জাহীদ রেজা নূর
না বুঝে কিছু বলার চেয়ে ঘটনা যা ঘটছে, সেদিকে দৃষ্টি রাখা ভালো। পরিবর্তন কী হচ্ছে, কতটা হচ্ছে, আদৌ হচ্ছে কি না, সেই সব প্রশ্ন নিয়ে এখনই বিতর্ক করার সময় আসেনি। কেবল তো ক্ষমতা হাতে নিল অন্তর্বর্তী সরকার। সত্যিই এমন কোনো সংস্কার করা সম্ভব কি না, যাতে ক্ষমতাসীন কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে, সেদিকে গণ-অভ্যুত্থানকারী চালিকাশক্তির চোখ থাকবে নিশ্চয়ই। নইলে ‘থোড় বড়ি খাড়া-খাড়া বড়ি থোড়ের’ গাড্ডায় পড়ে যাবে দেশ।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর থেকে নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। যখন যা ঘটছে, তা নিয়ে তৎক্ষণাৎ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মানুষ ঘটনার বিষয়ে তাঁদের বিশ্লেষণ প্রকাশ করছেন। প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন থাকায় এবং সেই ফোনে ইন্টারনেট থাকায় অনেকেই ইউটিউব, ফেসবুক বা অন্য কোনো মাধ্যমে ঘটনাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। কনটেন্টগুলোর কোনো কোনোটিতে আপন মনের মাধুরী মিশিয়েও কোনো ঘটনা ‘রচনা’ করতে দেখা যাচ্ছে। ফলে ঘটনার সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
ওলট-পালট সময় ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই স্থিত হবে, সেটাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু কেউ কেউ ইতিমধ্যে নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে শুরু করেছেন। প্রশাসনে যে অদলবদল হচ্ছে, তাতে বঞ্চিত যোগ্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অযোগ্য, অদক্ষরাও ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছেন। পেট্রোবাংলার একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ২০তম গ্রেডের কয়েকজন কর্মচারীকে এক লাফে নবম গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কোন ক্ষমতাবলে এ রকম অসাধ্য সাধন হলো, তা এক বিরাট বিস্ময়। কেউ সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। এ ধরনের কর্মকাণ্ড এই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে যায় না। সংবাদটি সত্য হলে এখনই এর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নইলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে। জনগণ মনে করবে, দখল-বেদখলের রাজনীতিই বুঝি ফিরে এল আবার।
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে মাত্র। ১৫ বছর যারা বুভুক্ষু ছিল, তারাই এখন চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক হয়ে বসছে সর্বত্র। দলীয়করণ ও চাঁদাবাজি যেন আর না চলে, সেটাও তো চেয়েছে ছাত্র-জনতা। কিন্তু পরিবহন খাতে এই আলামত মোটেই স্বস্তি দিতে পারছে না কাউকে। অন্যদিকে আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, সেগুলোকে জনরোষ নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেখানে জনতা কোথায়? সেখানে মূলত বিএনপি দলীয় আইনজীবীরাই উপস্থিত থেকে আটক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী বা নেতাদের গায়ে ছুড়ে মারছেন পচা ডিম। কেউ কেউ পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই আটক ব্যক্তির শরীরে হাত তুলছেন। বিচারপতি মানিকের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে, এরই আলোকে ন্যায়সংগত বিচার হতে হবে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটা কোনো সভ্য আচরণ নয়। আর হরে-দরে সবার নামে হত্যা মামলা দিয়ে মামলাগুলোকেই করে ফেলা হচ্ছে জোলো, মেরিটহীন। সালমান এফ রহমান স্টক এক্সচেঞ্জের বারোটা বাজিয়েছেন, ঋণ নিয়ে তেলেসমাতি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলে তো এসব বড় অনাচারের ব্যাপারেই হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একসময় এই অদ্ভুত মামলাগুলো নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। বলা হবে, তাহলে পরিবর্তনটা কোথায় হলো? সেই মামলাবাজির মধ্যেই কি ঢুকে যাচ্ছি আমরা? এসব জায়গায় পরিবর্তনের ছোঁয়া একেবারেই লাগেনি। বরং ক্ষমতাশালী কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে, ‘আওয়ামী লীগ আমলেও তো এসব ঘটনা ঘটেছিল, তার বেলা?’ আওয়ামী আমলে সে রকম ঘটনা ঘটেছে বলেই তো তা প্রতিরোধ করাটা এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত। একই কাণ্ড যদি এখনো ঘটতে থাকে, তাহলে পরিবর্তনটা কী হলো?
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো নিয়ে। ফেসবুকে অথবা ইউটিউবে এই উন্মত্ততার যে চিত্র দেখা গেছে, তা কোনো শুভারম্ভের ইঙ্গিত দেয় না। শিক্ষককে অসম্মান করে যারা মজা পেয়েছে, তারা আর যাই হোক, শোভন আচরণ করেনি। শিক্ষকদের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করার মাধ্যমে তারা নিজেদের সম্মানও ক্ষুণ্ন করল কি না, সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? শিক্ষক লাঞ্ছনার ব্যাপারে ইতিমধ্যে বিবিসিতে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়েছে।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করানোর নামে যে অরাজকতা চালাল, তাতে সংস্কারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এটাকে বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বা ক্রোধ বলে চালানো যাবে না। এর জন্য লজ্জা পেতে হবে পুরো জাতিকে।
১৫ বছরের শাসনামলে সবকিছুর দলীয়করণ এবং আকাশপ্রমাণ দুর্নীতির যে পরিচয় আওয়ামী লীগ রেখে গেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে, যে অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছে ক্ষমতায় বসা কোন শাসক দল? আওয়ামী লীগ? বিএনপি? বিএনপি-জামায়াত? জাতীয় পার্টি? যে যত কম সময় ক্ষমতায় থেকেছে, সে তত ছোট স্বৈরাচার আর যে যত বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেছে, সে তত বড় স্বৈরাচার হয়েছে। এ তো দিবালোকের মতোই সত্য। প্রতিটি আমলের অনাচার নিয়ে একগাদা প্রমাণ রয়েছে বই-পুস্তকেই। সেসব পড়ে নিলেই আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যাটা পরিষ্কার ধরা যাবে।
শঙ্কা থাকে, যদি রাজনীতির এই চরিত্রের পরিবর্তন না হয়, তাহলে অপশাসনের ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে। ক্ষমতার শুধু পালাবদল হবে, নতুন কিছু হবে না। নতুন নতুন স্বপ্ন দেখবে মানুষ, সেই স্বপ্নের সমাধিও রচিত হবে।
কিন্তু দেশের জনগণ তো আবার কোনো নতুন স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায় না। তারা চায় সুখে-শান্তিতে অন্তত ডাল-ভাত খেয়ে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে। সেই জীবনের কি আভাস পাওয়া যাচ্ছে কোথাও? বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ নিশ্চিন্তে বসবাস করবে—এমন নিশ্চয়তা কি সত্যিই মনে শক্তি দিতে পারছে? এর জন্য দরকার রোডম্যাপ।
সংকট উত্তরণের রোডম্যাপ যত দ্রুত দেওয়া যাবে, ততই জনগণ বর্তমানে ঘটতে থাকা ঘটনাবলির সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারবে। বুঝতে পারবে, এই সরকার কতটা আন্তরিক। রোডম্যাপ অনুযায়ী তারা যদি সংস্কারকাজ করতে পারে, তাহলে কিছুটা হলেও আশা আছে।
সংবিধান নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। যে সংবিধান সরকারকে একনায়ক করে তুলবে না, সেই রকম আশাপ্রদ কিছু হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো যেন তাতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূস বলেছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই, সবার সমান অধিকার’। এ কথাটা সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু সব ধর্মের মানুষ সমান সুযোগ ভোগ করার পাশাপাশি সব ধর্মের মানুষ সমান নিরাপত্তা পাচ্ছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। আমাদের দেশে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ধর্মীয় হানাহানির ক্ষেত্র তৈরি করার প্রবণতা আছে তাদের মধ্যে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এরাও সেই আন্দোলনে ঢুকে পড়েছে। এদের দিকে রাখতে হবে সতর্ক খেয়াল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না।
যত দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক নির্বাচন হয়েছে, তত দিন পর্যন্ত দেখা গেছে দেশের মানুষের বড় একটা অংশ মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিকে সমর্থন করে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে জাতীয় পার্টির প্রতি জনসমর্থন আছে। ইসলামি দলগুলো সেভাবে হালে পানি পায়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইসলাম ভাঙিয়ে খাওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে বাংলার প্রবল প্রতিবাদ দিয়েই কেবল তার ব্যাখ্যা করা যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মূলত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। সেই আন্দোলনও ইসলামবিরোধী তকমা এঁটে দিয়েছিল ধর্মব্যবসায়ীরা। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে গিয়ে সে কথাগুলো মনে রাখা দরকার।
দুঃখের ব্যাপার হলো, ৩০ লাখ মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছেলেখেলা খেলেছে। মুখে বলেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, দৃশ্যত করেছে লুটপাট। দলীয়করণকে করে তুলেছে শিল্প। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রবাদ স্মরণে রেখে স্ফীত করেছে ব্যাংক ব্যালান্স। ভাবা যায়, ক্ষমতাসীন দলের ডাকসাইটে নেতাদের মুখেও শোনা গেছে ‘যদি দল ক্ষমতাচ্যুত হয়, তাহলে পিঠের চামড়া থাকবে না’! কেন পিঠের চামড়া থাকবে না? দেশ পরিচালনা করার সময় কী এমন করা হয়েছে, যার উপহারস্বরূপ দেশের মানুষ তাদের পিঠের চামড়া খুলে নেবে?
এই পিঠের চামড়া খুলে নেওয়ার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারা ক্ষমতায় যাবে এবং নির্ধারিত সময় পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করবে। জনগণ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হলে আবার তারা ক্ষমতায় আসবে, নইলে যেকোনো সভ্য দেশে পরিচালিত নির্বাচনের মতোই নির্দিষ্ট সময়ে অন্য দলের হাতে ক্ষমতা দেবে। নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হবে আনন্দময়, উৎসবমুখর। বিরোধী দলের তাতে অংশগ্রহণ থাকবে স্বতঃস্ফূর্ত।
সামনে অবারিত পথ। অসংখ্য পথ। কোন পথে এগোবে বাংলাদেশ, দেখা যাক।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
না বুঝে কিছু বলার চেয়ে ঘটনা যা ঘটছে, সেদিকে দৃষ্টি রাখা ভালো। পরিবর্তন কী হচ্ছে, কতটা হচ্ছে, আদৌ হচ্ছে কি না, সেই সব প্রশ্ন নিয়ে এখনই বিতর্ক করার সময় আসেনি। কেবল তো ক্ষমতা হাতে নিল অন্তর্বর্তী সরকার। সত্যিই এমন কোনো সংস্কার করা সম্ভব কি না, যাতে ক্ষমতাসীন কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে, সেদিকে গণ-অভ্যুত্থানকারী চালিকাশক্তির চোখ থাকবে নিশ্চয়ই। নইলে ‘থোড় বড়ি খাড়া-খাড়া বড়ি থোড়ের’ গাড্ডায় পড়ে যাবে দেশ।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর থেকে নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। যখন যা ঘটছে, তা নিয়ে তৎক্ষণাৎ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মানুষ ঘটনার বিষয়ে তাঁদের বিশ্লেষণ প্রকাশ করছেন। প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন থাকায় এবং সেই ফোনে ইন্টারনেট থাকায় অনেকেই ইউটিউব, ফেসবুক বা অন্য কোনো মাধ্যমে ঘটনাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। কনটেন্টগুলোর কোনো কোনোটিতে আপন মনের মাধুরী মিশিয়েও কোনো ঘটনা ‘রচনা’ করতে দেখা যাচ্ছে। ফলে ঘটনার সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
ওলট-পালট সময় ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই স্থিত হবে, সেটাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু কেউ কেউ ইতিমধ্যে নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে শুরু করেছেন। প্রশাসনে যে অদলবদল হচ্ছে, তাতে বঞ্চিত যোগ্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অযোগ্য, অদক্ষরাও ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছেন। পেট্রোবাংলার একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ২০তম গ্রেডের কয়েকজন কর্মচারীকে এক লাফে নবম গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কোন ক্ষমতাবলে এ রকম অসাধ্য সাধন হলো, তা এক বিরাট বিস্ময়। কেউ সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। এ ধরনের কর্মকাণ্ড এই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে যায় না। সংবাদটি সত্য হলে এখনই এর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নইলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে। জনগণ মনে করবে, দখল-বেদখলের রাজনীতিই বুঝি ফিরে এল আবার।
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে মাত্র। ১৫ বছর যারা বুভুক্ষু ছিল, তারাই এখন চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক হয়ে বসছে সর্বত্র। দলীয়করণ ও চাঁদাবাজি যেন আর না চলে, সেটাও তো চেয়েছে ছাত্র-জনতা। কিন্তু পরিবহন খাতে এই আলামত মোটেই স্বস্তি দিতে পারছে না কাউকে। অন্যদিকে আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, সেগুলোকে জনরোষ নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেখানে জনতা কোথায়? সেখানে মূলত বিএনপি দলীয় আইনজীবীরাই উপস্থিত থেকে আটক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী বা নেতাদের গায়ে ছুড়ে মারছেন পচা ডিম। কেউ কেউ পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই আটক ব্যক্তির শরীরে হাত তুলছেন। বিচারপতি মানিকের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে, এরই আলোকে ন্যায়সংগত বিচার হতে হবে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটা কোনো সভ্য আচরণ নয়। আর হরে-দরে সবার নামে হত্যা মামলা দিয়ে মামলাগুলোকেই করে ফেলা হচ্ছে জোলো, মেরিটহীন। সালমান এফ রহমান স্টক এক্সচেঞ্জের বারোটা বাজিয়েছেন, ঋণ নিয়ে তেলেসমাতি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলে তো এসব বড় অনাচারের ব্যাপারেই হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একসময় এই অদ্ভুত মামলাগুলো নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। বলা হবে, তাহলে পরিবর্তনটা কোথায় হলো? সেই মামলাবাজির মধ্যেই কি ঢুকে যাচ্ছি আমরা? এসব জায়গায় পরিবর্তনের ছোঁয়া একেবারেই লাগেনি। বরং ক্ষমতাশালী কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে, ‘আওয়ামী লীগ আমলেও তো এসব ঘটনা ঘটেছিল, তার বেলা?’ আওয়ামী আমলে সে রকম ঘটনা ঘটেছে বলেই তো তা প্রতিরোধ করাটা এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত। একই কাণ্ড যদি এখনো ঘটতে থাকে, তাহলে পরিবর্তনটা কী হলো?
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো নিয়ে। ফেসবুকে অথবা ইউটিউবে এই উন্মত্ততার যে চিত্র দেখা গেছে, তা কোনো শুভারম্ভের ইঙ্গিত দেয় না। শিক্ষককে অসম্মান করে যারা মজা পেয়েছে, তারা আর যাই হোক, শোভন আচরণ করেনি। শিক্ষকদের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করার মাধ্যমে তারা নিজেদের সম্মানও ক্ষুণ্ন করল কি না, সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? শিক্ষক লাঞ্ছনার ব্যাপারে ইতিমধ্যে বিবিসিতে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়েছে।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করানোর নামে যে অরাজকতা চালাল, তাতে সংস্কারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এটাকে বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বা ক্রোধ বলে চালানো যাবে না। এর জন্য লজ্জা পেতে হবে পুরো জাতিকে।
১৫ বছরের শাসনামলে সবকিছুর দলীয়করণ এবং আকাশপ্রমাণ দুর্নীতির যে পরিচয় আওয়ামী লীগ রেখে গেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে, যে অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছে ক্ষমতায় বসা কোন শাসক দল? আওয়ামী লীগ? বিএনপি? বিএনপি-জামায়াত? জাতীয় পার্টি? যে যত কম সময় ক্ষমতায় থেকেছে, সে তত ছোট স্বৈরাচার আর যে যত বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেছে, সে তত বড় স্বৈরাচার হয়েছে। এ তো দিবালোকের মতোই সত্য। প্রতিটি আমলের অনাচার নিয়ে একগাদা প্রমাণ রয়েছে বই-পুস্তকেই। সেসব পড়ে নিলেই আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যাটা পরিষ্কার ধরা যাবে।
শঙ্কা থাকে, যদি রাজনীতির এই চরিত্রের পরিবর্তন না হয়, তাহলে অপশাসনের ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে। ক্ষমতার শুধু পালাবদল হবে, নতুন কিছু হবে না। নতুন নতুন স্বপ্ন দেখবে মানুষ, সেই স্বপ্নের সমাধিও রচিত হবে।
কিন্তু দেশের জনগণ তো আবার কোনো নতুন স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায় না। তারা চায় সুখে-শান্তিতে অন্তত ডাল-ভাত খেয়ে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে। সেই জীবনের কি আভাস পাওয়া যাচ্ছে কোথাও? বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ নিশ্চিন্তে বসবাস করবে—এমন নিশ্চয়তা কি সত্যিই মনে শক্তি দিতে পারছে? এর জন্য দরকার রোডম্যাপ।
সংকট উত্তরণের রোডম্যাপ যত দ্রুত দেওয়া যাবে, ততই জনগণ বর্তমানে ঘটতে থাকা ঘটনাবলির সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারবে। বুঝতে পারবে, এই সরকার কতটা আন্তরিক। রোডম্যাপ অনুযায়ী তারা যদি সংস্কারকাজ করতে পারে, তাহলে কিছুটা হলেও আশা আছে।
সংবিধান নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। যে সংবিধান সরকারকে একনায়ক করে তুলবে না, সেই রকম আশাপ্রদ কিছু হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো যেন তাতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূস বলেছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই, সবার সমান অধিকার’। এ কথাটা সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু সব ধর্মের মানুষ সমান সুযোগ ভোগ করার পাশাপাশি সব ধর্মের মানুষ সমান নিরাপত্তা পাচ্ছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। আমাদের দেশে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ধর্মীয় হানাহানির ক্ষেত্র তৈরি করার প্রবণতা আছে তাদের মধ্যে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এরাও সেই আন্দোলনে ঢুকে পড়েছে। এদের দিকে রাখতে হবে সতর্ক খেয়াল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না।
যত দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক নির্বাচন হয়েছে, তত দিন পর্যন্ত দেখা গেছে দেশের মানুষের বড় একটা অংশ মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিকে সমর্থন করে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে জাতীয় পার্টির প্রতি জনসমর্থন আছে। ইসলামি দলগুলো সেভাবে হালে পানি পায়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইসলাম ভাঙিয়ে খাওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে বাংলার প্রবল প্রতিবাদ দিয়েই কেবল তার ব্যাখ্যা করা যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মূলত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। সেই আন্দোলনও ইসলামবিরোধী তকমা এঁটে দিয়েছিল ধর্মব্যবসায়ীরা। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে গিয়ে সে কথাগুলো মনে রাখা দরকার।
দুঃখের ব্যাপার হলো, ৩০ লাখ মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছেলেখেলা খেলেছে। মুখে বলেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, দৃশ্যত করেছে লুটপাট। দলীয়করণকে করে তুলেছে শিল্প। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রবাদ স্মরণে রেখে স্ফীত করেছে ব্যাংক ব্যালান্স। ভাবা যায়, ক্ষমতাসীন দলের ডাকসাইটে নেতাদের মুখেও শোনা গেছে ‘যদি দল ক্ষমতাচ্যুত হয়, তাহলে পিঠের চামড়া থাকবে না’! কেন পিঠের চামড়া থাকবে না? দেশ পরিচালনা করার সময় কী এমন করা হয়েছে, যার উপহারস্বরূপ দেশের মানুষ তাদের পিঠের চামড়া খুলে নেবে?
এই পিঠের চামড়া খুলে নেওয়ার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারা ক্ষমতায় যাবে এবং নির্ধারিত সময় পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করবে। জনগণ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হলে আবার তারা ক্ষমতায় আসবে, নইলে যেকোনো সভ্য দেশে পরিচালিত নির্বাচনের মতোই নির্দিষ্ট সময়ে অন্য দলের হাতে ক্ষমতা দেবে। নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হবে আনন্দময়, উৎসবমুখর। বিরোধী দলের তাতে অংশগ্রহণ থাকবে স্বতঃস্ফূর্ত।
সামনে অবারিত পথ। অসংখ্য পথ। কোন পথে এগোবে বাংলাদেশ, দেখা যাক।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে