চিররঞ্জন সরকার
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা। আর সবচেয়ে বেশি মব জাস্টিসের শিকার হয়েছেন শিক্ষকেরা। যে যেভাবে পেরেছে, শিক্ষকদের ওপর ঝাল মিটিয়েছে। এখনো মেটাচ্ছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারী ও বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের সীমাহীন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুটপাট করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ক্ষোভ কমতে থাকে।
আন্দোলনকারীরা ঘরে ফিরতে শুরু করেন। কিন্তু একশ্রেণির সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ছাত্রদের উসকে দেয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। নতুন করে শুরু হয় মব জাস্টিস। আর এর অসহায় শিকার হন শিক্ষকেরা। পৃথিবীর আর কোনো দেশে শিক্ষকেরা এমন অপমান ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কি না সন্দেহ! অবশ্য নানা ছুতোয় শিক্ষকদের অপমান ও নির্যাতনের ধারা আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরেই চলছে। মনে পড়ছে নিকট-অতীতের কিছু ঘটনা।
২০২২ সালের ১৮ জুন। কথিত এক ফেসবুক পোস্টের জের ধরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের গুজব ছড়িয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই কলেজের তখনকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পরানো হয় জুতার মালা। নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে। সে সময় কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার। তাঁদের সঙ্গে ছিল ২০০ থেকে ২৫০ পুলিশ। স্বপন কুমার বিশ্বাস প্রাণে বেঁচেছিলেন। কিন্তু ঢাকার আশুলিয়ার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার প্রাণেও বাঁচতে পারেননি। তিনি ২০২২ সালের ২৫ জুন এক ছাত্রের অতর্কিত হামলায় আহত হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যান।
এই দুই ঘটনার কিছুদিন আগে, ২০২২ সালের ২০ মার্চ মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ১৯ দিন কারাভোগের পর জামিন পান তিনি।
শ্যামল কান্তি ভক্তের কথাও মনে পড়ে যায়। তিনি নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৩ মে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। প্রধান শিক্ষক কান ধরে ওঠবস করছেন, আর জাতীয় পার্টির তৎকালীন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান কয়বার তিনি ওঠবস করলেন, তা গুনছেন—এমন একটি ভিডিও সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ঘটনার পর শ্যামল কান্তিকে চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি।
মনে পড়ে ২০১৬ সালে বাগেরহাটের দুই শিক্ষকের কথা। ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে চিতলমারীর হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী ও বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষালকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল ধর্ম সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তোলে প্রধান শিক্ষকের কাছে। পরে প্রধান শিক্ষক বিজ্ঞান শিক্ষকের পক্ষ নেন বলে জানায় তারা। শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের জানালে তাঁরা পরদিন ২৫ এপ্রিল স্কুলে আক্রমণ করেন এবং একপর্যায়ে দুই শিক্ষককে লাইব্রেরিকক্ষে আটকে রাখেন। পরে উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার পারভেজ তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের শিক্ষক নির্যাতনের চিত্র দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। প্রতিবাদ করেছি। তখন নানা অজুহাতে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন সংখ্যালঘু শিক্ষকেরা। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শিক্ষক নির্যাতন তীব্র হয়ে ওঠে। আক্রান্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের দালালি করেছেন। প্রমোশন পেয়েছেন, পদ বাগিয়েছেন।
দাপট দেখিয়েছেন। দুর্নীতি করেছেন। তবে কোনো শিক্ষককেই কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ‘আপনি দালাল, দুর্নীতিবাজ, অতএব পদত্যাগ করুন’ এই ‘মব জাস্টিস’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন অভিযোগে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষককে অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কোথাও টেনেহিঁচড়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে, কোথাও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, চড়-থাপ্পড় মেরে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। কোথাও আবার জুতার মালা পরিয়ে শিক্ষককে ঘোরানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই অগণতান্ত্রিক এবং অরাজক পরিস্থিতিতে তাঁরা দাবি মানতে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় অনেকে সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখে জমা দিতে বাধ্য হয়েছেন। সামাজিকমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যা একটি সভ্য সমাজে অকল্পনীয়।
এ কথা ঠিক যে আমাদের এই অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজে শিক্ষকেরা ধোয়া তুলসী পাতা নন। অনেক শিক্ষকই সরকারি দলের নির্লজ্জ দালালি করেছেন। কেউ কেউ অন্যায়, দুর্নীতিসহ নানা দুষ্কর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আপত্তির কিছু নেই। তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতেই পারে। দলবাজ শিক্ষকদের এটাও বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে দলবাজি শোভন নয়। সংগতও নয়। শিক্ষকের প্রধান ধ্যানজ্ঞান হবে শিক্ষা প্রদান। শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল্যাণ। কোনো রাজনৈতিক দলের ভক্ত সেজে যদি কেউ কর্মকাণ্ড করতে চান, তাহলে শিক্ষকতা পেশা ত্যাগ করেই তা করা উচিত। শিক্ষকনেতা নন। তাঁরা নেতা তৈরি করেন। তৈরি করেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার প্রয়োজনীয় জনশক্তি।
সমাজে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা ক্লাসে ঠিকমতো পড়ান না। তাঁরা টিউশনি আর কোচিং সেন্টারে অধিক সময় দেন। যেসব শিক্ষার্থী তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়ে না বা তাঁর কোচিং সেন্টারে যায় না, তাদের কম নম্বর দেওয়া হয়। নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যেসব শিক্ষক যুক্ত, তাঁরা আসলে যেকোনো শাসনামলেই সুবিধা ভোগ করেন। তাঁদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হওয়ার সংগত কারণ আছে। এসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, শিক্ষকদের যেকোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষা সংস্কারে এসব বিষয়কে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে তাঁদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়টিও।
কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন না করে ঢালাওভাবে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা, অপমান করা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উগ্র সমর্থকেরা ধরে নিয়েছেন যে বিগত সরকার সমর্থকদের ওপর যেকোনো অন্যায়-অত্যাচার করলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হবে না। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষকদের প্রধান টার্গেট করা হয়েছে। যেন যাবতীয় অনিয়ম-দুর্নীতি কেবল শিক্ষকেরাই করে থাকেন। বিগত সরকারের যাবতীয় অনিয়ম-অপকর্মের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিলেন দেশের আমলারা। তাঁরা কোনো রকম রাখঢাক ছাড়া একেবারে দলীয় কর্মীর চেয়ে অধিক দলবাজ হয়ে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছেন। নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন। জনগণের ম্যান্ডেট না-থাকা সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেরাই হয়ে উঠেছেন এক-একজন মহাক্ষমতাবান। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁদের দিকে কেউ আঙুল তুলছে না। সচিবালয়ের কোনো কর্মকর্তাকে তো নয়ই, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কোনো কর্মকর্তাকেও কেউ শাসায়নি। কেউ বলেনি, এক্ষুনি পদত্যাগ করুন।
তাহলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কেন এত ক্ষোভ? কেন তাঁদের জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে? তাঁরা দুর্বল বলে? দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য? একজন শিক্ষক হিসেবে যাঁদের দায়িত্ব সমাজকে আলোকিত করা, তাঁরা যদি এমন নিপীড়নের শিকার হন, তাহলে আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ কী হবে?
এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যেকোনো মূল্যে মব জাস্টিস বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। ইতিমধ্যে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। যে শিক্ষকেরা অপমানিত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ক্লাসরুমে ফিরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা খুব কঠিন। তারপরও প্রশাসন-শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী—সবাই মিলে চেষ্টা করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। প্রথমেই জোর করে পদত্যাগ করানো শিক্ষকদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
কেননা, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভালো মানুষ আছেন। আর যাঁরা সত্যিই দোষী, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অভিভাবকদেরও ভূমিকা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের নিষ্পাপ আবেগকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটা স্বার্থান্বেষী মহল ব্যবহার করছে। তাদের কারণেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। এখন তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার মূল দায়িত্ব অভিভাবকদেরই নিতে হবে।
লেখক:গবেষক, কলামিস্ট
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা। আর সবচেয়ে বেশি মব জাস্টিসের শিকার হয়েছেন শিক্ষকেরা। যে যেভাবে পেরেছে, শিক্ষকদের ওপর ঝাল মিটিয়েছে। এখনো মেটাচ্ছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারী ও বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের সীমাহীন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুটপাট করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ক্ষোভ কমতে থাকে।
আন্দোলনকারীরা ঘরে ফিরতে শুরু করেন। কিন্তু একশ্রেণির সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ছাত্রদের উসকে দেয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। নতুন করে শুরু হয় মব জাস্টিস। আর এর অসহায় শিকার হন শিক্ষকেরা। পৃথিবীর আর কোনো দেশে শিক্ষকেরা এমন অপমান ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কি না সন্দেহ! অবশ্য নানা ছুতোয় শিক্ষকদের অপমান ও নির্যাতনের ধারা আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরেই চলছে। মনে পড়ছে নিকট-অতীতের কিছু ঘটনা।
২০২২ সালের ১৮ জুন। কথিত এক ফেসবুক পোস্টের জের ধরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের গুজব ছড়িয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই কলেজের তখনকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পরানো হয় জুতার মালা। নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে। সে সময় কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার। তাঁদের সঙ্গে ছিল ২০০ থেকে ২৫০ পুলিশ। স্বপন কুমার বিশ্বাস প্রাণে বেঁচেছিলেন। কিন্তু ঢাকার আশুলিয়ার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার প্রাণেও বাঁচতে পারেননি। তিনি ২০২২ সালের ২৫ জুন এক ছাত্রের অতর্কিত হামলায় আহত হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যান।
এই দুই ঘটনার কিছুদিন আগে, ২০২২ সালের ২০ মার্চ মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ১৯ দিন কারাভোগের পর জামিন পান তিনি।
শ্যামল কান্তি ভক্তের কথাও মনে পড়ে যায়। তিনি নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৩ মে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। প্রধান শিক্ষক কান ধরে ওঠবস করছেন, আর জাতীয় পার্টির তৎকালীন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান কয়বার তিনি ওঠবস করলেন, তা গুনছেন—এমন একটি ভিডিও সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ঘটনার পর শ্যামল কান্তিকে চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি।
মনে পড়ে ২০১৬ সালে বাগেরহাটের দুই শিক্ষকের কথা। ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে চিতলমারীর হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী ও বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষালকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল ধর্ম সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তোলে প্রধান শিক্ষকের কাছে। পরে প্রধান শিক্ষক বিজ্ঞান শিক্ষকের পক্ষ নেন বলে জানায় তারা। শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের জানালে তাঁরা পরদিন ২৫ এপ্রিল স্কুলে আক্রমণ করেন এবং একপর্যায়ে দুই শিক্ষককে লাইব্রেরিকক্ষে আটকে রাখেন। পরে উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার পারভেজ তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের শিক্ষক নির্যাতনের চিত্র দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। প্রতিবাদ করেছি। তখন নানা অজুহাতে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন সংখ্যালঘু শিক্ষকেরা। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শিক্ষক নির্যাতন তীব্র হয়ে ওঠে। আক্রান্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের দালালি করেছেন। প্রমোশন পেয়েছেন, পদ বাগিয়েছেন।
দাপট দেখিয়েছেন। দুর্নীতি করেছেন। তবে কোনো শিক্ষককেই কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ‘আপনি দালাল, দুর্নীতিবাজ, অতএব পদত্যাগ করুন’ এই ‘মব জাস্টিস’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন অভিযোগে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষককে অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কোথাও টেনেহিঁচড়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে, কোথাও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, চড়-থাপ্পড় মেরে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। কোথাও আবার জুতার মালা পরিয়ে শিক্ষককে ঘোরানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই অগণতান্ত্রিক এবং অরাজক পরিস্থিতিতে তাঁরা দাবি মানতে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় অনেকে সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখে জমা দিতে বাধ্য হয়েছেন। সামাজিকমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যা একটি সভ্য সমাজে অকল্পনীয়।
এ কথা ঠিক যে আমাদের এই অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজে শিক্ষকেরা ধোয়া তুলসী পাতা নন। অনেক শিক্ষকই সরকারি দলের নির্লজ্জ দালালি করেছেন। কেউ কেউ অন্যায়, দুর্নীতিসহ নানা দুষ্কর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আপত্তির কিছু নেই। তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতেই পারে। দলবাজ শিক্ষকদের এটাও বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে দলবাজি শোভন নয়। সংগতও নয়। শিক্ষকের প্রধান ধ্যানজ্ঞান হবে শিক্ষা প্রদান। শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল্যাণ। কোনো রাজনৈতিক দলের ভক্ত সেজে যদি কেউ কর্মকাণ্ড করতে চান, তাহলে শিক্ষকতা পেশা ত্যাগ করেই তা করা উচিত। শিক্ষকনেতা নন। তাঁরা নেতা তৈরি করেন। তৈরি করেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার প্রয়োজনীয় জনশক্তি।
সমাজে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা ক্লাসে ঠিকমতো পড়ান না। তাঁরা টিউশনি আর কোচিং সেন্টারে অধিক সময় দেন। যেসব শিক্ষার্থী তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়ে না বা তাঁর কোচিং সেন্টারে যায় না, তাদের কম নম্বর দেওয়া হয়। নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যেসব শিক্ষক যুক্ত, তাঁরা আসলে যেকোনো শাসনামলেই সুবিধা ভোগ করেন। তাঁদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হওয়ার সংগত কারণ আছে। এসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, শিক্ষকদের যেকোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষা সংস্কারে এসব বিষয়কে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে তাঁদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়টিও।
কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন না করে ঢালাওভাবে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা, অপমান করা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উগ্র সমর্থকেরা ধরে নিয়েছেন যে বিগত সরকার সমর্থকদের ওপর যেকোনো অন্যায়-অত্যাচার করলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হবে না। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষকদের প্রধান টার্গেট করা হয়েছে। যেন যাবতীয় অনিয়ম-দুর্নীতি কেবল শিক্ষকেরাই করে থাকেন। বিগত সরকারের যাবতীয় অনিয়ম-অপকর্মের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিলেন দেশের আমলারা। তাঁরা কোনো রকম রাখঢাক ছাড়া একেবারে দলীয় কর্মীর চেয়ে অধিক দলবাজ হয়ে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছেন। নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন। জনগণের ম্যান্ডেট না-থাকা সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেরাই হয়ে উঠেছেন এক-একজন মহাক্ষমতাবান। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁদের দিকে কেউ আঙুল তুলছে না। সচিবালয়ের কোনো কর্মকর্তাকে তো নয়ই, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কোনো কর্মকর্তাকেও কেউ শাসায়নি। কেউ বলেনি, এক্ষুনি পদত্যাগ করুন।
তাহলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কেন এত ক্ষোভ? কেন তাঁদের জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে? তাঁরা দুর্বল বলে? দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য? একজন শিক্ষক হিসেবে যাঁদের দায়িত্ব সমাজকে আলোকিত করা, তাঁরা যদি এমন নিপীড়নের শিকার হন, তাহলে আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ কী হবে?
এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যেকোনো মূল্যে মব জাস্টিস বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। ইতিমধ্যে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। যে শিক্ষকেরা অপমানিত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ক্লাসরুমে ফিরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা খুব কঠিন। তারপরও প্রশাসন-শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী—সবাই মিলে চেষ্টা করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। প্রথমেই জোর করে পদত্যাগ করানো শিক্ষকদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
কেননা, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভালো মানুষ আছেন। আর যাঁরা সত্যিই দোষী, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অভিভাবকদেরও ভূমিকা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের নিষ্পাপ আবেগকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটা স্বার্থান্বেষী মহল ব্যবহার করছে। তাদের কারণেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। এখন তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার মূল দায়িত্ব অভিভাবকদেরই নিতে হবে।
লেখক:গবেষক, কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে