পাভেল পার্থ
সিলেট ও সুনামগঞ্জ নদী-জলাভূমির এলাকা। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বহু নদীর নাম আছে। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির (১৯১০) ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে’ বহু নদীর বিবরণ আছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (২০২৩) সর্বশেষ জরিপে জানাচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি নদী আছে সুনামগঞ্জ জেলায়, প্রায় ৯৭টি।
কেবল নদী নয়, বৃহত্তর সিলেটজুড়ে লক্ষাধিক ছড়ার অস্তিত্ব ছিল। এত ছড়া, নালা, হাওর ও নদীর মূল কাজ কী? উজান থেকে ভাটিতে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখা। এই অঞ্চলের মতো এত বেশি পানির আধার দেশে অন্য কোথাও নেই। তাহলে এমন একটি অঞ্চলে পরপর ভোগান্তির বন্যা হচ্ছে কেন? কোনোভাবেই এটি মৌসুমি বন্যা নয়, ‘জলাবদ্ধ বন্যা’।
সিলেট, সুনামগঞ্জ কিংবা বান্দরবানের সাম্প্রতিক জলাবদ্ধ বন্যা পরিস্থিতি বুঝতে হলে ‘বন্যা বিশেষজ্ঞ’ হওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জারি থাকা প্রবল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো বোঝাই যথেষ্ট। পাশাপাশি এই উভয় অঞ্চলের গ্রামীণ নিম্নবর্গ বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, তা বোঝা জরুরি। একই সঙ্গে এসব জনভাষ্য আন্দাজে নিতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে।
২০০৬ সাল থেকে যখন পদ্ধতিগতভাবে উল্লিখিত অঞ্চলে কাজ শুরু করি, তখন থেকেই গ্রামীণ নিম্নবর্গের বহু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুনেছি। প্রাণ ও প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়নকেই বারবার তাঁরা সর্বনাশের মূলে দাঁড় করিয়েছেন। পরিবেশগত ক্ষয়কে নানাভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশে বিদ্যায়তনিক, গণমাধ্যম কিংবা উন্নয়ন পরিসরে সেই সব আলোচনা তখনো কেউ শুরু করেনি। প্রায় ২০ বছর ধরে দেখছি প্রবল উন্নয়নচিন্তাগুলো প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ন প্রসঙ্গকে পাত্তাই দেয়নি।
তবে খুব সম্প্রতি বিদ্যায়তনে ও গণমাধ্যমে নিতান্তই স্বল্পপরিসরে পরিবেশগত ক্ষয়ের প্রসঙ্গ টেনে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার চল শুরু হয়েছে। যদিও কেউ স্বীকার করছেন না এই বিশ্লেষণ বৃহত্তর সিলেটের গ্রামীণ নিম্নবর্গের।
২০২২ কিংবা ২০২৪ সালের সিলেট ও সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ জন্য মূলত প্রাণ-প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দায়ী। নিঃসন্দেহে জলবায়ুসংকটের কারণে একেক সময়ে হওয়া অতিবর্ষণ এই যন্ত্রণাকে আরও জটিল ও দুঃসহ করে তুলছে। কিন্তু সবকিছু জলবায়ুর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের অন্যায় উন্নয়ন-বাহাদুরিকে কোনোভাবেই আড়াল করে ফেলা যাবে না। রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষকে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গত জীবনের আহাজারি আগলে দাঁড়াতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের রক্তক্ষত সারিয়ে তোলার ভেতর দিয়েই কেবল এই জলাবদ্ধ-বন্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। যেকোনো ধরনের ভুয়া সমাধান ভবিষ্যতের যন্ত্রণা ও জটিলতাকে দুঃসহ করে তুলবে।
চলতি আলাপটিতে আমরা আবারও মনে করিয়ে দেব বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যা ঘটছে, যার নিদারুণ আঘাত তৈরি হচ্ছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। উল্লিখিত অঞ্চল দুটি বৃষ্টিপ্রবণ। উত্তর-পূর্ব ভারতের চেরাপুঞ্জি পৃথিবীর সর্বোচ্চ এবং বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। উভয় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বৃষ্টিকে ধারণ করতে জানে, বৃষ্টির পানি সঞ্চয় ও প্রবাহিত করার বাস্তুতন্ত্র এখানে আছে। কিন্তু উভয় অঞ্চলে আদি প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলো ভেঙেচুরে দখল ও দূষিত করা হয়েছে।
অনাবৃষ্টি বা অতিবর্ষণ সবকিছুই এই অঞ্চলের নদীতীরের প্রাণপ্রকৃতি ও জনজীবনকে প্রভাবিত করে। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে আছে, সুনামগঞ্জে বৃষ্টির পরিমাণ অধিক এবং ১৯০৪ সালে সেখানে প্রায় ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। সুনামগঞ্জে বছরে ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের কথা ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারেও আছে।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও সিলেট সীমান্তে অবস্থিত উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ের খাসি ও জৈন্তিয়া পাহাড় ছিল প্রাকৃতিক জঙ্গলে ভরপুর এক বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। বর্ষার ঢল পাহাড়ি বনভূমির ভেতর দিয়ে এক প্রতিবেশীয় স্বরলিপি মেনে গড়িয়ে নামত হাওর ভাটিতে।
হাওরপারের মানুষেরা আন্দাজ করতে পারতেন উজানের পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ার কত সময় বাদে এই ঢল নেমে আসবে ভাটিতে। কিন্তু এখন এসব আন্দাজ করা যাচ্ছে না। মেঘালয় পাহাড় আজ বনশূন্য। বর্তমানে বৃষ্টি হলে তা প্রবাহের কোনো নিয়ম ও গতি না মেনে ছড়া বা নালা দিয়ে প্রবল তোড়ে নামছে হাওর ভাটিতে। তৈরি হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের সংকট এবং তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের একমাত্র ধানের মৌসুম বোরো ধান।
অপরদিকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে জাহাজভাঙা বালুতে তলিয়ে যাচ্ছে বসত, কৃষিজমি ও জলাশয়। কুশিয়ারা, সুরমা, বৌলাই, সারি-গোয়াইন, লালাখাল, কালনী, যাদুকাটা, রক্তি যেসব নদী দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাবে সমুদ্রে, প্রায় আন্তসীমান্ত নদীতেই ভারত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বা বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সিলেটের বৈশিষ্ট্যময় বাস্তুতন্ত্রকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।
পাহাড়-টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। বনভূমি বিনাশ। ছড়া, নালা ও হাওর দখল করে ভরাট। পানিপ্রবাহের রাস্তা মানুষ দখল করেছে বলে আজ বৃষ্টির পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গড়িয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজছে অনবরত। আটকে থাকা বন্দী পানিপ্রবাহের এই যন্ত্রণা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি না। আমাদের কাছে কেবল মানুষের জলাবদ্ধতার কষ্টকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। উজান থেকে ভাটি বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হওয়ার প্রাকৃতিক পথগুলোকে উন্মুক্ত ও দখলমুক্ত রাখলে সিলেট-সুনামগঞ্জ কোনোভাবেই জলাবদ্ধ হবে না।
২০২২ সালে সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ আর সিলেটের ৮০ ভাগ তলিয়ে যায়। বাজার, দোকান, হাসপাতাল, শিক্ষালয় সব কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সিলেটে ১৭ জুন ২০২২ তারিখে ২৮২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন ৩৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় এবং ১৯৫৯ সালের ১৯ জুন ৩৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।
২০২২ সালের জুনে তিন দিনে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ২৪৫৮ মিলিমিটার, যা বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানায়, ১৭ জুন ২০২২ চেরাপুঞ্জিতে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১৯৯৫ সালের পর জুন মাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন চেরাপুঞ্জিতে ১৫৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। একই বছরের ১৫ জুন বৃষ্টি হয়েছিল ৯৩০ মিলিমিটার। ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
চলতি বছর, ২০২৪ সালের ২৯ মে চেরাপুঞ্জিতে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সিলেটের বহু এলাকা এক দিনেই তখন প্লাবিত হয়ে যায়। ৯ জুন সিলেটে কয়েক ঘণ্টায় বৃষ্টি হয় ২২০ মিলিমিটার। ১৩ জুন ৩৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় চেরাপুঞ্জিতে। ঈদুল আজহার সময়ে অবিরাম বৃষ্টি হয় সিলেটে। সিলেটের লালাখালে ৩৩৩, জাফলংয়ে ৩২৭ এবং সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড়ে ১৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে ২০২২ সালের মতোই আবারও জলাবদ্ধ-বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় সিলেট ও সুনামগঞ্জে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য পানি জমে থাকে এবং প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে হাওর ও নদীতে মিশে যায়। কিন্তু এখন পানি সরতে পারছে না। পানি আটকে থাকছে। কারণ পানি প্রবাহের সব পথ ও আধার উন্নয়নের নামে দখল করে রাখা হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের বিন্যাস ও পঞ্জিকা এবং একক সময়ে অতিবর্ষণের মতো প্রবণতাগুলো সম্প্রতি আগের চেয়ে বেড়েছে।
সিলেট-সুনামগঞ্জে ১৭৮৭, ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫, ১৮৯২, ১৯৩১, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৪ সালের বন্যার পাশাপাশি বছর বছর পাহাড়ি ঢলে হাওর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু ২০২২ এবং ২০২৪ সালের জলাবদ্ধ বন্যা আমাদের প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের বার্তা দেয়। এই বার্তা পাঠ না করলে সামনে আরও দুঃসহ জটিল পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
লেখক: প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক
সিলেট ও সুনামগঞ্জ নদী-জলাভূমির এলাকা। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বহু নদীর নাম আছে। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির (১৯১০) ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে’ বহু নদীর বিবরণ আছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (২০২৩) সর্বশেষ জরিপে জানাচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি নদী আছে সুনামগঞ্জ জেলায়, প্রায় ৯৭টি।
কেবল নদী নয়, বৃহত্তর সিলেটজুড়ে লক্ষাধিক ছড়ার অস্তিত্ব ছিল। এত ছড়া, নালা, হাওর ও নদীর মূল কাজ কী? উজান থেকে ভাটিতে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখা। এই অঞ্চলের মতো এত বেশি পানির আধার দেশে অন্য কোথাও নেই। তাহলে এমন একটি অঞ্চলে পরপর ভোগান্তির বন্যা হচ্ছে কেন? কোনোভাবেই এটি মৌসুমি বন্যা নয়, ‘জলাবদ্ধ বন্যা’।
সিলেট, সুনামগঞ্জ কিংবা বান্দরবানের সাম্প্রতিক জলাবদ্ধ বন্যা পরিস্থিতি বুঝতে হলে ‘বন্যা বিশেষজ্ঞ’ হওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জারি থাকা প্রবল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো বোঝাই যথেষ্ট। পাশাপাশি এই উভয় অঞ্চলের গ্রামীণ নিম্নবর্গ বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, তা বোঝা জরুরি। একই সঙ্গে এসব জনভাষ্য আন্দাজে নিতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে।
২০০৬ সাল থেকে যখন পদ্ধতিগতভাবে উল্লিখিত অঞ্চলে কাজ শুরু করি, তখন থেকেই গ্রামীণ নিম্নবর্গের বহু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুনেছি। প্রাণ ও প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়নকেই বারবার তাঁরা সর্বনাশের মূলে দাঁড় করিয়েছেন। পরিবেশগত ক্ষয়কে নানাভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশে বিদ্যায়তনিক, গণমাধ্যম কিংবা উন্নয়ন পরিসরে সেই সব আলোচনা তখনো কেউ শুরু করেনি। প্রায় ২০ বছর ধরে দেখছি প্রবল উন্নয়নচিন্তাগুলো প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ন প্রসঙ্গকে পাত্তাই দেয়নি।
তবে খুব সম্প্রতি বিদ্যায়তনে ও গণমাধ্যমে নিতান্তই স্বল্পপরিসরে পরিবেশগত ক্ষয়ের প্রসঙ্গ টেনে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার চল শুরু হয়েছে। যদিও কেউ স্বীকার করছেন না এই বিশ্লেষণ বৃহত্তর সিলেটের গ্রামীণ নিম্নবর্গের।
২০২২ কিংবা ২০২৪ সালের সিলেট ও সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ জন্য মূলত প্রাণ-প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দায়ী। নিঃসন্দেহে জলবায়ুসংকটের কারণে একেক সময়ে হওয়া অতিবর্ষণ এই যন্ত্রণাকে আরও জটিল ও দুঃসহ করে তুলছে। কিন্তু সবকিছু জলবায়ুর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের অন্যায় উন্নয়ন-বাহাদুরিকে কোনোভাবেই আড়াল করে ফেলা যাবে না। রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষকে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গত জীবনের আহাজারি আগলে দাঁড়াতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের রক্তক্ষত সারিয়ে তোলার ভেতর দিয়েই কেবল এই জলাবদ্ধ-বন্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। যেকোনো ধরনের ভুয়া সমাধান ভবিষ্যতের যন্ত্রণা ও জটিলতাকে দুঃসহ করে তুলবে।
চলতি আলাপটিতে আমরা আবারও মনে করিয়ে দেব বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যা ঘটছে, যার নিদারুণ আঘাত তৈরি হচ্ছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। উল্লিখিত অঞ্চল দুটি বৃষ্টিপ্রবণ। উত্তর-পূর্ব ভারতের চেরাপুঞ্জি পৃথিবীর সর্বোচ্চ এবং বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। উভয় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বৃষ্টিকে ধারণ করতে জানে, বৃষ্টির পানি সঞ্চয় ও প্রবাহিত করার বাস্তুতন্ত্র এখানে আছে। কিন্তু উভয় অঞ্চলে আদি প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলো ভেঙেচুরে দখল ও দূষিত করা হয়েছে।
অনাবৃষ্টি বা অতিবর্ষণ সবকিছুই এই অঞ্চলের নদীতীরের প্রাণপ্রকৃতি ও জনজীবনকে প্রভাবিত করে। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে আছে, সুনামগঞ্জে বৃষ্টির পরিমাণ অধিক এবং ১৯০৪ সালে সেখানে প্রায় ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। সুনামগঞ্জে বছরে ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের কথা ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারেও আছে।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও সিলেট সীমান্তে অবস্থিত উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ের খাসি ও জৈন্তিয়া পাহাড় ছিল প্রাকৃতিক জঙ্গলে ভরপুর এক বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। বর্ষার ঢল পাহাড়ি বনভূমির ভেতর দিয়ে এক প্রতিবেশীয় স্বরলিপি মেনে গড়িয়ে নামত হাওর ভাটিতে।
হাওরপারের মানুষেরা আন্দাজ করতে পারতেন উজানের পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ার কত সময় বাদে এই ঢল নেমে আসবে ভাটিতে। কিন্তু এখন এসব আন্দাজ করা যাচ্ছে না। মেঘালয় পাহাড় আজ বনশূন্য। বর্তমানে বৃষ্টি হলে তা প্রবাহের কোনো নিয়ম ও গতি না মেনে ছড়া বা নালা দিয়ে প্রবল তোড়ে নামছে হাওর ভাটিতে। তৈরি হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের সংকট এবং তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের একমাত্র ধানের মৌসুম বোরো ধান।
অপরদিকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে জাহাজভাঙা বালুতে তলিয়ে যাচ্ছে বসত, কৃষিজমি ও জলাশয়। কুশিয়ারা, সুরমা, বৌলাই, সারি-গোয়াইন, লালাখাল, কালনী, যাদুকাটা, রক্তি যেসব নদী দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাবে সমুদ্রে, প্রায় আন্তসীমান্ত নদীতেই ভারত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বা বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সিলেটের বৈশিষ্ট্যময় বাস্তুতন্ত্রকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।
পাহাড়-টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। বনভূমি বিনাশ। ছড়া, নালা ও হাওর দখল করে ভরাট। পানিপ্রবাহের রাস্তা মানুষ দখল করেছে বলে আজ বৃষ্টির পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গড়িয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজছে অনবরত। আটকে থাকা বন্দী পানিপ্রবাহের এই যন্ত্রণা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি না। আমাদের কাছে কেবল মানুষের জলাবদ্ধতার কষ্টকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। উজান থেকে ভাটি বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হওয়ার প্রাকৃতিক পথগুলোকে উন্মুক্ত ও দখলমুক্ত রাখলে সিলেট-সুনামগঞ্জ কোনোভাবেই জলাবদ্ধ হবে না।
২০২২ সালে সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ আর সিলেটের ৮০ ভাগ তলিয়ে যায়। বাজার, দোকান, হাসপাতাল, শিক্ষালয় সব কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সিলেটে ১৭ জুন ২০২২ তারিখে ২৮২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন ৩৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় এবং ১৯৫৯ সালের ১৯ জুন ৩৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।
২০২২ সালের জুনে তিন দিনে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ২৪৫৮ মিলিমিটার, যা বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানায়, ১৭ জুন ২০২২ চেরাপুঞ্জিতে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১৯৯৫ সালের পর জুন মাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন চেরাপুঞ্জিতে ১৫৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। একই বছরের ১৫ জুন বৃষ্টি হয়েছিল ৯৩০ মিলিমিটার। ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
চলতি বছর, ২০২৪ সালের ২৯ মে চেরাপুঞ্জিতে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সিলেটের বহু এলাকা এক দিনেই তখন প্লাবিত হয়ে যায়। ৯ জুন সিলেটে কয়েক ঘণ্টায় বৃষ্টি হয় ২২০ মিলিমিটার। ১৩ জুন ৩৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় চেরাপুঞ্জিতে। ঈদুল আজহার সময়ে অবিরাম বৃষ্টি হয় সিলেটে। সিলেটের লালাখালে ৩৩৩, জাফলংয়ে ৩২৭ এবং সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড়ে ১৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে ২০২২ সালের মতোই আবারও জলাবদ্ধ-বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় সিলেট ও সুনামগঞ্জে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য পানি জমে থাকে এবং প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে হাওর ও নদীতে মিশে যায়। কিন্তু এখন পানি সরতে পারছে না। পানি আটকে থাকছে। কারণ পানি প্রবাহের সব পথ ও আধার উন্নয়নের নামে দখল করে রাখা হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের বিন্যাস ও পঞ্জিকা এবং একক সময়ে অতিবর্ষণের মতো প্রবণতাগুলো সম্প্রতি আগের চেয়ে বেড়েছে।
সিলেট-সুনামগঞ্জে ১৭৮৭, ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫, ১৮৯২, ১৯৩১, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৪ সালের বন্যার পাশাপাশি বছর বছর পাহাড়ি ঢলে হাওর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু ২০২২ এবং ২০২৪ সালের জলাবদ্ধ বন্যা আমাদের প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের বার্তা দেয়। এই বার্তা পাঠ না করলে সামনে আরও দুঃসহ জটিল পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
লেখক: প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে