চিররঞ্জন সরকার
বসন্ত এসেছে। বাংলা ভাষার গায়ে বসন্তের ফুরফুরে বাতাস লেগেছে, তা অবশ্য বলা যাবে না; বরং চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যাদের বয়স কম, তারা ভবিষ্যতে কোন ভাষা বেশি ব্যবহার করবে, তার ওপরেই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ভাষার ভবিষ্যৎ। আমাদের দেশে উঠতি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা কিন্তু ক্রমেই বাংলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যবর্তী বয়সী বাঙালিরা ভাষা নিয়ে কী ভাবছেন, তার ওপর।
এই পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ নানা অর্থনৈতিক শ্রেণির অন্তর্গত, ঊর্ধ্বসীমার দিকে যাঁরা আছেন, সেই পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হলেন এখনকার কম বয়সী বাবা-মা। তবে যে অর্থনৈতিক শ্রেণিরই অন্তর্গত হোন না কেন, সবাই কম-বেশি স্বপ্ন দেখেন, নিজেদের ছেলেমেয়েকে ভালো করে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবেন। এই স্বপ্নে ভাষার একটা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
আগে স্কুল-কলেজগুলোতে বাংলা ভাষাতেই লেখাপড়া হতো। এখনো হয়। তবে ইংরেজি দিন দিন তার আসন পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাও অর্থকরী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যাদের টাকা আছে তারা ভালো-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর বর্তমানে ‘ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ মানে হচ্ছে ইংরেজি-প্রধান শিক্ষা। গরিবেরা পড়ছে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর তুলনামূলক ধনীরা পড়ছে ইংরেজি-প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এভাবে এই দুই শ্রেণির শিক্ষা, বুঝ,
চিন্তা, মূল্যবোধ, স্টাইল—সবকিছুই আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমেই ইংরেজিবিহীন সহজ বাংলা মিডিয়ামের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের রমরমা ব্যবসা চলছে। ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতা কমেছে। যাঁদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, সেই অভিভাবকেরা কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও এখন ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে পাঠাতে পারেন না। কারণ ভালো বাংলা মিডিয়াম স্কুল প্রায় নেই। ফলে ইংলিশ মিডিয়াম অনিবার্য ভবিতব্য হয়ে উঠছে।
আমাদের দেশে উচ্চবিত্তদের একটা অংশ দলে দলে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের যোগ কমছে। এভাবে দেশে স্পষ্ট দুটি শ্রেণি গড়ে উঠছে। যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে সবল তাঁরা ইংরেজির চর্চা করছেন। আর গরিব চাষাভূষারা বাংলা নিয়ে পড়ে আছেন। ব্যবসা-চাকরি সবখানে ইংরেজি জানাদের আধিপত্য, কদর। বাংলাওয়ালাদের জন্য ব্লগ আর ফেসবুকে হতাশার পদ্য রচনা ছাড়া আপাতত তেমন কোনো পুরস্কার নেই!
সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষার অবস্থা আজ বড়ই করুণ। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাংলা উচ্চারণের দশা দেখলে আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালাতে চায়। কে যে কী ‘অ্যাকসেন্টে’ বাংলা বলে! সেই বিচিত্রবাদিনী রাত্রিদিন বাংলা ব্যান্ড, বাঙালির এফএম, বাঙালির চ্যানেলে নৃত্য করছে। একটা বাংলা শব্দ তো সাতটা ইংরেজি। ক্রিয়া পদের মাথামুণ্ডু নেই। মিসড কল মারে, আদর পায়, হ্যাপি থাকে। বানানের কথা বেশি না বলাই ভালো। বাংলা বই পড়ার বালাই নেই। সুতরাং গো, ওয়েন্ট, গন। বাংলা ক্রমেই চাষা-মজুরের ভাষায় পরিণত হচ্ছে। ভদ্রলোকেরা বাংলাকে ক্রমে টা-টা জানাচ্ছেন। বাংলা ইলেকট্রিক চুল্লিতে গন গনাগন হতে চলেছে। এ যেন নেভার রিটার্ন! যে ভাষা না জানলে চাকরি হয় না, ব্যবসা হয় না, বিদেশে যাওয়া যায় না, সেই ভাষা নিয়ে মেতে থাকবে কে?
যাদের কিছু করার নেই, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের সাধ আছে, সাধ্য আছে, তারা কেন ‘বাংলার গান’ গেয়ে যাবে?
‘একুশের প্রথম প্রভাতফেরি-অলৌকিক ভোর’ রক্তে রাঙানো সেই সূর্যোদয়ের গাথা কি এখন আর সত্যিই বাঙালিকে দোলা দেয়? বিশ্বায়িত দুনিয়ার নয়া ‘ট্রেন্ড’—বাঙালি ‘গ্লোবাল’ হচ্ছে। সেই সঙ্গেই বদলে যাচ্ছে ভাষার বিন্যাস। মাতৃভাষা থোড়াই কেয়ার, ‘বাংলিশ’ (বাংলা ২০ ও ইংরেজি ৮০ শতাংশ)-এর এখন একাধিপত্য। আর অদ্ভুত কিছু বাংলা খিস্তি যার দারুণ কদর। এই ‘ট্রেন্ড’ দেখে গুলিয়ে যেতে শুরু করে নিজের অস্তিত্ব।
যদিও বাংলাকে নিয়ে মুখে মুখে গর্ব করার লোকের এখনো অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? ইংরেজি না জানলে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কারোর ভাত নেই। তাহলে মরার বাংলা নিয়ে পড়ে থাকতে যাবে কোন দুঃখে? এখন এমন মানুষও দেখা যাচ্ছে, যাঁরা বলছেন, ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ বা ‘আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে বা লিখতে জানে না’। ঔপনিবেশিক শাসনকর্তাদের ভাষাটাকে নিজের মনে না করলে আর কোনো থই পাওয়া যাবে না! যুগধর্মকে অগ্রাহ্য করে খামোখা বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়াতে কে চায়?
এখন এই কম্পিউটার-স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের যুগে, ইংরেজির মতো শক্তিশালী ভাষা কমই আছে। কারণ, এসব মাধ্যমে কাজ করতে গেলে আপনাকে ইংরেজি কিছুটা জানতেই হবে। ফলে এলিট ক্লাস হোক আর আটপৌরে বাঙালি, কিছুটা বিভ্রান্তও বটে। কারণ, বাংলা যদি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ে, তাহলে সেটাকে আঁকড়ে থেকে লাভ কী! আর বই যদি ইংরেজিতেই পড়তে হয়, তাহলে তাতে লিখলেই বা ক্ষতি কী! না, বাঙালির ইংরেজি জানা নিয়ে বা তাতে পড়াশোনা করা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। থাকতেই পারে না। এখানে প্রশ্নটা বিকল্পের; অর্থাৎ যদি কেউ চায় বাংলাকে অবলম্বন করতে, সে ক্ষেত্রে কী সুযোগ থাকবে তার কাছে? খুবই সীমিত তা।
সে জন্য তাকে নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই খুব ভালো করে বুঝতে হবে ইংরেজিকেও। দুটো ভাষাকে মিশিয়েই মাতৃভাষায় শিক্ষাচর্চা করতে হবে। শুধু বাংলানির্ভরতা থাকলে কিন্তু একটা সময় পর কানাগলিতে ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সে জন্য নিজের ভাষাকে বিসর্জন দেওয়ার মতো যে সর্বনাশের খেলায় আমরা ক্রমেই মেতে উঠেছি, তা হলে সেই ভাষাকে বাঁচানোর রসদ আমরা কোথায় পাব?
আসলে আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রীয় শক্তিতে সংখ্যাগুরু সব ভাষাভাষীর দ্বারাই অপরাপর অপেক্ষাকৃত দুর্বল গোষ্ঠী (জনসংখ্যা-আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক নিরিখে) শিকার হয়। আমরা ইংরেজি দ্বারা নিয়মিত পিষ্ট হই—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি আমরা বাংলাভাষীরা সাঁওতালি, খাসি, চাকমা, মুন্ডাসহ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক ভাষাভাষীদের কি কখনো প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দিয়ে থাকি? প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারী বহু ভাষা এই অসম লড়াইয়ে হেরেছে অবিরত। নতুন শাসকশ্রেণির কাছে বহু সময় নতুন ভাষা গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু তাতে সব ভাষাভাষী পুষ্ট হয়নি।
কিছু স্লোগান, কিছু প্রচারসর্বস্ব কর্মসূচিতে ভাষার বিলোপকে রোখা সম্ভব নয়। প্রত্যেকের মাতৃভাষার অধিকার ও বিকাশকে অন্তর থেকে স্বীকার করতে পারলে, বৈচিত্র্যকে শক্তি এবং সৌন্দর্য হিসাবে স্বীকার করতে পারলে বিশ্বব্যাপী বহু ভাষা, বহু ভাষাভাষী রক্ষা পায়। নচেৎ নয়।
বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাকে রক্ষার জন্য যেমন ইতিবাচক মানসিকতা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি বাংলাকে কীভাবে বড়লোক-গরিব সবার প্রাণের ভাষায় পরিণত করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ প্রয়োজন। বাংলা ভাষা নিশ্চয়ই মরবে না। তেমন কোনো আশঙ্কা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু গরিব-মেহনতি মানুষের ভাষা হয়ে বাংলা টিকে থাকলে কী লাভ? যারা বাংলা বর্জন করে ইংরেজি শিখবে, কিংবা বাংলা কম জানবে, তারাই যদি শাসক-প্রশাসক-সংস্কৃতির ধ্বজাধারী হয়, তাহলে তো ভবিষ্যৎ ইতিহাস অন্য রকম হতে বাধ্য।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার আলো, বাংলার বায়ুতে আমাদের জন্ম, জীবন, মৃত্যু। আত্মশক্তি ও দেশীয় সম্পদ অবলম্বন করে বাইরের জগৎ থেকে প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী পুষ্টি গ্রহণ করে আমরা আমাদের সত্তাকে এবং দেশকে সমৃদ্ধ করব—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজেদের নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক পরিচয় পরিত্যাগ করে যখন আমরা বিদেশি-বিভাষী-বিজাতি হয়ে উঠতে চাই, তখন কি আমরা ঠিক কাজ করি?
আমরা চাইলে এবং চেষ্টা করলে বাইরের জগৎ থেকে গ্রহণ করে অবশ্যই আরও উন্নত বাঙালি হতে পারব। কিন্তু আত্মপরিচয় ত্যাগ করে, পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের মগজধোলাই প্রক্রিয়ায় আত্মসমর্পণ করে, তাদের চাপিয়ে দেওয়া ‘উন্নয়ন মডেল’ অনুযায়ী চলে আমরা কি মোক্ষলাভ করতে পারব? নীতিনির্ধারকদের আজ এ প্রশ্নটির সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
বসন্ত এসেছে। বাংলা ভাষার গায়ে বসন্তের ফুরফুরে বাতাস লেগেছে, তা অবশ্য বলা যাবে না; বরং চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যাদের বয়স কম, তারা ভবিষ্যতে কোন ভাষা বেশি ব্যবহার করবে, তার ওপরেই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ভাষার ভবিষ্যৎ। আমাদের দেশে উঠতি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা কিন্তু ক্রমেই বাংলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যবর্তী বয়সী বাঙালিরা ভাষা নিয়ে কী ভাবছেন, তার ওপর।
এই পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ নানা অর্থনৈতিক শ্রেণির অন্তর্গত, ঊর্ধ্বসীমার দিকে যাঁরা আছেন, সেই পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হলেন এখনকার কম বয়সী বাবা-মা। তবে যে অর্থনৈতিক শ্রেণিরই অন্তর্গত হোন না কেন, সবাই কম-বেশি স্বপ্ন দেখেন, নিজেদের ছেলেমেয়েকে ভালো করে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবেন। এই স্বপ্নে ভাষার একটা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
আগে স্কুল-কলেজগুলোতে বাংলা ভাষাতেই লেখাপড়া হতো। এখনো হয়। তবে ইংরেজি দিন দিন তার আসন পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাও অর্থকরী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যাদের টাকা আছে তারা ভালো-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর বর্তমানে ‘ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ মানে হচ্ছে ইংরেজি-প্রধান শিক্ষা। গরিবেরা পড়ছে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর তুলনামূলক ধনীরা পড়ছে ইংরেজি-প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এভাবে এই দুই শ্রেণির শিক্ষা, বুঝ,
চিন্তা, মূল্যবোধ, স্টাইল—সবকিছুই আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমেই ইংরেজিবিহীন সহজ বাংলা মিডিয়ামের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের রমরমা ব্যবসা চলছে। ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতা কমেছে। যাঁদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, সেই অভিভাবকেরা কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও এখন ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে পাঠাতে পারেন না। কারণ ভালো বাংলা মিডিয়াম স্কুল প্রায় নেই। ফলে ইংলিশ মিডিয়াম অনিবার্য ভবিতব্য হয়ে উঠছে।
আমাদের দেশে উচ্চবিত্তদের একটা অংশ দলে দলে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের যোগ কমছে। এভাবে দেশে স্পষ্ট দুটি শ্রেণি গড়ে উঠছে। যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে সবল তাঁরা ইংরেজির চর্চা করছেন। আর গরিব চাষাভূষারা বাংলা নিয়ে পড়ে আছেন। ব্যবসা-চাকরি সবখানে ইংরেজি জানাদের আধিপত্য, কদর। বাংলাওয়ালাদের জন্য ব্লগ আর ফেসবুকে হতাশার পদ্য রচনা ছাড়া আপাতত তেমন কোনো পুরস্কার নেই!
সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষার অবস্থা আজ বড়ই করুণ। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাংলা উচ্চারণের দশা দেখলে আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালাতে চায়। কে যে কী ‘অ্যাকসেন্টে’ বাংলা বলে! সেই বিচিত্রবাদিনী রাত্রিদিন বাংলা ব্যান্ড, বাঙালির এফএম, বাঙালির চ্যানেলে নৃত্য করছে। একটা বাংলা শব্দ তো সাতটা ইংরেজি। ক্রিয়া পদের মাথামুণ্ডু নেই। মিসড কল মারে, আদর পায়, হ্যাপি থাকে। বানানের কথা বেশি না বলাই ভালো। বাংলা বই পড়ার বালাই নেই। সুতরাং গো, ওয়েন্ট, গন। বাংলা ক্রমেই চাষা-মজুরের ভাষায় পরিণত হচ্ছে। ভদ্রলোকেরা বাংলাকে ক্রমে টা-টা জানাচ্ছেন। বাংলা ইলেকট্রিক চুল্লিতে গন গনাগন হতে চলেছে। এ যেন নেভার রিটার্ন! যে ভাষা না জানলে চাকরি হয় না, ব্যবসা হয় না, বিদেশে যাওয়া যায় না, সেই ভাষা নিয়ে মেতে থাকবে কে?
যাদের কিছু করার নেই, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের সাধ আছে, সাধ্য আছে, তারা কেন ‘বাংলার গান’ গেয়ে যাবে?
‘একুশের প্রথম প্রভাতফেরি-অলৌকিক ভোর’ রক্তে রাঙানো সেই সূর্যোদয়ের গাথা কি এখন আর সত্যিই বাঙালিকে দোলা দেয়? বিশ্বায়িত দুনিয়ার নয়া ‘ট্রেন্ড’—বাঙালি ‘গ্লোবাল’ হচ্ছে। সেই সঙ্গেই বদলে যাচ্ছে ভাষার বিন্যাস। মাতৃভাষা থোড়াই কেয়ার, ‘বাংলিশ’ (বাংলা ২০ ও ইংরেজি ৮০ শতাংশ)-এর এখন একাধিপত্য। আর অদ্ভুত কিছু বাংলা খিস্তি যার দারুণ কদর। এই ‘ট্রেন্ড’ দেখে গুলিয়ে যেতে শুরু করে নিজের অস্তিত্ব।
যদিও বাংলাকে নিয়ে মুখে মুখে গর্ব করার লোকের এখনো অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? ইংরেজি না জানলে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কারোর ভাত নেই। তাহলে মরার বাংলা নিয়ে পড়ে থাকতে যাবে কোন দুঃখে? এখন এমন মানুষও দেখা যাচ্ছে, যাঁরা বলছেন, ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ বা ‘আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে বা লিখতে জানে না’। ঔপনিবেশিক শাসনকর্তাদের ভাষাটাকে নিজের মনে না করলে আর কোনো থই পাওয়া যাবে না! যুগধর্মকে অগ্রাহ্য করে খামোখা বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়াতে কে চায়?
এখন এই কম্পিউটার-স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের যুগে, ইংরেজির মতো শক্তিশালী ভাষা কমই আছে। কারণ, এসব মাধ্যমে কাজ করতে গেলে আপনাকে ইংরেজি কিছুটা জানতেই হবে। ফলে এলিট ক্লাস হোক আর আটপৌরে বাঙালি, কিছুটা বিভ্রান্তও বটে। কারণ, বাংলা যদি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ে, তাহলে সেটাকে আঁকড়ে থেকে লাভ কী! আর বই যদি ইংরেজিতেই পড়তে হয়, তাহলে তাতে লিখলেই বা ক্ষতি কী! না, বাঙালির ইংরেজি জানা নিয়ে বা তাতে পড়াশোনা করা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। থাকতেই পারে না। এখানে প্রশ্নটা বিকল্পের; অর্থাৎ যদি কেউ চায় বাংলাকে অবলম্বন করতে, সে ক্ষেত্রে কী সুযোগ থাকবে তার কাছে? খুবই সীমিত তা।
সে জন্য তাকে নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই খুব ভালো করে বুঝতে হবে ইংরেজিকেও। দুটো ভাষাকে মিশিয়েই মাতৃভাষায় শিক্ষাচর্চা করতে হবে। শুধু বাংলানির্ভরতা থাকলে কিন্তু একটা সময় পর কানাগলিতে ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সে জন্য নিজের ভাষাকে বিসর্জন দেওয়ার মতো যে সর্বনাশের খেলায় আমরা ক্রমেই মেতে উঠেছি, তা হলে সেই ভাষাকে বাঁচানোর রসদ আমরা কোথায় পাব?
আসলে আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রীয় শক্তিতে সংখ্যাগুরু সব ভাষাভাষীর দ্বারাই অপরাপর অপেক্ষাকৃত দুর্বল গোষ্ঠী (জনসংখ্যা-আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক নিরিখে) শিকার হয়। আমরা ইংরেজি দ্বারা নিয়মিত পিষ্ট হই—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি আমরা বাংলাভাষীরা সাঁওতালি, খাসি, চাকমা, মুন্ডাসহ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক ভাষাভাষীদের কি কখনো প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দিয়ে থাকি? প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারী বহু ভাষা এই অসম লড়াইয়ে হেরেছে অবিরত। নতুন শাসকশ্রেণির কাছে বহু সময় নতুন ভাষা গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু তাতে সব ভাষাভাষী পুষ্ট হয়নি।
কিছু স্লোগান, কিছু প্রচারসর্বস্ব কর্মসূচিতে ভাষার বিলোপকে রোখা সম্ভব নয়। প্রত্যেকের মাতৃভাষার অধিকার ও বিকাশকে অন্তর থেকে স্বীকার করতে পারলে, বৈচিত্র্যকে শক্তি এবং সৌন্দর্য হিসাবে স্বীকার করতে পারলে বিশ্বব্যাপী বহু ভাষা, বহু ভাষাভাষী রক্ষা পায়। নচেৎ নয়।
বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাকে রক্ষার জন্য যেমন ইতিবাচক মানসিকতা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি বাংলাকে কীভাবে বড়লোক-গরিব সবার প্রাণের ভাষায় পরিণত করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ প্রয়োজন। বাংলা ভাষা নিশ্চয়ই মরবে না। তেমন কোনো আশঙ্কা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু গরিব-মেহনতি মানুষের ভাষা হয়ে বাংলা টিকে থাকলে কী লাভ? যারা বাংলা বর্জন করে ইংরেজি শিখবে, কিংবা বাংলা কম জানবে, তারাই যদি শাসক-প্রশাসক-সংস্কৃতির ধ্বজাধারী হয়, তাহলে তো ভবিষ্যৎ ইতিহাস অন্য রকম হতে বাধ্য।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার আলো, বাংলার বায়ুতে আমাদের জন্ম, জীবন, মৃত্যু। আত্মশক্তি ও দেশীয় সম্পদ অবলম্বন করে বাইরের জগৎ থেকে প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী পুষ্টি গ্রহণ করে আমরা আমাদের সত্তাকে এবং দেশকে সমৃদ্ধ করব—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজেদের নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক পরিচয় পরিত্যাগ করে যখন আমরা বিদেশি-বিভাষী-বিজাতি হয়ে উঠতে চাই, তখন কি আমরা ঠিক কাজ করি?
আমরা চাইলে এবং চেষ্টা করলে বাইরের জগৎ থেকে গ্রহণ করে অবশ্যই আরও উন্নত বাঙালি হতে পারব। কিন্তু আত্মপরিচয় ত্যাগ করে, পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের মগজধোলাই প্রক্রিয়ায় আত্মসমর্পণ করে, তাদের চাপিয়ে দেওয়া ‘উন্নয়ন মডেল’ অনুযায়ী চলে আমরা কি মোক্ষলাভ করতে পারব? নীতিনির্ধারকদের আজ এ প্রশ্নটির সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে