সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বর্তমান পরিস্থিতিতে পয়লা বৈশাখ আমাদের জন্য জরুরি। বাঙালির নতুন বছর বাঙালির জন্য যে নব নব আশা ও সম্ভাবনা বয়ে নিয়ে আসে, তা মোটেই সত্য নয়।অবস্থা বরং ক্রমান্বয়ে খারাপই হচ্ছে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ একটা পথ দেখায়। পথটা হচ্ছে ইহজাগতিকতার এবং তার ভিত্তিতে ঐক্যের। আমাদের অনেক অনুষ্ঠান আছে। কোনোটা রাষ্ট্রীয়, অনেকগুলো সামাজিক। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান সব মানুষকে স্পর্শ করে না।
কেননা, রাষ্ট্র এখনো মানুষের মিত্র হয়নি; কখনো ছিল না, যে জন্য তাকে বদলানোর অনেক চেষ্টা হয়েছে, তবু চরিত্রগতভাবে বদলায়নি, শাসকশ্রেণির করতলগতই রয়ে গেছে এবং তাদের শোষণ-লুণ্ঠনের কাজে ব্যবহারের অস্ত্র হিসেবেই মূলত ব্যবহৃত হচ্ছে। এখনো সামাজিক অনুষ্ঠান নিজ নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেগুলোতে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি আহ্বান নেই। আর পয়লা বৈশাখ হচ্ছে সর্বজনীন। সব ধর্মের, সব শ্রেণির।
নতুন বছর সবার জন্য সমানভাবে আসে না, কিন্তু সবার জন্যই আসে। সেটা ঘটে এই সাধারণ ও সরল কারণে যে, প্রকৃতিই বলে দেয় বৈশাখ এসেছে। পুরাতন বছর বিদায় নিয়েছে। বাংলার ছয়টি ঋতুর মধ্যে গ্রীষ্মই সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ এবং ওই ঋতুতে বৈশাখের তুলনায় জ্যৈষ্ঠের উত্তাপ অধিক; তবু বৈশাখই প্রথম জানায় যে গ্রীষ্ম এসেছে এবং জ্যৈষ্ঠও দূরে নেই।
সব ঋতুই ইহজাগতিক। হতেই হবে। কিন্তু গ্রীষ্ম বোধ করি কিছুটা অতিরিক্ত পরিমাণেই ইহজাগতিক। সে যখন আসে, তখন বঙ্গবাসীর জন্য জগৎ সম্পর্কে উদাসীন হওয়ার সুযোগ নাকচ হয়ে যায়। প্রকৃতি রুষ্ট হয়, আকাশে আমরা মেঘ খুঁজি, আশঙ্কা করি ঝড়ের, মাটির দিকে তাকিয়ে পানির অভাব দেখে হতাশ হই।
বিপন্ন বোধ করি। লক্ষ করি, বর্ষে বর্ষে প্রকৃতির রুক্ষতা বাড়ছে, গ্রীষ্ম ভীষণ থেকে ভীষণতর হচ্ছে। আমরা জানি এর জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়, দায়ী হলো মানুষ।আমরা নিজেরাই তো গাছপালা কেটে সাফ করে ফেলেছি, নদীনালা ভরাট হয়ে গেছে আমাদেরই হস্তক্ষেপে। কিন্তু এও জানা রয়েছে আমাদের যে, এ কাজ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই ঘটে গেছে।
পুঁজিবাদ প্রকৃতির পয়লা নম্বরের শত্রু। সারা বিশ্বে ধরিত্রী তপ্ত হচ্ছে পুঁজিবাদের অনির্বাণ অগ্নিকাণ্ডে। হতেই থাকবে, যদি তাকে প্রতিহত করা না যায়। ওই তাপ এসে লেগেছে আমাদের দেশেও। যে জন্য খরা ও বন্যা দুই বিপরীতের সমান তৎপরতা আমাদের এই হতভাগ্য দেশে। আমরা গাছ কাটি, কারণ জ্বালানি নেই। গাছ বিক্রি করে দিই, কারণ গাছ ভালো পণ্য। নতুন বর্ষ প্রতিবার আসে এবং বলে, তোমরা পুঁজিবাদবিরোধী হও, যদি বাঁচতে চাও। পুঁজিবাদ প্রকৃতির গলা চেপে ধরেছে, তোমাদেরও শেষ করবে।
বাংলার ঋতুগুলো বাংলা ভাষার মতোই সর্বজনীন। কিন্তু আবার সর্বজনীন নয়ও। দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রটিতে সর্বজনীনতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ব্যবস্থায় তা নেই। কেননা, বাস্তবে শ্রেণিবিভাজন আছে এবং সেই বিভাজন মানুষকে এমনভাবে ভাগ করে, যেটা অতিক্রম করা অত্যন্ত কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। ধনী যারা তারা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। ঘামে না; ঘাম ঝরায় গরিব মানুষ, নিরুপায় এবং আশ্রয়হীনভাবে। প্রকৃতির সঙ্গে শত্রুতা ধনী দেশগুলোরই বেশি; বাংলাদেশেও ওই একই ঘটনা, এখানেও ধনীরাই জ্বালানি পোড়ায়, তারাই গাছ কেটে আসবাব বানায় এবং তাদের হস্তক্ষেপেই বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে নানা রকমের বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বাংলাকে প্রধান ভাষা হতে দেয়নি; আর অতীতে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও উৎপাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ভাষার ওপর আঘাত এসেছে বাইরে থেকেও। যে জন্য রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছে। স্পষ্টতই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পয়লা বৈশাখ গভীর আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ। পয়লা বৈশাখ আগের, একুশে ফেব্রুয়ারি পরের। পয়লা বৈশাখ যাতে রক্ষা পায়, তার সর্বজনীনতা, ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা যাতে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রবহমান হয়, সে জন্যই তো একুশের আন্দোলন। বাংলা ভাষা বাঙালির জন্য কেবল পরিচয়ের চিহ্ন নয়, দাঁড়াবার জায়গাও বটে। ওইখানে দাঁড়িয়ে সে বিশ্বায়নের মুখোমুখি হবে এবং আন্তর্জাতিকতার চর্চা করবে। সে তার শক্তিকে বিকশিত করবে, প্রতিহত করবে আগ্রাসনকারীদের ক্ষমতা। পয়লা বৈশাখও নিজস্বতা রক্ষা এবং বিশ্বকে গ্রহণ করার ওই চেষ্টারই অংশ। পয়লা বৈশাখ শ্রেণি ও ধর্মকে মানতে চায় না; সেই মানতে না-চাওয়াকে শক্তিশালী করার জন্যই তো আবশ্যক হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের।
কথা ছিল রাষ্ট্রের অধীনে বাঙালি বিলীন হয়ে যাবে না, বরং বাঙালির অধীনেই রাষ্ট্র থাকবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক। সেটা হয়নি, যে জন্য বাংলা ভাষা অসুবিধায় আছে, পয়লা বৈশাখও ইংরেজি নববর্ষের দাপটে ম্রিয়মাণ রয়েছে। তাদের দুর্দশা যে আমাদের দুর্দশারই স্মারকচিহ্ন, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
পয়লা বৈশাখে মেলা হয়। মেলায় আনন্দ থাকে, সে একটা উৎসব বটে। কিন্তু মেলায় বাণিজ্যও থাকে। একটা আরেকটাকে বাদ দিয়ে নয়। আমাদের সমাজে এখন আনন্দ কমেছে এবং প্রায় সমানতালে ও তেজে বাণিজ্য বেড়ে উঠেছে। বাণিজ্য ধন আনে, সেখানে লক্ষ্মী থাকে, কিন্তু বাণিজ্য যে নিয়ম মানে না এবং সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করে, এটাও একটা নির্মম সত্য। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সেই যে ক্ষোভ—‘বাঙালি কেবল কেরানি হতে জানে, ব্যবসা করতে জানে না’—সেকালে সেটা মোটেই অযথার্থ ছিল না। কেরানি হওয়া সহজ ছিল ব্যবসায়ী হওয়ার তুলনায় এবং বাঙালির পক্ষে শিল্পোদ্যোক্তা হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। এখন ব্যবসা এসেছে, শিল্পায়ন আসেনি। আর যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব দেখা দিয়েছে, যে বিষয়টা নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র ভাবেননি। কেননা, পরাধীন দেশে দেশপ্রেমের বড় রকমের অভাব ঘটবে, এটা প্রত্যাশিত ছিল না; অর্থাৎ, প্রত্যাশিত ছিল এটাই যে, বাণিজ্য থাকবে দেশপ্রেমের অধীনে, যার দরুন দেশের মানুষের বিস্তর উপকার হবে। দেশ এখনো পরাধীন বটে, পুঁজিবাদী বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা স্বাধীন নন। কেননা, তাঁরা উৎপাদন করেন না, বিক্রি করেন মাত্র; এবং মুনাফা ভিন্ন অন্য কিছু বোঝেন না, বুঝতেও চান না।
প্রফুল্লচন্দ্র নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন যে, কেবল দোকানদারি নয়, বাঙালি বহির্বাণিজ্যও করবে। সেটা তার পক্ষে করা খুবই কঠিন ছিল। কেননা, সমুদ্র বাঙালির জন্য খোলা ছিল না। ওই পথেই একদিন ইংরেজ বণিকেরা এসেছিল, এসে দেশ দখল করে নিয়েছিল। ইংরেজ আসার আগেও বহির্বাণিজ্য যে বাঙালির হাতে ছিল তা নয়। বণিকেরা ছিল বিদেশি। সমুদ্রে ছিল জলদস্যুরাও, যারা উৎপাত করত, ভেতরে এসে হানা দিত। সমুদ্র ব্যবহার করতে না পেরে বাঙালি দুর্বল হয়েছে।
যেমন অর্থনৈতিকভাবে, তেমনি সাংস্কৃতিকভাবেও। সামাজিক জীবনের ওপরও ওই না-পারার প্রভাব পড়েছে। বাঙালি আটকা পড়ে গেছে। সে পাহাড়ে ঘেরা, সমুদ্র তার ব্যবহারের বাইরে, শুধু একদিকেই খোলা, যেদিক থেকে পশ্চিমের প্রভাব এসেছে; কিন্তু নিজে সে দক্ষিণে ও পূর্বে ছড়িয়ে যেতে পারেনি।
বাঙালির জন্য এখন সমুদ্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সমুদ্রকে ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানো। দাঁড়াতে পারবে সে তার ভাষাকে ব্যবহার করে। এই ভাষা পারে তাকে দেশপ্রেম এবং ইহজাগতিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রাখতে এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে দেশের দিকে তাকাবে—এটাই বাঞ্ছনীয়। দেশের দিকে তাকানোর দিকটা এখন দেখা যাচ্ছে। সেটাকে বাড়ানো দরকার।
বাঙালির নতুন বছর সত্যি সত্যি নতুন বছর হয়ে প্রতিবছর দেখা দেবে বলে আশা করা যাবে তখনই, যখন বাঙালির গৃহমুখিনতা আরও বাড়বে, ঘরকুনো হওয়ার জন্য নয়, সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিকতার জন্য। যার ঘর নেই, তার আবার বিশ্ব কোথায়? বাঙালির জন্য শক্তিকে বিকশিত করার পথে দিশা রয়েছে পয়লা বৈশাখে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিতে। আলাদা করে নয়, দুটিকে একত্র করে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান পরিস্থিতিতে পয়লা বৈশাখ আমাদের জন্য জরুরি। বাঙালির নতুন বছর বাঙালির জন্য যে নব নব আশা ও সম্ভাবনা বয়ে নিয়ে আসে, তা মোটেই সত্য নয়।অবস্থা বরং ক্রমান্বয়ে খারাপই হচ্ছে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ একটা পথ দেখায়। পথটা হচ্ছে ইহজাগতিকতার এবং তার ভিত্তিতে ঐক্যের। আমাদের অনেক অনুষ্ঠান আছে। কোনোটা রাষ্ট্রীয়, অনেকগুলো সামাজিক। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান সব মানুষকে স্পর্শ করে না।
কেননা, রাষ্ট্র এখনো মানুষের মিত্র হয়নি; কখনো ছিল না, যে জন্য তাকে বদলানোর অনেক চেষ্টা হয়েছে, তবু চরিত্রগতভাবে বদলায়নি, শাসকশ্রেণির করতলগতই রয়ে গেছে এবং তাদের শোষণ-লুণ্ঠনের কাজে ব্যবহারের অস্ত্র হিসেবেই মূলত ব্যবহৃত হচ্ছে। এখনো সামাজিক অনুষ্ঠান নিজ নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেগুলোতে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি আহ্বান নেই। আর পয়লা বৈশাখ হচ্ছে সর্বজনীন। সব ধর্মের, সব শ্রেণির।
নতুন বছর সবার জন্য সমানভাবে আসে না, কিন্তু সবার জন্যই আসে। সেটা ঘটে এই সাধারণ ও সরল কারণে যে, প্রকৃতিই বলে দেয় বৈশাখ এসেছে। পুরাতন বছর বিদায় নিয়েছে। বাংলার ছয়টি ঋতুর মধ্যে গ্রীষ্মই সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ এবং ওই ঋতুতে বৈশাখের তুলনায় জ্যৈষ্ঠের উত্তাপ অধিক; তবু বৈশাখই প্রথম জানায় যে গ্রীষ্ম এসেছে এবং জ্যৈষ্ঠও দূরে নেই।
সব ঋতুই ইহজাগতিক। হতেই হবে। কিন্তু গ্রীষ্ম বোধ করি কিছুটা অতিরিক্ত পরিমাণেই ইহজাগতিক। সে যখন আসে, তখন বঙ্গবাসীর জন্য জগৎ সম্পর্কে উদাসীন হওয়ার সুযোগ নাকচ হয়ে যায়। প্রকৃতি রুষ্ট হয়, আকাশে আমরা মেঘ খুঁজি, আশঙ্কা করি ঝড়ের, মাটির দিকে তাকিয়ে পানির অভাব দেখে হতাশ হই।
বিপন্ন বোধ করি। লক্ষ করি, বর্ষে বর্ষে প্রকৃতির রুক্ষতা বাড়ছে, গ্রীষ্ম ভীষণ থেকে ভীষণতর হচ্ছে। আমরা জানি এর জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়, দায়ী হলো মানুষ।আমরা নিজেরাই তো গাছপালা কেটে সাফ করে ফেলেছি, নদীনালা ভরাট হয়ে গেছে আমাদেরই হস্তক্ষেপে। কিন্তু এও জানা রয়েছে আমাদের যে, এ কাজ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই ঘটে গেছে।
পুঁজিবাদ প্রকৃতির পয়লা নম্বরের শত্রু। সারা বিশ্বে ধরিত্রী তপ্ত হচ্ছে পুঁজিবাদের অনির্বাণ অগ্নিকাণ্ডে। হতেই থাকবে, যদি তাকে প্রতিহত করা না যায়। ওই তাপ এসে লেগেছে আমাদের দেশেও। যে জন্য খরা ও বন্যা দুই বিপরীতের সমান তৎপরতা আমাদের এই হতভাগ্য দেশে। আমরা গাছ কাটি, কারণ জ্বালানি নেই। গাছ বিক্রি করে দিই, কারণ গাছ ভালো পণ্য। নতুন বর্ষ প্রতিবার আসে এবং বলে, তোমরা পুঁজিবাদবিরোধী হও, যদি বাঁচতে চাও। পুঁজিবাদ প্রকৃতির গলা চেপে ধরেছে, তোমাদেরও শেষ করবে।
বাংলার ঋতুগুলো বাংলা ভাষার মতোই সর্বজনীন। কিন্তু আবার সর্বজনীন নয়ও। দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রটিতে সর্বজনীনতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ব্যবস্থায় তা নেই। কেননা, বাস্তবে শ্রেণিবিভাজন আছে এবং সেই বিভাজন মানুষকে এমনভাবে ভাগ করে, যেটা অতিক্রম করা অত্যন্ত কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। ধনী যারা তারা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। ঘামে না; ঘাম ঝরায় গরিব মানুষ, নিরুপায় এবং আশ্রয়হীনভাবে। প্রকৃতির সঙ্গে শত্রুতা ধনী দেশগুলোরই বেশি; বাংলাদেশেও ওই একই ঘটনা, এখানেও ধনীরাই জ্বালানি পোড়ায়, তারাই গাছ কেটে আসবাব বানায় এবং তাদের হস্তক্ষেপেই বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে নানা রকমের বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বাংলাকে প্রধান ভাষা হতে দেয়নি; আর অতীতে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও উৎপাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ভাষার ওপর আঘাত এসেছে বাইরে থেকেও। যে জন্য রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছে। স্পষ্টতই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পয়লা বৈশাখ গভীর আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ। পয়লা বৈশাখ আগের, একুশে ফেব্রুয়ারি পরের। পয়লা বৈশাখ যাতে রক্ষা পায়, তার সর্বজনীনতা, ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা যাতে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রবহমান হয়, সে জন্যই তো একুশের আন্দোলন। বাংলা ভাষা বাঙালির জন্য কেবল পরিচয়ের চিহ্ন নয়, দাঁড়াবার জায়গাও বটে। ওইখানে দাঁড়িয়ে সে বিশ্বায়নের মুখোমুখি হবে এবং আন্তর্জাতিকতার চর্চা করবে। সে তার শক্তিকে বিকশিত করবে, প্রতিহত করবে আগ্রাসনকারীদের ক্ষমতা। পয়লা বৈশাখও নিজস্বতা রক্ষা এবং বিশ্বকে গ্রহণ করার ওই চেষ্টারই অংশ। পয়লা বৈশাখ শ্রেণি ও ধর্মকে মানতে চায় না; সেই মানতে না-চাওয়াকে শক্তিশালী করার জন্যই তো আবশ্যক হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের।
কথা ছিল রাষ্ট্রের অধীনে বাঙালি বিলীন হয়ে যাবে না, বরং বাঙালির অধীনেই রাষ্ট্র থাকবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক। সেটা হয়নি, যে জন্য বাংলা ভাষা অসুবিধায় আছে, পয়লা বৈশাখও ইংরেজি নববর্ষের দাপটে ম্রিয়মাণ রয়েছে। তাদের দুর্দশা যে আমাদের দুর্দশারই স্মারকচিহ্ন, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
পয়লা বৈশাখে মেলা হয়। মেলায় আনন্দ থাকে, সে একটা উৎসব বটে। কিন্তু মেলায় বাণিজ্যও থাকে। একটা আরেকটাকে বাদ দিয়ে নয়। আমাদের সমাজে এখন আনন্দ কমেছে এবং প্রায় সমানতালে ও তেজে বাণিজ্য বেড়ে উঠেছে। বাণিজ্য ধন আনে, সেখানে লক্ষ্মী থাকে, কিন্তু বাণিজ্য যে নিয়ম মানে না এবং সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করে, এটাও একটা নির্মম সত্য। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সেই যে ক্ষোভ—‘বাঙালি কেবল কেরানি হতে জানে, ব্যবসা করতে জানে না’—সেকালে সেটা মোটেই অযথার্থ ছিল না। কেরানি হওয়া সহজ ছিল ব্যবসায়ী হওয়ার তুলনায় এবং বাঙালির পক্ষে শিল্পোদ্যোক্তা হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। এখন ব্যবসা এসেছে, শিল্পায়ন আসেনি। আর যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব দেখা দিয়েছে, যে বিষয়টা নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র ভাবেননি। কেননা, পরাধীন দেশে দেশপ্রেমের বড় রকমের অভাব ঘটবে, এটা প্রত্যাশিত ছিল না; অর্থাৎ, প্রত্যাশিত ছিল এটাই যে, বাণিজ্য থাকবে দেশপ্রেমের অধীনে, যার দরুন দেশের মানুষের বিস্তর উপকার হবে। দেশ এখনো পরাধীন বটে, পুঁজিবাদী বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা স্বাধীন নন। কেননা, তাঁরা উৎপাদন করেন না, বিক্রি করেন মাত্র; এবং মুনাফা ভিন্ন অন্য কিছু বোঝেন না, বুঝতেও চান না।
প্রফুল্লচন্দ্র নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন যে, কেবল দোকানদারি নয়, বাঙালি বহির্বাণিজ্যও করবে। সেটা তার পক্ষে করা খুবই কঠিন ছিল। কেননা, সমুদ্র বাঙালির জন্য খোলা ছিল না। ওই পথেই একদিন ইংরেজ বণিকেরা এসেছিল, এসে দেশ দখল করে নিয়েছিল। ইংরেজ আসার আগেও বহির্বাণিজ্য যে বাঙালির হাতে ছিল তা নয়। বণিকেরা ছিল বিদেশি। সমুদ্রে ছিল জলদস্যুরাও, যারা উৎপাত করত, ভেতরে এসে হানা দিত। সমুদ্র ব্যবহার করতে না পেরে বাঙালি দুর্বল হয়েছে।
যেমন অর্থনৈতিকভাবে, তেমনি সাংস্কৃতিকভাবেও। সামাজিক জীবনের ওপরও ওই না-পারার প্রভাব পড়েছে। বাঙালি আটকা পড়ে গেছে। সে পাহাড়ে ঘেরা, সমুদ্র তার ব্যবহারের বাইরে, শুধু একদিকেই খোলা, যেদিক থেকে পশ্চিমের প্রভাব এসেছে; কিন্তু নিজে সে দক্ষিণে ও পূর্বে ছড়িয়ে যেতে পারেনি।
বাঙালির জন্য এখন সমুদ্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সমুদ্রকে ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানো। দাঁড়াতে পারবে সে তার ভাষাকে ব্যবহার করে। এই ভাষা পারে তাকে দেশপ্রেম এবং ইহজাগতিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রাখতে এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে দেশের দিকে তাকাবে—এটাই বাঞ্ছনীয়। দেশের দিকে তাকানোর দিকটা এখন দেখা যাচ্ছে। সেটাকে বাড়ানো দরকার।
বাঙালির নতুন বছর সত্যি সত্যি নতুন বছর হয়ে প্রতিবছর দেখা দেবে বলে আশা করা যাবে তখনই, যখন বাঙালির গৃহমুখিনতা আরও বাড়বে, ঘরকুনো হওয়ার জন্য নয়, সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিকতার জন্য। যার ঘর নেই, তার আবার বিশ্ব কোথায়? বাঙালির জন্য শক্তিকে বিকশিত করার পথে দিশা রয়েছে পয়লা বৈশাখে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিতে। আলাদা করে নয়, দুটিকে একত্র করে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে