শাওন মাহমুদ
তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল?
ঘৃণার ছিল?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কার্নিশে কি ধূসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমার যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শহীদের প্রতি
-আসাদ চৌধুরী
ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরে শহীদেরা তাঁদের সবটুকু দিয়ে বাঙালির জাতিগত অর্জন ভাষা, ভূমি, পরিচয়, পতাকা, নাগরিকত্ব, স্বাধীনতার অর্জনগুলো প্রজন্মের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন আগামীর পথযাত্রায়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, স্বাধীনতার স্তম্ভ, স্বাধীনতার মাইলফলক। এই সময়েই আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম পাঠের সঙ্গে পরিচয়, নিজের পরিচয় বহনের জন্য লড়াই করার সাহস সঞ্চয়ের হিসাব শুরু। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন–সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিণতি একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম জাতি, যারা রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার লক্ষ্যে ভাষা রক্ষার লড়াই করে জয়ী হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির হাতে উঠে আসে প্রথম অর্জন, তা হচ্ছে একতা। গণমানুষের মাঝে তীব্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস। এই আন্দোলন ঝড়ের মতো জানান দিয়েছিল যে তারা হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান নয়, সমষ্টিগতভাবে তারা সবাই বাঙালি। যে বাঙালিত্বকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল ভয় পেত। তারা প্রচার করত—বাংলা ভাষা হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের নয়। বাংলা ভাষা ভারতের ভাষা, পাকিস্তানের নয়। দিকে দিকে বাংলা ভাষাকে তালাবদ্ধ করার চেষ্টায় বাধা দেওয়ার জন্য এক এক করে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখক, সুরকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, ছাত্র ও যুব সংগঠন, নারীসহ সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাইলফলক। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীনির্বিশেষে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। এই ঐক্য বাহিত হয়েছিল পরবর্তী সব আন্দোলনে, প্রতিবাদে, রাজপথের মিছিলে, গ্রামগঞ্জের আনাচকানাচে। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানুষ নিজ ভূমি স্বাধীন করার লক্ষ্যে যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পেছনে ছিল সেই একতা।
বিণুনির মতো এর সঙ্গে দ্বিতীয় অর্জন যোগ হয়েছিল, অসাম্প্রদায়িকতা। ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে তৈরি হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠন, যুব সংগঠন, রাজনৈতিক দল। এ সময়ে জাতীয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে তৈরি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শাখার বিস্তার ঘটায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন সংগঠন তাদের সাম্প্রদায়িক নাম বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শে, সংগঠনের নামে পরিবর্তন এনেছিল। সবাই নিজের ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শকে তুলে রেখে একসঙ্গে পথ হাঁটার সেতুবন্ধে আবদ্ধ হয়ে উঠেছিল, আপনা-আপনি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দৃঢ় সম্মিলনে এক স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন সূচিত হয়েছিল। দল-মত-ধর্ম-শ্রেণিনির্বিশেষে বাঙালির ভাবনায় পথ হয়েছিল প্রসারিত।
বাঙালির জন্য তৃতীয় অর্জন ছিল, নিজস্ব সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সে সময় নতুন নতুন প্রচুর সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্ম নিয়েছিল; বিশেষ করে গণসংগীত হয়ে উঠেছিল গণমানুষের প্রতিবাদের ভাষা। সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে শহরে, মফস্বলে তাঁদের প্রতিবাদী অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। গীতিনাট্য, ছায়ানাট্য, মঞ্চনাটকের ব্যাপ্তি প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছিল, প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরি, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন আর ব্যানারে আঁকা হতো প্রতিবাদী স্লোগান। কবিতা, উপন্যাস, গান, নাটক, সাংবাদিকতা, অঙ্কনে সমৃদ্ধ এবং বিকশিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় এসেছিল ঠিক তখনই। সে সময়ে একুশের গান লিখিত এবং সুর রচিত হয়, যা আজ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ একুশে ফেব্রুয়ারিতে একই সুরে সবার কণ্ঠে ভেসে বেড়ায়। একুশ এখন দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে আমাদের মাতৃভাষা রক্ষার লড়াইয়ের বীরত্বগাথা শুনিয়ে যায়।
ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে নীরব অর্জন ঘটেছিল নারী জাগরণে। বাঙালি নারীর স্বকীয়তা ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের শুরুর সময়। ’৪৭ সালের পরপরই দেশজুড়ে নারীরা পড়াশোনা করার জন্য অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। গ্রামগঞ্জে, শহরে, বন্দরে মেয়েদের স্কুল, কলেজে লেখাপড়ার হার বেড়ে যায়। অভিভাবকেরাও তাঁদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধিতে। ১৯৪৭-৫১ মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সংখ্যা ৮০-৮৫ জন, যা তখনকার সময়ে বিশাল অর্জন। এই ছাত্রীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাশাপাশি মিছিলে হেঁটেছেন, পুলিশের বাধা ভেঙে ভাষা আন্দোলনে সরাসরি রাজপথে থেকেছেন। পারিবারিক বা সামাজিক বাধা পেছনে ফেলে ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। এই ছাত্রীরা স্কুল, কলেজে গিয়ে মেয়েদের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় উদ্বুদ্ধ এবং একত্র করতেন। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার হয়েছেন, তারপরও থেমে থাকেননি। ভালোবাসা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতায় পূর্ণ বাঙালি নারীরা ভাষা আন্দোলনেই নিজেদের পরিপূর্ণ উদ্ভাসিত এবং প্রস্ফুটিত করেছেন।
ভাষা আন্দোলনে বাঙালির সর্বোচ্চ এবং শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল স্বকীয়তা। আমরা যে এক অনন্য, অসাধারণ এবং অন্যতম চেতনা বহনকারী জাতি, তার স্পষ্ট অবয়ব আঁকা হয়ে গিয়েছিল সেই বছরগুলোতেই। মাতৃভাষা রক্ষায় আমরা রক্তে ভেসেছি, ভূমি রক্ষায় রক্তঋণে আবদ্ধ হয়েছি সেই ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। স্বকীয়তাকে স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর করার দুর্বার শক্তিতে শোকের পাহাড় পার হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি বারবার। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িক কাঠামোতে বিকশিত হয়েছি স্বকীয়তায়। বাংলাদেশের বিজয় বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের সময়, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ডালপালা মেলে আমাদের ছায়া দেওয়া বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছিল।
স্বাধীন নাগরিক হিসেবে এই স্বাধীন দেশে প্রতিটি রক্তস্নাত অর্জনের শোকে স্পন্দিত হোক হৃদয়ের অহমবোধের স্পন্দন। আরও হাজার কোটি বছর পরও সারা বিশ্বের বিস্ময়, বাংলা ভাষার লড়াই শিহরণ জাগিয়ে তুলুক আগামীর শিরায় শিরায়।
শাওন মাহমুদ
শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল?
ঘৃণার ছিল?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কার্নিশে কি ধূসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমার যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শহীদের প্রতি
-আসাদ চৌধুরী
ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরে শহীদেরা তাঁদের সবটুকু দিয়ে বাঙালির জাতিগত অর্জন ভাষা, ভূমি, পরিচয়, পতাকা, নাগরিকত্ব, স্বাধীনতার অর্জনগুলো প্রজন্মের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন আগামীর পথযাত্রায়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, স্বাধীনতার স্তম্ভ, স্বাধীনতার মাইলফলক। এই সময়েই আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম পাঠের সঙ্গে পরিচয়, নিজের পরিচয় বহনের জন্য লড়াই করার সাহস সঞ্চয়ের হিসাব শুরু। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন–সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিণতি একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম জাতি, যারা রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার লক্ষ্যে ভাষা রক্ষার লড়াই করে জয়ী হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির হাতে উঠে আসে প্রথম অর্জন, তা হচ্ছে একতা। গণমানুষের মাঝে তীব্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস। এই আন্দোলন ঝড়ের মতো জানান দিয়েছিল যে তারা হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান নয়, সমষ্টিগতভাবে তারা সবাই বাঙালি। যে বাঙালিত্বকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল ভয় পেত। তারা প্রচার করত—বাংলা ভাষা হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের নয়। বাংলা ভাষা ভারতের ভাষা, পাকিস্তানের নয়। দিকে দিকে বাংলা ভাষাকে তালাবদ্ধ করার চেষ্টায় বাধা দেওয়ার জন্য এক এক করে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখক, সুরকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, ছাত্র ও যুব সংগঠন, নারীসহ সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাইলফলক। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীনির্বিশেষে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। এই ঐক্য বাহিত হয়েছিল পরবর্তী সব আন্দোলনে, প্রতিবাদে, রাজপথের মিছিলে, গ্রামগঞ্জের আনাচকানাচে। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানুষ নিজ ভূমি স্বাধীন করার লক্ষ্যে যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পেছনে ছিল সেই একতা।
বিণুনির মতো এর সঙ্গে দ্বিতীয় অর্জন যোগ হয়েছিল, অসাম্প্রদায়িকতা। ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে তৈরি হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠন, যুব সংগঠন, রাজনৈতিক দল। এ সময়ে জাতীয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে তৈরি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শাখার বিস্তার ঘটায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন সংগঠন তাদের সাম্প্রদায়িক নাম বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শে, সংগঠনের নামে পরিবর্তন এনেছিল। সবাই নিজের ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শকে তুলে রেখে একসঙ্গে পথ হাঁটার সেতুবন্ধে আবদ্ধ হয়ে উঠেছিল, আপনা-আপনি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দৃঢ় সম্মিলনে এক স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন সূচিত হয়েছিল। দল-মত-ধর্ম-শ্রেণিনির্বিশেষে বাঙালির ভাবনায় পথ হয়েছিল প্রসারিত।
বাঙালির জন্য তৃতীয় অর্জন ছিল, নিজস্ব সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সে সময় নতুন নতুন প্রচুর সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্ম নিয়েছিল; বিশেষ করে গণসংগীত হয়ে উঠেছিল গণমানুষের প্রতিবাদের ভাষা। সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে শহরে, মফস্বলে তাঁদের প্রতিবাদী অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। গীতিনাট্য, ছায়ানাট্য, মঞ্চনাটকের ব্যাপ্তি প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছিল, প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরি, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন আর ব্যানারে আঁকা হতো প্রতিবাদী স্লোগান। কবিতা, উপন্যাস, গান, নাটক, সাংবাদিকতা, অঙ্কনে সমৃদ্ধ এবং বিকশিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় এসেছিল ঠিক তখনই। সে সময়ে একুশের গান লিখিত এবং সুর রচিত হয়, যা আজ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ একুশে ফেব্রুয়ারিতে একই সুরে সবার কণ্ঠে ভেসে বেড়ায়। একুশ এখন দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে আমাদের মাতৃভাষা রক্ষার লড়াইয়ের বীরত্বগাথা শুনিয়ে যায়।
ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে নীরব অর্জন ঘটেছিল নারী জাগরণে। বাঙালি নারীর স্বকীয়তা ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের শুরুর সময়। ’৪৭ সালের পরপরই দেশজুড়ে নারীরা পড়াশোনা করার জন্য অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। গ্রামগঞ্জে, শহরে, বন্দরে মেয়েদের স্কুল, কলেজে লেখাপড়ার হার বেড়ে যায়। অভিভাবকেরাও তাঁদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধিতে। ১৯৪৭-৫১ মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সংখ্যা ৮০-৮৫ জন, যা তখনকার সময়ে বিশাল অর্জন। এই ছাত্রীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাশাপাশি মিছিলে হেঁটেছেন, পুলিশের বাধা ভেঙে ভাষা আন্দোলনে সরাসরি রাজপথে থেকেছেন। পারিবারিক বা সামাজিক বাধা পেছনে ফেলে ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। এই ছাত্রীরা স্কুল, কলেজে গিয়ে মেয়েদের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় উদ্বুদ্ধ এবং একত্র করতেন। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার হয়েছেন, তারপরও থেমে থাকেননি। ভালোবাসা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতায় পূর্ণ বাঙালি নারীরা ভাষা আন্দোলনেই নিজেদের পরিপূর্ণ উদ্ভাসিত এবং প্রস্ফুটিত করেছেন।
ভাষা আন্দোলনে বাঙালির সর্বোচ্চ এবং শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল স্বকীয়তা। আমরা যে এক অনন্য, অসাধারণ এবং অন্যতম চেতনা বহনকারী জাতি, তার স্পষ্ট অবয়ব আঁকা হয়ে গিয়েছিল সেই বছরগুলোতেই। মাতৃভাষা রক্ষায় আমরা রক্তে ভেসেছি, ভূমি রক্ষায় রক্তঋণে আবদ্ধ হয়েছি সেই ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। স্বকীয়তাকে স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর করার দুর্বার শক্তিতে শোকের পাহাড় পার হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি বারবার। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িক কাঠামোতে বিকশিত হয়েছি স্বকীয়তায়। বাংলাদেশের বিজয় বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের সময়, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ডালপালা মেলে আমাদের ছায়া দেওয়া বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছিল।
স্বাধীন নাগরিক হিসেবে এই স্বাধীন দেশে প্রতিটি রক্তস্নাত অর্জনের শোকে স্পন্দিত হোক হৃদয়ের অহমবোধের স্পন্দন। আরও হাজার কোটি বছর পরও সারা বিশ্বের বিস্ময়, বাংলা ভাষার লড়াই শিহরণ জাগিয়ে তুলুক আগামীর শিরায় শিরায়।
শাওন মাহমুদ
শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে