বিএনপির তফসিলবিরোধী আন্দোলন

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮: ১৬

গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। ২ হাজার ৭৪১ জন প্রার্থী তাঁদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ৪ ডিসেম্বর যাচাই-বাছাই শেষে বৈধতা পেয়েছেন ১ হাজার ৯৬৫ জন প্রার্থী। ৭৩১ জনের মনোনয়নপত্র ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে। এসব আবেদনপত্রের এখন শুনানি চলছে। তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে অবস্থান করছে দেশ। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হবে। আগামী ৭ জানুয়ারি তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তারা ঘোষিত তফসিল বাতিলের দাবি নিয়ে মাঠে আন্দোলন করছে। সপ্তাহে চার দিন হরতাল বা অবরোধ ডাকা হচ্ছে।

কিন্তু এসব হরতাল বা অবরোধ শুরু থেকেই ঢিলেঢালাভাবে পালিত হচ্ছিল। এখন যানবাহন, অফিস-আদালত, দোকানপাট অনেকটাই স্বাভাবিক আছে। তবে বিএনপি গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে মাঠে সক্রিয়ভাবে নেই। অনেক নেতাই কারাগারে, আবার অনেকে আত্মগোপনে আছেন। বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল ও যুবদলের কিছু কিছু ঝটিকা মিছিল হতে দেখা যাচ্ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কিছু কিছু যাত্রীবাহী বাস এবং পণ্য পরিবাহী ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, ট্রেনেও করা হয়েছে। তাতে জনমনে কিছুটা ভীতি আছে।

যাত্রীবাহী বাস কিছুটা পরিহার করা হচ্ছে। এসব অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত অনেককেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সে কারণে বিএনপি হরতাল ও অবরোধে মাঠে খুব একটা সক্রিয় নেই।

প্রেসক্লাব, বিজয়নগর সড়ক, তোপখানা রোডে গণতন্ত্র মঞ্চ এবং অন্যান্য দলের স্বল্পসংখ্যক নেতা-কর্মীকে মিছিল ও বক্তৃতা করতে দেখা যায়। বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অনলাইনে প্রতিদিন আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, তাঁদের চলমান আন্দোলন সফল হবে, নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না, বিএনপি কীভাবে নির্বাচন প্রতিহত করবে।

রাজনীতিসচেতন মানুষ মনে করছে, বিএনপির সঙ্গে যেহেতু জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কিছু ইসলামি রাজনৈতিক দল রয়েছে, তাই এদের সবার সম্মিলিত শক্তি দিয়ে নির্বাচনের আগে আগে নির্বাচন পণ্ড করার জন্য তারা বড় ধরনের কোনো সহিংসতা করতে পারে। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ককটেল বানানোর সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে ধরাও হয়েছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনের আগমুহূর্তে সহিংস হয়ে ওঠার মতো কোনো ঘটনা ঘটতেও পারে।

আবার অনেকে মনে করছেন, ২০১৩-১৪ সালের অগ্নিসন্ত্রাস করার মতো অবস্থা বিএনপি-জামায়াতের এবার নেই। এ সবই অনুমাননির্ভর কথা। বাস্তবে কী হবে না হবে, সেটা কয়েক দিন পরেই দেখা যাবে। তবে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা প্রতিদিন তফসিল বাতিল করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবিও অনেকটাই যেন এখন গণতন্ত্র মঞ্চ এবং আরও কিছু ছোট নামসর্বস্ব দলের নেতাদের মুখ থেকে শুনতে হচ্ছে। তবে সংযোজনের বিষয়টি হচ্ছে, বাম গণতান্ত্রিক মোর্চাকেও প্রায় একই দাবিতে পুরানা পল্টন এলাকায় মিছিল করতে দেখা যায়। সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক মোর্চার জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে একত্রে না হলেও একই কর্মসূচিতে মাঠে নামার বিষয়টি অনেকের কাছেই বেশ বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। যে আন্দোলনে জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে, সেই আন্দোলনের সঙ্গে সিপিবি, বাসদের সহাবস্থান নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবেই অনেকে মনে করছে।

বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো মাঠে নেই। কর্মসূচি পালনের দায়িত্ব নিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ এবং আরও কিছু ডান-বাম নামসর্বস্ব দল। কিন্তু আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, তার ছিটেফোঁটাও নেই। জনগণও ত্যক্তবিরক্ত হয়ে এখন স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা ও কাজকর্ম করছে। তবে টেলিভিশনের টকশোতে মাঠের আন্দোলনকারী ডান-বাম নেতাদের অনেকেই তফসিল বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সরে যাওয়ার দাবি জানিয়েই যাচ্ছেন।

এরই মধ্যে নির্বাচনী ট্রেন এগিয়ে চলেছে। জনগণ ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কেমনভাবে অংশগ্রহণ করবে, তা সেদিনই কেবল বোঝা যাবে। আপাতত প্রতি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো বিভিন্ন দল ও একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ নেই এটা যেমন দাবি করা যাবে না, তেমনি আবার উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সে কথাও বলা ঠিক হবে না।

বিএনপি দাবি করছে, তাদের আন্দোলন সফল হবে। তাদের আশঙ্কা ছিল বিপুলসংখ্যক বড় নেতা দল ছেড়ে চলে যাতে পারেন। ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ছাড়া বড় কোনো নেতা না গেলেও বিএনপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন ত্রিশের অধিক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। সেদিক থেকে বিএনপির জন্য স্বস্তি যে বেশিসংখ্যক নেতা দল ছেড়ে যাননি। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির অবস্থান কতটা সংহত থাকবে তা বলা মুশকিল। বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করবে এমন আশায় অনেকেই বুক বেঁধে ছিলেন। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের হঠকারিতা সবকিছুকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। 

ওই দিন বিএনপি আসলে কী করতে চেয়েছিল, তা দলের সমর্থকদের অনেকেরই অজানা। সেদিন পুলিশ হত্যাকাণ্ড, আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, প্রধান বিচারপতির বাড়ি, বিচারপতিদের লাউঞ্জ আক্রমণ, পুলিশের ৯টি অস্ত্র লুট করে নেওয়া, হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, কথিত জো বাইডেনের উপদেষ্টার আবির্ভাবের রহস্য অনেকের কাছেই নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। সরকার উৎখাতের কোনো পরিকল্পনা থেকেই সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মীদের এভাবে ঢাকায় জড়ো করা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়েও নানা প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। অথচ তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকেই ধরে রেখেছিলেন যে এই আন্দোলন দ্বারা সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব না হলেও সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির কাজটি চূড়ান্ত করেই যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচনে অংশ নিলে সরকার বেশ বেকায়দায়ই পড়ত।

২৮ অক্টোবরের পর থেকে যা কিছু ঘটছে, তার ফলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হবে তা ভবিষ্যৎই কেবল বলতে পারবে। আপাতত নির্বাচন ভন্ডুল করার মতো কোনো বাস্তব অবস্থা বিএনপির সমর্থকেরাও খুব একটা দেখছেন না। কিছু কিছু জায়গায় সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলেও তাতে বড় ধরনের কোনো অর্জন ঘটবে না। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচন কমিশন সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। সরকার কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি দলীয় কর্মীদের দিক থেকে ছাড় দেবে না। সেই অবস্থায় নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর যুগপৎ আন্দোলনকারীদের আন্দোলন ধরে রাখা যাবে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর যেমন বিএনপি-জামায়াত আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেনি, এবারও ৭ জানুয়ারির পর আন্দোলন করার কোনো বাস্তবতা থাকবে না।

তফসিল বাতিলের আন্দোলন সফল হবে না, নির্বাচনও বাতিল হবে না। বিএনপি এ পর্যন্ত যেসব স্বপ্ন নেতা-কর্মীদের দেখিয়েছিল, সেগুলো যেমন বাস্তবে রূপ নেয়নি, তফসিল বাতিলের আন্দোলনও একইভাবে ব্যর্থ হবে। বিএনপির আন্দোলন শুরু থেকেই লক্ষ্য নির্ধারণ ও কৌশল নির্মাণে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে বিবেচনায় নেয়নি। বিএনপি মনে করেছিল, বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিতে পারলে সরকারকে একঘরে করে দেওয়া যাবে। কিন্তু সেটাও পুরোপুরি সফল হয়নি।

সুতরাং তফসিল বাতিলের আন্দোলন অসফল হওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন নিস্তেজ হওয়া ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না। বিএনপির আন্দোলন ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ‘মরা গাঙে’ পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কূলে ওঠার শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। তার পরও বিএনপির রাজনীতি এবং দল নিঃশেষিত হওয়ার নয়। কিন্তু প্রাণবন্ত হওয়ার সুযোগ বিএনপির নেতৃবৃন্দ নিতে পারেননি।

এখানেই দল হিসেবে বিএনপির সামর্থ্যের অভাব—এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন জামায়াতের ওপর ভর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে যে খবর এসেছে, তাতে পেট্রলবোমা, নাশকতা, অগ্নিসংযোগ, থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি, নির্বাচন কেন্দ্র, সরকারি স্থাপনা ইত্যাদিতে আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনকে কতটা কাবু করা যাবে, তা দেখার বিষয়। তবে বিএনপির ভাবমূর্তিতে দেশে ও বিদেশে চিড় ধরার আশঙ্কা রয়েছে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত