প্রথম শ্রেণির সখ্যে কোটিপতি তৃতীয় শ্রেণির জামাল

সোহেল মারমা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০: ৩৭

তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও চট্টগ্রামের সাবেক দুই জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছের মানুষ ছিলেন মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। এ কারণে তাঁর দাপটও ছিল। থাকেন চট্টগ্রামের মূল শহরে দেড় কোটি টাকার বেশি দামের দুটি অ্যাপার্টমেন্ট একসঙ্গে করে। রয়েছে ব্যবসাও।

ডিসিদের প্রভাব খাটিয়ে তদবির, নিয়োগ, বদলি-বাণিজ্য, জায়গার লিজ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁর দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়ার তালুকদারপাড়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ ফয়েজ আহমদের ছেলে জামাল। ২০০৫ সালে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তিনি চাকরি নেন। শুরুতে বিভিন্ন উপজেলার ভূমি অফিসে চাকরি করেন। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর তিনি জেলা প্রশাসনের ‘নাজির’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পান। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের দুজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, সাবেক দুই ডিসির আমলে জামালের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। নিয়োগ, বদলি-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিভিন্ন উপজেলার তহশিলদারদের পছন্দমতো বদলি বাবদ মোটা অঙ্কের ঘুষও নিতেন।

ওই দুই কর্মকর্তা জানান, সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান এবং সাবেক জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমানের প্রভাব খাটিয়ে জামাল বিভিন্ন অনিয়ম করেন। 

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জামাল তেমন একটা অফিস করছেন না। এলেও কিছু সময় থাকেন। সার্কিট হাউসে একটি রুম নিয়ে সেখান থেকে কয়েক দিন অফিস করেছেন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামালের সাকল্যে বেতন ৩০ হাজার টাকার কিছু বেশি। কিন্তু তাঁর নামে রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ।
গত ২ আগস্ট চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৪-এ জামালের আয়কর রিটার্ন প্রাপ্তি স্বীকারপত্রে দেখা যায়, তিনি আয়কর রিটার্নে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র অর্ধকোটি টাকার সম্পদের তথ্য উল্লেখ করেছেন। তবে বাস্তবে তাঁর সম্পদের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। কেননা গত বছর জামাল ও তাঁর স্ত্রীর পৌনে ১ কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছিল। 

দুদক সূত্রে জানা যায়, গত বছর দুদক জামাল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি অনুসন্ধান শুরু করে। এ জন্য তাঁদের সম্পদ বিবরণী জমা দিতে বলা হয়। পরে জামাল ও তাঁর স্ত্রীর পৌনে ১ কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে জামালের সম্পদের পরিমাণ ৩৭ লাখ টাকা (স্থাবর ১৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ও অস্থাবর ২২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা) ও তাঁর স্ত্রী রুনা আক্তারের প্রায় অর্ধকোটি (স্থাবর ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬০০ ও অস্থাবর ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬০০) টাকার সম্পদ বিবরণীতে দেখানো হয়। 

অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, তাঁর বিষয়ে অনুসন্ধান এখনো চলমান রয়েছে। অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের কোতোয়ালিতে কোর্ট রোডে ‘কেসি দে গ্র্যান্ড ক্যাসেল’ নামে একটি বিলাসবহুল ভবনের চতুর্থ তলায় ফোর-সি ও ফোর-ডি নামে দুটি অ্যাপার্টমেন্টে জামাল তাঁর পরিবার নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে থাকছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৮৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকায় তিনি ওই অ্যাপার্টমেন্ট দুটি (২ হাজার ৬৫ বর্গফুট) আবাসন প্রতিষ্ঠান ডি-ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের কাছ থেকে কেনেন। বর্তমানে এখানকার একটি অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য প্রতি বর্গফুট ৭ হাজার টাকা। সেই অনুযায়ী জামাল উদ্দিনের অ্যাপার্টমেন্ট দুটির বর্তমান বাজারমূল্য দেড় কোটি টাকার বেশি। অ্যাপার্টমেন্ট দেখা, কেনা, বায়নানামা, আর্থিক লেনদেন, চুক্তি, রেজিস্ট্রিসহ সবকিছুতেই শুরু থেকে জামালের উপস্থিতি থাকলেও এটার মালিকানা তিনি ২০২২ সালে কৌশলে শ্বশুরের নামে করিয়েছেন।

এ ছাড়া নগরের কেসি দে রোডে সোসাইটি টাওয়ারে একটি আবাসিক হোটেলের যৌথ মালিকানার ব্যবসা রয়েছে জামালের। ২০১৫ সালে তিনি ওই বিনিয়োগ করেন। হোটেল ব্যবসার চুক্তিনামাপত্রে দেখা যায়, কেসি দে রোডে সোসাইটি টাওয়ারের পঞ্চম তলায় ৫ হাজার ৪০০ বর্গফুটের আবাসিক হোটেলটিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত জামাল তাঁর নিজের নামে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। খুলশী এলাকায় বিটিভি ভবনের ভেতরে ‘লা মেনসা’ নামের একটি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে স্ত্রীর নামে ব্যবসায় বিনিয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে। 

অভিযোগ অস্বীকার করে জামাল বলেন, ‘কেসি দে রোডে আমি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকি। আমি সরকারি চাকরি করি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনব কীভাবে। এ ছাড়া আমার বিরুদ্ধে অনিয়ম, নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকাসহ যা যা অভিযোগ শুনেছেন, সেগুলো কোনোটি সত্য নয়। আমার বিরুদ্ধে যাঁরা এসব বলছেন, তাঁদের আল্লাহ বিচার করবে।’ সার্কিট হাউসে অফিস করার বিষয়টিও সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি। 

এ বিষয়ে নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম আজকের পত্রিকা’কে বলেন, ‘আমি আপনার কাছে তাঁর বিষয়ে এইমাত্র শুনেছি। কদিন হয়েছে, আমি এখানে যোগদান করেছি। কিছুদিন যাক। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’

আরও খবর পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত