জাহীদ রেজা নূর
বেশ কয়েক বছর ধরেই আমাদের দেশে শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিষোদ্গার। আগে মূলত করত স্বল্পশিক্ষিত ধর্মান্ধ মানুষ। এই ধর্মান্ধ মানুষের প্ররোচনায় সাধারণ মুসলমানেরাও একসময় এসব কুৎসায় বিশ্বাস আনত। তারা রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিত নজরুলকে। বিতর্ক করত রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে। বলা হতো, নজরুলই তো নোবেল পুরস্কারের যোগ্য ছিলেন। কিন্তু তাঁকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রুদ্ধবাক করে (আরেক ভার্সন, পাগল বানিয়ে) রবীন্দ্রনাথ সেই পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছেন।
এখন এই রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষিত মতলববাজ মানুষ। তারা যেকোনো মূল্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়। এই রবীন্দ্রবিরোধিতার পুরোটাই রাজনৈতিক। আরও সোজা কথায়, এই মতলববাজদের মনের কথা হলো, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কেন একজন ভিন্নধর্মী মানুষকে তাদের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এতটা মূল্য দেবে?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতি শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এই রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারছে। যে কেউ তথ্যের উৎস হিসেবে এমন কিছু ব্যবহার করছে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিষয়টি শুধু রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার চেষ্টা, তা নয়; ভাবনার এ ধরনটির মধ্যে উগ্র ধর্মান্ধতা, পরধর্মবিদ্বেষ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাজের সূত্র ধরে এ প্রসঙ্গগুলো এগোয় না। এগোয় তিনি যা করেননি, তা কেন করেননি, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে।
২. প্রথমেই বলে রাখি, রবীন্দ্রনাথকে পয়গম্বর বানানোর কোনো ইচ্ছে থেকে এই লেখা নয়; কিংবা অন্ধভাবে রবীন্দ্রনাথের সব কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করার ইচ্ছেও আমার নেই। রবীন্দ্র-ভক্ত একটা গোঁড়া সম্প্রদায় আছে, যারা মনে করে, জগতের সব প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথে আছে—আমি সেই দলের নই। আজকের আলোচনায় সেই দিকগুলো আনারও দরকার নেই। একেবারে অপ্রয়োজনীয় একটি বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেছিলেন কি না, তা নিয়ে। আরও একটি বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গানটি ব্রিটিশ রাজের প্রশংসা হিসেবে উল্লেখ করে। এই দুটি বিষয়েই তথ্য-প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে যে দুটি অভিযোগই নির্জলা মিথ্যা।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের নৃশংসতা নিয়েও যেসব গল্পকাহিনি ফাঁদা হয়েছে, সেগুলোও রবীন্দ্রনাথ পাঠেই নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রজাদের সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক বিষয়টি তাঁর লেখাতেই স্পষ্ট হয়ে আছে। নতুন পণ্ডিতদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় কিছু আসে-যায় না।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কে আর এ সময় রবীন্দ্রনাথ পড়তে যায়? তিনি কী লিখেছেন, তাঁর ভাবনার পরিবর্তন, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়া ইত্যাদির নিবিড় পাঠ ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে ইচ্ছে হলেই খারিজ করে দেওয়া যায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে না পড়েই তাঁর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা মানুষে-মানুষে সাংস্কৃতিক বন্ধন মলিন করে দিতে পারে। সেটাই যা চিন্তার।
৩. ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার অধিবাসী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই দেশ ভাঙলেও রবীন্দ্রনাথকে ভাগ করে নেওয়া যাবে না—এই সহজ সত্যটি যে কারণে রাজনীতিবিদেরা মাথায় নিলেন না তা হলো, রবীন্দ্রনাথের ধর্ম পরিচয়। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ যে নিরাকার ঈশ্বরের প্রতি অনুগত ছিলেন, সে কথা বারবার মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলে গেছেন। আরও অনেকেই তখন আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সরকারি প্রচারণার কারণে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতায় কতটা দেশ ও প্রকৃতি মিশে আছে, সে প্রশ্ন মুখ্য না হয়ে মুখ্য হলো, মুসলমান সমাজে রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি। এ বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, তা সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়।
রাষ্ট্রভাষার ওপর আঘাত এলেই কেবল দ্বিধান্বিত বাঙালি সমাজ নিজ সংস্কৃতির প্রতি বিপুলভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ম্লান করে দিয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে চালিকাশক্তি। আর সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাঁচার এক বড় অবলম্বন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। সরকারি পক্ষ নেন অনেক বুদ্ধিজীবী। কিন্তু সরকারি পক্ষ অবলম্বনকারী বুদ্ধিজীবীদের খোঁড়া যুক্তিতে সাধারণ মানুষ আস্থা রাখেনি।
ফলে সে সময় রবীন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিভূরূপে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছিল। ভুললে চলবে না, আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলই ছিলেন মূল সাংস্কৃতিক চালিকাশক্তি। রবীন্দ্রনাথের গান তাই আমাদের জাতীয় সংগীত। নজরুলের গান আমাদের রণসংগীত।
৪. তাহলে হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথকে ‘পরদেশি’ করার কথা ভাবল কারা? একটি দলের কথা তো শুরুতেই উল্লেখ করেছি, যারা ধর্মীয়ভাবে সাহিত্য বা সমাজের বিভাজন চায়। আরেকটি হলো ফুকো-দেরিদা পড়া প্রাজ্ঞ মহাজনের দল। প্রত্যক্ষভাবে তারা রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতাগুলো নিয়ে গল্প ফাঁদে; কিন্তু তাদের পরোক্ষ বা মূল উদ্দেশ্য হলো রবীন্দ্রনাথকে বিতর্কিত করা, রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির মন থেকে সরিয়ে নেওয়া। তৃতীয় আরেকটি দল আছে, যারা নেতিবাচক কোনো স্থূল বাক্য লিখে উসকে দেয় পাঠককে। আর সেই সুযোগে উগ্র মতবাদ ধারণ করা মানুষ তাদের রোষ ঢেলে দিতে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
উদাহরণ দিয়ে আমার মতামত প্রতিষ্ঠিত করব না। কারণ, যারা রবীন্দ্রনাথের পেছনে লেগেছে, তারা এই লেখা পড়বে না কিংবা পড়লেও তারা যুক্তিকে গ্রহণ করবে না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য, অন্ধভাবে রবীন্দ্রবিরোধিতা করা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অপপ্রচারগুলোর জবাব দেওয়াও জরুরি।
কৃষক বা শ্রমিকশ্রেণি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, ধর্ম প্রসঙ্গে তাঁর মতামত, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে তাঁর উপলব্ধি, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করলেই সত্যিকার রবীন্দ্রনাথ উঠে আসবেন। কিন্তু সেই পরিশ্রমটুকু কে করবে? সোশ্যাল মিডিয়ায় অডিও-ভিজ্যুয়াল বয়ানে কিংবা লেখায় যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তাতে প্রলুব্ধ হবেই সাধারণ মানুষ। এই প্রচারণার বিরুদ্ধে সত্য উদ্ঘাটন করাও এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
৫. কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করলে কার লাভ? কেন লাভ?
এখানেই রয়েছে রাজনীতি। বাঙালি মুসলমানকে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো গেলে ‘পেয়ারা পাকিস্তান’ ভাঙার একটা জবাব দেওয়া যাবে, এটা একটা দিক। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যাবে, আমাদের সামাজিক গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যে যেভাবে সালাফি মনোভাব ঢুকে গেছে, তাতে নতুন যুগের মানুষের পক্ষে মানবিক হয়ে কোনো কিছুর সন্ধান লাভ কঠিন হয়ে পড়বে। উগ্র ধর্মান্ধতার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণা যুক্ত হওয়ায় এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন প্রচার পাওয়ায় রবীন্দ্রনাথকে তো প্রশ্নবিদ্ধ করাই গেছে। এরই অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা যাবে সমাজে কোন পরিবর্তনগুলো ঘটানোর চেষ্টা চলছে।
পোশাক-আশাকে, ভাবনায়-চিন্তায় দেশের মাটিকে শ্রদ্ধা না করে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব সমাজে একধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকেই এখন এমন সব প্রশ্ন তুলছেন, যে প্রশ্নগুলোর সঙ্গে সেই সময়কার স্পিরিটের কোনো সংযোগ নেই। ফলে ‘কার লাভ’ প্রশ্নটির একটা উত্তর হয়তো হতে পারে এমন: পরাজিত ধর্মব্যবসায়ীদের লাভ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধিতাকারীদের লাভ।
এ কথা বলার সময় সচেতনভাবেই মনে রাখছি, কোনো জাতীয়তাবাদই দীর্ঘ সময়ের জন্য মুখ্য হয়ে থাকতে পারে না। জাতীয়তাবাদের মধ্যে যে নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠ’ হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা আছে, সেটা ভয়ংকর। একই রকমভাবে নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলার মধ্যেও রয়েছে সেই ভয়ংকর প্রবণতা। এই সংকট মনে রেখেই ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোনো উচিত।
৬. রবীন্দ্রনাথের সব রচনাই এখনকার পাঠককে আকৃষ্ট করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁর বহু কবিতা পড়ে এখন হয়তোবা রস আস্বাদন করা যাবে না। কোনো কোনো রচনা হারিয়েছে তার সময়োপযোগিতা। কিন্তু সমাজ-ভাবনা, রাষ্ট্র-ভাবনা, সমবায়-ভাবনা, ভাষা-ভাবনা ইত্যাদিতে তাঁর যে বক্তব্য আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করলে উঠে আসবেন সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি অবিনশ্বর হয়ে উঠবেন।
হোমার, ভার্জিল, দান্তে, সারভান্তেস, শেক্সপিয়ার, পুশকিনেরও সমালোচনা হয়। সমালোচনা তো হবেই। নদীর স্রোত থাকলেই তো সজীব হয়ে ওঠে আশপাশের প্রান্তর। সে স্রোতেই তো ভাসিয়ে দিতে হয় জলযান। কিন্তু নদীকে অস্বীকার করে জলযান চালানো কি যায়? যে মনীষীদের নাম লিখলাম এইমাত্র, তাঁদেরও সমালোচনা করা হয়, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কড়া কথা বলেন অনেকেই। কিন্তু তা তাঁদের খারিজ করে দিয়ে নয়; কিংবা তাঁরা যা করেননি, কেন করেননি, এ ধরনের বোকা প্রশ্ন উত্থাপন করে নয়। তাঁদের কীর্তির ওপর আস্থা রেখেই তা করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর রচনাগুলো রেখেই গেছেন। সমালোচনা হোক সেই সূত্র ধরেই। অযথা বাগাড়ম্বর তাতে কমবে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বেশ কয়েক বছর ধরেই আমাদের দেশে শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিষোদ্গার। আগে মূলত করত স্বল্পশিক্ষিত ধর্মান্ধ মানুষ। এই ধর্মান্ধ মানুষের প্ররোচনায় সাধারণ মুসলমানেরাও একসময় এসব কুৎসায় বিশ্বাস আনত। তারা রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিত নজরুলকে। বিতর্ক করত রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে। বলা হতো, নজরুলই তো নোবেল পুরস্কারের যোগ্য ছিলেন। কিন্তু তাঁকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রুদ্ধবাক করে (আরেক ভার্সন, পাগল বানিয়ে) রবীন্দ্রনাথ সেই পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছেন।
এখন এই রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষিত মতলববাজ মানুষ। তারা যেকোনো মূল্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়। এই রবীন্দ্রবিরোধিতার পুরোটাই রাজনৈতিক। আরও সোজা কথায়, এই মতলববাজদের মনের কথা হলো, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কেন একজন ভিন্নধর্মী মানুষকে তাদের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এতটা মূল্য দেবে?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতি শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এই রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারছে। যে কেউ তথ্যের উৎস হিসেবে এমন কিছু ব্যবহার করছে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিষয়টি শুধু রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার চেষ্টা, তা নয়; ভাবনার এ ধরনটির মধ্যে উগ্র ধর্মান্ধতা, পরধর্মবিদ্বেষ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাজের সূত্র ধরে এ প্রসঙ্গগুলো এগোয় না। এগোয় তিনি যা করেননি, তা কেন করেননি, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে।
২. প্রথমেই বলে রাখি, রবীন্দ্রনাথকে পয়গম্বর বানানোর কোনো ইচ্ছে থেকে এই লেখা নয়; কিংবা অন্ধভাবে রবীন্দ্রনাথের সব কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করার ইচ্ছেও আমার নেই। রবীন্দ্র-ভক্ত একটা গোঁড়া সম্প্রদায় আছে, যারা মনে করে, জগতের সব প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথে আছে—আমি সেই দলের নই। আজকের আলোচনায় সেই দিকগুলো আনারও দরকার নেই। একেবারে অপ্রয়োজনীয় একটি বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেছিলেন কি না, তা নিয়ে। আরও একটি বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গানটি ব্রিটিশ রাজের প্রশংসা হিসেবে উল্লেখ করে। এই দুটি বিষয়েই তথ্য-প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে যে দুটি অভিযোগই নির্জলা মিথ্যা।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের নৃশংসতা নিয়েও যেসব গল্পকাহিনি ফাঁদা হয়েছে, সেগুলোও রবীন্দ্রনাথ পাঠেই নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রজাদের সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক বিষয়টি তাঁর লেখাতেই স্পষ্ট হয়ে আছে। নতুন পণ্ডিতদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় কিছু আসে-যায় না।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কে আর এ সময় রবীন্দ্রনাথ পড়তে যায়? তিনি কী লিখেছেন, তাঁর ভাবনার পরিবর্তন, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়া ইত্যাদির নিবিড় পাঠ ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে ইচ্ছে হলেই খারিজ করে দেওয়া যায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে না পড়েই তাঁর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা মানুষে-মানুষে সাংস্কৃতিক বন্ধন মলিন করে দিতে পারে। সেটাই যা চিন্তার।
৩. ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার অধিবাসী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই দেশ ভাঙলেও রবীন্দ্রনাথকে ভাগ করে নেওয়া যাবে না—এই সহজ সত্যটি যে কারণে রাজনীতিবিদেরা মাথায় নিলেন না তা হলো, রবীন্দ্রনাথের ধর্ম পরিচয়। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ যে নিরাকার ঈশ্বরের প্রতি অনুগত ছিলেন, সে কথা বারবার মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলে গেছেন। আরও অনেকেই তখন আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সরকারি প্রচারণার কারণে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতায় কতটা দেশ ও প্রকৃতি মিশে আছে, সে প্রশ্ন মুখ্য না হয়ে মুখ্য হলো, মুসলমান সমাজে রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি। এ বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, তা সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়।
রাষ্ট্রভাষার ওপর আঘাত এলেই কেবল দ্বিধান্বিত বাঙালি সমাজ নিজ সংস্কৃতির প্রতি বিপুলভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ম্লান করে দিয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে চালিকাশক্তি। আর সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাঁচার এক বড় অবলম্বন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। সরকারি পক্ষ নেন অনেক বুদ্ধিজীবী। কিন্তু সরকারি পক্ষ অবলম্বনকারী বুদ্ধিজীবীদের খোঁড়া যুক্তিতে সাধারণ মানুষ আস্থা রাখেনি।
ফলে সে সময় রবীন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিভূরূপে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছিল। ভুললে চলবে না, আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলই ছিলেন মূল সাংস্কৃতিক চালিকাশক্তি। রবীন্দ্রনাথের গান তাই আমাদের জাতীয় সংগীত। নজরুলের গান আমাদের রণসংগীত।
৪. তাহলে হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথকে ‘পরদেশি’ করার কথা ভাবল কারা? একটি দলের কথা তো শুরুতেই উল্লেখ করেছি, যারা ধর্মীয়ভাবে সাহিত্য বা সমাজের বিভাজন চায়। আরেকটি হলো ফুকো-দেরিদা পড়া প্রাজ্ঞ মহাজনের দল। প্রত্যক্ষভাবে তারা রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতাগুলো নিয়ে গল্প ফাঁদে; কিন্তু তাদের পরোক্ষ বা মূল উদ্দেশ্য হলো রবীন্দ্রনাথকে বিতর্কিত করা, রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির মন থেকে সরিয়ে নেওয়া। তৃতীয় আরেকটি দল আছে, যারা নেতিবাচক কোনো স্থূল বাক্য লিখে উসকে দেয় পাঠককে। আর সেই সুযোগে উগ্র মতবাদ ধারণ করা মানুষ তাদের রোষ ঢেলে দিতে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
উদাহরণ দিয়ে আমার মতামত প্রতিষ্ঠিত করব না। কারণ, যারা রবীন্দ্রনাথের পেছনে লেগেছে, তারা এই লেখা পড়বে না কিংবা পড়লেও তারা যুক্তিকে গ্রহণ করবে না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য, অন্ধভাবে রবীন্দ্রবিরোধিতা করা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অপপ্রচারগুলোর জবাব দেওয়াও জরুরি।
কৃষক বা শ্রমিকশ্রেণি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, ধর্ম প্রসঙ্গে তাঁর মতামত, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে তাঁর উপলব্ধি, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করলেই সত্যিকার রবীন্দ্রনাথ উঠে আসবেন। কিন্তু সেই পরিশ্রমটুকু কে করবে? সোশ্যাল মিডিয়ায় অডিও-ভিজ্যুয়াল বয়ানে কিংবা লেখায় যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তাতে প্রলুব্ধ হবেই সাধারণ মানুষ। এই প্রচারণার বিরুদ্ধে সত্য উদ্ঘাটন করাও এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
৫. কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করলে কার লাভ? কেন লাভ?
এখানেই রয়েছে রাজনীতি। বাঙালি মুসলমানকে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো গেলে ‘পেয়ারা পাকিস্তান’ ভাঙার একটা জবাব দেওয়া যাবে, এটা একটা দিক। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যাবে, আমাদের সামাজিক গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যে যেভাবে সালাফি মনোভাব ঢুকে গেছে, তাতে নতুন যুগের মানুষের পক্ষে মানবিক হয়ে কোনো কিছুর সন্ধান লাভ কঠিন হয়ে পড়বে। উগ্র ধর্মান্ধতার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণা যুক্ত হওয়ায় এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন প্রচার পাওয়ায় রবীন্দ্রনাথকে তো প্রশ্নবিদ্ধ করাই গেছে। এরই অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা যাবে সমাজে কোন পরিবর্তনগুলো ঘটানোর চেষ্টা চলছে।
পোশাক-আশাকে, ভাবনায়-চিন্তায় দেশের মাটিকে শ্রদ্ধা না করে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব সমাজে একধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকেই এখন এমন সব প্রশ্ন তুলছেন, যে প্রশ্নগুলোর সঙ্গে সেই সময়কার স্পিরিটের কোনো সংযোগ নেই। ফলে ‘কার লাভ’ প্রশ্নটির একটা উত্তর হয়তো হতে পারে এমন: পরাজিত ধর্মব্যবসায়ীদের লাভ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধিতাকারীদের লাভ।
এ কথা বলার সময় সচেতনভাবেই মনে রাখছি, কোনো জাতীয়তাবাদই দীর্ঘ সময়ের জন্য মুখ্য হয়ে থাকতে পারে না। জাতীয়তাবাদের মধ্যে যে নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠ’ হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা আছে, সেটা ভয়ংকর। একই রকমভাবে নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলার মধ্যেও রয়েছে সেই ভয়ংকর প্রবণতা। এই সংকট মনে রেখেই ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোনো উচিত।
৬. রবীন্দ্রনাথের সব রচনাই এখনকার পাঠককে আকৃষ্ট করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁর বহু কবিতা পড়ে এখন হয়তোবা রস আস্বাদন করা যাবে না। কোনো কোনো রচনা হারিয়েছে তার সময়োপযোগিতা। কিন্তু সমাজ-ভাবনা, রাষ্ট্র-ভাবনা, সমবায়-ভাবনা, ভাষা-ভাবনা ইত্যাদিতে তাঁর যে বক্তব্য আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করলে উঠে আসবেন সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি অবিনশ্বর হয়ে উঠবেন।
হোমার, ভার্জিল, দান্তে, সারভান্তেস, শেক্সপিয়ার, পুশকিনেরও সমালোচনা হয়। সমালোচনা তো হবেই। নদীর স্রোত থাকলেই তো সজীব হয়ে ওঠে আশপাশের প্রান্তর। সে স্রোতেই তো ভাসিয়ে দিতে হয় জলযান। কিন্তু নদীকে অস্বীকার করে জলযান চালানো কি যায়? যে মনীষীদের নাম লিখলাম এইমাত্র, তাঁদেরও সমালোচনা করা হয়, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কড়া কথা বলেন অনেকেই। কিন্তু তা তাঁদের খারিজ করে দিয়ে নয়; কিংবা তাঁরা যা করেননি, কেন করেননি, এ ধরনের বোকা প্রশ্ন উত্থাপন করে নয়। তাঁদের কীর্তির ওপর আস্থা রেখেই তা করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর রচনাগুলো রেখেই গেছেন। সমালোচনা হোক সেই সূত্র ধরেই। অযথা বাগাড়ম্বর তাতে কমবে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে