কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়ন। ৭ নভেম্বর বিকেল থেকে পাঁচ বছরের শিশু ফাহিমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তার বাবা আমির হোসেনসহ পরিচিত সবাই ফাহিমাকে খুঁজতে শুরু করেন। আমির হোসেনের বন্ধু সোহেলের সিএনজিতে করে পুরো এলাকায় মাইকিং করা হয়। আরেক বন্ধু রেজাউল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সবাইকে খোঁজার অনুরোধ জানান। দাদা, দাদি নিয়ে আসেন কবিরাজ। কিন্তু কিছুতেই মিলছিল না শিশুটির খোঁজ। এক সপ্তাহ পর ১৪ নভেম্বর বাড়ির পাশেরই এক কালভার্টের ডোবার নিচে গরুর খাবারের বস্তার ভেতর পাওয়া যায় ফাহিমার লাশ। তদন্তে খবর আসে, পরকীয়া সম্পর্ক বাঁচাতে বাবাই হত্যা করেছেন নিজের একমাত্র মেয়েকে।

গতকাল কারওয়ান বাজারের র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, আমির হোসেনের সঙ্গে লাইলি আক্তারের প্রায় এক বছর ধরে পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। ৫ নভেম্বর নিজ বাসায় লাইলি আক্তারের সঙ্গে আমির হোসেনকে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখে ফেলে ফাহিমা। তখন ফাহিমা বলে, “আমি মাকে বলে দেব”। এই চারটি শব্দই কেড়ে নেয় ফাহিমার জীবন।

র‍্যাব জানায়, চকলেট কিনে দেওয়ার কথা বলে ফাহিমাকে ঘুরতে নিয়ে যান তাঁরা। নদীর পাড়ে নিয়ে মুখ চেপে ধরে নিজ হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ফাহিমার বাবা। হত্যার পর গরুর খাবারের বস্তায় ভরে নদীর পাড়ে কালভার্টের নিচে ফেলে আসে।

খুনের মূল পরিকল্পনাকারী শিশুটির বাবা আমির হোসেনসহ হত্যার ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে কুমিল্লার দেবিদ্বার ও ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। অন্য অভিযুক্তরা হলেন রবিউল আউয়াল (১৯), রেজা উল ইসলাম ইমন (২২), সোহেল রানা (২৭) ও লাইলি আক্তার (৩০)।

প্রতিনিয়ত বড়দের রাগ-ক্ষোভ, হিংসা-প্রতিহিংসা, বিদ্বেষের শিকার হচ্ছে শিশুরা। গত ৫ এপ্রিল খুলনায় সৎমায়ের প্রতিহিংসার শিকার হয় পাঁচ বছরের শিশু তানিশা খাতুন। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েকে কুপিয়ে খুন করেন মা তিথি আক্তার মুক্তা। মায়ের সঙ্গে চাচার পরকীয়ার কারণে গত ১ মার্চ খুন হয়েছে সিলেটের সাব্বির আহমেদ (১৫)। আগস্টে কুমিল্লায় শ্বশুর-শাশুড়ির মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে ১৯ দিনের কন্যা শিশুকে পানিতে ফেলে হত্যা করেছে রহিমা আক্তার রত্না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বলেই বেশির ভাগ অপরাধী শিশুদের টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়। নিজের অপরাধের দায়ভার অন্যের ওপর চাপানোর জন্যই শিশুদের বেছে নেওয়া হচ্ছে। আর বিপদ বুঝতে পারার সামর্থ্য না থাকা শিশুদের প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার অন্যতম বড় কারণ।

প্রায় দুই বছর পর বুধবার আরও এক শিশুর হত্যার রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ। এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায়, গুলিস্তানের আশপাশে চুরি-ছিনতাই করতেন চাঁন মিয়া। একে কেন্দ্র করে ওই এলাকার আরেক নামকরা ছিনতাইকারী ল্যাংড়া রাসেলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়। পথের কাঁটা ল্যাংড়া রাসেলকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে শ্যালিকার ৫ বছরের ছেলে শিশু সানিকে পাশবিক শারীরিক নির্যাতন করে গলা টিপে হত্যা করেন চাঁন মিয়া।

ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার এ বিষয়ে বলেন, ‘এসব ঘটনা নিজে স্বীকার করেছে সে।’

শিশু নির্যাতন বা হত্যার ঘটনাগুলো অনেকাংশেই স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হয়ে যায় জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘যে ঘটনাগুলোর মামলা হয় সেগুলোর বিচার শেষ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এ ধরনের ঘটনার যথাযথ বিচার না হলে এবং ভুক্তভোগীর পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে না পারলে এ ধরনের ঘটনা বাড়বে।’