মামুনুর রশীদ
১৪ ডিসেম্বর আমরা ছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে প্রবাসে। প্রবাস থেকেই খবর পেয়েছিলাম আমাদের প্রিয় মানুষ বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির নায়কদের পাকিস্তানের দোসররা তুলে নিয়ে গেছে। তাঁদের কোনো খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের তুলে নিয়ে গেছে, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমাদের খুব নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সুদীর্ঘ সময় ধরে সমাজে তাঁদের অবদান আমরা দেখে এসেছি। তাঁদের শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি। আবার তাঁরা যে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাননি, তার জন্য ক্ষুব্ধও হয়েছি। কারণ এই শহর তখন কোনো অবস্থাতেই কোনো দেশপ্রেমিকের জন্য নিরাপদ ছিল না।
‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতে গিয়ে শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমার তৈরি হয়েছিল। শুধু শহীদুল্লা কায়সার নন, তাঁর পরিবারের সঙ্গেও। প্রায়ই সকাল বেলায় তাঁর কায়েতটুলির বাসায় যেতাম, টেলিভিশনের জন্য ‘সংশপ্তক’-এর নাট্যরূপের পাণ্ডুলিপি নিয়ে। শহীদুল্লা কায়সার তখন সংবাদের অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে সকালের নাশতা করছেন। শিশু পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে তাঁর ভোরবেলার খেলা। কোলে বসিয়ে কাউকে তিনি দুধ খাওয়াচ্ছেন। তিনি স্যুট পরতে ভালোবাসতেন, স্যুট পরেই এই কাজটি করতেন। কোলে বসিয়ে সন্তানদের দুধও খাওয়াতেন। প্রথম প্রথম একটু অবাক লাগত। একজন জেলখাটা কমিউনিস্ট, যিনি তাঁর অসাধারণ শিল্পগুণসমৃদ্ধ ‘সারেং বউ’ বা ‘সংশপ্তক’ লিখেছেন, কী গভীর গ্রামীণ জীবনের আখ্যান রচয়িতা, তিনি স্যুট-প্যান্ট কী করে পরেন! নিজেই ফক্সওয়াগন গাড়ি চালান আবার সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
পরবর্তীকালে আমি যখন ‘ওরা কদম আলী’ নাটক লিখি, বিভিন্ন জায়গায় আমি প্রশ্নের সম্মুখীন হই—কী করে আমিও স্যুট পরি এবং দামি সিগারেট খাই! একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন জবাবে বলেছিলাম, আপনারা একটু চিন্তা করুন আমার নাটকের নাম ‘ওরা কদম আলী’, আমি কিন্তু বলিনি আমরা কদম আলী। আমি তো কদম আলী নই, কদম আলীদের জন্য লিখেছি। কদম আলী হলে আমি লিখতে পারতাম কি? সেই থেকে এতগুলো বছর যে শ্রেণিসংগ্রামের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি, একটা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করে তা কি সম্ভব হতো? পৃথিবীতে আমার নমস্য যাঁরা—ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয়, আন্তন চেখভ, বের্টল্ট ব্রেখট, শেক্সপিয়ার—তাঁরা কি কদম আলী শ্রেণির মানুষ?
যাই হোক, সেই অসাধারণ লেখক শহীদুল্লা কায়সারকে আমরা হারালাম, হারালাম মুনীর চৌধুরীকে, যিনি আধুনিক নাটকের জন্ম দিয়েছিলেন। আরও কিছু অসাধারণ সাংবাদিক, যাঁরা এই পেশাকে বেছে নিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যকে গ্রহণ করেছিলেন। তখনকার দিনে সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক জীবন আজকের দিনে কল্পনাই করা যায় না। যেসব পত্রিকা তখন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিল, তার সাংবাদিকেরা কেউই নিয়মিত বেতন পেতেন না, বেতনকাঠামোও তৈরি হয়নি তখন। মাসের পর মাস অনেক সাংবাদিক বেতন পেতেন না। কিন্তু লেখালেখিতে তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী। ব্যাপারটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল। তারা দেশটাকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের বেছে নিয়েছিল।
আবার যেসব চিকিৎসক গণমানুষের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়, যাঁরা চিকিৎসার জন্য ধনী-গরিব বিবেচনা করতেন না, সামান্য ভিজিট নিয়ে কিংবা না নিয়েই মানুষের চিকিৎসা করতেন, তাঁরাও হানাদারদের টার্গেট হয়ে পড়লেন। কী নিষ্ঠুর বিবেচনা! কিন্তু ওই সব চিকিৎসক ভেবেছিলেন—আমরা তো মানুষের সেবা করি, আমাদের কী অপরাধ? সেই অপরাধটাই পাকিস্তানিদের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল, তাদের হত্যা করল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী। তিনি রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। কত অন্ধজনকে তিনি চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাঁকেও হত্যা করল পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা।
এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করেছিল এ দেশেরই কিছু নরঘাতক পিশাচ। প্রশ্ন জাগে—কেন এ দেশের একধরনের ঘাতককুল তাঁদের হত্যা করল? তাঁদের তো কোনো দল ছিল না, রাজনীতি যতটুকু ছিল, তা মানুষের মুক্তির জন্যই। তারপর জল গড়িয়ে কেটে গেছে বায়ান্ন বছর। কোথাও গিয়ে মিলল না একটি ধারায়। দুটি বড় বিভাজন তৈরি হয়ে গেল। একদিকে দেশপ্রেমিক ধারা, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক ধারা। ওই একাত্তরের শেষ প্রহরে যারা দেশপ্রেমিকদের হত্যা করল, তারা কিন্তু তাদের কৃতকর্মের জন্য কোনো অনুশোচনা করল না, বরং এ দেশে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখল।
এর মধ্যে রাজনীতিতে একটি নতুন উপাদানের সৃষ্টি হলো, তা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে সমাজের সর্বস্তরে প্রবেশ করতে থাকল। আর সেই সঙ্গে একটা ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির সৃষ্টি হলো, যা একেবারেই ছিল কল্পনার বাইরে। যে চিহ্নিত শক্তি একাত্তরজুড়ে, বিশেষ করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করল, তারাই একটা সময়ে শক্তি সঞ্চয় করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলো। পৃথিবীতে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে কোথাও মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি ক্ষমতার অংশীদার হতে পারেনি। এ এক বড় বিস্ময়!
আর মুক্তিযুদ্ধের শক্তি এই পরিস্থিতিতে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে শুরু করল। মানুষ এমন কেন হলো? এটা কি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থতা? কিছুটা তো বটেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের যে সামষ্টিক অংশগ্রহণ, তা বিবেচিত হয়নি। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং তাদের আত্মত্যাগ কোথাও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় বিবেচনা করা হয়নি। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, সেইভাবে নাগরিকদের অবদান স্বীকার করা হয়নি। এটি একটি বড় উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের পরে যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল, একপর্যায়ে তারা দেউলিয়া হয়ে যায়, এটিও মুক্তিযুদ্ধের এক বড় ধরনের পরাজয়। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো অতীতে লাভজনক হলেও তা একসময় দেউলিয়াত্বের মর্যাদা গ্রহণ করে। যে সংস্কৃতি হওয়া উচিত ছিল অসাম্প্রদায়িক, সম্প্রতি তাও মুষ্টিমেয় সংস্কৃতিকর্মীর দ্বারা একটি সংগ্রামী রূপ পাওয়ার পরেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এ এক বড় দুর্ভাগ্য!
বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক কারণে যেসব দাঙ্গা ও অভিবাসন প্রক্রিয়া চলেছে, তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়নি, যার ফলে কখনো কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে। এই বিরূপ ধারণা তৈরি হওয়ার কারণে ধর্মীয় সংস্কৃতির এক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। নারীমুক্তির ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো কাজ করেনি। তাই দেশে বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রক্ষমতা থাকার ফলেও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার তেমন কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে দেখা গেছে এসব ব্যবস্থাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছে। দেশে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী মাদ্রাসা বোর্ড গড়ে উঠেছে। রাজনীতি এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে এই ব্যবস্থাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকেও মেনে নিতে হয়েছে।
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে যেসব রাজনৈতিক দল সাম্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলত, তারাও এই পর্যায়ে এসে সেই সব সংগ্রাম তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাখেনি, যার ফলে তারা অতি সংখ্যালঘু একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। এই জটিল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চর্চা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
যদিও মাঠে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ তেমন কোনো কাজ নেই, কিন্তু ধর্মভিত্তিক কাজ অনেক প্রসারিত। আজ মনে পড়ে—কত রাজনীতিবিদ নিজেকে নিঃস্ব করে কত বড় বড় ঘটনার জন্ম দিয়েছেন, কত বড় বড় কৃষক আন্দোলন করেছেন, সেই সব কৃষক-শ্রমিকের কত বড় বড় আত্মত্যাগ—সব বৃথা হতে চলেছে। আজ ছাত্ররাজনীতি, কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতি—সবকিছু কোন দিকে কী পর্যায়ে গিয়ে অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে! আজ বায়ান্ন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, শুধু ঢাকা শহরে নয়, সারা দেশে বুদ্ধিজীবী নিধন চলছে। মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করছে উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী। যাঁরা সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য, তাঁদেরইবা জায়গা কোথায় হলো? আজ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চর্চা প্রায় অন্তর্নিহিত, বুদ্ধিজীবীরা খণ্ডিত-বিখণ্ডিত। আমরা কি বাংলাদেশে একটি অখণ্ড অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার কথা ভাবতে পারি?
১৪ ডিসেম্বর আমরা ছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে প্রবাসে। প্রবাস থেকেই খবর পেয়েছিলাম আমাদের প্রিয় মানুষ বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির নায়কদের পাকিস্তানের দোসররা তুলে নিয়ে গেছে। তাঁদের কোনো খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের তুলে নিয়ে গেছে, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমাদের খুব নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সুদীর্ঘ সময় ধরে সমাজে তাঁদের অবদান আমরা দেখে এসেছি। তাঁদের শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি। আবার তাঁরা যে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাননি, তার জন্য ক্ষুব্ধও হয়েছি। কারণ এই শহর তখন কোনো অবস্থাতেই কোনো দেশপ্রেমিকের জন্য নিরাপদ ছিল না।
‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতে গিয়ে শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমার তৈরি হয়েছিল। শুধু শহীদুল্লা কায়সার নন, তাঁর পরিবারের সঙ্গেও। প্রায়ই সকাল বেলায় তাঁর কায়েতটুলির বাসায় যেতাম, টেলিভিশনের জন্য ‘সংশপ্তক’-এর নাট্যরূপের পাণ্ডুলিপি নিয়ে। শহীদুল্লা কায়সার তখন সংবাদের অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে সকালের নাশতা করছেন। শিশু পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে তাঁর ভোরবেলার খেলা। কোলে বসিয়ে কাউকে তিনি দুধ খাওয়াচ্ছেন। তিনি স্যুট পরতে ভালোবাসতেন, স্যুট পরেই এই কাজটি করতেন। কোলে বসিয়ে সন্তানদের দুধও খাওয়াতেন। প্রথম প্রথম একটু অবাক লাগত। একজন জেলখাটা কমিউনিস্ট, যিনি তাঁর অসাধারণ শিল্পগুণসমৃদ্ধ ‘সারেং বউ’ বা ‘সংশপ্তক’ লিখেছেন, কী গভীর গ্রামীণ জীবনের আখ্যান রচয়িতা, তিনি স্যুট-প্যান্ট কী করে পরেন! নিজেই ফক্সওয়াগন গাড়ি চালান আবার সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
পরবর্তীকালে আমি যখন ‘ওরা কদম আলী’ নাটক লিখি, বিভিন্ন জায়গায় আমি প্রশ্নের সম্মুখীন হই—কী করে আমিও স্যুট পরি এবং দামি সিগারেট খাই! একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন জবাবে বলেছিলাম, আপনারা একটু চিন্তা করুন আমার নাটকের নাম ‘ওরা কদম আলী’, আমি কিন্তু বলিনি আমরা কদম আলী। আমি তো কদম আলী নই, কদম আলীদের জন্য লিখেছি। কদম আলী হলে আমি লিখতে পারতাম কি? সেই থেকে এতগুলো বছর যে শ্রেণিসংগ্রামের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি, একটা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করে তা কি সম্ভব হতো? পৃথিবীতে আমার নমস্য যাঁরা—ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয়, আন্তন চেখভ, বের্টল্ট ব্রেখট, শেক্সপিয়ার—তাঁরা কি কদম আলী শ্রেণির মানুষ?
যাই হোক, সেই অসাধারণ লেখক শহীদুল্লা কায়সারকে আমরা হারালাম, হারালাম মুনীর চৌধুরীকে, যিনি আধুনিক নাটকের জন্ম দিয়েছিলেন। আরও কিছু অসাধারণ সাংবাদিক, যাঁরা এই পেশাকে বেছে নিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যকে গ্রহণ করেছিলেন। তখনকার দিনে সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক জীবন আজকের দিনে কল্পনাই করা যায় না। যেসব পত্রিকা তখন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিল, তার সাংবাদিকেরা কেউই নিয়মিত বেতন পেতেন না, বেতনকাঠামোও তৈরি হয়নি তখন। মাসের পর মাস অনেক সাংবাদিক বেতন পেতেন না। কিন্তু লেখালেখিতে তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী। ব্যাপারটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল। তারা দেশটাকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের বেছে নিয়েছিল।
আবার যেসব চিকিৎসক গণমানুষের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়, যাঁরা চিকিৎসার জন্য ধনী-গরিব বিবেচনা করতেন না, সামান্য ভিজিট নিয়ে কিংবা না নিয়েই মানুষের চিকিৎসা করতেন, তাঁরাও হানাদারদের টার্গেট হয়ে পড়লেন। কী নিষ্ঠুর বিবেচনা! কিন্তু ওই সব চিকিৎসক ভেবেছিলেন—আমরা তো মানুষের সেবা করি, আমাদের কী অপরাধ? সেই অপরাধটাই পাকিস্তানিদের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল, তাদের হত্যা করল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী। তিনি রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। কত অন্ধজনকে তিনি চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাঁকেও হত্যা করল পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা।
এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করেছিল এ দেশেরই কিছু নরঘাতক পিশাচ। প্রশ্ন জাগে—কেন এ দেশের একধরনের ঘাতককুল তাঁদের হত্যা করল? তাঁদের তো কোনো দল ছিল না, রাজনীতি যতটুকু ছিল, তা মানুষের মুক্তির জন্যই। তারপর জল গড়িয়ে কেটে গেছে বায়ান্ন বছর। কোথাও গিয়ে মিলল না একটি ধারায়। দুটি বড় বিভাজন তৈরি হয়ে গেল। একদিকে দেশপ্রেমিক ধারা, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক ধারা। ওই একাত্তরের শেষ প্রহরে যারা দেশপ্রেমিকদের হত্যা করল, তারা কিন্তু তাদের কৃতকর্মের জন্য কোনো অনুশোচনা করল না, বরং এ দেশে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখল।
এর মধ্যে রাজনীতিতে একটি নতুন উপাদানের সৃষ্টি হলো, তা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে সমাজের সর্বস্তরে প্রবেশ করতে থাকল। আর সেই সঙ্গে একটা ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির সৃষ্টি হলো, যা একেবারেই ছিল কল্পনার বাইরে। যে চিহ্নিত শক্তি একাত্তরজুড়ে, বিশেষ করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করল, তারাই একটা সময়ে শক্তি সঞ্চয় করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলো। পৃথিবীতে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে কোথাও মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি ক্ষমতার অংশীদার হতে পারেনি। এ এক বড় বিস্ময়!
আর মুক্তিযুদ্ধের শক্তি এই পরিস্থিতিতে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে শুরু করল। মানুষ এমন কেন হলো? এটা কি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থতা? কিছুটা তো বটেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের যে সামষ্টিক অংশগ্রহণ, তা বিবেচিত হয়নি। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং তাদের আত্মত্যাগ কোথাও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় বিবেচনা করা হয়নি। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, সেইভাবে নাগরিকদের অবদান স্বীকার করা হয়নি। এটি একটি বড় উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের পরে যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল, একপর্যায়ে তারা দেউলিয়া হয়ে যায়, এটিও মুক্তিযুদ্ধের এক বড় ধরনের পরাজয়। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো অতীতে লাভজনক হলেও তা একসময় দেউলিয়াত্বের মর্যাদা গ্রহণ করে। যে সংস্কৃতি হওয়া উচিত ছিল অসাম্প্রদায়িক, সম্প্রতি তাও মুষ্টিমেয় সংস্কৃতিকর্মীর দ্বারা একটি সংগ্রামী রূপ পাওয়ার পরেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এ এক বড় দুর্ভাগ্য!
বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক কারণে যেসব দাঙ্গা ও অভিবাসন প্রক্রিয়া চলেছে, তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়নি, যার ফলে কখনো কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে। এই বিরূপ ধারণা তৈরি হওয়ার কারণে ধর্মীয় সংস্কৃতির এক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। নারীমুক্তির ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো কাজ করেনি। তাই দেশে বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রক্ষমতা থাকার ফলেও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার তেমন কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে দেখা গেছে এসব ব্যবস্থাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছে। দেশে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী মাদ্রাসা বোর্ড গড়ে উঠেছে। রাজনীতি এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে এই ব্যবস্থাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকেও মেনে নিতে হয়েছে।
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে যেসব রাজনৈতিক দল সাম্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলত, তারাও এই পর্যায়ে এসে সেই সব সংগ্রাম তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাখেনি, যার ফলে তারা অতি সংখ্যালঘু একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। এই জটিল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চর্চা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
যদিও মাঠে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ তেমন কোনো কাজ নেই, কিন্তু ধর্মভিত্তিক কাজ অনেক প্রসারিত। আজ মনে পড়ে—কত রাজনীতিবিদ নিজেকে নিঃস্ব করে কত বড় বড় ঘটনার জন্ম দিয়েছেন, কত বড় বড় কৃষক আন্দোলন করেছেন, সেই সব কৃষক-শ্রমিকের কত বড় বড় আত্মত্যাগ—সব বৃথা হতে চলেছে। আজ ছাত্ররাজনীতি, কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতি—সবকিছু কোন দিকে কী পর্যায়ে গিয়ে অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে! আজ বায়ান্ন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, শুধু ঢাকা শহরে নয়, সারা দেশে বুদ্ধিজীবী নিধন চলছে। মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করছে উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী। যাঁরা সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য, তাঁদেরইবা জায়গা কোথায় হলো? আজ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চর্চা প্রায় অন্তর্নিহিত, বুদ্ধিজীবীরা খণ্ডিত-বিখণ্ডিত। আমরা কি বাংলাদেশে একটি অখণ্ড অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার কথা ভাবতে পারি?
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে