ড. মঞ্জুরে খোদা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সেটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক চলমান। সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের আলোকে বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নাগরিকের সংগঠন করার অধিকারের বিষয়টি সামনে এনে বুয়েটে সংগঠন করতে বাধা নেই বলে রায় দিয়েছে। সেটা নিয়ে আপিল পর্যন্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে যখন বিষয়টি অমীমাংসিত, ঠিক সেই সময়েই আমেরিকাসহ বিশ্বের নামকরা শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধ, যুদ্ধবিরতি ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে।
এই যে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন হচ্ছে, তা ছাত্ররাজনীতির কারণেই সংগঠিত হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। ছাত্ররাজনীতি আছে বলেই আজ আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্যায়ের প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের একশ্রেণির শিক্ষিত নাগরিকের কাছ থেকে প্রায়ই শোনা যায় যে, উন্নত দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ছাত্ররাজনীতি নেই, সেখানে ছাত্ররা রাজনীতি করে না ইত্যাদি। তাদের এমন মন্তব্য ও দাবির জবাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা। শুধু দেখিয়ে দিচ্ছেন তা-ই নয়, ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদের মাধ্যমে বুঝিয়েও দিচ্ছে তাঁরা কতটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেন।
বছরের শুরুতে কানাডার বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়েও গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে সপ্তাহকাল ধরে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানকার ছাত্র ইউনিয়ন এই প্রতিবাদের আয়োজন করে। প্রো-প্যালেস্টাইন প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি সম্প্রদায়ের ডোনার ও বিভিন্ন ইহুদি সংগঠন এর প্রতিবাদ করে এবং এই আন্দোলন বন্ধের দাবি জানায়। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি আমলে নিলেও পরে শিক্ষার্থীদের ‘যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে’ বলে স্বীকার করে। কানাডার বৃহত্তম সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ব্র্যান্ডন রিয়েল নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘অবশ্যই দখলদারিত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ছাত্রদের সংগ্রাম করতে হবে। ফিলিস্তিনে যে মানবতা লঙ্ঘিত ও গণহত্যা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ সব ছাত্রের করা উচিত।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত থাকলে ইহুদিদের বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয় যে, এই প্রতিবাদ বন্ধ না করলে তারা তাদের তহবিল প্রত্যাহার করবে এবং নতুন করে কোনো অর্থ প্রদান করবে না। দাতাদের এমন হুমকির প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় যে, তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। শান্তিপূর্ণ উপায়ে শিক্ষার্থীরা তাঁদের মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার অধিকার রাখেন। সে ক্ষেত্রে তারা বাধা প্রদান করতে পারে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
যাঁরা ছাত্ররাজনীতির বিরোধিতা করেন, তাঁদের বলি, এগুলো কি ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলন নয়? বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদ করছেন, সেটা কি আপনারা সমর্থন করেন না? তারা কি লেখাপড়া-গবেষণা করছেন না? সেখানে কি পেশাদারত্ব ও সৃষ্টিশীলতা গড়ে উঠছে না? এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই সেরা ছাত্ররা তাঁদের জীবনের সর্বোচ্চ মেধা ও সামর্থ্য ব্যয় করেন। তাঁরা শুধু তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেন না, বিশ্বমানবতা নিয়েও ভাবেন, দায়িত্ব পালন করেন। আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা থেকে তথাকথিত নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যতের তোয়াক্কা করে না। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের শাস্তি এবং রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছেন।
আমেরিকা-কানাডার যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন হচ্ছে, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। বিভিন্ন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন থাকে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ার। তাঁদের মধ্যে এই অহংকার-বড়াই কাজ করে না যে, ‘আমরা সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করি, অতএব আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম করা ঠিক হবে না।’ বইয়ের মধ্যে, ল্যাবে মুখ গুঁজে থাকাই শিক্ষা নয়। দুনিয়ার কোথায়, কী হচ্ছে, সেটাও জানতে হবে। আমাদের দেশের আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দায়িত্ববোধ তৈরি হচ্ছে না। শুধু বলি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়, তা দেশ-বিদেশের যে প্রান্তেই হোক।
বলতে পারেন, আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির মতো অবস্থা তো তাঁদের নয়। সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু দায় কার? এককভাবে কি শুধু ছাত্রদের? ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব সর্বত্রই আছে, থাকবে। কিন্তু অশুভকে প্রতিহত করে, অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হবে। কারও প্রতিবাদ করার অধিকার কেড়ে নেওয়াকে কোনোভাবেই সমর্থন করি না, তা সংখ্যায় যত নগণ্যই হোক। ভালোভাবে লেখাপড়া করে পাস করলেই ভালো মানুষ হবে, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? বাংলাদেশে দুর্নীতি-লুটপাট-পাচার-সন্ত্রাস কারা করছে? তারাও একদা কি ছাত্র ছিল না? তাহলে তাদের শিক্ষা কী?
এপ্রিলের শুরুতে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার প্রতি সংহতি এবং ইসরায়েলের ইহুদি আগ্রাসনের প্রতিবাদ প্রথমে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়। তাঁরা গাজায় নারী-শিশু ও গণহত্যা বন্ধের কথা বলেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গাজা সলিডারিটি এনক্যাম্পমেন্ট’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই আন্দোলনে প্রথমে শত শত, পরে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রদের এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও যোগ দেন।
শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করলে কর্তৃপক্ষ ক্লাস স্থগিত করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষাও স্থগিত করে। বিক্ষোভকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনগুলো দখল করে নেন। তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে, ক্যাম্পাসে তাঁবু টানিয়ে ঠান্ডা ও বৃষ্টিতে অবস্থান করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে পুলিশ মোতায়েন করে। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে তারা কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, লাঠিপেটা করে। পুলিশি নির্যাতনে অনেকে আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় শত শত শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক কারাবরণ করেন।
এই প্রতিবাদ আমেরিকা-কানাডার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমআইটি, নিউইয়র্ক, মিশিগান, ইয়েল, মেট্রোপলিটন, কানাডার ম্যাকগিলসহ ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। বোস্টনে, নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তাঁবু থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদ করায় পুলিশ ১০০ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে। মিডওয়েস্টের ব্লুমিংটনে, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের একটি তাঁবু তুলে ফেলার সময় পুলিশ ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তাঁবু তৈরি করায় ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বিক্ষোভের মুখে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির হামবোল্ড ক্যাম্পাসসহ কয়েকটি ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জিল স্টেইন, তাঁর প্রচার ব্যবস্থাপকসহ কমপক্ষে ৮০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইয়েল, সাউদার্ন, ক্যালিফোর্নিয়া, ভ্যান্ডারবিল্ট ও মিনেসোটাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারও করা হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বাক্স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও বিরোধ তৈরি হলেও ছাত্রদের প্রতিবাদের কারণে কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তারা ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের অসহিষ্ণু আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদন শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেছে। কেননা, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা তাঁদের শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে গড়ে প্রতিবছর একজন ছাত্রকে ব্যয় করতে হয় ৫০ হাজার ডলার বা প্রায় ৫৫ লাখ টাকা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই আন্দোলনের সমালোচনা করেছেন। শিক্ষার্থীরা এসব কথায় কর্ণপাত না করে দাবি জানাচ্ছেন—গাজায় অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ ও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে। ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধ এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কলাম্বিয়া, ম্যাকগিল, কনকর্ডিয়াসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারীরা ‘জায়নিস্ট’ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা তহবিল বাতিল করার পাশাপাশি ইহুদিবাদী একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানান। সেখানে ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। আমেরিকার ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ইসরায়েলবিরোধী চলমান এই আন্দোলনকে দেশটির সর্ববৃহৎ প্রতিবাদ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
লেখক: লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সেটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক চলমান। সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের আলোকে বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নাগরিকের সংগঠন করার অধিকারের বিষয়টি সামনে এনে বুয়েটে সংগঠন করতে বাধা নেই বলে রায় দিয়েছে। সেটা নিয়ে আপিল পর্যন্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে যখন বিষয়টি অমীমাংসিত, ঠিক সেই সময়েই আমেরিকাসহ বিশ্বের নামকরা শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধ, যুদ্ধবিরতি ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে।
এই যে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন হচ্ছে, তা ছাত্ররাজনীতির কারণেই সংগঠিত হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। ছাত্ররাজনীতি আছে বলেই আজ আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্যায়ের প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের একশ্রেণির শিক্ষিত নাগরিকের কাছ থেকে প্রায়ই শোনা যায় যে, উন্নত দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ছাত্ররাজনীতি নেই, সেখানে ছাত্ররা রাজনীতি করে না ইত্যাদি। তাদের এমন মন্তব্য ও দাবির জবাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা। শুধু দেখিয়ে দিচ্ছেন তা-ই নয়, ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদের মাধ্যমে বুঝিয়েও দিচ্ছে তাঁরা কতটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেন।
বছরের শুরুতে কানাডার বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়েও গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে সপ্তাহকাল ধরে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানকার ছাত্র ইউনিয়ন এই প্রতিবাদের আয়োজন করে। প্রো-প্যালেস্টাইন প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি সম্প্রদায়ের ডোনার ও বিভিন্ন ইহুদি সংগঠন এর প্রতিবাদ করে এবং এই আন্দোলন বন্ধের দাবি জানায়। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি আমলে নিলেও পরে শিক্ষার্থীদের ‘যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে’ বলে স্বীকার করে। কানাডার বৃহত্তম সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ব্র্যান্ডন রিয়েল নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘অবশ্যই দখলদারিত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ছাত্রদের সংগ্রাম করতে হবে। ফিলিস্তিনে যে মানবতা লঙ্ঘিত ও গণহত্যা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ সব ছাত্রের করা উচিত।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত থাকলে ইহুদিদের বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয় যে, এই প্রতিবাদ বন্ধ না করলে তারা তাদের তহবিল প্রত্যাহার করবে এবং নতুন করে কোনো অর্থ প্রদান করবে না। দাতাদের এমন হুমকির প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় যে, তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। শান্তিপূর্ণ উপায়ে শিক্ষার্থীরা তাঁদের মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার অধিকার রাখেন। সে ক্ষেত্রে তারা বাধা প্রদান করতে পারে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
যাঁরা ছাত্ররাজনীতির বিরোধিতা করেন, তাঁদের বলি, এগুলো কি ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলন নয়? বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদ করছেন, সেটা কি আপনারা সমর্থন করেন না? তারা কি লেখাপড়া-গবেষণা করছেন না? সেখানে কি পেশাদারত্ব ও সৃষ্টিশীলতা গড়ে উঠছে না? এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই সেরা ছাত্ররা তাঁদের জীবনের সর্বোচ্চ মেধা ও সামর্থ্য ব্যয় করেন। তাঁরা শুধু তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেন না, বিশ্বমানবতা নিয়েও ভাবেন, দায়িত্ব পালন করেন। আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা থেকে তথাকথিত নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যতের তোয়াক্কা করে না। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের শাস্তি এবং রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছেন।
আমেরিকা-কানাডার যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন হচ্ছে, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। বিভিন্ন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন থাকে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ার। তাঁদের মধ্যে এই অহংকার-বড়াই কাজ করে না যে, ‘আমরা সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করি, অতএব আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম করা ঠিক হবে না।’ বইয়ের মধ্যে, ল্যাবে মুখ গুঁজে থাকাই শিক্ষা নয়। দুনিয়ার কোথায়, কী হচ্ছে, সেটাও জানতে হবে। আমাদের দেশের আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দায়িত্ববোধ তৈরি হচ্ছে না। শুধু বলি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়, তা দেশ-বিদেশের যে প্রান্তেই হোক।
বলতে পারেন, আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির মতো অবস্থা তো তাঁদের নয়। সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু দায় কার? এককভাবে কি শুধু ছাত্রদের? ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব সর্বত্রই আছে, থাকবে। কিন্তু অশুভকে প্রতিহত করে, অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হবে। কারও প্রতিবাদ করার অধিকার কেড়ে নেওয়াকে কোনোভাবেই সমর্থন করি না, তা সংখ্যায় যত নগণ্যই হোক। ভালোভাবে লেখাপড়া করে পাস করলেই ভালো মানুষ হবে, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? বাংলাদেশে দুর্নীতি-লুটপাট-পাচার-সন্ত্রাস কারা করছে? তারাও একদা কি ছাত্র ছিল না? তাহলে তাদের শিক্ষা কী?
এপ্রিলের শুরুতে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার প্রতি সংহতি এবং ইসরায়েলের ইহুদি আগ্রাসনের প্রতিবাদ প্রথমে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়। তাঁরা গাজায় নারী-শিশু ও গণহত্যা বন্ধের কথা বলেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গাজা সলিডারিটি এনক্যাম্পমেন্ট’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই আন্দোলনে প্রথমে শত শত, পরে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রদের এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও যোগ দেন।
শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করলে কর্তৃপক্ষ ক্লাস স্থগিত করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষাও স্থগিত করে। বিক্ষোভকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনগুলো দখল করে নেন। তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে, ক্যাম্পাসে তাঁবু টানিয়ে ঠান্ডা ও বৃষ্টিতে অবস্থান করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে পুলিশ মোতায়েন করে। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে তারা কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, লাঠিপেটা করে। পুলিশি নির্যাতনে অনেকে আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় শত শত শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক কারাবরণ করেন।
এই প্রতিবাদ আমেরিকা-কানাডার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমআইটি, নিউইয়র্ক, মিশিগান, ইয়েল, মেট্রোপলিটন, কানাডার ম্যাকগিলসহ ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। বোস্টনে, নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তাঁবু থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদ করায় পুলিশ ১০০ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে। মিডওয়েস্টের ব্লুমিংটনে, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের একটি তাঁবু তুলে ফেলার সময় পুলিশ ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তাঁবু তৈরি করায় ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বিক্ষোভের মুখে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির হামবোল্ড ক্যাম্পাসসহ কয়েকটি ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জিল স্টেইন, তাঁর প্রচার ব্যবস্থাপকসহ কমপক্ষে ৮০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইয়েল, সাউদার্ন, ক্যালিফোর্নিয়া, ভ্যান্ডারবিল্ট ও মিনেসোটাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারও করা হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বাক্স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও বিরোধ তৈরি হলেও ছাত্রদের প্রতিবাদের কারণে কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তারা ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের অসহিষ্ণু আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদন শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেছে। কেননা, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা তাঁদের শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে গড়ে প্রতিবছর একজন ছাত্রকে ব্যয় করতে হয় ৫০ হাজার ডলার বা প্রায় ৫৫ লাখ টাকা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই আন্দোলনের সমালোচনা করেছেন। শিক্ষার্থীরা এসব কথায় কর্ণপাত না করে দাবি জানাচ্ছেন—গাজায় অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ ও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে। ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধ এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কলাম্বিয়া, ম্যাকগিল, কনকর্ডিয়াসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারীরা ‘জায়নিস্ট’ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা তহবিল বাতিল করার পাশাপাশি ইহুদিবাদী একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানান। সেখানে ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। আমেরিকার ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ইসরায়েলবিরোধী চলমান এই আন্দোলনকে দেশটির সর্ববৃহৎ প্রতিবাদ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
লেখক: লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে