ড. মঞ্জুরে খোদা
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা তৈরি করে। প্রথমত এই অভ্যুত্থান কোনো রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়নি, হয়েছে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এবং অতি অল্প সময়ে। সে কারণে এই সরকারের ওপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগের নৈতিক অধিকার নেই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেনাবাহিনী মৌনতা অবলম্বন করে তাদের সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছে। সুশীল সমাজ, এনজিওপাড়া, বিদেশি সংস্থার পরোক্ষ ভূমিকার কথাও শোনা যায়।
অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারপ্রধান হয়েছেন বিশ্বখ্যাত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, যাঁর দেশ-বিদেশে বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্ব আছে। সুতরাং ব্যক্তি হিসেবেও তিনি কোনো দুর্বল ব্যক্তি নন। তাঁকে কোনো দল ও নেতা-নেত্রীকে সমীহ ও তোয়াজ করে চলতে হবে, এমনটা মনে হয় না।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কী অবস্থা?
দলটির নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পলায়ন করলে দলটির নেতা-কর্মীরাও জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেন, অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান, কেউ কেউ পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন, অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, অনেকে খুনও হন। মোটকথা দলটি এখন অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা ও মার্কিন দেশে থাকা তাঁর ছেলে জয়ের বক্তব্য দলটির নেতা-কর্মীদের যতটা না স্বস্তির কারণ হয়েছে, তারচেয়ে অধিক অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখন সারা দেশে ছাত্র-জনতার ক্রোধ ও প্রতিহিংসার কবলে। তারা এখন ফের কীভাবে রাজনীতিতে সংগঠিত হবে, ঘুরে দাঁড়াবে, তার হয়তো কৌশল ভাবছে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে আজকের অবস্থাটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য শেষ কথা—এমনটা নয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়তো এই অবস্থা শিগগির পাল্টে দিতে পারে। কীভাবে?
ভবিষ্যৎ ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোনো পক্ষ তাদের নিজ স্বার্থে তাদের সঙ্গে কোনো গোপন আঁতাত ও বোঝাপড়ায় আসতে পারে। সেটা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিএনপি কি তাহলে ক্ষমতায় যাচ্ছে?
জুলাই অভ্যুত্থান বিএনপির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্য মাঠটি ফাঁকা হয়ে যায়। সরকার পতনের পরপরই সর্বত্রই পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা জেল থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, সর্বত্র তাঁদের মহড়াও শুরু হয়ে যায়। নেতা-কর্মীদের মধ্যে শাসক দলের ভাবভঙ্গি আমেজ চলে আসে। কোণঠাসা ও নীরব থাকা সমর্থকেরাও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু অজানা বাস্তবতায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমীকরণ কি এতটা সরল ও সহজ হবে তাঁদের জন্য?
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভাষণে অনেক কথা বলেছেন। বিএনপি তাতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তাদের নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ (রূপরেখা) দেবেন। আমরা গণতন্ত্রে উত্তরণের সেই রোডম্যাপ ওনার বক্তব্যের মধ্যে পাইনি। ধোঁয়াশা এখনো পরিষ্কার হয়নি।’ ইতিমধ্যে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ১/১১-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বিএনপি নির্বাচনমুখী একটি দল, এটা কোনো বিপ্লবী বা শক্ত নীতি-আদর্শের সুশৃঙ্খল দল নয়। তাই আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াই এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের ক্ষমতায়ন যত বিলম্ব হবে, সংকট ততই বাড়বে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা নেতা-কর্মীদের তারা কীভাবে, কী বলে নিয়ন্ত্রণ করবে? তাঁরা ইতিমধ্যে দখল, চাঁদাবাজি, মাস্তানি শুরু করে দিয়েছেন। হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে গোপনে-প্রকাশ্যে লেনদেন চলছে। নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি হলে তা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। সেটা নিশ্চয়ই দলটির জন্য সুখকর হবে না। অতএব তাদের দাবি দ্রুত নির্বাচন। বিএনপির নেতা তারেক রহমানও বিদেশ থেকে সে কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যদি নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে অন্য কোনো পথে হাঁটে, তাহলে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করা ছাড়া উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে তাদের মিত্র দরকার। কে হবে সেই মিত্র?
বিএনপি ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে। দলটির ওপর দিয়ে গেছে অনেক বিপর্যয়। একটি বুর্জোয়া দল হিসেবে এখানে নীতিনৈতিকতার বিষয় সামান্যই কাজ করে, ব্যক্তিগত স্বার্থ-সুবিধাই প্রধান। এমতাবস্থায় ক্ষমতার বাইরে যত দিন থাকবে, তত তাদের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে এই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে দখল, চাঁদাবাজি, ক্ষমতাবাজির অভিযোগ আসছে। সেটা নিশ্চয়ই তাদের ইমেজকে উজ্জ্বল করছে না। যদিও মূল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু নেতা-কর্মীরা তার সামান্য অনুসরণ করছেন।
জামায়াত-হেফাজত কি হবে বিএনপির জোটসঙ্গী, না একক শক্তি?
জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে আছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি তা বজায় থাকবে? ইতিমধ্যে ইসলামপন্থী দলগুলোর একটা বৈঠক হয়েছে। সেখানে তারা আলোচনা করেছে যে ইসলামপন্থী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভবিষ্যতে তারাই সরকার গঠন করবে এবং ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। তেমনটা হলে বিএনপির জন্য সেটা স্বস্তিকর নয়। কেননা বিএনপি ও ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একটা ভোট ভাগের হিসাব আছে। তেমনটা হলে সেই অবস্থা কাকে সুবিধা করে দেবে?
জুলাই অভ্যুত্থানের পর জামায়াত বেশ খোশ মেজাজে আছে। তাদের তৎপরতা, কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মতো। নেতৃত্বের বক্তব্যও শোভন ও নেতৃত্বসুলভ। তাঁদের কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাস লক্ষ করা যাচ্ছে। জামায়াতই একমাত্র দল যাদের পরিষ্কার হিসাবে আছে প্রশাসনের কোথায় তাদের কী অবস্থা। এমনকি দল হিসেবেও সুশৃঙ্খল। তারা বাংলাদেশে ইসলামি শাসন কায়েম করতে মরিয়া। তারা এই সময়টা উপযুক্ত মনে করছে তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। অতএব জামায়াত এখন নিজেদেরকে আর কারও জোটসঙ্গী না ভেবে হয়তো একক শক্তির কথা ভাবছে।
জামায়াত-হেফাজত এখনই নির্বাচনের পক্ষে না, তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে চায়। সেই সুযোগে তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থান সংহত ও দলকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চায়।
ইউনূসকে ঘিরে কি তৃতীয় কোনো শক্তির উত্থান ঘটবে?
শোনা যাচ্ছে, প্রফেসর ইউনূসের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হতে পারে। ইতিমধ্যে বিদেশি একটি সংবাদমাধ্যমে ছাত্রদের নতুন দল গঠনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁরা অবশ্য পরে জানিয়েছেন তাঁরা এখনই এমনটা ভাবছেন না। সেটা হলে নির্বাচনের আরেকটি শক্তি মাঠে চলে আসবে, তখন নির্বাচনী লড়াই হবে ৪ থেকে ৫টি ফ্রন্টে। যদি প্রধান দলগুলো এককভাবে নির্বাচন করে তাহলে নির্বাচনের হিসাব হবে হয়তো অন্য রকম।
ইউনূসের পক্ষেও ব্যাপক জনসমর্থন আছে। মানুষ পরিবারকেন্দ্রিক দ্বি-দলীয় ধারার তাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট দেখতে চায় না। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে একজন যোগ্য, শিক্ষিত, স্বীকৃত বিশ্বনন্দিত ব্যক্তির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক শক্তিও তাঁর প্রতি ইতিবাচক।
জনগণই ঠিক করবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রফেসর ইউনূস বলেন, আমাদের ক্ষমতায় থাকা নির্ভর করছে ছাত্র-জনতার ওপর। তিনি বলেছেন, ছাত্ররা আমাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, সুতরাং ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষাকে আমার গুরুত্ব দিতে হবে। তার মানে তাঁর ক্ষমতায় থাকা কি অনির্দিষ্ট নয়? তিনি বলেন, গত সরকারের সময় সব প্রতিষ্ঠান—বিচার, শাসন, আইন, নির্বাচন সব ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলো ঠিক করতে হবে এবং তা করতে সময় লাগবে। সেটা করেই অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরকার বিদায় নেবে। মিডিয়ার সঙ্গে এক আলাপে সাংবাদিক নূরুল কবীর বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে পর্যায়ের সংস্কারের কথা বলছে তা করতে তো প্রায় ২০ বছর সময় লাগবে। তত দিন কি রাজনৈতিক দলগুলো অপেক্ষা করবে? অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকবে? সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ থাকা উচিত। সেটা পরিষ্কার না থাকাই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির আরেক অধ্যায় ও গল্পের শুরু।
প্রথমত, ইউনূস সাহেব কি কোনো ক্ষমতালোভী ব্যক্তি? সেটা হলে সেই সুযোগ তাঁর আগেই ছিল, তিনি নেননি। কিন্তু সেই অবস্থার বাস্তবতা ও মানুষের চাওয়ার ওপর পরিবর্তন হতে পারে না?
তাঁকে ঘিরে যে সুশীল সমাজ, এনজিওপাড়া, ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী, পশ্চিমা শক্তি, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি, ছাত্র শক্তির নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে, তারা সব ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে দৃশ্যমান একটি গুণগত পরিবর্তন আনার অঙ্গীকারের কথা বলছে। তার জন্য তারা ৩ থেকে ৬ বছরের একটা ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল। তার অধিক সময় নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কেমন হতে পারে সেই নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমীকরণ?
এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক।
১. ভবিষ্যতে নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান দাবিদার কি বিএনপি? নির্বাচন কি বিএনপি একা করবে, না জোটগতভাবে?
২. জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো কি নিজেরা আলাদা জোট করে নির্বাচন করবে?
৩. ড. ইউনূসকে ঘিরে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটবে কি না?
৪. আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতিই বলবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে/প্রশ্নে তাদের অবস্থান কী হবে?
৫. ডান-বাম-মধ্য অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দল-জোট অবস্থান কী হবে সেটা খুব বড় বিষয় না হলেও তারাও নির্বাচনে থাকবে।
৬. একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এই সরকার কি সেনা সমর্থিত না ছাত্র সমর্থিত সরকার? ছাত্রদের শক্তির ও সাহসের উৎস তাহলে কী?
৭. আগামী নির্বাচন ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, সমীকরণ ও বোঝাপড়াও গুরুত্বপূর্ণ।
(বাকি অংশ পড়ুন আগামীকাল)
লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা তৈরি করে। প্রথমত এই অভ্যুত্থান কোনো রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়নি, হয়েছে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এবং অতি অল্প সময়ে। সে কারণে এই সরকারের ওপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগের নৈতিক অধিকার নেই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেনাবাহিনী মৌনতা অবলম্বন করে তাদের সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছে। সুশীল সমাজ, এনজিওপাড়া, বিদেশি সংস্থার পরোক্ষ ভূমিকার কথাও শোনা যায়।
অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারপ্রধান হয়েছেন বিশ্বখ্যাত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, যাঁর দেশ-বিদেশে বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্ব আছে। সুতরাং ব্যক্তি হিসেবেও তিনি কোনো দুর্বল ব্যক্তি নন। তাঁকে কোনো দল ও নেতা-নেত্রীকে সমীহ ও তোয়াজ করে চলতে হবে, এমনটা মনে হয় না।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কী অবস্থা?
দলটির নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পলায়ন করলে দলটির নেতা-কর্মীরাও জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেন, অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান, কেউ কেউ পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন, অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, অনেকে খুনও হন। মোটকথা দলটি এখন অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা ও মার্কিন দেশে থাকা তাঁর ছেলে জয়ের বক্তব্য দলটির নেতা-কর্মীদের যতটা না স্বস্তির কারণ হয়েছে, তারচেয়ে অধিক অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখন সারা দেশে ছাত্র-জনতার ক্রোধ ও প্রতিহিংসার কবলে। তারা এখন ফের কীভাবে রাজনীতিতে সংগঠিত হবে, ঘুরে দাঁড়াবে, তার হয়তো কৌশল ভাবছে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে আজকের অবস্থাটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য শেষ কথা—এমনটা নয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়তো এই অবস্থা শিগগির পাল্টে দিতে পারে। কীভাবে?
ভবিষ্যৎ ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোনো পক্ষ তাদের নিজ স্বার্থে তাদের সঙ্গে কোনো গোপন আঁতাত ও বোঝাপড়ায় আসতে পারে। সেটা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিএনপি কি তাহলে ক্ষমতায় যাচ্ছে?
জুলাই অভ্যুত্থান বিএনপির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্য মাঠটি ফাঁকা হয়ে যায়। সরকার পতনের পরপরই সর্বত্রই পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা জেল থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, সর্বত্র তাঁদের মহড়াও শুরু হয়ে যায়। নেতা-কর্মীদের মধ্যে শাসক দলের ভাবভঙ্গি আমেজ চলে আসে। কোণঠাসা ও নীরব থাকা সমর্থকেরাও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু অজানা বাস্তবতায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমীকরণ কি এতটা সরল ও সহজ হবে তাঁদের জন্য?
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভাষণে অনেক কথা বলেছেন। বিএনপি তাতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তাদের নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ (রূপরেখা) দেবেন। আমরা গণতন্ত্রে উত্তরণের সেই রোডম্যাপ ওনার বক্তব্যের মধ্যে পাইনি। ধোঁয়াশা এখনো পরিষ্কার হয়নি।’ ইতিমধ্যে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ১/১১-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বিএনপি নির্বাচনমুখী একটি দল, এটা কোনো বিপ্লবী বা শক্ত নীতি-আদর্শের সুশৃঙ্খল দল নয়। তাই আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াই এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের ক্ষমতায়ন যত বিলম্ব হবে, সংকট ততই বাড়বে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা নেতা-কর্মীদের তারা কীভাবে, কী বলে নিয়ন্ত্রণ করবে? তাঁরা ইতিমধ্যে দখল, চাঁদাবাজি, মাস্তানি শুরু করে দিয়েছেন। হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে গোপনে-প্রকাশ্যে লেনদেন চলছে। নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি হলে তা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। সেটা নিশ্চয়ই দলটির জন্য সুখকর হবে না। অতএব তাদের দাবি দ্রুত নির্বাচন। বিএনপির নেতা তারেক রহমানও বিদেশ থেকে সে কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যদি নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে অন্য কোনো পথে হাঁটে, তাহলে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করা ছাড়া উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে তাদের মিত্র দরকার। কে হবে সেই মিত্র?
বিএনপি ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে। দলটির ওপর দিয়ে গেছে অনেক বিপর্যয়। একটি বুর্জোয়া দল হিসেবে এখানে নীতিনৈতিকতার বিষয় সামান্যই কাজ করে, ব্যক্তিগত স্বার্থ-সুবিধাই প্রধান। এমতাবস্থায় ক্ষমতার বাইরে যত দিন থাকবে, তত তাদের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে এই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে দখল, চাঁদাবাজি, ক্ষমতাবাজির অভিযোগ আসছে। সেটা নিশ্চয়ই তাদের ইমেজকে উজ্জ্বল করছে না। যদিও মূল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু নেতা-কর্মীরা তার সামান্য অনুসরণ করছেন।
জামায়াত-হেফাজত কি হবে বিএনপির জোটসঙ্গী, না একক শক্তি?
জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে আছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি তা বজায় থাকবে? ইতিমধ্যে ইসলামপন্থী দলগুলোর একটা বৈঠক হয়েছে। সেখানে তারা আলোচনা করেছে যে ইসলামপন্থী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভবিষ্যতে তারাই সরকার গঠন করবে এবং ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। তেমনটা হলে বিএনপির জন্য সেটা স্বস্তিকর নয়। কেননা বিএনপি ও ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একটা ভোট ভাগের হিসাব আছে। তেমনটা হলে সেই অবস্থা কাকে সুবিধা করে দেবে?
জুলাই অভ্যুত্থানের পর জামায়াত বেশ খোশ মেজাজে আছে। তাদের তৎপরতা, কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মতো। নেতৃত্বের বক্তব্যও শোভন ও নেতৃত্বসুলভ। তাঁদের কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাস লক্ষ করা যাচ্ছে। জামায়াতই একমাত্র দল যাদের পরিষ্কার হিসাবে আছে প্রশাসনের কোথায় তাদের কী অবস্থা। এমনকি দল হিসেবেও সুশৃঙ্খল। তারা বাংলাদেশে ইসলামি শাসন কায়েম করতে মরিয়া। তারা এই সময়টা উপযুক্ত মনে করছে তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। অতএব জামায়াত এখন নিজেদেরকে আর কারও জোটসঙ্গী না ভেবে হয়তো একক শক্তির কথা ভাবছে।
জামায়াত-হেফাজত এখনই নির্বাচনের পক্ষে না, তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে চায়। সেই সুযোগে তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থান সংহত ও দলকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চায়।
ইউনূসকে ঘিরে কি তৃতীয় কোনো শক্তির উত্থান ঘটবে?
শোনা যাচ্ছে, প্রফেসর ইউনূসের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হতে পারে। ইতিমধ্যে বিদেশি একটি সংবাদমাধ্যমে ছাত্রদের নতুন দল গঠনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁরা অবশ্য পরে জানিয়েছেন তাঁরা এখনই এমনটা ভাবছেন না। সেটা হলে নির্বাচনের আরেকটি শক্তি মাঠে চলে আসবে, তখন নির্বাচনী লড়াই হবে ৪ থেকে ৫টি ফ্রন্টে। যদি প্রধান দলগুলো এককভাবে নির্বাচন করে তাহলে নির্বাচনের হিসাব হবে হয়তো অন্য রকম।
ইউনূসের পক্ষেও ব্যাপক জনসমর্থন আছে। মানুষ পরিবারকেন্দ্রিক দ্বি-দলীয় ধারার তাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট দেখতে চায় না। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে একজন যোগ্য, শিক্ষিত, স্বীকৃত বিশ্বনন্দিত ব্যক্তির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক শক্তিও তাঁর প্রতি ইতিবাচক।
জনগণই ঠিক করবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রফেসর ইউনূস বলেন, আমাদের ক্ষমতায় থাকা নির্ভর করছে ছাত্র-জনতার ওপর। তিনি বলেছেন, ছাত্ররা আমাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, সুতরাং ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষাকে আমার গুরুত্ব দিতে হবে। তার মানে তাঁর ক্ষমতায় থাকা কি অনির্দিষ্ট নয়? তিনি বলেন, গত সরকারের সময় সব প্রতিষ্ঠান—বিচার, শাসন, আইন, নির্বাচন সব ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলো ঠিক করতে হবে এবং তা করতে সময় লাগবে। সেটা করেই অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরকার বিদায় নেবে। মিডিয়ার সঙ্গে এক আলাপে সাংবাদিক নূরুল কবীর বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে পর্যায়ের সংস্কারের কথা বলছে তা করতে তো প্রায় ২০ বছর সময় লাগবে। তত দিন কি রাজনৈতিক দলগুলো অপেক্ষা করবে? অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকবে? সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ থাকা উচিত। সেটা পরিষ্কার না থাকাই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির আরেক অধ্যায় ও গল্পের শুরু।
প্রথমত, ইউনূস সাহেব কি কোনো ক্ষমতালোভী ব্যক্তি? সেটা হলে সেই সুযোগ তাঁর আগেই ছিল, তিনি নেননি। কিন্তু সেই অবস্থার বাস্তবতা ও মানুষের চাওয়ার ওপর পরিবর্তন হতে পারে না?
তাঁকে ঘিরে যে সুশীল সমাজ, এনজিওপাড়া, ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী, পশ্চিমা শক্তি, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি, ছাত্র শক্তির নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে, তারা সব ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে দৃশ্যমান একটি গুণগত পরিবর্তন আনার অঙ্গীকারের কথা বলছে। তার জন্য তারা ৩ থেকে ৬ বছরের একটা ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল। তার অধিক সময় নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কেমন হতে পারে সেই নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমীকরণ?
এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক।
১. ভবিষ্যতে নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান দাবিদার কি বিএনপি? নির্বাচন কি বিএনপি একা করবে, না জোটগতভাবে?
২. জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো কি নিজেরা আলাদা জোট করে নির্বাচন করবে?
৩. ড. ইউনূসকে ঘিরে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটবে কি না?
৪. আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতিই বলবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে/প্রশ্নে তাদের অবস্থান কী হবে?
৫. ডান-বাম-মধ্য অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দল-জোট অবস্থান কী হবে সেটা খুব বড় বিষয় না হলেও তারাও নির্বাচনে থাকবে।
৬. একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এই সরকার কি সেনা সমর্থিত না ছাত্র সমর্থিত সরকার? ছাত্রদের শক্তির ও সাহসের উৎস তাহলে কী?
৭. আগামী নির্বাচন ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, সমীকরণ ও বোঝাপড়াও গুরুত্বপূর্ণ।
(বাকি অংশ পড়ুন আগামীকাল)
লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে