রাহুল শর্মা, ঢাকা
কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রী বর্ষা রহমান বলেন, ‘কোনো রকমে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ করলাম। না পেলাম শিক্ষক, না পেলাম আবাসিক হল। অন্য সুযোগ-সুবিধার কথা আর না-ই বললাম।’ ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, শিক্ষকের সংকটে শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না। যারা খুবই মেধাবী, তারা হয়তো কোনো কাজে যুক্ত হচ্ছে। বাকি শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে।
জানা যায়, দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষক ও প্রশিক্ষক সংকট ভয়াবহ। ল্যাব বা গবেষণাগারও অপর্যাপ্ত। অনেক প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও যন্ত্রপাতি নেই। যন্ত্রপাতিও সব পুরোনো। এমন বহুমুখী সংকটে ধুঁকছে দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আছে সনদ-বাণিজ্যের অভিযোগ। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যক্রম-পাঠ্যসূচিও সেকেলে। ফলে কোর্স শেষ করে শিক্ষার্থীরা সনদ পেলেও কার্যকর কারিগরি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মহসিন বলেন, কারিগরিতে সবচেয়ে বড় সংকট শিক্ষকের। এ সংকট নিরসন করতে পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) মাধ্যমে নন-ক্যাডার হিসেবে এবং সরাসরি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আর কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা (যন্ত্রপাতি, আধুনিক ল্যাব, একাডেমিক ভবন) বাড়াতে দুটি প্রকল্প চলমান। এগুলো শেষ হলে অবস্থার উন্নতি হবে।
সরকারি তথ্যমতে, দেশে তিনটি স্তরে কারিগরি শিক্ষার পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এগুলো হলো– সার্টিফিকেট স্তর (এইচএসসি ভোকেশনাল, এইচএসসি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনাল ও বেসিক ট্রেড কোর্স); ডিপ্লোমা স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং) এবং ডিগ্রি স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে বিএসসি-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-টেকনিক্যাল এডুকেশন)। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১০ হাজার ৬৮৪টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৩০।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, জোড়াতালি দিয়ে চললে কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কোনোভাবেই পূরণ হবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের কারিগরি শিক্ষা নানা সমস্যায় জর্জরিত। বলা যায়, অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।’
শিক্ষকসংকট চরমে
দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকসংকট তীব্র। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮১ শতাংশের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য। শিক্ষক ও ইনস্ট্রাক্টর (প্রশিক্ষক) না থাকায় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখা থেকে জানা যায়, দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৫ হাজার ৫৯৭টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ২ হাজার ৮৯৩ জন শিক্ষক। বাকি ১২ হাজার ৭০৩টি পদই শূন্য। এ ছাড়া ৬ হাজার ৭০টি কর্মচারী পদও শূন্য।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবশ্য জানিয়েছেন, পিএসসির মাধ্যমে শিক্ষক, জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ও ইনস্ট্রাক্টর মিলিয়ে মোট ৫ হাজার ২৬৫টি পদে নিয়োগের কার্যক্রম চলমান।
যন্ত্রপাতি-শ্রেণিকক্ষও অপর্যাপ্ত
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ ল্যাবে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতি যা আছে, সেগুলোও আধুনিক নয়। কিছু ল্যাবের সব যন্ত্রপাতিই অকার্যকর। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে ল্যাব ও যন্ত্রপাতি আছে, সেখানে শিক্ষকসংকটের কারণে হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ল্যাবে যন্ত্রপাতির ভীষণ সংকট। যেসব যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোও আধুনিক নয়। ইনস্টিটিউটের চিফ ইনস্ট্রাক্টর (নন-টেক) গণিত ও একাডেমিক ইনচার্জ মো. মাহবুব উল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
১ আগস্ট দুপুরে চাঁদপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষ ঘুরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানে শুরুতে যেসব যন্ত্রপাতি সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু কম্পিউটার ক্লাসের যন্ত্রপাতি প্রয়োজনে সংযোজন বা আপডেট করা হয়।
রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টর কবির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের শিক্ষক-কর্মচারীর সংকটটাই ভোগাচ্ছে। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের সংকটও প্রকট। আমাকে তো ফিজিকস ল্যাবে ক্লাস নিতে হয়। শিক্ষার্থীরা ল্যাবে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লাসে অংশ নেয়। এভাবে পড়াশোনা করা তো কষ্টকর।’
সেকেলে সিলেবাস, মান নিয়ে প্রশ্ন
শিক্ষকদের অভিযোগ, কারিগরি শিক্ষার সিলেবাস যুগোপযোগী করা হচ্ছে না। এতে চাকরির বাজারের জন্য যোগ্য হতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা।
পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি নির্মল চন্দ্র সিকদার বলেন, ‘প্রতিনিয়ত টেকনোলজি পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু আমরা সে পথে নেই। আগের সিলেবাসকেই আঁকড়ে আছি। আর একাডেমির সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির যোগসূত্রেও আমাদের গুরুতর ঘাটতি রয়েছে।’
দীর্ঘদিন ধরে অপর্যাপ্ত শিক্ষক, আধুনিক ল্যাব না থাকা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টার্নশিপসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কারিগরি শিক্ষার মান নিম্নমুখী। কুমিল্লার একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষকসংকট ও আধুনিক ল্যাব না থাকায় শিক্ষার্থীরা ‘অর্ধশিক্ষা’ নিয়ে বেরোচ্ছে। এতে চাকরির বাজারে তাদের বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, কারিগরি শিক্ষার মান দিন দিন কমছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা
সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও খারাপ অবস্থা বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। ঢাকার বেশ কয়েকটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা যায়, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই মানসম্মত শিক্ষক ও আধুনিক ল্যাব। রাজধানীর পান্থপথে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও আধুনিক ল্যাব। ছোট একটি ল্যাব থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ব্যবস্থাপক কবির হোসেন কিছু বলতে রাজি হননি।
একাধিক বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক জানান, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে দক্ষ শিক্ষক নেই, যথাযথ নজরদারির অভাব এবং আধুনিক ল্যাব নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের মনোযোগ বেশি সার্টিফিকেট-বাণিজ্যে।
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার শ্যামপুর পলিটেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে প্রতি ট্রেডে ২০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ক্লাস করেন দুই-একজন। তবে পরীক্ষার সময় সব শিক্ষার্থী অংশ নেন। পাসের হারও প্রায় শতভাগ। এ প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও নেই কোনো যন্ত্রপাতি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু বলতে রাজি হয়নি।
গাইবান্ধা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনেকেই কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা খুলেছেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ল্যাব আছে কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই। শিক্ষার্থীদের তারা কী শেখাচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়।’
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মান যথাযথ নয়। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রোগ্রামের প্রস্তাব দিয়েছি। প্রোগ্রামটি অনুমোদিত হলে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের মান বৃদ্ধি, ল্যাব আধুনিকায়নে সহায়তা করা হবে। একই সঙ্গে নজরদারি বাড়ানোও সম্ভব হবে।’
প্রবাসে দক্ষতার ঘাটতি
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ শ্রমিক। এর মধ্যে মাত্র ২ লাখ ১ হাজার ৭৩১ জন (১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ) দক্ষ। বাকি ৮২ দশমিক ২৪ শতাংশই অদক্ষ।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, বিদেশে কাজের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব। কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে চললে কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কোনোভাবেই পূরণ হবে না। ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘শুধু দক্ষতার ঘাটতির কারণে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা কম বেতন পান। এ ঘাটতি কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই পূরণ করা সম্ভব।’ এই শিক্ষাবিদ কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা দ্রুত নিরসন করার পাশাপাশি পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি যুগোপযোগী করার তাগিদ দেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মুহাম্মদ মাসুদ আলম (চাঁদপুর), আব্দুল্লাহ আল মাসুদ (ঝিনাইদহ), আনোয়ার হোসেন শামীম (গাইবান্ধা), রিমন রহমান (রাজশাহী), আরিফুল ইসলাম রিগান (কুড়িগ্রাম), সাদ্দাম হোসেন (ঠাকুরগাঁও), শাহীন রহমান (পাবনা), গনেশ দাস (বগুড়া), আয়শা সিদ্দিকা আকাশী (মাদারীপুর)]
কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রী বর্ষা রহমান বলেন, ‘কোনো রকমে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ করলাম। না পেলাম শিক্ষক, না পেলাম আবাসিক হল। অন্য সুযোগ-সুবিধার কথা আর না-ই বললাম।’ ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, শিক্ষকের সংকটে শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না। যারা খুবই মেধাবী, তারা হয়তো কোনো কাজে যুক্ত হচ্ছে। বাকি শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে।
জানা যায়, দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষক ও প্রশিক্ষক সংকট ভয়াবহ। ল্যাব বা গবেষণাগারও অপর্যাপ্ত। অনেক প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও যন্ত্রপাতি নেই। যন্ত্রপাতিও সব পুরোনো। এমন বহুমুখী সংকটে ধুঁকছে দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আছে সনদ-বাণিজ্যের অভিযোগ। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যক্রম-পাঠ্যসূচিও সেকেলে। ফলে কোর্স শেষ করে শিক্ষার্থীরা সনদ পেলেও কার্যকর কারিগরি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মহসিন বলেন, কারিগরিতে সবচেয়ে বড় সংকট শিক্ষকের। এ সংকট নিরসন করতে পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) মাধ্যমে নন-ক্যাডার হিসেবে এবং সরাসরি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আর কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা (যন্ত্রপাতি, আধুনিক ল্যাব, একাডেমিক ভবন) বাড়াতে দুটি প্রকল্প চলমান। এগুলো শেষ হলে অবস্থার উন্নতি হবে।
সরকারি তথ্যমতে, দেশে তিনটি স্তরে কারিগরি শিক্ষার পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এগুলো হলো– সার্টিফিকেট স্তর (এইচএসসি ভোকেশনাল, এইচএসসি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনাল ও বেসিক ট্রেড কোর্স); ডিপ্লোমা স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং) এবং ডিগ্রি স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে বিএসসি-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-টেকনিক্যাল এডুকেশন)। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১০ হাজার ৬৮৪টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৩০।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, জোড়াতালি দিয়ে চললে কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কোনোভাবেই পূরণ হবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের কারিগরি শিক্ষা নানা সমস্যায় জর্জরিত। বলা যায়, অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।’
শিক্ষকসংকট চরমে
দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকসংকট তীব্র। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮১ শতাংশের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য। শিক্ষক ও ইনস্ট্রাক্টর (প্রশিক্ষক) না থাকায় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখা থেকে জানা যায়, দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৫ হাজার ৫৯৭টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ২ হাজার ৮৯৩ জন শিক্ষক। বাকি ১২ হাজার ৭০৩টি পদই শূন্য। এ ছাড়া ৬ হাজার ৭০টি কর্মচারী পদও শূন্য।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবশ্য জানিয়েছেন, পিএসসির মাধ্যমে শিক্ষক, জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ও ইনস্ট্রাক্টর মিলিয়ে মোট ৫ হাজার ২৬৫টি পদে নিয়োগের কার্যক্রম চলমান।
যন্ত্রপাতি-শ্রেণিকক্ষও অপর্যাপ্ত
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ ল্যাবে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতি যা আছে, সেগুলোও আধুনিক নয়। কিছু ল্যাবের সব যন্ত্রপাতিই অকার্যকর। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে ল্যাব ও যন্ত্রপাতি আছে, সেখানে শিক্ষকসংকটের কারণে হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ল্যাবে যন্ত্রপাতির ভীষণ সংকট। যেসব যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোও আধুনিক নয়। ইনস্টিটিউটের চিফ ইনস্ট্রাক্টর (নন-টেক) গণিত ও একাডেমিক ইনচার্জ মো. মাহবুব উল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
১ আগস্ট দুপুরে চাঁদপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষ ঘুরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানে শুরুতে যেসব যন্ত্রপাতি সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু কম্পিউটার ক্লাসের যন্ত্রপাতি প্রয়োজনে সংযোজন বা আপডেট করা হয়।
রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টর কবির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের শিক্ষক-কর্মচারীর সংকটটাই ভোগাচ্ছে। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের সংকটও প্রকট। আমাকে তো ফিজিকস ল্যাবে ক্লাস নিতে হয়। শিক্ষার্থীরা ল্যাবে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লাসে অংশ নেয়। এভাবে পড়াশোনা করা তো কষ্টকর।’
সেকেলে সিলেবাস, মান নিয়ে প্রশ্ন
শিক্ষকদের অভিযোগ, কারিগরি শিক্ষার সিলেবাস যুগোপযোগী করা হচ্ছে না। এতে চাকরির বাজারের জন্য যোগ্য হতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা।
পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি নির্মল চন্দ্র সিকদার বলেন, ‘প্রতিনিয়ত টেকনোলজি পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু আমরা সে পথে নেই। আগের সিলেবাসকেই আঁকড়ে আছি। আর একাডেমির সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির যোগসূত্রেও আমাদের গুরুতর ঘাটতি রয়েছে।’
দীর্ঘদিন ধরে অপর্যাপ্ত শিক্ষক, আধুনিক ল্যাব না থাকা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টার্নশিপসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কারিগরি শিক্ষার মান নিম্নমুখী। কুমিল্লার একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষকসংকট ও আধুনিক ল্যাব না থাকায় শিক্ষার্থীরা ‘অর্ধশিক্ষা’ নিয়ে বেরোচ্ছে। এতে চাকরির বাজারে তাদের বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, কারিগরি শিক্ষার মান দিন দিন কমছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা
সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও খারাপ অবস্থা বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। ঢাকার বেশ কয়েকটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা যায়, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই মানসম্মত শিক্ষক ও আধুনিক ল্যাব। রাজধানীর পান্থপথে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও আধুনিক ল্যাব। ছোট একটি ল্যাব থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ব্যবস্থাপক কবির হোসেন কিছু বলতে রাজি হননি।
একাধিক বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক জানান, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে দক্ষ শিক্ষক নেই, যথাযথ নজরদারির অভাব এবং আধুনিক ল্যাব নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের মনোযোগ বেশি সার্টিফিকেট-বাণিজ্যে।
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার শ্যামপুর পলিটেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে প্রতি ট্রেডে ২০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ক্লাস করেন দুই-একজন। তবে পরীক্ষার সময় সব শিক্ষার্থী অংশ নেন। পাসের হারও প্রায় শতভাগ। এ প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও নেই কোনো যন্ত্রপাতি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু বলতে রাজি হয়নি।
গাইবান্ধা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনেকেই কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা খুলেছেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ল্যাব আছে কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই। শিক্ষার্থীদের তারা কী শেখাচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়।’
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মান যথাযথ নয়। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রোগ্রামের প্রস্তাব দিয়েছি। প্রোগ্রামটি অনুমোদিত হলে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের মান বৃদ্ধি, ল্যাব আধুনিকায়নে সহায়তা করা হবে। একই সঙ্গে নজরদারি বাড়ানোও সম্ভব হবে।’
প্রবাসে দক্ষতার ঘাটতি
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ শ্রমিক। এর মধ্যে মাত্র ২ লাখ ১ হাজার ৭৩১ জন (১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ) দক্ষ। বাকি ৮২ দশমিক ২৪ শতাংশই অদক্ষ।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, বিদেশে কাজের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব। কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে চললে কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কোনোভাবেই পূরণ হবে না। ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘শুধু দক্ষতার ঘাটতির কারণে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা কম বেতন পান। এ ঘাটতি কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই পূরণ করা সম্ভব।’ এই শিক্ষাবিদ কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা দ্রুত নিরসন করার পাশাপাশি পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি যুগোপযোগী করার তাগিদ দেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মুহাম্মদ মাসুদ আলম (চাঁদপুর), আব্দুল্লাহ আল মাসুদ (ঝিনাইদহ), আনোয়ার হোসেন শামীম (গাইবান্ধা), রিমন রহমান (রাজশাহী), আরিফুল ইসলাম রিগান (কুড়িগ্রাম), সাদ্দাম হোসেন (ঠাকুরগাঁও), শাহীন রহমান (পাবনা), গনেশ দাস (বগুড়া), আয়শা সিদ্দিকা আকাশী (মাদারীপুর)]
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে