর চূড়ান্তভাবে চাপে গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ প্রভৃতি ইউটিলিটির ওপর।
তা সে ইউটিলিটির দায় তো আছেই। আমাদের গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার যত বেড়েছে, এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনাও বেড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, এই ঢাকাতেই নাকি প্রতিবছর তিন হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। অর্থাৎ প্রতিদিন ৮-৯টি। এর বেশির ভাগেরই কারণ গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং সেই সূত্রে বিস্ফোরণ। কিন্তু আমাদের নগর ব্যবস্থাপনায় এর প্রতিকারের কোনো বিধান নেই। আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনায় আছে। নগরবাসী এবং নগর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে নিয়ম মেনে সে দায়িত্ব পালন করে।
যেমন, বিদ্যুৎ-সংযোগের ক্ষেত্রে সংযোগ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে বাসা-বাড়ি কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জরিপ করে নির্দিষ্ট লোডে (বিদ্যুৎ ব্যবহারের নির্ধারিত পরিমাণ) সংযোগ দেওয়া হয়। এরপর আর বিতরণ কোম্পানির কোনো খবর থাকে না বিল নেওয়া ছাড়া। এদিকে গ্রাহক বছরের পর বছর ধরে ইচ্ছেমতো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাড়িয়ে চলেন। বিদ্যুৎ ব্যবহারও নির্ধারিত লোডের চেয়ে অনেক বেশি হয়। সেই বাড়তি বিলও বিতরণ কোম্পানি নিতে থাকে। কিন্তু গ্রাহক অননুমোদিতভাবে লোড বাড়ানোর ফলে তাঁর বাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় কতটা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, উভয় পক্ষের কাছেই তা থাকে উপেক্ষিত। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের যেমন দায় আছে, তেমনি দায় আছে বিতরণ কোম্পানিরও। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় অনেক বেশি। তাই সেখানে অব্যবস্থাপনার ঝুঁকিও অনেক উঁচুমাত্রার। বিতরণ কোম্পানি বছরে কিংবা দুই বছরেও একবার গ্রাহকের দুয়ারে হাজির হলে এসব দুর্ঘটনা কমত।
নগর-মহানগরীর কোনো ভবনে গ্যাস জমতে পারে নানাভাবে। রান্নার গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকে ছড়িয়ে পড়া গ্যাস যেমন ভবনের কোনো আবদ্ধ স্থানে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে জমা হতে পারে, তেমনি পয়োনিষ্কাশন লাইনের ছিদ্র, ভূগর্ভস্থ জলাধার, সেপটিক ট্যাংক, জেনারেটর প্রভৃতি থেকেও গ্যাস জমা হতে পারে। এই ধরনের জমা হওয়া গ্যাস কোনো অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে এলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এইভাবে জমা হওয়া গ্যাসই ঢাকার সর্বশেষ দুটি বিস্ফোরণের কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
আমাদের গ্যাসলাইনগুলো অনেক পুরোনো। তাতে ছিদ্রও আছে অসংখ্য। বাসাবাড়ি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লাইনও ছিদ্রমুক্ত নয়। তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির হয়ে একটি পেশাদার প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান বছর কয়েক আগে একটি জরিপ করেছিল গ্যাসলাইনের ছিদ্র বিষয়ে। সমগ্র ঢাকায় নয়, কয়েকটি এলাকায় করা হয়েছিল সেই জরিপ। তার ভিত্তিতে হিসাব করে দেখা গেছে, লাইনে ছিদ্র থাকায় প্রতিদিন তিতাসের সিস্টেম থেকে অন্তত ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) ঘনফুট গ্যাস উবে যাচ্ছে। এই গ্যাস পুরোটাই যে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে, তা বলা যায় না। কোথাও কোথাও কোনো আবদ্ধ স্থানে (ট্র্যাপ) কিছু কিছু গ্যাস জমা হতে পারে, যা একসময় প্রাণঘাতী বিস্ফোরক হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া আমাদের পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থার অবস্থা যাচ্ছেতাই। সেখান থেকেও মিথেন গ্যাস তৈরি ও নির্গত হয়ে কোনো কোনো স্থানে জমতে পারে। সেপটিক ট্যাংক ও ভূগর্ভস্থ জলাধার পরিষ্কার করার সময় বিষাক্ত গ্যাসে শ্রমিকের মৃত্যুর খবর আমরা মাঝেমধ্যেই শুনে থাকি। এই বিষাক্ত গ্যাস আর কিছু না, মিথেন।
আমাদের ভবনগুলোর অধিকাংশ ত্রুটিপূর্ণ। আজকাল বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়ও দেখা যায় কিছু অকালকুষ্মাণ্ড একত্র হয়ে কোনো একটা জায়গা কিনে কিংবা কোনোভাবে দখলে নিয়ে ভবন তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি করে। এরা সব বর্তমান অসুস্থ রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার ফসল হিসেবে গজিয়ে ওঠা বাটপার। এদের তৈরি ভবনগুলোও হয় সে রকমই। ফলে সাধারণ মানুষের ঝুঁকি বাড়ে।
কিন্তু আমাদের নগর ব্যবস্থাপকেরা কী করেন! গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পয়োনিষ্কাশন, মানসম্পন্ন ভবন নির্মাণ প্রভৃতি যে বিষয়গুলো এখানে উল্লেখ করা হলো, তার প্রতিটির জন্য অন্তত একটি করে সংস্থা রয়েছে। জননিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে তারা কি নিয়মিত এগুলোর দেখভাল করে? করে না।
নগরে কোনো একটি ভবন তৈরি হওয়ার পর সেটি নিরাপদে বসবাসযোগ্য কি না, তা দেখার জন্যও কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তাদের দায়িত্ব ভবনটির বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করে একটি ব্যবহার সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) দেওয়া। শুধু তা-ই নয়, প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর ভবন পুনঃ পরীক্ষা করে সেই সনদ নবায়ন করারও বিধান রয়েছে। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ পেশাজীবী জানালেন, ঢাকায় অন্তত ৬ লাখ ভবনের মধ্যে এই সনদ রয়েছে ১০০টির মতো ভবনের।
এ ছাড়া রয়েছে রান্নায় ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার। এই সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর সতর্কতা বিশেষ প্রয়োজন। এখানে রয়েছে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের গুদাম। অনুমোদিত এবং অননুমোদিত। এই নগরীতে দুর্ঘটনা না ঘটার কি কোনো কারণ আছে?
নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর এক যুগের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। চুরিহাট্টায় রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের পর চার বছর চলে গেছে। রাসায়নিক সামগ্রীর গুদাম-ব্যবসার জন্য সরকার নতুন জায়গা করে দিয়েছে। তারপরও নগরীতে রাসায়নিকের গুদাম থাকে কীভাবে? রাখেন কারা? নগর ব্যবস্থাপনার এই হাল কারা করেছেন? যাঁরা করেছেন দুর্ঘটনার জন্য, প্রাণহানির জন্য, তাঁদের কোনো দায় নেই!
শুধু তো বিস্ফোরণ কিংবা অগ্নিকাণ্ড নয়, সড়ক দুর্ঘটনাও আছে! গত ফেব্রুয়ারি মাসেও এই ঢাকা মহানগরীতে ১৮ জন মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। এক দিন অন্তর একটি করে প্রাণ পৃথিবীর আর কোনো নগর-মহানগরীতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে কি? অথচ কেউ দায় নেবেন না! কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান দায়ী হবে না! বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো মানুষের জন্য দাফন-কাফনের নিমিত্তে কিছু অর্থ দিয়েই শেষ হবে দায়িত্ব।
মূলত অব্যবস্থাপনার কারণে অরক্ষিত এই মহানগরী। এই মহানগরীতে সব ধরনের দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর জন্য দায়ী কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা। অব্যবস্থাপনা এবং অব্যবস্থাপনা। এর সঙ্গে আরও থাকতে পারে অবহেলা। মানুষের প্রতি অবহেলা। কর্তব্যের প্রতি অবহেলা, যা ক্ষমার অযোগ্য।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে