মামুনুর রশীদ
এ কথা আজ প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে ফেসবুক সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী। প্রিন্ট মিডিয়া মানে সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানে টেলিভিশন– এসবকে অতিক্রম করেছে ফেসবুক। ফেসবুকের ক্ষমতা অসীম। ফেসবুক অনেক তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদের নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় এবং একটি টেলিফোন সেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে বিষয়টি চাউর হয়ে যায়। এর অনেক ইতিবাচক ফল আছে। কিন্তু মানব চরিত্রের মতোই তার মধ্যে রয়েছে অনেক নেতিবাচক দিক।
এত সহজলভ্য একটি মাধ্যম কখনো কখনো মানুষকে খুব সংকীর্ণ এবং ছোট করে ফেলে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে এই সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই মাধ্যমটির আবার যান্ত্রিক পরিচালনায় থাকে নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেলে তার শক্তি আরও বেড়ে যায়। যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক ভেঙে সে মানুষ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার ক্ষোভ, যন্ত্রণা তখন রাজপথে সঙ্গীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই টেলিফোন সেটটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ক্যামেরা। সেই আগের ক্যামেরার মতো এত জটিল নয়, যেকোনো জায়গায় যেকোনো আলোতে বলতে গেলে ন্যূনতম আলো থাকলেই এটি ছবি এবং ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম হয়। তাই শুধু কথা নয়, চিন্তার প্রকাশ নয়, সেই সঙ্গে একটি ছবি ও ভিডিও বিশাল এক ভাবনার বা বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে।
পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবে, গণ-অভ্যুত্থানে একটা উত্তেজনাকর মুহূর্ত থাকে। সেই মুহূর্ত কখনো প্রলম্বিত, কখনো সংক্ষিপ্ত। সেই মুহূর্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটে একটা পুরোনো শক্তির মধ্য দিয়ে। এই সময় ক্ষমতা জনগণের মধ্যে চলে আসে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তখন অচল ও দৃশ্যমান হয় না। এবারেও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে তাই হয়েছে। কেউ কেউ সেই সঙ্গে কিছু বিশৃঙ্খল অভ্যুত্থানের মহিমাকে দারুণভাবে খর্ব করেছে। তাৎক্ষণিক এই উত্তেজনা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি তা ছড়িয়ে পড়ে নতুন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়, তখন কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হয়। কর্তৃত্ববাদ যখন অর্থ উপার্জনে বা অন্যের অধিকার হরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন পূর্ববর্তী শাসনের কথাই মানুষ মনে করে এবং ভীত হয়ে ওঠে। যে কর্তৃত্ববাদ দুর্নীতির জন্ম দেয়, দখলের জন্ম দেয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তার বিরুদ্ধেই মানুষের চিরায়ত প্রতিবাদ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সমাজের যেসব স্থানে আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের সম্মানবোধ দীর্ঘ সময় ধরে একেবারে নির্দিষ্ট করা আছে, সেইসব জায়গায় একটা নতুন ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে দৃশ্যমান। ছাত্ররা শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করব না যে কিছু শিক্ষক অবশ্যই শিক্ষাবান্ধব বা ছাত্রবান্ধব নন। সেখানেও প্রতিবাদ করার ভাষা আছে, কিন্তু তাঁকে দৈহিক বলপ্রয়োগ, অপমানিত করা একেবারেই সমীচীন বলে কেউ মনে করছেন না। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা বারবার এ কথা বললেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না—একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরে, যেখানে কারও কর্তৃত্ব খাটে না।
মানুষের ভাবনা, বিবেক দ্বারা যা পরিচালিত হয়, একমাত্র সেই ফেসবুকে লেখালেখির স্বাধীনতাও অন্যের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এবং তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ যেন যেকোনো কিছু লেখার জায়গা; তাতে কার ক্ষতি হলো, কার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো, সমাজের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল কি না—তা ভাববার অবকাশ নেই। এই ক্ষতিকর স্বাধীনতা অন্য ধরনের প্রবণতারও জন্ম দিয়েছে। যেমন, ইচ্ছেমতো মামলা দেওয়া, যেগুলোর আসামি এক শ, দুই শ, তিন শ কিংবা চার শ। এই ধরনের মামলা ক্ষোভ প্রকাশের একটা ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু তাতে অভিযুক্তরা বেশ আনন্দের সঙ্গেই খালাস হয়ে যান।
একটা কথা কি আমরা মনে রাখব না যে, কোনো গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ নয়? অথচ এমনটাই ঘটছে ফেসবুকে এবং আদালতে। এর একটা ভয়াবহ রূপ আমরা দেখতে পাই সামাজিক আচরণে। সেই আচরণে আবার সেই পুরোনো প্রথা চলে এসেছে, যার নাম চাঁদাবাজি। পুরোনো চাঁদাবাজদের পরিবর্তে আমরা নতুনদের দেখতে পাই। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমে গেছে, ফুটপাতের দোকানিরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন; রিকশাচালক, সিএনজিচালক থেকে শুরু করে বাস-ট্রাকচালকেরাও উচ্ছ্বসিত হয়েছেন যে এখন আর তাঁদের চাঁদা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই প্রবণতাগুলো খুব খারাপভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। এ যেন অতীতেরই পুনরাবৃত্তি।
চাঁদাবাজি যেন এক মজার জিনিস, আমাদের এই উপমহাদেশে সর্বত্রই দৃশ্যমান! রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু লোক এই কাজটি করে থাকেন এবং প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক লোক এই কাজে নিয়োজিত থেকে নিজের জন্য এবং দলের জন্য বেশ কিছু অর্থ নানান জায়গা থেকে আদায় করে থাকেন এবং কর্মজীবী মানুষের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণকে বিভিন্ন দমনমূলক কায়দায় প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আবার আরেক দল এসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে থাকে। এই চাঁদার টাকা দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে এবং পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং যা পরিশোধ করে থাকে সাধারণ জনগণ। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যখন উপদল সৃষ্টি হয়, নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়, তখন আবার এদের মধ্যেই দ্বন্দ্বের সর্বোচ্চ রূপ মারামারি এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত হয়।
এ তো গেল চাঁদাবাজির বিষয়। এর চেয়েও একটা বড় বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ—রাষ্ট্রের খাসজমি, বন, পাহাড়, নদী এসবের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কর্তৃত্ব গ্রহণ। একসময় শুরু হয়েছিল বন উজাড় করা এবং সেটি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায়, যেটার প্রবণতা আজও আছে। বিপুল পরিমাণে নদী দখল করা হয়েছে, নদীর জায়গায় আমরা দেখেছি বড় বড় ভবন, বাসস্থান, দোকানপাট তৈরি করে একদিকে নদীর নাব্যতা নষ্ট করেছে, আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রেরই সম্পদকে একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে পাহাড় কাটার মহোৎসব দেখি। সরকার পরিবর্তনের পরে এখন হয়তো একটু থমকে আছে, কিন্তু কোনো একটি নির্বাচিত সরকার এলেই আবার সেই উৎসব শুরু হয়ে যাবে।
প্রকৃতির দান এইসব নদী, পাহাড়, বন যখন রাষ্ট্রের মালিকানায় চলে আসে, তখন রাজনৈতিক দল মনে করে এগুলো তাদেরই সম্পত্তি। এইভাবেই রাষ্ট্রের সম্পদ আমরা বহুবার হাতছাড়া হতে দেখেছি। তারপর একটা সময় যারা দখলদার, তাদেরকেই এই সম্পদের মালিক বলে মনে হয়েছে। আমাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার জন্য, বিশেষ করে বন এবং পাহাড়ে রয়েছে বিশেষ জাতিসত্তার মানুষেরা। যারা শত শত বছর ধরে ধরিত্রীকে মনে করে তাদের মা, নদীকে মনে করে ভগ্নি। আর এই ধরিত্রীর যে অংশে তারা বসবাস করে, সেটিকে মায়ের স্থান দেয়। বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই মানুষগুলোকে উচ্ছেদের কাজে দীর্ঘদিন ধরে লেগে আছেন। নানা ধরনের মামলা দিয়ে বিশেষ জাতিসত্তার মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে শুধু এলাকা ছাড়তে নয়, দেশত্যাগ করতেও বাধ্য করেছেন। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে শুরু করে শেরপুর পর্যন্ত অনেক বিশেষ জাতিসত্তার মানুষ বাধ্য হয়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে গিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামও একদা সম্পূর্ণভাবে তাদের আবাসভূমি ছিল। তারা পাহাড়, বনভূমি, নদী এসবকে রক্ষা করে চলত। কিন্তু ষাটের দশকে কাপ্তাই হ্রদ নির্মাণের সময় তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হলো। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সময় তাদের ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, স্কুল, এমনকি চাকমা রাজার প্রাসাদটিও নদীর পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এই আশ্রয়হীন মানুষেরা তখন তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাদের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেছে এবং কেউ কেউ দেশত্যাগ করে চলে গিয়েছে। সবকিছুর মূলেই আছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ।
যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদকে সমূলে বিনাশ করতে চায়। কিন্তু সেখানেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় মানুষের নেতিবাচক কর্মস্পৃহা। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ছিল স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব। অর্থাৎ সেখানেও বৈষম্যহীনতার কথা বলা হয়েছে। সেই সময়ে ১৭৮৯ সালে এইসব উদ্দেশ্য নিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হলেও সেখানে বিশৃঙ্খলা রোধ করা যায়নি। অনেক ধরনের ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে, অনেক ধরনের বড় বড় অঘটন ঘটেছে এবং সেই বিশৃঙ্খলা বহুদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, যার ফলে নেপোলিয়ানের আবির্ভাব হয়। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের পরেও তাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেল একদিকে যেমন স্বাধীনতার আনন্দ, স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে অসহিষ্ণু এবং দুষ্কৃতকারীদের লুণ্ঠনকাজ। পরবর্তীকালেও সেই প্রবণতা রোধ করা যায়নি। একদিকে দেশপ্রেমিক সৎ নাগরিকদের কষ্টকর জীবনযাপন আর অন্যদিকে দুষ্কৃতকারীদের রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠার কাহিনি।
বিভিন্ন ধরনের শাসনকালেই নতুন ধরনের নব্য ধনীর সৃষ্টি হয়েছে। লুটপাটের নতুন নতুন সুযোগও হয়েছে। আর এই লুটপাটের অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনাও জনগণ জানতে পেরেছে। ফেসবুকে এসব ঘটনা কমই আসে, বরং ব্যক্তিগত ক্ষোভ মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যেকোনো সামাজিক আন্দোলনে এই সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন ব্যক্তিগত না হয়ে সামাজিকই হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
এ কথা আজ প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে ফেসবুক সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী। প্রিন্ট মিডিয়া মানে সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানে টেলিভিশন– এসবকে অতিক্রম করেছে ফেসবুক। ফেসবুকের ক্ষমতা অসীম। ফেসবুক অনেক তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদের নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় এবং একটি টেলিফোন সেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে বিষয়টি চাউর হয়ে যায়। এর অনেক ইতিবাচক ফল আছে। কিন্তু মানব চরিত্রের মতোই তার মধ্যে রয়েছে অনেক নেতিবাচক দিক।
এত সহজলভ্য একটি মাধ্যম কখনো কখনো মানুষকে খুব সংকীর্ণ এবং ছোট করে ফেলে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে এই সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই মাধ্যমটির আবার যান্ত্রিক পরিচালনায় থাকে নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেলে তার শক্তি আরও বেড়ে যায়। যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক ভেঙে সে মানুষ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার ক্ষোভ, যন্ত্রণা তখন রাজপথে সঙ্গীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই টেলিফোন সেটটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ক্যামেরা। সেই আগের ক্যামেরার মতো এত জটিল নয়, যেকোনো জায়গায় যেকোনো আলোতে বলতে গেলে ন্যূনতম আলো থাকলেই এটি ছবি এবং ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম হয়। তাই শুধু কথা নয়, চিন্তার প্রকাশ নয়, সেই সঙ্গে একটি ছবি ও ভিডিও বিশাল এক ভাবনার বা বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে।
পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবে, গণ-অভ্যুত্থানে একটা উত্তেজনাকর মুহূর্ত থাকে। সেই মুহূর্ত কখনো প্রলম্বিত, কখনো সংক্ষিপ্ত। সেই মুহূর্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটে একটা পুরোনো শক্তির মধ্য দিয়ে। এই সময় ক্ষমতা জনগণের মধ্যে চলে আসে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তখন অচল ও দৃশ্যমান হয় না। এবারেও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে তাই হয়েছে। কেউ কেউ সেই সঙ্গে কিছু বিশৃঙ্খল অভ্যুত্থানের মহিমাকে দারুণভাবে খর্ব করেছে। তাৎক্ষণিক এই উত্তেজনা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি তা ছড়িয়ে পড়ে নতুন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়, তখন কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হয়। কর্তৃত্ববাদ যখন অর্থ উপার্জনে বা অন্যের অধিকার হরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন পূর্ববর্তী শাসনের কথাই মানুষ মনে করে এবং ভীত হয়ে ওঠে। যে কর্তৃত্ববাদ দুর্নীতির জন্ম দেয়, দখলের জন্ম দেয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তার বিরুদ্ধেই মানুষের চিরায়ত প্রতিবাদ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সমাজের যেসব স্থানে আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের সম্মানবোধ দীর্ঘ সময় ধরে একেবারে নির্দিষ্ট করা আছে, সেইসব জায়গায় একটা নতুন ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে দৃশ্যমান। ছাত্ররা শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করব না যে কিছু শিক্ষক অবশ্যই শিক্ষাবান্ধব বা ছাত্রবান্ধব নন। সেখানেও প্রতিবাদ করার ভাষা আছে, কিন্তু তাঁকে দৈহিক বলপ্রয়োগ, অপমানিত করা একেবারেই সমীচীন বলে কেউ মনে করছেন না। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা বারবার এ কথা বললেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না—একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরে, যেখানে কারও কর্তৃত্ব খাটে না।
মানুষের ভাবনা, বিবেক দ্বারা যা পরিচালিত হয়, একমাত্র সেই ফেসবুকে লেখালেখির স্বাধীনতাও অন্যের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এবং তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ যেন যেকোনো কিছু লেখার জায়গা; তাতে কার ক্ষতি হলো, কার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো, সমাজের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল কি না—তা ভাববার অবকাশ নেই। এই ক্ষতিকর স্বাধীনতা অন্য ধরনের প্রবণতারও জন্ম দিয়েছে। যেমন, ইচ্ছেমতো মামলা দেওয়া, যেগুলোর আসামি এক শ, দুই শ, তিন শ কিংবা চার শ। এই ধরনের মামলা ক্ষোভ প্রকাশের একটা ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু তাতে অভিযুক্তরা বেশ আনন্দের সঙ্গেই খালাস হয়ে যান।
একটা কথা কি আমরা মনে রাখব না যে, কোনো গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ নয়? অথচ এমনটাই ঘটছে ফেসবুকে এবং আদালতে। এর একটা ভয়াবহ রূপ আমরা দেখতে পাই সামাজিক আচরণে। সেই আচরণে আবার সেই পুরোনো প্রথা চলে এসেছে, যার নাম চাঁদাবাজি। পুরোনো চাঁদাবাজদের পরিবর্তে আমরা নতুনদের দেখতে পাই। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমে গেছে, ফুটপাতের দোকানিরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন; রিকশাচালক, সিএনজিচালক থেকে শুরু করে বাস-ট্রাকচালকেরাও উচ্ছ্বসিত হয়েছেন যে এখন আর তাঁদের চাঁদা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই প্রবণতাগুলো খুব খারাপভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। এ যেন অতীতেরই পুনরাবৃত্তি।
চাঁদাবাজি যেন এক মজার জিনিস, আমাদের এই উপমহাদেশে সর্বত্রই দৃশ্যমান! রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু লোক এই কাজটি করে থাকেন এবং প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক লোক এই কাজে নিয়োজিত থেকে নিজের জন্য এবং দলের জন্য বেশ কিছু অর্থ নানান জায়গা থেকে আদায় করে থাকেন এবং কর্মজীবী মানুষের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণকে বিভিন্ন দমনমূলক কায়দায় প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আবার আরেক দল এসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে থাকে। এই চাঁদার টাকা দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে এবং পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং যা পরিশোধ করে থাকে সাধারণ জনগণ। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যখন উপদল সৃষ্টি হয়, নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়, তখন আবার এদের মধ্যেই দ্বন্দ্বের সর্বোচ্চ রূপ মারামারি এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত হয়।
এ তো গেল চাঁদাবাজির বিষয়। এর চেয়েও একটা বড় বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ—রাষ্ট্রের খাসজমি, বন, পাহাড়, নদী এসবের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কর্তৃত্ব গ্রহণ। একসময় শুরু হয়েছিল বন উজাড় করা এবং সেটি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায়, যেটার প্রবণতা আজও আছে। বিপুল পরিমাণে নদী দখল করা হয়েছে, নদীর জায়গায় আমরা দেখেছি বড় বড় ভবন, বাসস্থান, দোকানপাট তৈরি করে একদিকে নদীর নাব্যতা নষ্ট করেছে, আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রেরই সম্পদকে একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে পাহাড় কাটার মহোৎসব দেখি। সরকার পরিবর্তনের পরে এখন হয়তো একটু থমকে আছে, কিন্তু কোনো একটি নির্বাচিত সরকার এলেই আবার সেই উৎসব শুরু হয়ে যাবে।
প্রকৃতির দান এইসব নদী, পাহাড়, বন যখন রাষ্ট্রের মালিকানায় চলে আসে, তখন রাজনৈতিক দল মনে করে এগুলো তাদেরই সম্পত্তি। এইভাবেই রাষ্ট্রের সম্পদ আমরা বহুবার হাতছাড়া হতে দেখেছি। তারপর একটা সময় যারা দখলদার, তাদেরকেই এই সম্পদের মালিক বলে মনে হয়েছে। আমাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার জন্য, বিশেষ করে বন এবং পাহাড়ে রয়েছে বিশেষ জাতিসত্তার মানুষেরা। যারা শত শত বছর ধরে ধরিত্রীকে মনে করে তাদের মা, নদীকে মনে করে ভগ্নি। আর এই ধরিত্রীর যে অংশে তারা বসবাস করে, সেটিকে মায়ের স্থান দেয়। বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই মানুষগুলোকে উচ্ছেদের কাজে দীর্ঘদিন ধরে লেগে আছেন। নানা ধরনের মামলা দিয়ে বিশেষ জাতিসত্তার মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে শুধু এলাকা ছাড়তে নয়, দেশত্যাগ করতেও বাধ্য করেছেন। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে শুরু করে শেরপুর পর্যন্ত অনেক বিশেষ জাতিসত্তার মানুষ বাধ্য হয়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে গিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামও একদা সম্পূর্ণভাবে তাদের আবাসভূমি ছিল। তারা পাহাড়, বনভূমি, নদী এসবকে রক্ষা করে চলত। কিন্তু ষাটের দশকে কাপ্তাই হ্রদ নির্মাণের সময় তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হলো। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সময় তাদের ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, স্কুল, এমনকি চাকমা রাজার প্রাসাদটিও নদীর পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এই আশ্রয়হীন মানুষেরা তখন তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাদের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেছে এবং কেউ কেউ দেশত্যাগ করে চলে গিয়েছে। সবকিছুর মূলেই আছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ।
যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদকে সমূলে বিনাশ করতে চায়। কিন্তু সেখানেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় মানুষের নেতিবাচক কর্মস্পৃহা। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ছিল স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব। অর্থাৎ সেখানেও বৈষম্যহীনতার কথা বলা হয়েছে। সেই সময়ে ১৭৮৯ সালে এইসব উদ্দেশ্য নিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হলেও সেখানে বিশৃঙ্খলা রোধ করা যায়নি। অনেক ধরনের ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে, অনেক ধরনের বড় বড় অঘটন ঘটেছে এবং সেই বিশৃঙ্খলা বহুদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, যার ফলে নেপোলিয়ানের আবির্ভাব হয়। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের পরেও তাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেল একদিকে যেমন স্বাধীনতার আনন্দ, স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে অসহিষ্ণু এবং দুষ্কৃতকারীদের লুণ্ঠনকাজ। পরবর্তীকালেও সেই প্রবণতা রোধ করা যায়নি। একদিকে দেশপ্রেমিক সৎ নাগরিকদের কষ্টকর জীবনযাপন আর অন্যদিকে দুষ্কৃতকারীদের রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠার কাহিনি।
বিভিন্ন ধরনের শাসনকালেই নতুন ধরনের নব্য ধনীর সৃষ্টি হয়েছে। লুটপাটের নতুন নতুন সুযোগও হয়েছে। আর এই লুটপাটের অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনাও জনগণ জানতে পেরেছে। ফেসবুকে এসব ঘটনা কমই আসে, বরং ব্যক্তিগত ক্ষোভ মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যেকোনো সামাজিক আন্দোলনে এই সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন ব্যক্তিগত না হয়ে সামাজিকই হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২১ ঘণ্টা আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে