মাসুদ রানা
আজকের পত্রিকা: নতুন শিক্ষাক্রমে মুখস্থনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে সূক্ষ্ম চিন্তা এবং সৃজনশীলতা অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে আদৌ কি শিক্ষার্থীরা এসব অর্জন করতে পারবে?
ড. কামরুল হাসান মামুন: শুনতে ভালো শোনায়। কাদের দিয়ে মুখস্থনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসার কথা সরকার ভাবছে? কাদের দিয়ে শিক্ষার্থীদের সূক্ষ্ম চিন্তা এবং সৃজনশীলতা অর্জনের কথা বলা হচ্ছে? এগুলো অর্জনের প্রাথমিক শর্ত হলো আলোকিত এবং মেরুদণ্ডওয়ালা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। তার জন্য শিক্ষকদের বেতন ও সম্মানের মাধ্যমে সমাজে উচ্চাসনে বসানো। অন্য সব ঠিক আছে ধরে নিলেও বর্তমান মানের শিক্ষক, তাঁদের বেতন ও এই মানের সম্মান দিয়ে এসব অর্জনের কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু আদর্শের প্রশ্নে অন্য সবই তো ঠিক নেই। আদর্শটা হলো, আমরা একসময় চাইতাম একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশে চার ধারার শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান। মাদ্রাসা, বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন এবং ইংলিশ মিডিয়াম। একসময় আমি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনু মুহাম্মদসহ আরও অনেকে চাইতাম এত ধারা না রেখে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। বর্তমান সরকার নতুন যে শিক্ষাক্রম করল, এটা কিন্তু বিএনপিও করতে চেয়েছিল। আমরা সেই সময় প্রতিবাদ করায় তারা সেটা করতে পারেনি। কিন্তু এই সরকার করতে পেরেছে। কারণ, যারা বাধা দিয়েছিল, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের চিন্তার লোক বলে প্রতিবাদ হয়নি। কে করছে তার ওপর নির্ভর করে আমরা প্রতিবাদ করব, না করব না। এটাই হলো আমার একটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
এই একমুখী শিক্ষার নামে বর্তমান সরকার বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাকে এক করে ফেলেছে। এভাবে এক করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আর তা যদি করতেই হয়, যেমন ইংলিশ মিডিয়ামে যেভাবে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাকে বাদ দিয়ে সব বিষয় ওপেন করে দেওয়া হয়েছে। যার যে বিষয় পছন্দের সে তার ইচ্ছেমতো তা নেবে। এখন কী করা হলো বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায়কে একত্র করা হলো। যে শিক্ষার্থী গণিতের ভয়ে মানবিক বিভাগে যেত, সে কিন্তু বিপদে পড়ে যাবে। এতে সবাই একটু করে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা পড়বে। তার বিনিময়ে যারা একসময় বিজ্ঞান পড়ত, তাদের একটা বিশেষ বিষয় ছিল উচ্চতর গণিত। এটাকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান আগে যতটুকু পড়তে হতো তার চেয়ে কম পড়তে হবে। তার কারণ হলো, যারা মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, তাদের জ্ঞানোপযোগী বিজ্ঞান বই তৈরি করা হয়েছে। একদিক থেকে কিছু নামালাম আর অন্যদিকে কিছু উঠালাম। উঠিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এলাম; মানে জোর করে সবাইকে সব বিষয়ে পড়াতে বাধ্য করা হলো।
বৈচিত্র্যের কারণেই পৃথিবীটা সুন্দর। চারুকলা, সংগীত যেমন প্রয়োজন, তেমনি সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও বিজ্ঞান প্রয়োজন। কোনো বিষয়ই গুরুত্বহীন নয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ভালো থাকি’ নামে একটা বিষয় যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে; মানে উদ্দেশ্যটা হলো এসএসসি পাস করার পর যেন আমি কিছু কাজ করে খেতে পারি। তাৎক্ষণিক কিছু করতে পারার জন্য মাধ্যমটির নাম কারিগরিবিদ্যা হওয়ার কথা ছিল।
পৃথিবীর সব দেশে প্রবহমান মূল নদীর কিছু শাখানদী থাকে, তেমনি একটি দেশের শিক্ষারও একটা মূল ধারা থাকবে এবং তার কিছু শাখাও থাকবে।
শাখাগুলো হবে কারিগরি, ভোকেশনাল ইত্যাদি। এখানে মূল শিক্ষার ধারাকে কারিগরির পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।
আমার ধারণা, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে আমাদের সরকার এসব কাজ করছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা হলো উন্নত দেশগুলোর বাজারে পরিণত হওয়ার একটা ফর্মুলা। এটা একটা অনুৎপাদনশীল কাজ হবে। এই শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের বইয়ে কিছু কিছু ভালো কনটেন্ট থাকলেও বড় সমস্যা হলো, দার্শনিক সমস্যা।
এই দার্শনিক জায়গাটা যত দিন শুদ্ধ করা হবে না, তত দিন ভালো কিছু আশা করা ঠিক হবে না।
আজকের পত্রিকা: নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। শতভাগ মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। এটা কতটুকু সফল হবে?
ড. কামরুল হাসান: আবারও একই কথা বলতে হবে। পরীক্ষা ছাড়াও আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা অর্জন সম্ভব। কিন্তু তার জন্য এই ব্যবস্থা চালুর আগে কিছু গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের অনুকূলে নয়। নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার আগে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা দরকার ছিল। আমাদের সামাজিক অবস্থায় কোনো উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সন্তানকে কম নম্বর দেওয়ার সাহস কোনো স্কুলের শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের দেশে শিক্ষকদের যে বেতনকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তাতে কোনো শিক্ষকের মেরুদণ্ড শক্ত হতে পারে না।
মেরুদণ্ডহীন শিক্ষক দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মধ্যে যাওয়া মানেই হলো, এটা একটা বিপর্যয় ঘটাবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকেরা যেহেতু কম বেতন পান (প্রাইমারির একজন শিক্ষক বেতন পান ১৩তম গ্রেডে, আর সরকারি অফিসের গাড়ির চালক ১২তম গ্রেডে বেতন পান। তিনি আবার অষ্টম শ্রেণি পাস), সেহেতু কম বেতন দিয়ে মেধাবীদের এ পেশায় আনা সম্ভব নয়। যেহেতু শিক্ষকদের নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেহেতু কোনো শিক্ষার্থী তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে কম নম্বর দেওয়ার হুমকি তিনি দিতে পারেন। আর শিক্ষক নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমাজের ক্ষমতাবান পিতা-মাতার কথা চিন্তা করতে বাধ্য থাকবেন।
এখন নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার আগে যে পরিমাণ হোমওয়ার্ক এবং যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। যেহেতু আগে এসব কাজ করা হয়নি, সেহেতু এর ফলাফল ক্ষতি বয়ে আনবে।
আজকের পত্রিকা: এনসিটিবির একেকটি বইয়ের একাধিক লেখক থাকেন। বই প্রকাশের আগে বিশেষজ্ঞের কাছেও পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয়। এরপরও কীভাবে ভুল থেকে গেল?
ড. কামরুল হাসান: যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকত তারাও পাঠ্যপুস্তক রচনাসহ যেকোনো বিষয়ে কমিটি গঠন করার আগে যোগ্যতার বাইরে আগে দলীয় বিবেচনায় করত। আওয়ামী লীগও একই কাজ করেছে। তাই দলীয় ভিত্তিতে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ থাকবে না। তাঁরা মূলত টাকার কারণে এসবে থাকতে চান। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা ভালো বই লিখবেন, জাতি গঠনে কনট্রিবিউট করবেন, সে বিবেচনা থাকে না। বিবেচনায় থাকে দলের কথা।
এমনটা না হলে পাঠ্যপুস্তকে অসংখ্য ভুল থাকার কথা নয়। আমার ধারণা, শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা এসব কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে যে মোরাল দায়িত্ববোধ থাকার কথা, সেই বোধ নিয়ে তাঁরা কাজটি করেননি। এসব কারণে পাঠ্যপুস্তকে এত ভুল থেকে গেছে।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষামন্ত্রী পাঠ্যবইয়ের ভুল যাঁরা ধরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সাধুবাদ না জানিয়ে এটাকে সরকার হটানোর ইস্যু বলেছেন। এভাবে কথা বলা কতটা যৌক্তিক?
ড. কামরুল হাসান: সব সরকারই মনে করে যেসব সংগঠন, সংস্থা তাদের সমালোচনা করে, তারা এটা করে একটা দুরভিসন্ধি নিয়ে। যেকোনো ধরনের সমালোচনা আসলে আমলে নেওয়া উচিত। সমালোচনা নেওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব দরকার। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেটা আমরা পাইনি। তারা চায় সবাই তাদের তোয়াজ, তোসামোদি করবে। সবাই সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা বন্ধ করে দিয়ে তোয়াজ করলে কি দেশ সামনের দিকে এগোবে?
যাঁরা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সমালোচনা করেছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানানো উচিত ছিল। উল্টো সমালোচনা করে, তাঁদের থামিয়ে দিয়ে কোন পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা হলো।
আমাদের দেহের রক্তের মধ্যে শ্বেতকণিকার কাজ হলো জীবাণু ও রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। একটা সমাজও তাই। সমগ্র জনগণের মধ্য থেকে কিছু মানুষ থাকা উচিত শ্বেতকণিকার মতো। তাঁরা সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। আশঙ্কার কথা, তাঁদের সংখ্যা ক্রমে কমে যাচ্ছে। যখন শ্বেতকণিকার পরিমাণ কমে যায়, তখন দেহে ক্যানসারের সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণে আমাদের সমাজ এখন ক্যানসারে আক্রান্ত।
আজকের পত্রিকা: একটা গ্রহণযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা এবং নির্ভুল পাঠ্যবই প্রণয়নে আপনার পরামর্শ কী?
ড. কামরুল হাসান: স্বাধীনতার পরে কুদরাত-এ-খুদা থেকে এ পর্যন্ত সম্ভবত ১২ কি ১৩টি শিক্ষা কমিশন হয়েছে। যে সরকারের আমলে যে শিক্ষা কমিশন হয়েছে, সেই সরকারই কমিশনের রিপোর্ট মানেনি। এই সরকারের আমলে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মতামত কি বর্তমান শিক্ষাক্রমের সঙ্গে যায়? কমিটি করে, কমিশন গঠন করে যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়, সেটা তালাবদ্ধ করে রেখে দেওয়া হয়। এসব কাজ করেন মূলত আমলারা। আমলারা যখন শিক্ষাবিদ হয়ে যান, তখন যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে আরকি।
আমাদের দেশে চারটি মাধ্যম চালু আছে।
এতে সমাজের মধ্যে প্রচণ্ড বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চবিত্তদের সঙ্গে মাদ্রাসার কোনো সম্পর্কই নেই। সরকারের উচিত, গবেষণা করে দেখা এই বিভাজনটা কীভাবে কমানো যায়। এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা উচিত, যেখানে কীভাবে আমাদের দেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
বর্তমানে যেটা চালু করা হয়েছে, তাতে ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও বেড়ে যাবে এবং ইংরেজি মিডিয়াম আরও বেশি জনপ্রিয় হবে।
শুধু শিক্ষা কমিশন করলেই হবে না, এর সঙ্গে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং তাঁদের সন্তোষজনক বেতন দিতে হবে। যাতে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হন।
সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চালু করলাম ঘোড়ার আগে গাড়ি লাগিয়ে দেওয়ার মতো করে। কারণ, সৃজনশীল শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে আমরা পদ্ধতি চালু করে দিলাম। ফলে সেটা ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাক্রমেও একই ঘটনা ঘটবে। কারণ, শিক্ষকদের এখানে মেরুদণ্ড সোজা রাখার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই এটাও ব্যর্থ হবে।
আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
ড. কামরুল হাসান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: নতুন শিক্ষাক্রমে মুখস্থনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে সূক্ষ্ম চিন্তা এবং সৃজনশীলতা অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে আদৌ কি শিক্ষার্থীরা এসব অর্জন করতে পারবে?
ড. কামরুল হাসান মামুন: শুনতে ভালো শোনায়। কাদের দিয়ে মুখস্থনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসার কথা সরকার ভাবছে? কাদের দিয়ে শিক্ষার্থীদের সূক্ষ্ম চিন্তা এবং সৃজনশীলতা অর্জনের কথা বলা হচ্ছে? এগুলো অর্জনের প্রাথমিক শর্ত হলো আলোকিত এবং মেরুদণ্ডওয়ালা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। তার জন্য শিক্ষকদের বেতন ও সম্মানের মাধ্যমে সমাজে উচ্চাসনে বসানো। অন্য সব ঠিক আছে ধরে নিলেও বর্তমান মানের শিক্ষক, তাঁদের বেতন ও এই মানের সম্মান দিয়ে এসব অর্জনের কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু আদর্শের প্রশ্নে অন্য সবই তো ঠিক নেই। আদর্শটা হলো, আমরা একসময় চাইতাম একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশে চার ধারার শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান। মাদ্রাসা, বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন এবং ইংলিশ মিডিয়াম। একসময় আমি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনু মুহাম্মদসহ আরও অনেকে চাইতাম এত ধারা না রেখে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। বর্তমান সরকার নতুন যে শিক্ষাক্রম করল, এটা কিন্তু বিএনপিও করতে চেয়েছিল। আমরা সেই সময় প্রতিবাদ করায় তারা সেটা করতে পারেনি। কিন্তু এই সরকার করতে পেরেছে। কারণ, যারা বাধা দিয়েছিল, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের চিন্তার লোক বলে প্রতিবাদ হয়নি। কে করছে তার ওপর নির্ভর করে আমরা প্রতিবাদ করব, না করব না। এটাই হলো আমার একটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
এই একমুখী শিক্ষার নামে বর্তমান সরকার বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাকে এক করে ফেলেছে। এভাবে এক করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আর তা যদি করতেই হয়, যেমন ইংলিশ মিডিয়ামে যেভাবে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাকে বাদ দিয়ে সব বিষয় ওপেন করে দেওয়া হয়েছে। যার যে বিষয় পছন্দের সে তার ইচ্ছেমতো তা নেবে। এখন কী করা হলো বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায়কে একত্র করা হলো। যে শিক্ষার্থী গণিতের ভয়ে মানবিক বিভাগে যেত, সে কিন্তু বিপদে পড়ে যাবে। এতে সবাই একটু করে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা পড়বে। তার বিনিময়ে যারা একসময় বিজ্ঞান পড়ত, তাদের একটা বিশেষ বিষয় ছিল উচ্চতর গণিত। এটাকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান আগে যতটুকু পড়তে হতো তার চেয়ে কম পড়তে হবে। তার কারণ হলো, যারা মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, তাদের জ্ঞানোপযোগী বিজ্ঞান বই তৈরি করা হয়েছে। একদিক থেকে কিছু নামালাম আর অন্যদিকে কিছু উঠালাম। উঠিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এলাম; মানে জোর করে সবাইকে সব বিষয়ে পড়াতে বাধ্য করা হলো।
বৈচিত্র্যের কারণেই পৃথিবীটা সুন্দর। চারুকলা, সংগীত যেমন প্রয়োজন, তেমনি সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও বিজ্ঞান প্রয়োজন। কোনো বিষয়ই গুরুত্বহীন নয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ভালো থাকি’ নামে একটা বিষয় যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে; মানে উদ্দেশ্যটা হলো এসএসসি পাস করার পর যেন আমি কিছু কাজ করে খেতে পারি। তাৎক্ষণিক কিছু করতে পারার জন্য মাধ্যমটির নাম কারিগরিবিদ্যা হওয়ার কথা ছিল।
পৃথিবীর সব দেশে প্রবহমান মূল নদীর কিছু শাখানদী থাকে, তেমনি একটি দেশের শিক্ষারও একটা মূল ধারা থাকবে এবং তার কিছু শাখাও থাকবে।
শাখাগুলো হবে কারিগরি, ভোকেশনাল ইত্যাদি। এখানে মূল শিক্ষার ধারাকে কারিগরির পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।
আমার ধারণা, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে আমাদের সরকার এসব কাজ করছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা হলো উন্নত দেশগুলোর বাজারে পরিণত হওয়ার একটা ফর্মুলা। এটা একটা অনুৎপাদনশীল কাজ হবে। এই শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের বইয়ে কিছু কিছু ভালো কনটেন্ট থাকলেও বড় সমস্যা হলো, দার্শনিক সমস্যা।
এই দার্শনিক জায়গাটা যত দিন শুদ্ধ করা হবে না, তত দিন ভালো কিছু আশা করা ঠিক হবে না।
আজকের পত্রিকা: নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। শতভাগ মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। এটা কতটুকু সফল হবে?
ড. কামরুল হাসান: আবারও একই কথা বলতে হবে। পরীক্ষা ছাড়াও আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা অর্জন সম্ভব। কিন্তু তার জন্য এই ব্যবস্থা চালুর আগে কিছু গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের অনুকূলে নয়। নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার আগে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা দরকার ছিল। আমাদের সামাজিক অবস্থায় কোনো উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সন্তানকে কম নম্বর দেওয়ার সাহস কোনো স্কুলের শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের দেশে শিক্ষকদের যে বেতনকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তাতে কোনো শিক্ষকের মেরুদণ্ড শক্ত হতে পারে না।
মেরুদণ্ডহীন শিক্ষক দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মধ্যে যাওয়া মানেই হলো, এটা একটা বিপর্যয় ঘটাবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকেরা যেহেতু কম বেতন পান (প্রাইমারির একজন শিক্ষক বেতন পান ১৩তম গ্রেডে, আর সরকারি অফিসের গাড়ির চালক ১২তম গ্রেডে বেতন পান। তিনি আবার অষ্টম শ্রেণি পাস), সেহেতু কম বেতন দিয়ে মেধাবীদের এ পেশায় আনা সম্ভব নয়। যেহেতু শিক্ষকদের নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেহেতু কোনো শিক্ষার্থী তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে কম নম্বর দেওয়ার হুমকি তিনি দিতে পারেন। আর শিক্ষক নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমাজের ক্ষমতাবান পিতা-মাতার কথা চিন্তা করতে বাধ্য থাকবেন।
এখন নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার আগে যে পরিমাণ হোমওয়ার্ক এবং যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। যেহেতু আগে এসব কাজ করা হয়নি, সেহেতু এর ফলাফল ক্ষতি বয়ে আনবে।
আজকের পত্রিকা: এনসিটিবির একেকটি বইয়ের একাধিক লেখক থাকেন। বই প্রকাশের আগে বিশেষজ্ঞের কাছেও পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয়। এরপরও কীভাবে ভুল থেকে গেল?
ড. কামরুল হাসান: যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকত তারাও পাঠ্যপুস্তক রচনাসহ যেকোনো বিষয়ে কমিটি গঠন করার আগে যোগ্যতার বাইরে আগে দলীয় বিবেচনায় করত। আওয়ামী লীগও একই কাজ করেছে। তাই দলীয় ভিত্তিতে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ থাকবে না। তাঁরা মূলত টাকার কারণে এসবে থাকতে চান। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা ভালো বই লিখবেন, জাতি গঠনে কনট্রিবিউট করবেন, সে বিবেচনা থাকে না। বিবেচনায় থাকে দলের কথা।
এমনটা না হলে পাঠ্যপুস্তকে অসংখ্য ভুল থাকার কথা নয়। আমার ধারণা, শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা এসব কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে যে মোরাল দায়িত্ববোধ থাকার কথা, সেই বোধ নিয়ে তাঁরা কাজটি করেননি। এসব কারণে পাঠ্যপুস্তকে এত ভুল থেকে গেছে।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষামন্ত্রী পাঠ্যবইয়ের ভুল যাঁরা ধরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সাধুবাদ না জানিয়ে এটাকে সরকার হটানোর ইস্যু বলেছেন। এভাবে কথা বলা কতটা যৌক্তিক?
ড. কামরুল হাসান: সব সরকারই মনে করে যেসব সংগঠন, সংস্থা তাদের সমালোচনা করে, তারা এটা করে একটা দুরভিসন্ধি নিয়ে। যেকোনো ধরনের সমালোচনা আসলে আমলে নেওয়া উচিত। সমালোচনা নেওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব দরকার। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেটা আমরা পাইনি। তারা চায় সবাই তাদের তোয়াজ, তোসামোদি করবে। সবাই সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা বন্ধ করে দিয়ে তোয়াজ করলে কি দেশ সামনের দিকে এগোবে?
যাঁরা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সমালোচনা করেছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানানো উচিত ছিল। উল্টো সমালোচনা করে, তাঁদের থামিয়ে দিয়ে কোন পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা হলো।
আমাদের দেহের রক্তের মধ্যে শ্বেতকণিকার কাজ হলো জীবাণু ও রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। একটা সমাজও তাই। সমগ্র জনগণের মধ্য থেকে কিছু মানুষ থাকা উচিত শ্বেতকণিকার মতো। তাঁরা সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। আশঙ্কার কথা, তাঁদের সংখ্যা ক্রমে কমে যাচ্ছে। যখন শ্বেতকণিকার পরিমাণ কমে যায়, তখন দেহে ক্যানসারের সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণে আমাদের সমাজ এখন ক্যানসারে আক্রান্ত।
আজকের পত্রিকা: একটা গ্রহণযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা এবং নির্ভুল পাঠ্যবই প্রণয়নে আপনার পরামর্শ কী?
ড. কামরুল হাসান: স্বাধীনতার পরে কুদরাত-এ-খুদা থেকে এ পর্যন্ত সম্ভবত ১২ কি ১৩টি শিক্ষা কমিশন হয়েছে। যে সরকারের আমলে যে শিক্ষা কমিশন হয়েছে, সেই সরকারই কমিশনের রিপোর্ট মানেনি। এই সরকারের আমলে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মতামত কি বর্তমান শিক্ষাক্রমের সঙ্গে যায়? কমিটি করে, কমিশন গঠন করে যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়, সেটা তালাবদ্ধ করে রেখে দেওয়া হয়। এসব কাজ করেন মূলত আমলারা। আমলারা যখন শিক্ষাবিদ হয়ে যান, তখন যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে আরকি।
আমাদের দেশে চারটি মাধ্যম চালু আছে।
এতে সমাজের মধ্যে প্রচণ্ড বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চবিত্তদের সঙ্গে মাদ্রাসার কোনো সম্পর্কই নেই। সরকারের উচিত, গবেষণা করে দেখা এই বিভাজনটা কীভাবে কমানো যায়। এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা উচিত, যেখানে কীভাবে আমাদের দেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
বর্তমানে যেটা চালু করা হয়েছে, তাতে ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও বেড়ে যাবে এবং ইংরেজি মিডিয়াম আরও বেশি জনপ্রিয় হবে।
শুধু শিক্ষা কমিশন করলেই হবে না, এর সঙ্গে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং তাঁদের সন্তোষজনক বেতন দিতে হবে। যাতে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হন।
সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চালু করলাম ঘোড়ার আগে গাড়ি লাগিয়ে দেওয়ার মতো করে। কারণ, সৃজনশীল শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে আমরা পদ্ধতি চালু করে দিলাম। ফলে সেটা ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাক্রমেও একই ঘটনা ঘটবে। কারণ, শিক্ষকদের এখানে মেরুদণ্ড সোজা রাখার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই এটাও ব্যর্থ হবে।
আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
ড. কামরুল হাসান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে