মামুনুর রশীদ
সরকারের বাজেট ঘোষণা হবে। নানানভাবেই বাজেটে কোন পণ্যের দাম কত টাকা বাড়বে—এ ব্যাপারটি আগেই ফাঁস হয়ে যায়। সেই অনুযায়ী পণ্যগুলো গুদামজাত হয়ে যায়, উচ্চমূল্যে বিক্রির জন্য মজুত থাকে এবং ব্যবসায়ীদের জন্য আরও একটি সুযোগ তৈরি হয়।
একদা বাজেট ছিল খুবই ক্ষুদ্র এবং অর্থনীতিটাও ছিল ছোট। এখন অর্থের বাজার বড় হয়েছে, বাজেটও স্ফীত হয়েছে। সেই সঙ্গে টাকার মূল্যমান কমে গিয়ে একটা স্ফীত নয়া মুদ্রাস্ফীতি গড়ে উঠেছে। এর সুবিধাভোগী হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীরা, যাঁদের বেতন এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ঘুষের টাকাও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর সুবিধা হয়েছে ব্যবসায়ীদের, পরিবহন মালিকদের, যাঁরা দাম বাড়াতে একটুও দ্বিধাবোধ করেন না। কতজন এই মূল্যবৃদ্ধিতে জীবন হারাল, হাহাকারে পড়ে গেল, এ নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই আর সরকার তো ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও দুর্নীতিবাজ কমিশন এজেন্টদের ওপর নির্ভর করে। এ রকম অবস্থায় মুনাফা, কমিশনের টাকা, ঘুষের টাকা সব চলে যাচ্ছে বিদেশের ব্যাংকে। বিত্তবানদের টাকায় বিদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে।
এ কথা স্বীকার করছি, দেশে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। সেই উন্নয়নের খরচও হচ্ছে বিশাল। ধীরগতিতে চলা এই অবকাঠামো উন্নয়নে বারবার প্রাক্কলিত মূল্য বেড়েই চলেছে। ষাটের দশকে দেখেছি সৎ সরকারি চাকরিজীবীরা পে-কমিশন দিলেই আতঙ্কিত হয়ে যেতেন। কারণ একেবারেই অকারণে জিনিসপাতির দাম বেড়ে যেত, টাকার মূল্য কমে যেত। বাজেট এলেও তাই। এমনি করেই দশকের পর দশক চলছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি কমানো বা মানুষের ব্যয়ের বোঝা কমানোর কোনো প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
বাজেট কিছু অর্ধশিক্ষিত অর্থনীতি জানা আমলাদের হাতে। কারণ রাজনীতিবিদেরা বাজেট বোঝার চেষ্টা করেন না এবং খুব মনোযোগ দিয়ে তো নয়ই, একেবারে সামান্য মনোযোগ দিয়েও বাজেটটা বোঝার চেষ্টা করেন না। ব্যবসায়ীরা তাঁদের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে বাজেটেরই গুণগান গাইতে থাকেন। সংসদের বাইরে থাকা রাজনীতিবিদেরা বিরোধিতার জন্যই কিছু বিরোধিতা করেন, কিন্তু জনগণ এর মধ্যে সম্পৃক্ত হতে পারে না।
এযাবৎ পৃথিবীতে বহু অর্থনীতিবিদ এসেছেন, অর্থনীতিতে প্রচুর অঙ্কের কারসাজি ঢুকেছে, কিন্তু অর্থনীতিকে রাজনৈতিক এবং মানবিক করার প্রচেষ্টা তেমন একটা দেখা যায়নি। একমাত্র সহজ বোধগম্য অর্থনীতি হচ্ছে কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল। যেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করে একটা সহজ পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। তাতে রাশিয়ার মতো একটি বিশাল দেশ ৭০ বছর ধরে একটা নতুন অর্থনীতির জন্ম দিয়েছিল। এই অর্থনীতি প্রয়োগের ফলে দেশে ব্যাপক উন্নয়নসাধন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং অধনবাদী বিকাশের ব্যবস্থা হয়েছে।
চীন দেশেও বিপ্লবের পর একই ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদের তীব্র আক্রমণে এবং কিছু মানুষের লোভ-লালসা আকাশচুম্বী হওয়ায় তারা ফিরে গেছে আবার পুরোনো ব্যবস্থায়। এখানে ধনবিজ্ঞানীদের একটা বড় ভূমিকা আছে। এই বিজ্ঞানীরা শুধু অর্থনীতির কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তাঁরা বিপণনকে একটা শিল্পে পরিণত করেছেন। বিপণনের নতুন নতুন কলাকৌশলে এবং গণমাধ্যমের বিকাশকে এমনভাবে কাজে লাগিয়েছেন যে মানুষ পণ্য এবং ভোগে বিপুলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আজকাল সৃজনশীল শিল্পের ক্ষেত্রেও এই বিপণন প্রভূতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই অর্থনীতি এখন আর অর্থনীতির জায়গায় নেই। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ধনবিজ্ঞান। কীভাবে ধনী হওয়া যায়, এ বিজ্ঞানটি এখন মুখ্য।
সামগ্রিক বণ্টনব্যবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে অর্থনীতি তাকে সামাল দিতে পারছে না। রাষ্ট্র জনগণের ওপর বিপুল ট্যাক্স বসিয়ে দিলেও ধনী লোকেরা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার নানা কৌশল আবিষ্কার করেছেন। একমাত্র চাকরিজীবী এবং মধ্যবিত্তরা, যাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব নেই, তাঁরাই এই ট্যাক্সের বোঝা বহন করে চলেছেন। ধনবিজ্ঞানীরা অর্থ উপার্জনের নানা পথ বের করে ফেলেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা কোনো উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাঁরা শুধু তথ্য বিক্রি করে বিপুল পরিমাণে অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা রাষ্ট্রের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কালক্রমে সেই জায়গাগুলো চলে গেছে সবজান্তা আমলাদের হাতে। এই আমলারা শুধু বোঝেন ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। একপর্যায়ে তাঁরা ভিক্ষা করে দেশের অর্থনীতি চালাতেন। এই আমলাদের তখন ভিক্ষুক বলে আখ্যায়িত করা হতো। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্য সব দাতা সংস্থার কাছে নতজানু হয়ে দেশ চালাতেন এবং সেই থেকে উন্নত বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ মিসকিন বলে অভিহিত হতো। কালক্রমে সেই অপবাদ কিছুটা ঘুচেছে। ধনবিজ্ঞানীদের পরামর্শে অদূরদর্শী আমলাদের ব্যবস্থাপনায় দেশের বণ্টনব্যবস্থায় একটা নতুন অভিঘাত এসেছে। সেই অভিঘাতে মধ্যবিত্তশ্রেণি প্রায় ধ্বংসের পথে, কিন্তু উচ্চবিত্তের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। যে মধ্যবিত্তশ্রেণি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করত, সেই শ্রেণির ভূমিকা পালনে আর কোনো অবকাশ থাকেনি।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে মাদ্রাসা শিক্ষা দারিদ্র্য ও বেকারত্বের পথ খুলে দিয়েছে আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি স্কুল একধরনের অভিবাসনমুখী সম্প্রদায় গড়ে তুলেছে। এই অভিবাসনমুখী সম্প্রদায় আসলে দেশের অর্থ পাচারের মূল কারণ। তাঁরা ছোটবেলা থেকেই দেশকে বসবাসের অযোগ্য বলে মনে করেন, যদিও তাঁরা দেশের অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। তাঁরা পড়ালেখা করতে বিদেশে যান এবং সেখান থেকে আর ফেরেন না। আবার আরেক শ্রেণি সপরিবারেই বিদেশে অবস্থান করেন।
অর্থনীতিবিদেরা এটা পরিমাপ করতে পারবেন যে পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশের বিত্ত কী পরিমাণে বিদেশে পাচার হয়েছে। সেই পরিমাণ অর্থ যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে দেশে কত বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারত।
সব দেশেরই আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে সংস্কৃতিমান লোকদের সংস্পর্শে এসে দেশের সব ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। এমনকি বিরোধী দলের পরামর্শও নিয়ে থাকে ক্ষমতাসীন দল। আমাদের দেশের রাজনীতিটা সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, রাজনীতি ও সংস্কৃতি কীভাবে পাশাপাশি অবস্থান করেছে। ষাটের দশকের আন্দোলন এবং ছয় দফা রাজনীতি-অর্থনীতি ও সংস্কৃতির এক যুগপৎ ফলাফল।
প্রকৃত মেধা দেশপ্রেমিকদের নানা ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব দিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দীর্ঘ দিন জবাবদিহিহীন রাজনীতি এসব মহৎ ভাবনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। জাতীয় সংসদকে বারবার অকার্যকর করে আমলাতন্ত্রের আধিপত্যকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমলাতন্ত্রের আধিপত্যের ক্ষেত্রে কোনো সংস্কারকাজ ৫০ বছরে হয়নি। থানা থেকে উপজেলা, মহকুমা থেকে জেলা এসব ঘটেছে, কিন্তু কার্যকর ক্ষমতার ক্ষেত্রে আমলাদের আধিপত্য রয়ে গেছে। সংসদ সদস্যরা অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
একবার বিশ্বব্যাংকের এক কর্মকর্তা কোনো এক জেলা থেকে ঘুরে এসে বলেছিলেন, জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতার এ রকম অপব্যবহার তিনি কোথাও দেখেননি। কোটি টাকার ওপরে গাড়ি, অঢেল তেল, নানা ধরনের উৎসবের আয়োজন, এলআর ফান্ড নামের একটি জবাবদিহিহীন ফান্ড নিয়ে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনের দিন-রাত অতিবাহিত হয়।
বর্তমানে যদিও একটু-আধটু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, তবু অকারণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশযাত্রার এক অপচয়ী সংস্কৃতি রয়ে গেছে। অথচ অর্থ বরাদ্দের একটা বড় খাত হওয়া উচিত ছিল শিক্ষা এবং দুর্ভাগ্যজনক হলো, শিক্ষকদের এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে রাখা হয়েছে, যাঁদের বেতন ত্রয়োদশ গ্রেডে। তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী উচ্চশিক্ষিত হলেও তিনি কী শিক্ষা দেবেন? আমলা, রাজনীতিবিদেরা ওই প্রাইমারি স্কুল থেকে পাস করলেও তাঁরা শিক্ষকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না; বরং কোচিং ও নিয়োগ-বাণিজ্যের মধ্যে তাঁদের বেঁধে রেখেছেন।
যদিও এ লেখাটি অনেকের চিন্তার ও লেখার চর্বিত চর্বণ, তবুও একমাত্র মানুষেরই শুভবুদ্ধির উদয় হয় বলে সেই শুভবুদ্ধির প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
সরকারের বাজেট ঘোষণা হবে। নানানভাবেই বাজেটে কোন পণ্যের দাম কত টাকা বাড়বে—এ ব্যাপারটি আগেই ফাঁস হয়ে যায়। সেই অনুযায়ী পণ্যগুলো গুদামজাত হয়ে যায়, উচ্চমূল্যে বিক্রির জন্য মজুত থাকে এবং ব্যবসায়ীদের জন্য আরও একটি সুযোগ তৈরি হয়।
একদা বাজেট ছিল খুবই ক্ষুদ্র এবং অর্থনীতিটাও ছিল ছোট। এখন অর্থের বাজার বড় হয়েছে, বাজেটও স্ফীত হয়েছে। সেই সঙ্গে টাকার মূল্যমান কমে গিয়ে একটা স্ফীত নয়া মুদ্রাস্ফীতি গড়ে উঠেছে। এর সুবিধাভোগী হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীরা, যাঁদের বেতন এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ঘুষের টাকাও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর সুবিধা হয়েছে ব্যবসায়ীদের, পরিবহন মালিকদের, যাঁরা দাম বাড়াতে একটুও দ্বিধাবোধ করেন না। কতজন এই মূল্যবৃদ্ধিতে জীবন হারাল, হাহাকারে পড়ে গেল, এ নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই আর সরকার তো ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও দুর্নীতিবাজ কমিশন এজেন্টদের ওপর নির্ভর করে। এ রকম অবস্থায় মুনাফা, কমিশনের টাকা, ঘুষের টাকা সব চলে যাচ্ছে বিদেশের ব্যাংকে। বিত্তবানদের টাকায় বিদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে।
এ কথা স্বীকার করছি, দেশে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। সেই উন্নয়নের খরচও হচ্ছে বিশাল। ধীরগতিতে চলা এই অবকাঠামো উন্নয়নে বারবার প্রাক্কলিত মূল্য বেড়েই চলেছে। ষাটের দশকে দেখেছি সৎ সরকারি চাকরিজীবীরা পে-কমিশন দিলেই আতঙ্কিত হয়ে যেতেন। কারণ একেবারেই অকারণে জিনিসপাতির দাম বেড়ে যেত, টাকার মূল্য কমে যেত। বাজেট এলেও তাই। এমনি করেই দশকের পর দশক চলছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি কমানো বা মানুষের ব্যয়ের বোঝা কমানোর কোনো প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
বাজেট কিছু অর্ধশিক্ষিত অর্থনীতি জানা আমলাদের হাতে। কারণ রাজনীতিবিদেরা বাজেট বোঝার চেষ্টা করেন না এবং খুব মনোযোগ দিয়ে তো নয়ই, একেবারে সামান্য মনোযোগ দিয়েও বাজেটটা বোঝার চেষ্টা করেন না। ব্যবসায়ীরা তাঁদের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে বাজেটেরই গুণগান গাইতে থাকেন। সংসদের বাইরে থাকা রাজনীতিবিদেরা বিরোধিতার জন্যই কিছু বিরোধিতা করেন, কিন্তু জনগণ এর মধ্যে সম্পৃক্ত হতে পারে না।
এযাবৎ পৃথিবীতে বহু অর্থনীতিবিদ এসেছেন, অর্থনীতিতে প্রচুর অঙ্কের কারসাজি ঢুকেছে, কিন্তু অর্থনীতিকে রাজনৈতিক এবং মানবিক করার প্রচেষ্টা তেমন একটা দেখা যায়নি। একমাত্র সহজ বোধগম্য অর্থনীতি হচ্ছে কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল। যেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করে একটা সহজ পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। তাতে রাশিয়ার মতো একটি বিশাল দেশ ৭০ বছর ধরে একটা নতুন অর্থনীতির জন্ম দিয়েছিল। এই অর্থনীতি প্রয়োগের ফলে দেশে ব্যাপক উন্নয়নসাধন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং অধনবাদী বিকাশের ব্যবস্থা হয়েছে।
চীন দেশেও বিপ্লবের পর একই ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদের তীব্র আক্রমণে এবং কিছু মানুষের লোভ-লালসা আকাশচুম্বী হওয়ায় তারা ফিরে গেছে আবার পুরোনো ব্যবস্থায়। এখানে ধনবিজ্ঞানীদের একটা বড় ভূমিকা আছে। এই বিজ্ঞানীরা শুধু অর্থনীতির কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তাঁরা বিপণনকে একটা শিল্পে পরিণত করেছেন। বিপণনের নতুন নতুন কলাকৌশলে এবং গণমাধ্যমের বিকাশকে এমনভাবে কাজে লাগিয়েছেন যে মানুষ পণ্য এবং ভোগে বিপুলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আজকাল সৃজনশীল শিল্পের ক্ষেত্রেও এই বিপণন প্রভূতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই অর্থনীতি এখন আর অর্থনীতির জায়গায় নেই। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ধনবিজ্ঞান। কীভাবে ধনী হওয়া যায়, এ বিজ্ঞানটি এখন মুখ্য।
সামগ্রিক বণ্টনব্যবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে অর্থনীতি তাকে সামাল দিতে পারছে না। রাষ্ট্র জনগণের ওপর বিপুল ট্যাক্স বসিয়ে দিলেও ধনী লোকেরা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার নানা কৌশল আবিষ্কার করেছেন। একমাত্র চাকরিজীবী এবং মধ্যবিত্তরা, যাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব নেই, তাঁরাই এই ট্যাক্সের বোঝা বহন করে চলেছেন। ধনবিজ্ঞানীরা অর্থ উপার্জনের নানা পথ বের করে ফেলেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা কোনো উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাঁরা শুধু তথ্য বিক্রি করে বিপুল পরিমাণে অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা রাষ্ট্রের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কালক্রমে সেই জায়গাগুলো চলে গেছে সবজান্তা আমলাদের হাতে। এই আমলারা শুধু বোঝেন ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। একপর্যায়ে তাঁরা ভিক্ষা করে দেশের অর্থনীতি চালাতেন। এই আমলাদের তখন ভিক্ষুক বলে আখ্যায়িত করা হতো। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্য সব দাতা সংস্থার কাছে নতজানু হয়ে দেশ চালাতেন এবং সেই থেকে উন্নত বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ মিসকিন বলে অভিহিত হতো। কালক্রমে সেই অপবাদ কিছুটা ঘুচেছে। ধনবিজ্ঞানীদের পরামর্শে অদূরদর্শী আমলাদের ব্যবস্থাপনায় দেশের বণ্টনব্যবস্থায় একটা নতুন অভিঘাত এসেছে। সেই অভিঘাতে মধ্যবিত্তশ্রেণি প্রায় ধ্বংসের পথে, কিন্তু উচ্চবিত্তের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। যে মধ্যবিত্তশ্রেণি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করত, সেই শ্রেণির ভূমিকা পালনে আর কোনো অবকাশ থাকেনি।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে মাদ্রাসা শিক্ষা দারিদ্র্য ও বেকারত্বের পথ খুলে দিয়েছে আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি স্কুল একধরনের অভিবাসনমুখী সম্প্রদায় গড়ে তুলেছে। এই অভিবাসনমুখী সম্প্রদায় আসলে দেশের অর্থ পাচারের মূল কারণ। তাঁরা ছোটবেলা থেকেই দেশকে বসবাসের অযোগ্য বলে মনে করেন, যদিও তাঁরা দেশের অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। তাঁরা পড়ালেখা করতে বিদেশে যান এবং সেখান থেকে আর ফেরেন না। আবার আরেক শ্রেণি সপরিবারেই বিদেশে অবস্থান করেন।
অর্থনীতিবিদেরা এটা পরিমাপ করতে পারবেন যে পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশের বিত্ত কী পরিমাণে বিদেশে পাচার হয়েছে। সেই পরিমাণ অর্থ যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে দেশে কত বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারত।
সব দেশেরই আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে সংস্কৃতিমান লোকদের সংস্পর্শে এসে দেশের সব ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। এমনকি বিরোধী দলের পরামর্শও নিয়ে থাকে ক্ষমতাসীন দল। আমাদের দেশের রাজনীতিটা সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, রাজনীতি ও সংস্কৃতি কীভাবে পাশাপাশি অবস্থান করেছে। ষাটের দশকের আন্দোলন এবং ছয় দফা রাজনীতি-অর্থনীতি ও সংস্কৃতির এক যুগপৎ ফলাফল।
প্রকৃত মেধা দেশপ্রেমিকদের নানা ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব দিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দীর্ঘ দিন জবাবদিহিহীন রাজনীতি এসব মহৎ ভাবনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। জাতীয় সংসদকে বারবার অকার্যকর করে আমলাতন্ত্রের আধিপত্যকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমলাতন্ত্রের আধিপত্যের ক্ষেত্রে কোনো সংস্কারকাজ ৫০ বছরে হয়নি। থানা থেকে উপজেলা, মহকুমা থেকে জেলা এসব ঘটেছে, কিন্তু কার্যকর ক্ষমতার ক্ষেত্রে আমলাদের আধিপত্য রয়ে গেছে। সংসদ সদস্যরা অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
একবার বিশ্বব্যাংকের এক কর্মকর্তা কোনো এক জেলা থেকে ঘুরে এসে বলেছিলেন, জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতার এ রকম অপব্যবহার তিনি কোথাও দেখেননি। কোটি টাকার ওপরে গাড়ি, অঢেল তেল, নানা ধরনের উৎসবের আয়োজন, এলআর ফান্ড নামের একটি জবাবদিহিহীন ফান্ড নিয়ে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনের দিন-রাত অতিবাহিত হয়।
বর্তমানে যদিও একটু-আধটু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, তবু অকারণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশযাত্রার এক অপচয়ী সংস্কৃতি রয়ে গেছে। অথচ অর্থ বরাদ্দের একটা বড় খাত হওয়া উচিত ছিল শিক্ষা এবং দুর্ভাগ্যজনক হলো, শিক্ষকদের এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে রাখা হয়েছে, যাঁদের বেতন ত্রয়োদশ গ্রেডে। তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী উচ্চশিক্ষিত হলেও তিনি কী শিক্ষা দেবেন? আমলা, রাজনীতিবিদেরা ওই প্রাইমারি স্কুল থেকে পাস করলেও তাঁরা শিক্ষকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না; বরং কোচিং ও নিয়োগ-বাণিজ্যের মধ্যে তাঁদের বেঁধে রেখেছেন।
যদিও এ লেখাটি অনেকের চিন্তার ও লেখার চর্বিত চর্বণ, তবুও একমাত্র মানুষেরই শুভবুদ্ধির উদয় হয় বলে সেই শুভবুদ্ধির প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে