মোনায়েম সরকার
৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় সংঘটিত হয়েছিল এই দিনে।
১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
১৫ আগস্টের পর এই চার জাতীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত খুনিদের সরকার। তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ও বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি কর্নেল (বহিষ্কৃত) সৈয়দ ফারুক রহমান ও লে. কর্নেল (বহিষ্কৃত) খন্দকার আব্দুর রশিদ জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
এ কাজের জন্য তাঁরা আগেভাগে ঘাতক দল গঠন করেন। দলের প্রধান ছিলেন রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন। তিনি ছিলেন ফারুকের সবচেয়ে আস্থাভাজন। ১৫ আগস্ট শেখ মনির বাসভবনে যে ঘাতক দলটি হত্যাযজ্ঞ চালায়, সেই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুসলেহ উদ্দিন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘বাংলাদেশ আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরপরই জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি এমনভাবে নেওয়া হয়েছিল, যাতে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তা আপনা-আপনি কার্যকর হয়। এ কাজের জন্য পাঁচ সদস্যের ঘাতক দলও গঠন করা হয়।
ঘাতক দলের প্রতি নির্দেশ ছিল, পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করবে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানোর পরেই কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় এই চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল ওই নির্মম হত্যাকাণ্ড? বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে ২টা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেই গাড়িতে কয়েকজন সেনাসদস্য ছিলেন। ঢাকা তখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার আমিনুর রহমানকে তাৎক্ষণিক আসতে বলেন।
দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে আমিনুর রহমান দেখলেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনাসদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছেন। মূল ফটকের সামনে সেনাসদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন।
মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে ওঠে। আমিনুর রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।
২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনুর রহমান বলেন, ‘টেলিফোনে বলা হলো, প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন আইজি সাহেবের সঙ্গে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন, প্রেসিডেন্ট ফোনে বলেছেন, আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা করো।’
মূল ফটকের সামনে কথাবার্তা চলতে থাকে। একসময় রাত ৩টা বেজে যায়।
আমিনুর রহমান বলেন, একপর্যায়ে কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের তৎকালীন চার নেতাকে একত্র করার আদেশ আসে। কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন।
সেই চারজন হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। তারপর এই চার নেতাকে এক জায়গায় এনে গুলিতে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জেল হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র আছে। তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন।
২০১০ সালে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, তখন সেনাবাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পরিণতি ছিল জেলখানার হত্যাকাণ্ড। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল ৩ নভেম্বর। সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
আমিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি ছিল অনিবার্য। কারণ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের আওতায় আনা জরুরি মনে করা হচ্ছিল। তা ছাড়া, শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডকেও তাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না।
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন: ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান কতিপয় সেনাসদস্য ঘটালেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। অবশ্য কয়েকজন সেনাসদস্য বা কর্মকর্তার এতে সায় না-ও থাকতে পারে। ব্যতিক্রমকে সাধারণ নিয়মের মধ্যে ধরা হয় না। ঢাকায় সেনাবাহিনীর প্রধান শক্তি ছিল ৪৬ ব্রিগেড। অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন শ দেড়েক সৈন্য। ৪৬ ব্রিগেডে প্রায় ৪ হাজার সৈন্য ছিল। ১৫ তারিখে ওই ব্রিগেডের সদস্যরা শুধু নিষ্ক্রিয় ছিলেন না, তাঁদের রীতিমতো উল্লাস করতে দেখা গেছে বলে তৎকালীন সেনাপ্রধান কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহর কাছ থেকে জানা যায়।...
ফারুক-রশিদের পছন্দেই জিয়াকে ২৪ আগস্ট (১৯৭৫) সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ওসমানী এটা চাননি। ওসমানীকে দখলদার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন। এ ছাড়া তিন বাহিনীর ওপরে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ নামে একটা পদ তৈরি করে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং, সেনাপ্রধান হয়েও জিয়া একচ্ছত্র ক্ষমতা পাননি। তিন ধাপ ডিঙিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হতো। মোদ্দা কথা, তিনি মোশতাক ও ওসমানীর ওপর নাখোশ ছিলেন।
খালেদ সেনাপ্রধান হতে চেয়েছিলেন। না হতে পেরে তিনিও বঙ্গভবনের শাসকদের ওপর নাখোশ হন। বঙ্গভবনে বসে বসে অভ্যুত্থানকারী কতিপয় মেজর ছড়ি ঘোরাবে, ঢাকা সেনানিবাসে সেনা নেতৃত্বের এটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খালেদ চেয়েছিলেন ‘বিদ্রোহীদের’ সেনানিবাসে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতে। চেইন অব কমান্ড নিয়ে জিয়া খুব একটা মাথা ঘামাননি। তাঁর পথের কাঁটা ছিলেন মোশতাক, ফারুক-রশিদেরা নন।...
কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে বঙ্গভবনে থেকে যাওয়ায় নিরঙ্কুশ সেনানিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছিল না। এই প্রেক্ষাপটেই তৈরি হয় চেইন অব কমান্ড পুনর্বহালের তত্ত্ব। এই তত্ত্বের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। এই উদ্যোগে তিনি প্রথমে জিয়াকেই শামিল করতে চেয়েছিলেন। জিয়া ছিলেন দোটানায়। যাঁরা তাঁকে সেনাপ্রধান বানিয়েছেন, তিনি তাঁদের বিরাগভাজন হতে কিংবা তাঁদের দূরে ঠেলে দিতে চাননি। ফলে খালেদের শরণাপন্ন হন শাফায়াত। খালেদ বিষয়টাকে দেখেন তাঁর ইচ্ছাপূরণের একটা সুযোগ হিসেবে। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের চিত্রনাট্য।
৪৬ ব্রিগেডের সেনা কর্মকর্তারা বেশির ভাগ সক্রিয় অংশ নেওয়ায় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি সফল হয়। আপাতদৃষ্টিতে যেহেতু এটা ছিল মোশতাকবিরোধী অভ্যুত্থান, এর ফলে জনমনে ধারণা তৈরি করা সহজ হয় যে ‘আওয়ামী-বাকশালী’দের পক্ষে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।...
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি প্রথম প্রহরেই দুর্বল হয়ে পড়ে সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করে খালেদের সেনাপ্রধান হওয়ার তাড়না থেকে। তাঁর পরিকল্পনায় শুরু থেকেই ছিল গোঁজামিল। তিনি ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ১৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে সপরিবারে দেশত্যাগের সুযোগ করে দেন এবং মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল রেখেই নিজে সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য তৎপরতা চালাতে থাকেন। মোশতাক ছিলেন পাকা খেলোয়াড়। তিনি খালেদকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করতে কালক্ষেপণ করেন। ততক্ষণে খালেদের পায়ের নিচ থেকে মাটি অনেকটাই সরে গেছে।...
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের নারকীয় ঘটনাবলি বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্র বদলে দিয়েছে। হিংসা ও বিভেদের যে বীজ বপন করা হয়, তা এখন মহীরুহ হয়ে উঠেছে। দেশে এখনো গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত নয়, নির্বাচনব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়নি। বিরোধ ও বিভ্রান্তি এখনো সুস্থ রাজনৈতিক ধারার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। এখনো নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের বদলে রাজপথেই ফয়সালার কথা অনেক রাজনীতিবিদের মুখে শোনা যায়। রাজনীতির এই কলঙ্কযাত্রার অবসান হওয়া জরুরি।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় সংঘটিত হয়েছিল এই দিনে।
১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
১৫ আগস্টের পর এই চার জাতীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত খুনিদের সরকার। তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ও বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি কর্নেল (বহিষ্কৃত) সৈয়দ ফারুক রহমান ও লে. কর্নেল (বহিষ্কৃত) খন্দকার আব্দুর রশিদ জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
এ কাজের জন্য তাঁরা আগেভাগে ঘাতক দল গঠন করেন। দলের প্রধান ছিলেন রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন। তিনি ছিলেন ফারুকের সবচেয়ে আস্থাভাজন। ১৫ আগস্ট শেখ মনির বাসভবনে যে ঘাতক দলটি হত্যাযজ্ঞ চালায়, সেই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুসলেহ উদ্দিন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘বাংলাদেশ আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরপরই জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি এমনভাবে নেওয়া হয়েছিল, যাতে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তা আপনা-আপনি কার্যকর হয়। এ কাজের জন্য পাঁচ সদস্যের ঘাতক দলও গঠন করা হয়।
ঘাতক দলের প্রতি নির্দেশ ছিল, পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করবে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানোর পরেই কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় এই চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল ওই নির্মম হত্যাকাণ্ড? বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে ২টা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেই গাড়িতে কয়েকজন সেনাসদস্য ছিলেন। ঢাকা তখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার আমিনুর রহমানকে তাৎক্ষণিক আসতে বলেন।
দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে আমিনুর রহমান দেখলেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনাসদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছেন। মূল ফটকের সামনে সেনাসদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন।
মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে ওঠে। আমিনুর রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।
২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনুর রহমান বলেন, ‘টেলিফোনে বলা হলো, প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন আইজি সাহেবের সঙ্গে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন, প্রেসিডেন্ট ফোনে বলেছেন, আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা করো।’
মূল ফটকের সামনে কথাবার্তা চলতে থাকে। একসময় রাত ৩টা বেজে যায়।
আমিনুর রহমান বলেন, একপর্যায়ে কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের তৎকালীন চার নেতাকে একত্র করার আদেশ আসে। কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন।
সেই চারজন হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। তারপর এই চার নেতাকে এক জায়গায় এনে গুলিতে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জেল হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র আছে। তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন।
২০১০ সালে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, তখন সেনাবাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পরিণতি ছিল জেলখানার হত্যাকাণ্ড। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল ৩ নভেম্বর। সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
আমিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি ছিল অনিবার্য। কারণ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের আওতায় আনা জরুরি মনে করা হচ্ছিল। তা ছাড়া, শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডকেও তাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না।
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন: ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান কতিপয় সেনাসদস্য ঘটালেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। অবশ্য কয়েকজন সেনাসদস্য বা কর্মকর্তার এতে সায় না-ও থাকতে পারে। ব্যতিক্রমকে সাধারণ নিয়মের মধ্যে ধরা হয় না। ঢাকায় সেনাবাহিনীর প্রধান শক্তি ছিল ৪৬ ব্রিগেড। অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন শ দেড়েক সৈন্য। ৪৬ ব্রিগেডে প্রায় ৪ হাজার সৈন্য ছিল। ১৫ তারিখে ওই ব্রিগেডের সদস্যরা শুধু নিষ্ক্রিয় ছিলেন না, তাঁদের রীতিমতো উল্লাস করতে দেখা গেছে বলে তৎকালীন সেনাপ্রধান কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহর কাছ থেকে জানা যায়।...
ফারুক-রশিদের পছন্দেই জিয়াকে ২৪ আগস্ট (১৯৭৫) সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ওসমানী এটা চাননি। ওসমানীকে দখলদার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন। এ ছাড়া তিন বাহিনীর ওপরে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ নামে একটা পদ তৈরি করে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং, সেনাপ্রধান হয়েও জিয়া একচ্ছত্র ক্ষমতা পাননি। তিন ধাপ ডিঙিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হতো। মোদ্দা কথা, তিনি মোশতাক ও ওসমানীর ওপর নাখোশ ছিলেন।
খালেদ সেনাপ্রধান হতে চেয়েছিলেন। না হতে পেরে তিনিও বঙ্গভবনের শাসকদের ওপর নাখোশ হন। বঙ্গভবনে বসে বসে অভ্যুত্থানকারী কতিপয় মেজর ছড়ি ঘোরাবে, ঢাকা সেনানিবাসে সেনা নেতৃত্বের এটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খালেদ চেয়েছিলেন ‘বিদ্রোহীদের’ সেনানিবাসে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতে। চেইন অব কমান্ড নিয়ে জিয়া খুব একটা মাথা ঘামাননি। তাঁর পথের কাঁটা ছিলেন মোশতাক, ফারুক-রশিদেরা নন।...
কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে বঙ্গভবনে থেকে যাওয়ায় নিরঙ্কুশ সেনানিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছিল না। এই প্রেক্ষাপটেই তৈরি হয় চেইন অব কমান্ড পুনর্বহালের তত্ত্ব। এই তত্ত্বের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। এই উদ্যোগে তিনি প্রথমে জিয়াকেই শামিল করতে চেয়েছিলেন। জিয়া ছিলেন দোটানায়। যাঁরা তাঁকে সেনাপ্রধান বানিয়েছেন, তিনি তাঁদের বিরাগভাজন হতে কিংবা তাঁদের দূরে ঠেলে দিতে চাননি। ফলে খালেদের শরণাপন্ন হন শাফায়াত। খালেদ বিষয়টাকে দেখেন তাঁর ইচ্ছাপূরণের একটা সুযোগ হিসেবে। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের চিত্রনাট্য।
৪৬ ব্রিগেডের সেনা কর্মকর্তারা বেশির ভাগ সক্রিয় অংশ নেওয়ায় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি সফল হয়। আপাতদৃষ্টিতে যেহেতু এটা ছিল মোশতাকবিরোধী অভ্যুত্থান, এর ফলে জনমনে ধারণা তৈরি করা সহজ হয় যে ‘আওয়ামী-বাকশালী’দের পক্ষে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।...
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি প্রথম প্রহরেই দুর্বল হয়ে পড়ে সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করে খালেদের সেনাপ্রধান হওয়ার তাড়না থেকে। তাঁর পরিকল্পনায় শুরু থেকেই ছিল গোঁজামিল। তিনি ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ১৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে সপরিবারে দেশত্যাগের সুযোগ করে দেন এবং মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল রেখেই নিজে সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য তৎপরতা চালাতে থাকেন। মোশতাক ছিলেন পাকা খেলোয়াড়। তিনি খালেদকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করতে কালক্ষেপণ করেন। ততক্ষণে খালেদের পায়ের নিচ থেকে মাটি অনেকটাই সরে গেছে।...
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের নারকীয় ঘটনাবলি বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্র বদলে দিয়েছে। হিংসা ও বিভেদের যে বীজ বপন করা হয়, তা এখন মহীরুহ হয়ে উঠেছে। দেশে এখনো গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত নয়, নির্বাচনব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়নি। বিরোধ ও বিভ্রান্তি এখনো সুস্থ রাজনৈতিক ধারার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। এখনো নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের বদলে রাজপথেই ফয়সালার কথা অনেক রাজনীতিবিদের মুখে শোনা যায়। রাজনীতির এই কলঙ্কযাত্রার অবসান হওয়া জরুরি।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে